#বেনেবউ
#পর্ব_১১
#তানজিলা_খাতুন_তানু
নিভ্রের মা কলিংবেলের শব্দ পেয়ে দরজা খুলে ইপ্সিতাকে দেখে একটু বিরক্ত হলেন। ছেলের জেদের কাছে হার মেনে বিয়েতে রাজি হতে হয়েছে, নাহলে কখনোই ইপ্সিতার সাথে বিয়েতে রাজি হতেন না।
– ‘আন্টি নিভ্র কোথায়?’
– ‘নিজের ঘরেই আছে।’
ইপ্সিতা বেশি কথা না বলে নিভ্রের ঘরের দিকে পা বাড়াল। নিভ্রের মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, এই মেয়েকে নিয়ে কিভাবে সমাজে মুখ দেখাবেন সেটাই বুঝতে পারলেন না।
ইপ্সিতা নিভ্রের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
– ‘ হঠাৎ করে এইরকম একটা সিদ্ধান্ত নিলেন কেন?’
– ‘ভালোবাসি তোমাকে। আমি চাইবো না আমার ভালোবাসার মানুষটি অন্য কারোর হয়ে যাক।’
– ‘পাগলের মতো কথা বলবেন না। আপনি কেন এইরকম করছেন, আপনার মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখুন উনিও রাজি নন। সবার অমতে গিয়ে বিয়ে করলে আমরা সুখী হতে পারব না।’
– ‘সবসময়ে বাবা মায়েরা ঠিক করবে এটা তো ঠিক নয়। এই দ্যাখোই না তোমার বাবা মা তো রিতেশের সঙ্গে তোমার বিয়ে দিতে চেয়েছিল এটা কি ঠিক ছিল?’
– ‘আপনি কি কথা থেকে কি বলছেন?’
– ‘ঠিকই বলছি। বাবা মায়ের ভুল হলে সন্তানের দায়িত্ব সেই ভুলটা শুধরে দেওয়া। আমি তোমাকে ভালবাসি, তোমাকে পেলেই আমি সুখী হবো এটা মাকে বুঝতে হবে।’
– ‘কিন্তু আমি তো আপনাকে ভালোবাসি না।’
– ‘পবিত্র সম্পর্কের বাঁধনে পড়লে ঠিকই অনুভূতির জন্ম নেবে।’
– ‘আপনাকে আমি কিভাবে বোঝায়।’ (অধৈর্য হয়ে)
– ‘বোঝাতে হবে না। যাও গিয়ে বিয়ের প্রিপেরশন নাও, দরকার পড়লে জোর করে বিয়ে করবো।’
ইপ্সিতা বিরক্তসূচক শব্দ করে বড়ো বড়ো পা ফেলে চলে যায়। কাউকে বুঝিয়েই কোনো লাভ হলো না, ইপ্সিতা বিয়ের শাড়ি পড়ে তৈরি হয়ে নিল। নিজেকে আয়নায় দেখার ইচ্ছাটাও জাগলো না।
সময় ঘনিয়ে আসলো, কাজি সাহেব উপস্থিত হয়েছেন। ইপ্সিতা ও নিভ্রকে পাশাপাশি বসানো হলো, ইপ্সিতার মনে কোনোরকম অনুভূতি নেই।
কাজি বিয়ে পড়াতে শুরু করলো, ইপ্সিতা চুপ করে আছে। নিজের অতীতটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে, চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল। সকলের বলার পরে শেষমেশ ইপ্সিতা কবুল বললো।
ইপ্সিতার মা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলেন ইপ্সিতার চোখেও পানি গড়িয়ে পড়ছে। মেয়ে চোখের সামনে থাকবে তবুও সে তো অন্যকারোর।
নিভ্রের মা অইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ইপ্সিতাকে নিজের ঘরে তুললেন। ইপ্সিতা নিভ্রের ঘরে বসে আছে, ঘরটা একদম সাধারন হয়ে আছে। নিভ্র জানে ইপ্সিতা এতটা সহজে বিয়েটা মানবে না, তাই নাটক করে বাসর ঘর সাজানোর কোনো মানেই হয় না।
– ‘কেন করলেন এইটা।’
ইপ্সিতা চোখের পানি ফেলে কথাটা বলল। নিভ্র ইপ্সিতার চোখের পানিটা মুছে দিয়ে বলল,
– ‘এই চোখের পানিটা মুছে দেবার জন্য।”
ইপ্সিতা আর কিছু বলতে পারছে না। কেঁদে চোখ মুখ লাল করে ফেলেছে।
– ‘আরে বেনেবউ এত কাঁদছো কেন আমি আছি তো।’
নিভ্রের বেনেবউ সম্মোধনটা শুনে ইপ্সিতার কান্না থেমে যায়। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
– ‘আমাকে কি বলে ডাকলেন?’
