#আলোকিত_অন্ধকার
#কলমে_নাঈমা_বিনতে_আয়েশা
১২ তম পরিচ্ছেদ
___________________________________
কথায় আছে,
যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে,
সহস্র শৈবালদাম বাঁধি আসে তারে।
জীবনের কোথাও ছন্দপতন হয়ে গেলে নতুন করে সেই ছন্দে জীবনকে এগিয়ে নেওয়া শুধু কঠিন না যথেষ্ট ধৈর্য্যর ব্যাপার ও বটে।
ডিভোর্স হয়েছে মাত্র ছয়মাস হলো, শুনেছে তাহের বিয়ে করেছে। হায়রে সমাজ! আর চারু?
চারুর জীবনটা কোনো এক চড়ায় যেন আটকে গিয়েছে বলে মনে হয় ওর। দিনরাত একই রুটিন। ঘুম থেকে উঠে সালিহার খোঁটা শুনতে শুনতে আবার রাতে ঘুমানোর সময় হয়ে যায়।
প্রাণপণে চেষ্টা করে চারু সালিহার কাজ গুলো করে দেওয়ার কিন্তু তবুও মন পায় না মায়ের। নিধি ইদানীং অনেক বেশি উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠেছে। নিধির কাজ গুলো পছন্দ না হলেও কিছু বলার নেই চারুর। বোন হিসেবে শাসন করা তো অনেক দূরের কথা।
নিধির দেরি করে বাড়ি ফেরা নিয়ে বলতে গিয়েছিল একদিন।
সালিহা তেতে উঠেছিলেন একেবারে,
-তুই তো মেয়ে বাচ্চার মা হবি না, জানবি কি করে বাচ্চাদের নিয়ে অন্য কেউ কথা বললে কেমন লাগে।
চারু স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল একেবারে। সেদিনের পর থেকে চারু কথা বলাই ছেড়ে দিয়েছে।
আর রিহান? সেতো এক নিরব দর্শক। শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে যায়। চারু বুঝে সেই দীর্ঘশ্বাসের মাঝে কতটা ব্যথা লুকিয়ে আছে। কিন্তু তবুও রাগ হয় বাবার উপর।
বাবা কি একটু কিচ্ছু বলতে পারে না মাকে?
এত কিছুর মাঝে চারু যেটাকে আঁকড়ে ধরে আছে সেটা হলো লেখাপড়া। মাসছয়েক পরে মাস্টার্সের পরীক্ষা।
.
কক্সবাজার থেকে ফেরার দিনকয়েক পরেই পারিবারিক পছন্দে বিয়ে হয়ে যায় রাফিয়ার।
তিন্নি আতিফকে নিয়ে এতটাই মগ্ন ছিল যে রাফিয়ার বিয়েতে ড্রাইভারকে দিয়ে দামি গিফট পাঠিয়ে দিলেও নিজের যাওয়ার সুযোগ তার হয়নি।
নিষিদ্ধ বিষয়গুলোতে আকর্ষণ তীব্র হয়। তেমনি তীব্র ছিল আতিফ আর তিন্নির প্রেম। আজকাল আর শুধু ফোনালাপ আর কলেজ ক্যাম্পাসে দেখা করেই ভালবাসার গভীরতা প্রমাণ করা যায় না। ভালবাসার গভীরতা পরিমাপের নতুন নতুন নিয়মে নতুন ভাবে নিজেদের আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে আতিফ তিন্নি।
আতিফ আর তিন্নির সম্পর্কের গতি এতটাই বেশি ছিল যে আজ তিন্নিকে বলতে হচ্ছে,
-আতিফ আ…আমি প্রেগন্যান্ট।
আতিফ চমকে তিন্নির দিকে তাকায়। তারপর খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে,
-এবরশন করিয়ে ফেলো। তুমি তো জানোই লেখাপড়া শেষ না করে এখনি বিয়ে সম্ভব না।
-তোমার কি মনে হয় এবরশনের চেষ্টা আমি করিনি? কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে, তিন মাস….
