#আলোকিত_অন্ধকার
পর্ব-১
#কলমে_নাঈমা_বিনতে_আয়েশা
কোলের বাচ্চাটাকে খুব সন্তর্পণে রাস্তার পাশে শুইয়ে দিলো তিন্নি! তারপর উঠে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে বাচ্চাটা।
‘ওর কি মায়া লাগছে নিজের বাচ্চাকে এভাবে রাস্তায় ফেলে যেতে!’ আপন মনে নিজেকে প্রশ্ন করে ও। সাথে সাথে নিজের মনকে যুক্তি দিয়ে বুঝালো ‘পেট থাকলে ও রকম বাচ্চা আবার হবে!’ আর দাঁড়ালো না তিন্নি। এখানে কেউ দেখে ফেললে বিপদের সীমা থাকবে না। দ্রুত গাড়িতে উঠে গাড়ি ঘুরালো ও।
বাচ্চাটার দিকে তাকালেই বোঝা যায় বাচ্চাটা সদ্যোজাত, বয়স খুব বেশি হলেও এক থেকে দুই দিন। কি সুন্দর ঘুমাচ্ছে সে! কি মায়াবী নিষ্পাপ মুখ! সে জানেনা মা বাবার অবৈধ প্রেমলীলার ফলাফল হয়ে মায়ের উদরে অবহেলার আশ্রয় মিললেও মায়ের কোলে ঠাঁই মেলেনি তার।
হঠাৎই গভীর রাতের সুনশান-নিস্তব্ধ রাস্তায় নিরবতা ভেঙে কেঁদে উঠলো বাচ্চাটি, হয়তো নিজের একাকিত্ব তার অবচেতন মনকে সচেতন করে দিয়েছে।
হায়রে! কি করুণ সে কান্নার প্রতিটি প্রতিধ্বনি! আজ ওই বাচ্চাটার কান্নার শব্দগুলো বিবাহবহির্ভূত অবৈধ প্রেমকে পবিত্র আখ্যা দেওয়া সেই তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ সভ্যগণের কানে পৌঁছাচ্ছে কিনা সৃষ্টিকর্তা জানেন। আজ যদি বাচ্চাটার প্রতিবাদের ভাষা থাকত তবে “প্রেমই পবিত্র, হোক তা বিবাহবহির্ভূত” বলে চিৎকার করা মানুষগুলো কতক্ষণ চেঁচাতে পারতো আল্লাহই জানেন। হায়রে মূর্খের দল! স্রষ্টাকে রেখে এগিয়ে যেতে চায়!
সেদিন আল্লাহ সুবহানওয়া তায়ালা অন্তরীক্ষে থেকে কি পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন জানিনা, তবে সেদিন বাচ্চাটার কান্না একজনের কানে পৌঁছেছিল….. চারু….. যে কিনা পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে মাত্রই আত্মহত্যা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল!
-অনেক হয়েছে, এই অসহ্য পৃথিবীতে আর এক মুহূর্ত না! কি পেলাম জীবনে অবহেলা ছাড়া!
আপন মনে বিলাপ করতে করতে সিলিংফ্যানের সাথে ওড়না টাকে ভালভাবে বাঁধল চারু। আরেকবার নিজের ঘরটির দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল।
নিজের হাতে সাজানো ঘর। পুরো ঘর জুড়ে তার তৈরি কত রকম জিনিস, কত হাতের কাজ। বেডসাইড টেবিলে ফুলদানিসহ ফুল আর আর্টিফিশিয়াল ফলস্ এর দিকে তাকিয়ে আনমনে একটু হাসে। কোনো ধারণা না থাকাতে কি ঝামেলা করেই না ঝর্ণার নিচের পাথর গুলো সংগ্রহ করেছিল। সারাঘর কত্ত সুন্দর নিজের মতো সাজিয়েছিল সে! চোখ ভরে পানি আসে চারুর, ছেড়ে যেতে মায়া হয়। আবার মনে পড়ে যায় পুরানো দিনগুলোর কথা! নাহ! যথেষ্ট হয়েছে। চোখমুখ আবার শক্ত করে ফেলে।
টেবিলের উপরে দাঁড়িয়ে ফাঁস দেওয়া ওড়নার দিকে তাকিয়ে নিজেই হেসে ওঠে,
-তোমার হাইটটাও কম চারু!
