সন্ধ্যারাতে_শালুক_ফোঁটে ❤️ #আদনীন_নিশাত_তারান্নুম_চৌধুরী ❤️ #পর্বসংখ্যা-(০১)

0
145

০১.
বাসা থেকে বিয়ে ঠিক করেছে শশীপ্রভার। বিয়ে করবে না বলে নিষেধ করলেও পরিবারের কেউ তার কথা আমলে নিলো না। ছেলে নাকি খুব ভালো! নম্র-ভদ্র-সভ্য,ধার্মিক,দ্বীনদার,পরহেজগার এবং গরীব ঘরের সন্তান। তবে ছেলে একটি কোম্পানিতে সামান্য স্যালারির জব করে। এমনটাই শুনেছিলো দাদীমার মুখে। ছেলের পিকচার দিলেও শশীপ্রভা দেখেনি। জিদ করে ছিঁড়ে বাইরে ফেলে দিয়েছে। আবারও বিয়ের কথা উঠায় এবার শশীপ্রভা মায়ের রুম থেকে লুকিয়ে সিভি এনে পাত্রের নাম এবং ফোন নাম্বার নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ থেকে কল দিয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে পাত্রকে সাফ সাফ নিষেধ করে দিলো এই বিয়ে সে জীবনেও করতে পারবে না। সেই থেকেই মাঝেমধ্যে দু’জনের টুকটাক কথা হতো। কথা হতো বলতে,শুধুমাত্র মেসেজের মাধ্যমেই। শশীপ্রভা ভয়েসে কথা বললেও মানুষটা একটা শব্দও বলেনি সেদিন। এছাড়াও মানুষটা খুব সুন্দর করে চ্যাটিং করতে পারে। শশীপ্রভার প্রতিটি কথাকে সময় নিয়ে গুরুত্ব সহকারে রিপ্লাই দেওয়ার চেষ্টা করতো। কেনো যেন শশীপ্রভার ভীষণ ভালো লেগে গেলো পাত্রকে। তবে পাত্র কখনো নিজ থেকে নক দিতো না। শশীপ্রভা নিজেই নক দিতো। এজন্যই পাত্রের প্রতি শশীপ্রভার মনের ভেতরে একটা সুক্ষ্ম ক্ষোভ রয়েছে। তবে আরেকটা ব্যপার হচ্ছে,মানুষটা তাকে ইগনোর করলেও তার টেক্সগুলোকে কখনোই ইগনোর করেনি। সময় নিয়ে সবসময়ই মার্জিতভাবে রিপ্লাই দিয়েছিলো। তবে সেটা বোধহয় না পারতেই। টুকটাক মেসেজের পাশাপাশি একদিন শশীপ্রভা নিজ থেকেই মিট করতে চাইলো। মানুষটা কেন যেন নিষেধ করতে পারলো না। এতো সহজেই রাজী হয়ে যাওয়ায় শশীপ্রভা ভেবেছিলো পাত্র কেমন না জানি কেমন হবে! হয়তো হ্যাংলা-পাতলা,রোগা-সোগা কিংবা কালো-টালো হ্যাবলাক্যান্তের মতোই হবে দেখতে। যেহেতু সে পাত্রের পিকচার পূর্বে দেখেনি। কিন্তু শশীপ্রভা তো এই ইগো-মার্কা ছেলেকে ইহজীবনেও বিয়ে করবে না। যতোই নম্র-ভদ্র-সভ্য ভাবে কথা বলুক না কেন! ভদ্র সেজে ছেলেটা হয়তো তাকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করছে এমনটাই ভাবলো।

