তুই আমার অঙ্গারাম্লজান – পর্ব ১

0
1218

#তুই_আমার_অঙ্গারাম্লজান
পর্ব_১
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা

১.
আমার দীর্ঘ সময়কালীন অতি প্রিয় বন্ধু পিরিতের আঠা সর্বাঙ্গে লেপন করে সদ্য সম্পর্কে জড়িয়েছে। আঠার কার্যকারিতা এতো ঝাঁঝালো যে বান্ধবীর রেশমি চুল এখন কাউয়ার বাসার রূপ ধারণ করেছে। কথা ছিল দুজন দুই ভাইয়ের কাছে বিয়ে বসবো। একই পরিবারে বউ হয়ে গিয়ে সবার হাতে একটা একটা করে উচ্চতর গণিত বই ধরিয়ে দেব। এরপর সাইন্টিফিক উপায়ে জীবন ধুম ধাম তানা নানা করে রাখবো। কিন্তু এখন কি হলো? আমার পাপিষ্ঠ বান্ধবীর স্বর্গীয় প্রেমিক বাঁশ গাছের জ্বীনের মতো এসে হাজির হলো।

আজ তুশিরা তার প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে যাবে। সকাল থেকে আমার বাসায় এসে আমার আলমারি লন্ডভন্ড করে ছেড়েছে। আরে বাপ বয়ফ্রেন্ড থেকে শাড়ি আনতে পারলি না! সেই শাড়ি সাপের মতো শরীরে পেঁচিয়ে মুরগির মতো টুকুর টুকুর করতে করতে যেতি। এরপর শাড়ি পায়ে বেঁধে উষ্টা খেয়ে পড়তি, আর বয়ফ্রেন্ড দিলভালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক লাগিয়ে কাঁধে তুলে ছুটতো হস্পিটালে। আমি ক্যামেরা নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ছুটতাম আর বিবৃতি করতাম, ভাইবোনের অমর ভালোবাসা। ঠ্যাঙ্গা, লুলা হয়ে গেলেও এই ভালোবাসা কমবার নয়। ব্যস! হয়ে যেতাম জনপ্রিয় ব্লগার।
আমার এই পাপের সাগরে শুশুকের মতো সাঁতার কাটা বান্ধবী দ্বারা আমার জীবনের কোনো শখই পূরণ হলো না।

আমি তুশিরার মাথায় চাটি মেরে তিনশো ষাট ডিগ্রি এঙ্গেলে ঘুরিয়ে বললাম,
“শাড়ি পরে কি পেট দেখাবি? তোর পেটে না কয়দিন আগে তোর বিড়াল খামচি মেরে ছিল? নাহিয়ান দেখে যদি অন্য কিছু ভাবে?”
তুশিরা চোখ কপালে তুলে বললো,
“অন্য কিছু ভাববে কেন? আমাদের মধ্যে বিশ্বাস কী এতোই ঠুনকো? তুই কিছু জানিস আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে?”
আমি লালসালুর মজিদের মতো মনে মনে হা হা করে হেসে উঠে মুখে বললাম,
“কয়দিন পর যখন তোমায় সতীন গিফ্ট করবে তখন আমাকে ডেকো বন্ধু। আমি আমার বাহুডোরে তোমাকে আবদ্ধ করবো।”
তুশিরা চোখ পাকিয়ে বললো,
“একদম বাজে কথা বলবি না। নাহিয়ান মোটেও এরকম নয়। তুই কি ভাবিস ওকে? ও রিলেশনে জড়াবে না বলে আমাকে পছন্দ করা সত্ত্বেও..”
আমি ঠাশ করে তার গালে থাপ্পড় মেরে বললাম,
“আমি ওর কথা বলছি না ছাগলের আম্মা! তোর কথা বলছি। হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষায় কয়টায় ফেইল করছেন বাপ? তথ্যে লিখে আসিস ন্যানোটেকনলজি মানে মশা, কৃমি ধ্বংস করার অদৃশ্য ঔষধ। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি মানে স্বপ্নদোষের মাধ্যমে অন্যভুবনের স্বর্গীয় সুখ অর্জন। ম্যাথে পাঁচ আর তিন যোগ করে পাস দুই!”
তুশিরার চোখ গোল গোল হয়ে গেলো। আমি জানি কেন। ছাগলের বংশধর অনেক কায়দা ও চেষ্টা-চরিত্র অবলম্বন করেছিলো আমি যেন তার রেজাল্টের নম্বর জানতে পারলেও পরীক্ষার খাতার ভিতরে কিছু দেখতে না পারি। কিন্তু সে তো জানে না, কলেজের লেডি গুন্ডা শারফুন কবিরের সঙ্গে আমার অনেক ভাব। ভাগ্যিস, তুশিরা না থাকাকালীন ম্যামকে রিকোয়েস্ট করে তার খাতা দেখে এসেছিলাম। নাহলে জানতেই পারতাম না সে আদর্শ ও পরীক্ষার খাতায় দাগ লাগতে দেয় না।
তুশিরা পাপবিদ্ধ একটা হাসি দিয়ে বললো,
“আমি তো এইবার টেস্ট করছিলাম। স্যারদের ভেলকি দেখিয়ে পরের পরীক্ষায় টপ করার পরিকল্পনা করছিলাম।”
“চটকানা মেরে পাকস্থলী নষ্ট করে দেব বেয়াদব। পরে বয়ফ্রেন্ডের চুমু গিলেই বাঁচতে হবে। এখন বের হ আমার ঘর থেকে। গেট লস্ট!”