নিজেকেই যেন তিরস্কার করে। খাটের পাশ থেকে চেয়ার নিয়ে আসে। টেবিলের উপর চেয়ারটা দাঁড় করিয়ে উপরে উঠে চারু। ঠিক এই মুহুর্তে শুনতে পায় এক বাচ্চার কান্না।
হঠাৎ চমকে ওঠে ও! দৃষ্টি চলে যায় দেয়াল ঘড়িটার দিকে, ঘন্টার কাঁটাটা তিনটা ছুঁই ছুঁই করছে! এত রাতে বাচ্চা আসবে কোত্থেকে! যতদূর জানে এত ছোট বাচ্চা কোথাও নেই।
-যা পারে হোক ওর কি তাতে!
মন কে প্রবোধ দেয় চারু। কিন্তু বাচ্চাটার আর্তনাদ সহ্য করতে পারে না।
বরাবরই একটু সাহসী মেয়ে চারু। ধীরে ধীরে প্রথমে চেয়ার তারপর টেবিল থেকে নিচে নেমে আসে। চারুদের বাসার সাথেই লাগোয়া রাস্তা একেবারে। সাহস করে দরজা খুলে মেইনগেটের ফাঁক দিয়ে যা দেখে তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না চারু। একটা বাচ্চা রাস্তায় শুয়ে কেঁদেই চলেছে। কিছু দূরে একটা কুকুর ‘গরররর’ শব্দ করছে মুখ দিয়ে, হয়তো সঙ্গীদের ডাকার প্রস্তুতি নিচ্ছে। হায় মানবসভ্যতা! আধুনিক হতে হতে একেবারে আদিম হয়ে গেছ! সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ! আশরাফুল মাখলুকাতের আজ জায়গা হচ্ছে রাস্তায় তাও কুকুরের খাবার হয়ে!
কোনোকিছু না ভেবেই চাবি নিয়ে আসে স্ত্রস্তপায়ে। বিস্ময়ের সত্ত্বেও শান্তভাবে তালা খুলল। চারিদিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলো না চারু। আর কিছু ভাবলো না ও। দরজা খুলে বেরিয়ে এসে একটা ইট নিয়ে কুকুরের দিকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিল, ভয়ে দৌড়ে পালালো কুকুরটা। আস্তে আস্তে বাচ্চাটির পাশে এসে দাঁড়াল চারু। কিছু না ভেবেই বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে ঘরে চলে এলো। যা ভাবার পরে ভাবা যাবে। এভাবে তো আর ফেলে চলে যাওয়া যায় না!
রুমে ঢুকেই বাবা মাকে ডাকা শুরু করে চারু। ভুলে যায় সিলিং এর সাথে বাঁধা ওড়নার কথা!
চারুর চেঁচামেচিতে দেখে ছুটে আসে চারুর বাবা রিহান আর মা সালিহা। সালিহা চারুর সৎমা, চারুর মা মারা যাওয়ার পর কিছুটা বাধ্য হয়েই সালিহাকে বিয়ে করে এনেছেন রিহান। ©নাঈমা বিনতে আয়েশা।
-বাচ্চাটা কে? ঘরে ঢুকেই প্রশ্ন করে সালিহা।
চারু বাচ্চাটার কান্না থামাতে ব্যস্ত। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
-একটু দুধ গরম করে এনে দাও, সব বলছি!
-চারু এসব কি! চেঁচিয়ে ওঠেন রিহান, তার দৃষ্টি সিলিং ফ্যানের দিকে।
হঠাৎ থতমত খেয়ে যায় চারু। আস্তে আস্তে বলে,
-বাবা আমি বলছি সব, তুমি প্লিজ মাকে একটু দুধ গরম করে আনতে বলো!
সালিহা এখনো বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছেন। চারু আবার বলে,
-যাও না মা! আমি সব বলব বলছি তো! বাচ্চাটা কষ্ট পাচ্ছে! খুব ক্ষিধে পেয়েছে ওর!
কেঁপে ওঠা কন্ঠে বলে চারু। সালিহা চারুর দিকে একবার তাকিয়ে চলে গেলেন রান্নাঘরে। তার চোখে রাগ নাকি বিস্ময় ঠিক বুঝতে পারল না চারু। এরই মাঝে ঘরে ঢুকেছে সালিহার মেয়ে নিধি। সালিহা আর রিহানের মেয়ে। বয়স আঠারো ছাড়িয়েছে। বেশ নজরকাড়া সুন্দরী, সে কথা পরে বলা যাবে। নিধি ঘুম ঘুম কন্ঠে বলে,
-কি রে বড়পু?