তিন্নি কথা শেষ করার আগেই আতিফ ঘুরে বসে,
-বলতে কি চাইছো বলো তো! এখন আমি তোমাকে বিয়ে করি আর এনজয় করার এই লাইফটাকে হেল করে ফেলি বাচ্চার বাবা হয়ে! রেপুটেশন নেই আমার!
তিন্নি নিজেও বুঝতে পারছে কতটা রেপুটেশনের প্রশ্ন,
-আতিফ কি করব আমি!
-বুঝতে পারছি না তিন্নি। আমাকে একটু ভাবতে দাও, ভাল লাগছে না বসতে। আসি আর বাসায় যাও তুমি।
উঠে চলে যায় আতিফ।
তিন্নি আতিফের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। তিন্নি দুচোখে রাগ আর দুঃখ মিশিয়ে এক অদ্ভুত ছায়া নিয়ে তাকিয়ে আছে আতিফের দিকে।
তিন্নির অনুশোচনা এসেছে এটা ভাবলে পাঠকগণ গোড়াতেই ভুল করে ফেলবেন।
মানুষ যখন আল্লাহ সুবহানওয়া তায়ালাকে ভুলে অন্ধকারে পা বাড়ায় তখন আলোটা তাদের কাছে মরীচিকা আর অন্ধকার তাদের কাছে এক আলোর জগৎ মনে হয়।
তিন্নি ভাবছে আমি কেন আরো সতর্ক হলাম না, আতিফের ঘোর এখনো কাটেনি। আর আতিফ সম্পর্কে এখন বলা হয়তো একেবারেই নিষ্প্রয়োজন, তিন্নি ক্যাম্পাসে বসে যখন এসব ভাবছে আতিফ তখন আরেকটা মেয়ের চোখে নিজেকে হারিয়ে ফেলছে।
পবিত্র কুরআনে সূরা বাকারার ১৭১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন,
وَمَثَلُ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ كَمَثَلِ ٱلَّذِى يَنْعِقُ بِمَا لَا يَسْمَعُ إِلَّا دُعَآءً وَنِدَآءً صُمٌّۢ بُكْمٌ عُمْىٌ فَهُمْ لَا يَعْقِلُونَ
অর্থঃ আর যারা অবিশ্বাস পোষণ করে তাদের উপমা হচ্ছে তার দৃষ্টান্তের মতো যে ডাক দেয় এমন কতককে যে আওয়াজ ও চেচাঁমেচি ছাড়া আর কিছু শোনে না। তারা বধির, বোবা, অন্ধ, কাজেই তারা বুঝে না।
তিন্নির ক্ষেত্রেও একই রূপ পরিলক্ষিত হয়।
বাসায় ফিরে তিন্নি।
-মা ব্যস্ত তুমি?
তিন্নির মা টিনা খুব মনোযোগ দিয়ে ফোনে কথা বলছিলেন। মেয়ের দিকে ইশারা করলেন পরে আসতে। কে বলবে এই মহিলা তিন্নির মা? রূপচর্চা আর সাজগোজ তাকে তিন্নির আশেপাশেই রেখেছে। আজও যখন কেউ প্রশ্ন করে আপনি আনম্যারিড?
হাসিতে গড়িয়ে পড়ে টিনা।
মায়ের ঘর থেকে বেশ বিরক্তি নিয়ে বের হলো তিন্নি। রুমে এসে অতিপ্রয়োজনীয় জিনিস গুলোই নিয়েই ব্যাগপ্যাক করে ফেলল।
ঘন্টাখানেক পরে মেয়েকে ডেকে পাঠালেন টিনা,
-শোন তিন্নি আমার একটা কাজ পড়ে গিয়েছে কানাডায়, তোর বাবা যেতে বলছে কিন্তু ফিরতে তো প্রায় আটমাস বা একবছর লেগে যাবে। ওখানে তোর বাবা কি বিজনেসের কি করবে! আমাকে তো বুঝিয়ে বলল ও না।
এতদিন তোকে একা রেখে যাবো তুই বরং চল।
-আরে না মা আমি কেন! আমার এক্সাম আছে তো। আমি এখন যাবো না।
মায়ের যাওয়ার কথা শুনে তিন্নি যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি পেল।
-কিন্তু……. তোকে এতদিন…
-আরে কি কিন্তু কিন্তু করছ? এই যুগে এসে এত সামান্য ব্যাপারে হেজিটেশন তোমার মতো স্মার্ট লেডিকে মানায় না।
তিন্নি প্রশংসায় গদগদ হয়ে গেলেন টিনা।
মাকে খুশি দেখে তিন্নি আরো সাহস পায়,
-আর আমাকে তো কাজ করে খেতে হচ্ছে না। কত বিশ্বস্ত মেইড-সার্ভেন্ট, ড্রাইভার, হোম কেয়ারটেকার আছে।
-আচ্ছা তোর বাবাকে বলে দেখি। তুই যেন কি বলবি?