তুশিরা আমার গৃহ ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও পাজাঁকোলা করে বের হলো। আমার কাবাবের মধ্যে হাড্ডি হওয়া পছন্দ নয়, কিন্তু কাবাব খেতে পছন্দ। টুনাটুনি রেস্টুরেন্টে কোণায় গিয়ে ঠোকরা-ঠুকরি করবে, আর আমি আরাম করে বসে কাবাব খাবো। এই শর্তেই তার সঙ্গে আসা। রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখি নাহিয়ানও তার বন্ধু রিজওয়ানকে নিয়ে এসেছে। আলাদিনের চেরাগ ঘঁষে ঘঁষে একে কোথা থেকে নিয়ে এসেছে কে জানে। এই রিজওয়ানকে আমি দুই চোখে দেখতে পারি না। নাহিয়ানের বন্ধু হলেও সে সাইন্সের ছাত্র। আমি, তুশিরা, রিজওয়ান আমরা আবার একই কোচিংয়ে পড়ি। সেই অনুসারেই আগে থেকে ওকে চেনা। ওকে সহ্য করতে না পারার অন্যতম কারণ হলো তার অনর্থক কথাবার্তা। কয়দিন আগে কোচিংয়ের গেইটে আমি দাঁড়িয়ে আছি, আর সে সবে আসছে। সে পুরো কোচিংকে আকাশে উড়িয়ে বাতাসে ভাসিয়ে অবগত করলো তার সঙ্গে আমার ধাক্কা লাগে। মানে ভাই! ধাক্কা খেতে চাইলে আমাকে বললেও তো পারতো। যেতে একটা লাথি, আসতে একটা লাথি উপহার দিতাম।

তুশিরার চোখে চোখে ইশারায় এই রাম-ছাগলের সঙ্গে আমাকে বসতে হলো। নাহিয়ানের সঙ্গে রস-কস-বুলবুলি খেলতে খেলতে তুশিরা আমাকে টেক্সট করলো,
“দোস্ত মানুষ যাকে বেশি অপছন্দ করে তার জন্যই নাকি পরে বিরহের যাতনায় মরে।”
আমি হা হা রিয়্যাক্ট দিয়ে বললাম,
“এমন হলে আজ তুই সালমানের বউ হয়ে মি প্লাস মি ‘মিমি’ কেটে, মি প্লাস তুশিরা ‘মিতু’ বানাতি। বেচারার ষাট বছরের জীবন বাচ্চাকাচ্চা, নাতীপুতিতে ভরিয়ে তুলতি। কিন্তু তুই কি করছিস? সাইন্সের ছাত্রী হয়ে মানবিকের সিনিয়র ভাইয়ের মুখে কাটা চামচ ধরে আছিস? হা হা হা! হা হা টু দ্য পাওয়ার টেন।”