চারুর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে পালটা প্রশ্ন করে,
-দেখতো মায়ের কাজ কত দূর?
নিধিকে হা করে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবার ধমক লাগায় চারু,
-আরে যা না, দেখে আয়!
নিধি কিছু না বুঝে বোকার মতো আবার হাঁটা করে রান্না ঘরের দিকে।
গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে দুধ গরম করতে গিয়ে বাচ্চাটার কথা ভেবে দুধে আরো পানি ঢেলে পাতলা করে নেন সালিহা। দুধ নিয়ে আসলে সেটাকে খাওয়ার উপযোগী ঠান্ডা করে চামচে করে অল্প অল্প করে বাচ্চাটার মুখে দেয় চারু। বাচ্চাটা যেন সেই অপেক্ষায় ছিল। চুকচুক করে বিড়ালছানার মতো করে শুষে নেয় চামচে করে ঢেলে দেওয়া মুখের ভিতরের দুধটুকু। দেখতে খুব ভাল লাগে চারুর। বাচ্চাটা কিছুটা খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ে।
অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ও, কত্ত ছোট পেট, ছোট ছোট হাত পা… চারুর মনে হয় বাচ্চাটা যদি ওর হতো! -আচ্ছা এই ছোট্ট বাবুটাকে ও নিজের কাছে রাখতে পারবে না!
হঠাৎ চারুর খেয়াল হয় সবাই তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ঘুমন্ত বাচ্চাটাকে ওর ওড়না দিয়ে পেঁচিয়ে খাটের মাঝ বরাবর শুইয়ে দিয়ে তাকায় বাবার দিকে।
-বাবা আমি সুইসাইড করতে গিয়েছিলাম! আমার ভুল হয়ে গেছে! কিন্তু আজ কিছু বলব না। তোমরা ঘুমাতে যাও আর সকালে আমি সব বলব তোমাদের!
এবার রেগে যান সালিহা,
-মানে কি চারু! কে ওই বাচ্চা এত রাতে কোথায় পেলি! আর তোর মরা লাগবে কেন!
মায়ের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে চারু বলে,
-বুঝতে পারছি অনেক প্রশ্ন তোমাদের মনে। যাও না ঘুমাও, কাল সকালে সব বুঝিয়ে বলব!
বলে নিধির দিকে ইশারা করে চারু।
বুঝতে পেরে নিধি বাবা মাকে ঠেলে পাঠিয়ে দেয়। রিহান এখনো কিছু বলছেন না। বলার মতো কিছু পাচ্ছেন না। নিরবে গিয়ে শুয়ে পড়লেন।
সালিহা আরো কিছু বলতে চাইছিলেন। নিধি আস্তে ঠেলে দেয় মাকে,
-যাও না মা, কাল সকালেই না হয় শুনে নিও এখন থাক!
অগত্যা রুমে গিয়ে শুয়ে পড়েন তিনি। রিহানকে একবার ডেকে বুঝলেন রিহান ঘুমিয়ে গেছে।
-কি জানি বাবা! এসবের পর না শুনেও কি করে ঘুমায় মানুষ! আমার তো ঘুমই হবে না আর!
চরম বিরক্তি প্রকাশ করে পাশ ফিরে শুয়ে তিনিও কিছু না শুনেই ঘুমিয়ে গেলেন।
নিধি চেয়ার টেবিল গুলো ঠিক করে, চারুর বিছানায় এসে বসতে বসতে বলল,
-কি হয়েছে বল তো আপু?
-তার আগে তোর বালিশ কাঁথা নিয়ে আমার রুমে আয়, আজ এখানে থাকবি।
-আচ্ছা, বলে চারুর কথামতো কাজ করে চারুর পাশে এসে বসে পড়ে নিধি।
-এবার বল, আগ্রহ ভরে তাকিয়ে থাকে নিধি। চারু ধীরে ধীরে গুছিয়ে বলতে থাকে একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো।
এই সুযোগে জেনে আসা যাক চারু কেন আত্মহত্যার করতে চেয়েছিল! আর কেনই বা বাচ্চাটার জায়গা তার মায়ের কোলে না হয়ে রাস্তায় হলো!
ঘটনা গুলো কি ছিল!…..
(চলবে)
©নাঈমা বিনতে আয়েশা।