০২.
পাত্রের সাথে আজ শশীপ্রভার মিট করার কথা। একটা রেস্তোরাঁর এড্রেস দিয়ে পাত্র জানালো আসবে। তাই শশীপ্রভা খুব সুন্দর করে সাজগোজ করলো। ওই হ্যাবলাকান্ত ছেলেটাকেও তো দেখাতে হবে ছেলেটা কাকে ইগনোর করেছে আর ছেলেটা তার যোগ্য নয়। সে অনেক সুন্দরী! স্মার্ট! মডার্ণ! আর এইসব ভেবেই দামী একটা ড্রেস পরে গর্জিয়াস একটা সাজ দিয়েছে শশীপ্রভা। সাজসজ্জা কমপ্লিট হওয়ার পর শেষবারের মতো আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিলো। নাহ! মারাত্মক সুন্দর লাগছে ঐশ্বরিয়া রাই এর মতো। না! না! প্রীতি জিনতার মতোই লাগছে। আজ ছেলে ফিদাই হয়ে যাবে। ছেলে তার পেছনে ঘুরঘুর করবে ছ্যাঁছড়ার মতো। কিন্তু সে পাত্তা দিবে না মোটেও। মনে মনে এইসব ভেবে বাঁকা একটা হাসি দিয়ে শরীরে পারফিউম স্প্রে করে পার্স নিয়ে হাঁটা দিলো শশীপ্রভা। আসার সময় একা আসেনি! ওই অহংকারী গম্ভীর-টাইপের পাত্রকে হেনস্তা করার জন্য সুরভী-শুভশ্রী,শুভমিতা-শুভ্রতা,অন্যদিকে অরিন-তুরিন,ফারিন-জারিন,শোভন-রাকেশ,গণেশ-দীপক,দীপ্তকেও দলবেঁধে নিয়ে এলো। আজ জন্মের অর্ডার দিয়ে তার সবগুলো বন্ধু-বান্ধবীর হাতে ধোলাই খেলে এই ছেলে জীবনেও তাকে ইগনোর করবে না এবং বিয়েও করতে চাইবে না। অতঃপর ওরা নয়জন একটি রেস্তোরাঁয় বসে অপেক্ষা করতে লাগলো। ওরা আসার প্রায় মিনিট বিশেক পার হলেও পাত্রের আসার কোন নামগন্ধও নেই। ভীষণ বিরক্ত হলো শশীপ্রভা। এমন কেন লোকটা? নাকি ভয় পেয়েছে? মানুষটাকে বার-বার ফোন দিতে লাগলো। কিন্তু কল পিক-আপ করলো না। ভীষণ রাগ হলো শশীপ্রভার। বিরক্তিতে বলেই ফেললো,”আজব মানুষ তো একটা। ম্যানার্স বলতে কিছুই নেই। যত্তসব ফাউল।”

হঠাৎই পাত্রের ফোন এলো। বিরক্তির সহিত রিসিভ করে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠলো,”কোথায় আপনি? আসছেন না কেন?এতোক্ষণ লাগে আসতে?”

প্রতিত্তোরে ওপাশ থেকে গম্ভীরস্বরে শোনা গেলো,”বিজি ছিলাম। আসছি।”

কেঁপে উঠলো শশীপ্রভা। পাত্রের কণ্ঠ কেমন যেন অদ্ভুত শোনালো। দূর থেকে তাদের দেখে এগিয়ে এলো পাত্রপক্ষ। গম্ভীর স্বরে একটি ছেলে তাদের সবার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলো,”এক্সকিউজ মি এখানে মিস শেখ মেহেরান নিশাত শশীপ্রভা কে?”

কথাটা শুনতেই ওরা সবাই সামনের মানুষ দু’জনকে দেখতেই বিস্ময়বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলো। মানুষ দু’জনও গম্ভীরমুখে ওদের দিকে তাকালো। ওরা এমনভাবে তাকিয়ে রইলো যে মনে হচ্ছে ইহজীবনেও পুরুষ মানুষ চোখে দেখেনি। হ্যাবলার মতো চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রয়েছে। ছেলেটি গলায় হাঁক ছেড়ে বলল,”এক্সকিউজ মি,ইনি মিঃ মির্জা আরমান শাহরিয়ার চৌধুরী। আপনাদের মধ্যে শশীপ্রভা কে?”

আরমানের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে শশীপ্রভা বলল,”আ..আমি শশীপ্রভা।”

আরমান গম্ভীর রইলো। আরমানের পিএ রিয়াদ বলল,”স্যার আপনি বসুন।”

রিয়াদ চেয়ার টেনে দিলো। অবাক নয়নে আরমানের দিকে তাকালো শশীপ্রভা। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না এটাই সেই পাত্র! শিউর হওয়ার জন্য উশখুশ করে বলল,”আ..আপনি সত্যিই মিঃ মির্জা আরমান শাহরিয়ার চৌধুরী?”