নিভ্র জিভ কাটল, কি থেকে কি বলে ফেলেছে কে জানে।
– ‘কই কিছু না তো।’
– ‘না বলুন।’
– ‘বেনেবউ।’
– ‘এইটা আবার কি নাম?’
– ‘সিক্রেট, যেদিন তুমি আমাকে মন থেকে মেনে নেবে সেইদিন বলবো।’
– ”অদ্ভুত মানুষ।’
– ‘সবটাই তোমার জন্য।’
নিভ্রের হাসি দেখে ইপ্সিতার গা জ্বলে যেতে লাগল। রাতটা কোনরকমে পার হলো, দুইজন কোনো আপত্তি ছাড়া বেড শেয়ার করেছে। যেহেতু এক সাথেই থাকতে হবে তাই মিলেমিশে থাকাই বেস্ট।
পরেরদিন, ইপ্সিতা ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিল, কিন্তু পড়ার জন্য কিছুই পেল না তাই নিভ্রের মায়ের কাছে গিয়ে বলল,
– ‘আন্টি আমি একটু নিচে যাচ্ছি।’
– ‘কেন?’
– ‘আমর কিছু ড্রেস লাগবে তাই।’
– ‘প্রয়োজন নেই, আমি শাড়ি দিচ্ছি পড়ে আসো।’
নিভ্রের মা ইপ্সিতাকে নিজের একটা শাড়ি বার করে দিলেন। ইপ্সিতা মৃদু হেসে শাড়িটা নিয়ে চলে গেল। নিভ্রের মা দোটানায় ভুগছেন কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। একবার চাইছে সবকিছু ভুলে ইপ্সিতাকে আপন করে নিতে আবার পর মুহূর্তেই সবকিছু মনে পড়ে যাচ্ছে তখনি ইপ্সিতাটে সহ্য করে উঠতে পারছেন না।
ইপ্সিতা শাড়িটা পড়ে চা বানিয়ে নিভ্রের মাকে দিল। নিভ্রের মা ইপ্সিতাকে দেখে মুগ্ধ হলেন, লাল হলুদ শাড়িতে মেয়েটাকে ভারি মিষ্টি লাগছে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মনটা খুশি হয়ে যায় কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলেন না। ইপ্সিতার মনটা খারাপ হয়ে যায়।
কলিংবেলের শব্দ পেয়ে ইপ্সিতা এগিয়ে এসে দরজা খুলে দেখল কয়েকজন প্রতিবেশী মহিলা এসেছেন। ইপ্সিতার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল, না জানি মহিলাগুলো আবার কি না কি ঝামেলা লাগায়।
মহিলা গুলো নিভ্রছর মায়ের কাছে গিয়ে বসলেন ইপ্সিতাকে উনি সকলের জন্য চা বানাতে বললেন।
– ‘দিদি আপনি এইটা কি করলেন?’
– ‘কি করলাম আমি!’ (অবাক হয়ে)
– ‘ওই ইপ্সিতার সাথে কিভাবে নিজের ছেলের বিয়ে দিলেন? আপনি তো সবটাই জানতেন।’
নিভ্রের মা চুপ করে রইলেন।
– ‘দিদি ইপ্সিতাকে বেশি মাথাতে তুলবেন না। রূপ দেখিয়ে আপনার ছেলেকে হাত করেছে, বেশি লাই দিলে মাথাতে চড়ে বসবে।’
ইপ্সিতা রান্নাঘর থেকে সবকিছুই শুনতে পাচ্ছিল। মানুষজনের এইরকম কথা শুনে ওর মুডটা খারাপ হয়ে যায়। এই মানুষগুলো এইরকম কেন? মানুষের পেছনে মানুষের নামে বদনাম করা, ঝামেলা লাগায়।
কি পাই এইসব করে?