বান্ধবীকে ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়ে চেয়ার ছেড়ে ওয়াশরুমের দিকে গেলাম। এই রিজওয়ান কিভাবে হ্যাবলার মতো কতক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছে। আবারও এমন করতে থাকলে বুদ্ধি করে চেয়ার থেকে উঠিয়ে কাঁটাচামচ গেঁথে রাখবো। বাছাধনের ভবিষ্যৎ কাটিং!
আয়নায় নানারকম মুখভঙ্গি করে হাত ধুচ্ছিলাম এমন সময় একটা মাস্ক পরা ছেলে উপস্থিত হলো। চোখগুলো দেখে এক মুহুর্তের জন্য থেমে গেলাম। খুবই সুন্দর যাকে বলে। কিন্তু করোনার পিরিতের কাঁদার ফাঁদে পা ফেললাম না। মানুষ করোনাকে সুই দিয়ে গুঁতো মেরে প্রতিহত করার চেষ্টা করলেও এই বদমাশ আরেক অঘটন ঘটিয়ে রটিয়ে রেখেছে। এখন জনে জনে মানুষকে মাস্ক ব্যবহার করতে হয়। ফলে চেহারা ব্যতীত অন্য কোথাও প্রথমে না তাকালে ছেলে না মেয়ে সেটাও বুঝা যায় না। এর উপর আমার হৃদয় ভাঙা, ফ্যাঁপড়া শুকানো ছ্যাঁকা।
আমার এখনও মনে পড়ে। কলেজে তখন প্রথম প্রথম যাচ্ছি। চারদিকে কতো সুদর্শন ও সুন্দরীদের মেলা। বড় ভাইয়েরা দেখলেই সালাম দিচ্ছে, বড় আপুদের কাছে গেলেই বিউটি টিপস দিচ্ছে। রঙচঙে মেলার দিন অতিবাহিত করার একদিনে ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ ক্লাব থেকে এক লাজুক ছেলে তার দলবল নিয়ে এলো আমাদের সাদরে তাদের ক্লাবে নিমন্ত্রণ জানাতে। কথা বলা যখন শুরু করেছে ট্রাক্টারের মতো ট্যাক ট্যাক আওয়াজ ছাড়াই কথা বন্ধ করে দিচ্ছিল। সবাই তখন মাস্ক খুলে কথা বলতে বললো। আমি তখন গভীর আগ্রহে মাথা উঁচিয়ে চেয়ে আছি। চেহারা দেখাটা খুব জরুরি। পরে যদি ক্রাশকেই চিনতে না পারি।
মাস্ক খুলেই সে ফোকলা দাঁতে হাসি দিলো। সেটা সমস্যা না। দাঁতের বিস্তর ফাঁক দিয়ে বুলেট ট্রেনের মতো বাংলা ভাষার মূল্যবান ধ্বনি বাষ্পীভূত হয়ে হারিয়ে যাচ্ছিল। বুকে চাপ অনুভব করে তৎক্ষণাৎ তুশিরার উপর ভার ছেড়ে দিয়েছিলাম।

“এই যে ম্যাম, আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?”
ছেলেটির ডাক শুনে জ্ঞান ফিরে এলো। আরে আমি তো বর্তমানে!
ছেলেটি আবার দিকে খানিক এগিয়ে এসে বললো,
“ভাইয়ার সঙ্গে কী ঝগড়া হয়েছে আপু? দুজনেই মন খারাপ করে কতক্ষণ থেকে বসে আছেন।”
আমি ছেলেটিকে উদ্ভট চাহনি উপহার দিয়ে বললাম,
“ভাইয়াটি আমার গ্রামের চাচাতো ভাই। চাচাতো ভাইটি বাদামি রঙের হাওয়াই মিঠাই খেতে চেয়েছে। বাদামি রঙের কাবাব দিয়েছি, তাতে নাকি হচ্ছে না। তো আমি কি করবো!”
আমার অর্মষিত কণ্ঠ গায়ে না মেখে ছেলেটি ঝলমলে গলায় জিগ্যেস করলো,
“তার মানে বিশাল দেহের অধিকারী লোকটি আপনার বয়ফ্রেন্ড না?”
আমি আবারও অদ্ভুত চাহনি উপহার দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেলাম। কি আজব! একজন বয়ফ্রেন্ড নয় হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে বলে কি ওই ছেমড়াকে কৈফিয়ত দিতে হবে? ইচ্ছে করছে মাইক্রোবাস ভাড়া করে তুলে নিয়ে যাই। একদিন ছিনিমিনি খেলে এরপর ছেড়ে দেব। মেয়ে দেখলেই পাবনার পাগল হতে হবে? কই আমি তো এই ছেমড়ার সুন্দর চোখ দেখে জিগ্যেস করিনি, “পুতিনের পুত্র! তুই এতিম নাকি মেয়ে বেস্টফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ডের বান্ধবী নামক বোন নিয়ে প্রাচুর্যপূর্ণ?”
গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের সব গরম মনে হচ্ছে আমার জামার ভিতর ঢুকে গেছে। চিৎকার করিয়া কাঁদিতে সাধ জাগিয়াছে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here