নীরবতা ভেঙ্গে গম্ভীর স্বরে এই প্রথম আরমান বলল,”কেমন মনে হয়?”

থমকালো শশীপ্রভা। মানুষটা আধভাঙ্গা বাংলায় কথা বলছে! আমতা আমতা করে বলল,”ইয়ে মানে..আসলেই..”

শশীপ্রভার মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো আরমান। দ্বিতীয়বার তাকানোর সাহস করলো না। মেয়েটা ইচ্ছেমত সাজগোজ করেছে। মনে হচ্ছে বিয়ের মঞ্চে বসে আছে। কমতি রাখেনি একটুও। এইরকম সেজেগুজে সামনে বসে থাকলে যে-কোনো পুরুষের বার-বার তাকাতে মন চাইবে। আরমানের মনে হচ্ছে,তারা ভুলবশত কোন ওয়েডিং সেন্টারে ঢুকে পড়েছে। একেক জনের থেকে একেকজনের সাজগোজ মাশা-আল্লাহ! যেমন পাত্রীর সাজ তেমন পাত্রীর বান্ধবীদের সাজ! মেক-আপ করে সঙ সেজেছে। শশীপ্রভার দিকে তাকালেও ওর বান্ধবীদের দিকে দ্বিতীয়বার তাকালো না আরমান। প্রথম দেখায়ই তো সবার মাত্রাতিরিক্ত সাজগোজ চোখে পড়তেই চোখগুলো কপালে উঠে গেলো। এতে ওর বান্ধবীরা ইনসাল্ট ফিল করলো। ভেবেছিলো কোথাকার কোন হ্যাবলা ছেলে,এখন তো দেখতে পুরাই সিনেমার হিরোর মতো লম্বা-চওড়া,বলিষ্ঠ এবং সুদর্শন এক পুরুষ। এক ভীনদেশী রাজকুমার! নিঃসন্দেহে মানুষটা ভীনদেশী এবং আধভাঙ্গা বাংলায় কথা বলছে। কোন কথাই বলতে পারছে না শশীপ্রভা। গুলিয়ে ফেলেছে সব। ইংলিশ বাবুর দিকে একপলক তাকালো। মানুষটার চোখগুলো ভয়ঙ্কর! ভয়ঙ্কর বলতে ভয়ঙ্কর রকমের স্বচ্ছ,সুন্দর আর গভীর। কি রকম তীক্ষ্ণদৃষ্টি! প্রথম দর্শনেই তো চোখের দৃষ্টি দিয়ে ঘায়েল করে ফেললো তাকে। মানুষটার দিকে চোখ আঁটকে যায় শশীপ্রভার। কয়েক সেকেন্ড অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকে। এইরকম বলিষ্ঠ সুপুরুষ আজ পর্যন্ত চোখে পড়েনি তার। চেহারার আগে চোখদুটো নজর কাঁড়লো। চোখের মণি দুটো কটকটে সবুজ রঙের। মণি নয় যেন শ্যাওলা মিশ্রিত পানি ভরে রেখেছে চোখের ভিতর। এতো সুন্দর কেন চোখগুলো? কি সুন্দর! যেনো আস্ত রসগোল্লা! রসগোল্লার মতো দেখতে সুন্দর চোখগুলো খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে শশীপ্রভার। কিন্তু ভীষণ নার্ভাস ফিল করছে সে। এসির মধ্যেও ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গেছে। শশীপ্রভার দিকে তাকানোর ইচ্ছে থাকলেও আরমান ফের তাকালো না। দৃষ্টি নত করে রেখেছে। তার দাদীমা আয়েশা মির্জা মেয়েটিকে তার বিয়ের জন্য ঠিক করেছেন। পাত্রীকে না দেখেও আরমানের পক্ষ থেকে ছিলো,”হ্যাঁ” কিন্তু বিপত্তি বাঁধালো শশীপ্রভা। ফোন করে ঝাঁঝালো কণ্ঠে নাকোচ করে দিয়েছে। যদিও এইসবের জন্য প্রস্তুত ছিলো না আরমান। বিব্রতবোধ করেছিলো সে। তবে এতে আরমানের কোনো সমস্যা নেই। এক