– ‘আমার বউ আমাদের মাথাতে চড়ে বলে আপনাদের কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে?’
নিভ্রের কন্ঠস্বর শুনে সকলের মুখটা থতমত হয়ে যায়।
– “আপনারা এসেছেন, গল্প করুন বউ দেখুন চলে যান। কি দরকার অধর্মের নামে গীবত করার?’
– ‘তুমি কিন্তু আমাদের অপমান করছো?’
– ‘আপনাদের অপমান বোধ আছে!’ (তাচ্ছিল্যের হেসে)
মহিলা গুলো রেগে লাল হয়ে যাচ্ছে। নিভ্রের মা পরিস্থিতি খারাপ অনুভব করে বললেন,
– ‘আহ নিভ্র কি করছো? আপনারা কিছু মনে করবেন না ওর কথাতে।’
– ‘থাক দিদি আর কিছু বলতে হবে না। আমরা আপনাদের ভালোর জন্যই বলতে এসেছিলাম কিন্তু আপনার ছেলে এইভাবে অপমান করবে বুঝতে পারিনি।’
– ‘যদি অপমানটা আপনাদের গায়ে লেগে থাকে তো তাহলে আর কখনো আমার বাড়িতে এসে এইভাবে অন্যের নিন্দা করবেন না কেমন। আমাদেরকে সুখে থাকতে দিন।’
নিভ্র চলে যেতেই মহিলা গুলো নিজেদের মধ্যে গজগজ করতে করতে চলে গেল। নিভ্রের মা ছেলের উপরে একটু বিরক্ত হলেন। কে জানে নতুন সংসার কেমন হতে চলেছে!
ইপ্সিতা নিভ্রের কথাগুলো সবটাই শুনেছে তাই নিভ্রের কাছে গিয়ে বলল,
– ‘ওনাদের সাথে এইরকম ব্যবহার না করলেই পারতেন।’
– ‘ঠিক ভুলটা আমাকে শেখাতে আসো না। ওনাদের সাথে এটাই করা দরকার ছিল।’
– ‘কিন্তু তাই বলে সরাসরি এইভাবে।’
– ‘হ্যাঁ তাতে যদি ওনাদের আত্মসম্মান বোধটা একটু জাগ্রত হয়। আমি কখনোই চাইবো না একজন বাইরের মানুষের কথাতে আমার সংসারে অশান্তি হোক। আর এই বিষয়টাই তোমাকে সবথেকে বেশি শক্ত হতে হবে, কিছুতেই কারোর কাছে নিজের মাথা নত করবে না। নিজের বুদ্ধিমত্তার সাথে মায়ের মন জয় করে নেবে। কি পারবে তো!’
– ‘হুমম।’
ইপ্সিতাকে অবাক করে দিয়ে নিভ্র ওর দিকে এগিয়ে এসে কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিলো, ইপ্সিতা থমকে যায়। দ্বিতীয়বারের মতো কোনো পুরুষের স্পর্শ পেল, কিন্তু প্রথম স্পর্শের তুলনায় এটি একদম অন্যরকম। গোটা শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে, একটা অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে বড্ড ভালো লাগছে, কিন্তু এইরকম হচ্ছে কেন? নিভ্র ভালোবেসে স্পর্শ করেছে বলে এই অনুভূতি নাকি, নিভ্রের জন্য নিজের মনের অব্যক্ত অনুভবের জন্য এই অনুভূতি? ইপ্সিতা সঠিক কারনটা খুঁজে পেল না, শুধু এটা বুঝল স্পর্শটা ওকে টানছো ভীষন ভাবে।
নিভ্র ইপ্সিতার দুই গালে হাত দিলে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,
– ‘জীবনের প্রতিটা পদে তুমি আমাকে নিজের পাশে পাবে। সবসময়ে তোমার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়াব কথা দিলাম।’
ইপ্সিতা চোখ বন্ধ করে নিভ্রের নিঃশ্বাস অনুভব করতে ব্যস্ত। তবে কি এইবার ইপ্সিতা আর নিভ্রের ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে? নাকি জীবনে আবারো নতুন কোনো ঝড় উঠবে?
#চলবে…
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
আসসালামু আলাইকুম।