মেয়ে গেলে হাজার মেয়ে পাবে। তার জন্য মেয়ের অভাব হবে নাকি! এমনিতেই কতো মেয়ে তার জন্য পা’গ’ল। এছাড়াও তার বিয়ের কথা শুনলে হাজার হাজার মেয়ে তাদের মহলের সামনে লাইন লাগাবে। তাই এতো কেয়ার করলো না। কিন্তু আত্মসম্মানবোধ বলেও একটা কথা আছে। অন্যদিকে শশীপ্রভাই তার সাথে যে-চে মিট করতে চেয়েছিলো। কারণটা অবশ্য আরমান সঠিক জানে না। মেয়ে মানুষকে যথেষ্ঠ সম্মান করে বিধায় অনুরোধটা অগ্রাহ্য করতে পারলো না। শশীপ্রভার গিল্টিফিল হচ্ছে। মানুষটার দিকে তাকাতে পারছে না। খুব ভয় করছে! অথচ এই মানুষটাকে কতো ঝাঁঝালো গলায় কড়া কথা বলেছিলো সে। শুভশ্রীরা কথা বলতে চাইলেও আরমান কেয়ার করলো না। শুধু হাই-হ্যালোটুকু পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রইলো। তবে শুভশ্রীরা যেন চোখ দিয়ে গিলে নিচ্ছে আরমানকে। টের পেলেও আরমান গুরুত্ব দিলো না। মেয়েদের কাজই তো এটা। সুন্দর সুন্দর ছেলে দেখলে ছ্যাঁছড়ার মতো হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে। কখন মশা,মাছি মুখের মধ্যে ঢুকে যাবে সেটারও খেয়াল থাকবে না। এতোগুলো মেয়ের মধ্যে আরমানের ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিলো। অস্বস্তির হাত থেকে রক্ষা পেতে আরমান মেন্যুবুক দেখে নিজের পছন্দে অর্ডার দিলো। ওয়েটাররা লাইন ধরে এক এক করে আইটেমগুলো এনে টেবিল সাজাতে শুরু করলো। শশীপ্রভা সহ শুভশ্রীরা সবাই ভীষণ অবাক হলো। ওরা ভাবতেও পারেনি আরমান নিজ পছন্দে এতো এতোকিছু অর্ডার করবে। যেখানে ওরাই এসেছিলো অহংকারী,গম্ভীরমুখো ছেলেটাকে একটা রামধোলাই দিতে। এখানে কত নাম জানা না জানা খাবারের আইটেম রয়েছে যেটা ওরা জীবনেও খায়নি কিংবা চোখেও দেখেনি। আরমানকে দেখাতে এসে ওরা নিজেরাই বরং দেখে গেলো। এদিকে শশীপ্রভা এসেছে আরমানকে ডোজ দিতে। কিন্তু এখন সে নিজেই ডোজ খেয়ে বসে আছে। কি বলবে কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। শুভশ্রীরা টুকটাক কিছু প্রশ্ন করেছিলো আরমান নিচের দিকে তাকিয়ে মার্জিতভাবে এন্সার করেছে। এতে শুভশ্রীদের ইগোয় বাজেভাবে লাগলো। রিয়াদ আরমানের মনোবস্থা বুঝতে পারলো। তার স্যার মেয়ে মানুষের সঙ্গ একদম পছন্দ করে না। তবে শশীপ্রভারটা ভিন্ন। কারণ তার সাথে বিয়ে হওয়ার চান্স রয়েছে শতভাগ। কথাবার্তা চলছে জোরালোভাবে। আর শশীপ্রভা কেন ডেকেছে সেটাই জানতে এসেছে। এছাড়াও বিয়ের পূর্বে পাত্রীকে একবার দেখে নেয়া জায়েজ রয়েছে। গলা পরিষ্কার করে রিয়াদ শুভশ্রীদের উদ্দেশ্যে বলল,”এক্সকিউজ মি আপনারা আমার সাথে এদিকটায় বসুন। ওনারা আলাপ করুক।”

নির্বিকার হয়ে শুভশ্রীরা উঠে অন্য টেবিলে গিয়ে বসলো। এমনিতেই আরমান ওদেরকে পাত্তা দিচ্ছে না। তাই ওখানে বসে থেকে তো কোনো লাভ নেই। ওরা উঠে যাওয়ায় শশীপ্রভার ভীষণ অস্বস্তি হতে লাগলো। বুঝতে পেরে হাতঘড়িতে সময় দেখে নিলো আরমান।

“বাই দ্যা ওয়ে আপনি মিট করতে চেয়েছিলেন। কিছু বলার ছিলো?”

“আসলেই..”

হাত কচলাতে লাগলো শশীপ্রভা। নিচের দিকে তাকিয়ে চমৎকার হাসলো আরমান। ভ্যাবচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে রইলো শশীপ্রভা।

“ফ্রেন্ডদের দিয়ে হেনস্তা করতে তাই তো?”

ঘাবড়ে গেলো শশীপ্রভা।

“আরেহ! না। না। তা কেন হবে?”

আরমান বুঝতে পারলো শশীপ্রভা কিছু লুকাতে চাইছে। তার চোখকে ফাঁকি দেওয়ার জন্ম এই মেয়ের এখনো হয়নি। কত প্রিপারেশন নিয়ে এসেছে শশীপ্রভা। কত কি বলবে! অথচ এখন কিছুই বলতে পারছে না। ভেবেছিলো মানুষটা কেমন না কেমন। কিন্তু তার তো ভীষণ পছন্দ হয়ে গেছে মানুষটার এটিটিউড দেখতেই। তার বান্ধবীদেরকে একদম পাত্তাই দিচ্ছে না! তাকাচ্ছেও না।

“কফি নিন। পরেও কথা সাজাতে পারবেন।”

থতমত খেলো শশীপ্রভা। মানুষটা জানলো কিভাবে? একদম জিনিয়াস! আরমান কিছু খেলো না। কফি নিলো। কফিতে চুমুক দেওয়ার সাথে সাথেই শশীপ্রভা অসতর্কতাবশত জ্বীভ পুড়ে ফেললো। আরমান পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলল,”সাবধানে। কেউ আপনার কফি নিয়ে যাচ্ছে না। প্রয়োজন হলে আরো অর্ডার করবো।”

বিব্রতবোধ করে শশীপ্রভা এক ঢোক পানি পান করলো। এবার নাকে-মুখে পানি উঠে গেলো। আরমান কফিতে চুমুক দিয়ে শশীপ্রভার কাণ্ডকারখানা দেখতে লাগলো। কি যে করছে মেয়েটা বুঝতে পারছে না কিছুই। তবে মোটামুটি মেয়েটা সুন্দর! মুখটা জ্যামিতির কাঁটা কম্পাস দিয়ে অঙ্কিত গোল বৃত্তের মতো কিংবা গোল পূর্ণচন্দ্রের সাথে তুলনা করলেও মন্দ হয় না। মুখটা যেন গোল চাঁদ। হাসলে কিংবা কথা বললে খুব সুন্দর করে দুটো ডিম্পল পড়ে যায় মেদুর গাল দু-খানিতে,ঠিক বলিউড হিরোইন প্রীতি জিনতার মতো। চাঁদের মতো গোলগাল চেহারায় গালের ডিম্পল দুটো মানিয়েছে বেশ। ঠোঁট দুটো চিকন-পাতলা। তাতে গাঢ় করে পিংক কালারের লিপস্টিক দেওয়া। বাম ঠোঁটের থুতনির নিচে ছোট্ট একটি কালো কুচকুচে তিল রয়েছে। কথা বলার সময় তির তির করে কাঁপছে। আরমানকে তিলটা খুব বাজেভাবে আকৃষ্ট করলো। হঠাৎ দেখতে পেলো প্রভার বুকের উপরের দিকটায় পাশাপাশি দুটো তিল রয়েছে। আরমানের মনে হলো আশ্চর্যজনকভাবে পাশাপাশি দুটো শুকতারা আর সন্ধ্যাতারা দেখলো সে। যদিও শুকতারা আর সন্ধ্যাতারা একসাথে আকাশে উঠে না। এছাড়াও সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো মাথার চুলগুলো। ইয়া লম্বা কালো কুচকুচে রেশমি চুলগুলো কোমড়ের নিচে পড়েছে। মোটামুটি মেয়েটাকে ভালোই লাগলো। এই প্রথম কোনো মেয়ের কালো কুচকুচে রেশমি চুল দেখে আরমানের খুব ভালো লাগলো। সে যাই হোক,তবে খুব সাধারণ একটি মেয়ে। ওতোটা আহামরি সুন্দরীও নয়। তবে মেয়েটা তার থেকেও ওতো বেশি লম্বা হবে না। ৫’৫” হবে মেইবি। চোখ সরিয়ে নিলো আরমান। পাত্রী দেখা হয়ে গেছে তার। যতোটুকু দেখার দরকার ততটুকু দেখা হয়ে গেছে। কফি পান করতে করতে টুকটাক কিছু জিজ্ঞেস করলো। আড়ষ্টতার সহিত শশীপ্রভা উত্তর করলো। খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাই বেরিয়ে পড়লো। শশীপ্রভা আরমানের পাশাপাশি হাঁটছে। আরমান হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো। ভ্রুদ্বয় কপালে তুলে শশীপ্রভার মাথার চুলগুলোর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। শশীপ্রভা হকচকালো। আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলো,”এনিথিং রং?”

“মাথায় উঁকুন থাকা মেয়েদেরকে আমি একদম পছন্দ করি না মিস। তবে বিয়েটা ক্যান্সেল করে আপনি খুব ভালো কাজ করেছেন। থ্যাংক ইউ সো মাচ।”

চমকে উঠে আরমানের দিকে তাকালো শশীপ্রভা। আরমান চোখ দিয়ে ইশারা করলো,মাথায় উঁকুন। তার মাথায় উঁকুন রয়েছে এটা সত্য। কিন্তু মানুষটা জানলো কিভাবে? বিস্ময় ভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,”আপনি কিভাবে জানেন আমার মাথায় উঁকুন?”

“জানার কি আছে? ওয়াশরুমের ট্যাঙ্কির মধ্যে যেইরকম পোকারা ভ্যাশ ভ্যাশ করে ভেসে থাকে,সেইরকম আপনার মাথার উঁকুনগুলোও ভ্যাশ ভ্যাশ করে ভাসছে! আমার তো দেখেই ঘৃণা লাগছে। ছিঃ! আরো চুলগুলো ছেড়ে রেখেছেন।”

ভীষণ রাগ হলো শশীপ্রভার। মানসম্মান ইজ্জত সব চলে গেলো! দাঁতে দাঁত চাপলো। ছিঃ! ছিঃ! লোকটা কিসের সাথে কি বললো! আগুন চোখে তাকালো শশীপ্রভা। আরমান বাঁকা হাসলো।

“ওয়েট! ওয়েট! আমি এনে দিচ্ছি।”

“মানে?”

পূর্ব থেকেই আরমানের হাতে হ্যান্ডগ্লাভস ছিলো। তাই পড়ার প্রয়োজন হলো না। শশীপ্রভার চুল থেকে তিনজোড়া উঁকুন নিয়ে হাতে ধরিয়ে দিলো। উঁকুনগুলো জোড়ায় জোড়ায় শশীপ্রভার মাথায় ভেসে রয়েছে। এত্তো উঁকুন মানুষের মাথায় হয় কি-না আরমানের জানা নেই। ওয়াক থু! পোকার মতো সব ভাসছে! লজ্জায় শশীপ্রভার মাথা কাটা গেলো। ভেবেছিলো কোথায় মানুষটাকে একটা রামধোলাই দিবে অতিরিক্ত ভাব এবং তাকে ইগনোর করার জন্য। কিন্তু এই মানুষটাই তো তাকে দিয়ে বসলো। নিশ্চয়ই এটা ইচ্ছে করে করেছে। তার উপর রিভেঞ্জ নিচ্ছে। নয়তো এতো ধার্মিক মানুষের উঁকুনের দিকে কেনো চোখ যাবে? শশীপ্রভা দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে আরমানের মাথায় উঁকুনগুলো দিয়ে হাত দিয়ে চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল,”স্মৃতি হিসেবে উকুনগুলো আপনাকে দিয়ে দিলাম। সারাজীবন মাথার মধ্যে রেখে দিয়েন। আমার কথা মনে পড়লে স্মৃতিচারণ করে একটা একটা করে ফ্রাই করে খেয়ে নিয়েন।”

হতভম্ব হলো আরমান। বলেই শশীপ্রভা চলে যেতে নেয়। পেছন থেকে শুনতে পেলো,”নিজে তো আমার মাথা খেতে পারবেন না। তাই শেষমেশ উঁকুনকে দিলেন আমার মাথা খাওয়ার জন্য?”

পেছন ফিরে শাঁসানো গলায় বলল,”একদম ঠিক করেছি! ইংলিশ বাবু হয়ে বাঙালি মেয়ে বিয়ে করার বেশি শখ আপনার তাই না! এবার আমার পরিবর্তে উঁকুনগুলো আপনার মাথা খেয়ে ফেলুক! যা ইচ্ছে তাই করুক! জাহান্নামের চৌরাস্তায় যাক! তাতে আমার কি!”

“সো সেইরকম কোন চান্স নেই মিস। ইংলিশ উঁকুননাশক শ্যাম্পু ইউজ করলে আপনার স্মৃতি আর উঁকুনগুলো সব বিনাশ হয়ে যাবে। আর স্মৃতিচারণ করার প্রয়োজন নেই। আপনি নিজেই আস্ত একটা স্মৃতি। বাই দ্যা ওয়ে আমার বাঙালি মেয়ে বিয়ে করার কোনো শখ নেই। তবে কিছু বাঙালি মেয়েরা ব্রাইডাল সাজ দিয়ে আমার মতো ইংলিশ বাবুকে বোকা এবং ধোঁকা দিয়ে ইমপ্রেস করার ট্রাই করছে। বাট আই ডোন্ট কেয়ার। আর শুনুন,বিয়ের আগে ছেলে,মেয়েকে দেখার সময় মেক-আপ করে সুন্দর হয়ে ছেলের সামনে আসা নাজায়েজ। কারণ এটা ধোঁকা!”

কথাগুলো খুব বাজেভাবে লাগলো শশীপ্রভার গায়ে। রাগে গজগজ করলো শশীপ্রভা। আচ্ছা মানুষ তো একটা! একে ইট ছুঁড়লে এতো পাটকেল ছুঁড়ছে!

“আপনি সত্যি একটা ফাজিল মানুষ।”

“এতো না সাজসজ্জা না করলেও পারতেন। প্রাকৃতিকভাবে আপনি যেমন তেমনই উপস্থাপন করলে ভালো হতো। সে যাইহোক,আপনাকে ঠিক আফ্রিকার ভূত-প্রেত্নীর মতো লাগছে! আমি তো ফাস্ট ভেবেছিলাম ভুলবশত কোন ওয়েডিং সেন্টারে ঢুকে পড়েছি! পরক্ষণেই ভাবলাম আফ্রিকার বন-জঙ্গলে।”

তেঁড়ে এলো শশীপ্রভা।

“কী বললেন?”

“বাই দ্যা ওয়ে আপনাকে আমার পছন্দ হয়নি। বিয়েতে নিষেধ করার জন্য থ্যাংকস। আমার লাইফটা বেঁচে গেলো।”

অপমানিতবোধ করে দাঁতে দাঁত চাপলো শশীপ্রভা। কত্তো সুন্দর করে সেজেগুজে এলো মেক-আপ করে তাকে সুন্দরী এবং স্মার্ট দেখানোর জন্য। আর এই দুষ্ট লোকটা বলছে তাকে পছন্দ হয়নি! রাগে-ক্ষোভে মানুষটার গলা টিপে মে’রে ফেলতে ইচ্ছে করছে। শশীপ্রভা আর দাঁড়ালো না। মানুষটার চেহারা দেখতেও ইচ্ছুক নয় সে। বাসায় ফিরে আজ আবারও সাফ সাফ নিষেধ করে দিবে মানুষটা রিজেক্ট। রিজেক্ট মানে একশোবার রিজেক্ট!

“শুনুন মিস।”

আগুন হয়ে পেছনে ফিরে অভিমানী গলায় বলল,”আমাকে তো আপনার পছন্দ হয়নি তাহলে বার-বার ডাকছেন কেন?”

“একটা কথা বলার ছিলো।”

“কি বলবেন আপনি? কি বলার বাকি আছে আর? মুডটাই তো নষ্ট করে দিলেন।”

“একজন নারীর সৌন্দর্য তার বডি শেইপে না মিস। একজন নারীর আকর্ষণ করার ক্ষমতা তার শরীরে নেই। একজন নারী আকর্ষণীয় হয় তার সোলে লুকানো আগুনে। আশা করি বুঝতে পেরেছেন।”

বড় বড় চোখ করে তাকালো শশীপ্রভা।

“ভারী মেক-আপ নিয়ে সেজেগুঁজে পরপুরুষের সামনে উপস্থাপনা করে নিজেকে অযথা সুন্দরী ভাববেন না। কারণ আপনার চেয়েও অধিক সুন্দরীরা পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকে। ঠিক মুক্তো যেমন ঝিনুকের মধ্যে থাকে তেমনি। আর খোলা চকলেটে পিঁপড়া ধরে তাড়াতাড়ি।”

হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো শশীপ্রভা। রিয়েক্ট করতে ভুলে গেলো। দূর থেকে আরমান-শশীপ্রভার তামাশা দেখছে শুভশ্রীরা। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো ওরাও।

“মনে রাখবেন,রূহের সুগন্ধী পরিপূর্ণ ভাবে মানুষকে সুসজ্জিত করে। চেহারা থেকে সৌন্দর্য এবং পোশাক থেকে শুধু সুগন্ধী আসলেই হয় না। সৌন্দর্য এবং সুগন্ধী চরিত্র,ব্যবহার এবং মানসিকতা থেকেও আসতে হয়। এছাড়াও একজন মুসলিম নারীকে যদি কাফির নারীদের থেকে আলাদা না করা যায়,তবে এমন মুসলিমের কী মূল্য আছে? বাই দ্যা ওয়ে আপনাকে আমার পছন্দ হয়নি। বিয়ে তো আমি তাকেই করবো যার সৌন্দর্য রূহ থেকে আসে। আপনি রিজেক্ট।”

কথাগুলো বলে শশীপ্রভাকে হতভম্ব করে দ্রুত গাড়িতে উঠে চলে গেলো আরমান। শশীপ্রভাকে প্রতিত্তোর করার সময়টুকুও দিলো না। সেদিকে শশীপ্রভা সহ তার ফ্রেন্ডগুলো সবাই নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ব্যপারটা ঠিক কি বোধগম্য হলো না কারোরই। এতোদিন আরমানকে রিজেক্ট করলেও আজ আরমান থেকে রিজেক্টেড হয়ে অপমানে শশীপ্রভার চোখে জল চলে এলো। নিশ্চল,অনুভূতিশূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শশীপ্রভার দু-কাঁধে হাত রাখলো সুরভী আর শুভশ্রী। শুভশ্রী বলল,”শেষমেশ উঁকুনের জন্য রিজেক্ট হলি শশীপ্রভা?”

লজ্জায় অপমানে দু-ফোঁটা তপ্তজল গড়িয়ে পড়লো শশীপ্রভার গাল বেয়ে।
_____________________

#সন্ধ্যারাতে_শালুক_ফোঁটে ❤️
#আদনীন_নিশাত_তারান্নুম_চৌধুরী ❤️
#পর্বসংখ্যা-(০১)
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here