-কই? কিছুনা
মেয়ের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন টিনা,
-কোনো সমস্যা?
-আমি কি বলেছি আমার সমস্যা? এমনি আসা যাবে না তোমার ঘরে?…
মায়ের সাথে আরো টুকিটাকি কথা বলে নিজের ঘরে আসে তিন্নি। যাক একটা সমাধান পেয়েছে। আপাতত এইখানেই সব ব্যবস্থা করবে। ব্যাগ থেকে সব বের করে আবার। আর সবার মুখ কিভাবে বন্ধ করতে হয় তিন্নি জানে।
বাবাকে নিয়ে একটু ভয় ছিল তাকে বাংলাদেশে থাকতে দেয় কিনা। কিন্তু বিজনেসের চাপে দিশেহারা বাবাও রাজি হয়ে গেল।
শেষপর্যন্ত তিন্নি থেকে গেল। শুধু রাঁধুনি আর টুকটাক কাজের একজনকে রেখে সবাইকে টিনা না আসা পর্যন্ত ছুটি দিয়ে দেয়। তিন্নির চতুরতা বুঝতে পারে না কেউ। এতদিন পরে এতদিনের লম্বা সময় বেতনসহ ছাড়া পেয়ে সবাই খুব খুশি মনে ছুটিতে যায়।
এদিকে সাহসী, চতুর তিন্নি ডাক্তার থেকে শুরু করে কিচেনের রাঁধুনি সবাইকে টাকা দিয়ে লাইনে এনেছে।
এভাবেই তিন্নি প্রায় সবার অগোচরে জন্ম দেয় আতিফ আর তিন্নির তথাকথিত বিশুদ্ধ প্রেমের ফসল বাচ্চা মেয়েটাকে।
ছোট্ট বাবুটা হাত পা নাড়ছে একটু একটু। তিন্নির তাতে বিন্দুমাত্র অনুভূতি আসছে না। বরং সেদিকে তাকিয়ে খুব রাগ হচ্ছে।
মাতৃত্বটাকে বিনোদন আর উপভোগের আশায় হারিয়ে ফেলেছে তিন্নি। তার কথা একটাই,
এক্ষুণি মা হয়ে সে কিভাবে কি করবে! তার চেয়ে বড় কথা আতিফের ফ্যামিলি তার ফ্যামিলি মানবে না তাহলে কি করবে বাচ্চাটাকে নিয়ে! অসহ্য লাগছে তিন্নির।
এতদিন কি কষ্টটাই না গেছে। বাসায় অলটাইম নার্স রেখে দিয়েছিল, সবকিছু ঠিকঠাক ভাবে হলেও তিন্নি জানেনা এরপর ও বাচ্চাটাকে নিয়ে কি করবে।
অনেক ভেবে একটা উপায় তিন্নি বের করে, কোনো নিঃসন্তান দম্পতিকে দিয়ে আসবে। হঠাৎ ফোন আসায় সম্বিত ফেরে তিন্নির।
-হ্যাঁ মা বলো!
-আমরা কাল ফিরছি রে তিন্নি, কাল ভোরেই পৌঁছে যেতে পারি।
চমকে ওঠে তিন্নি। কি করবে এখন সে! আতিফের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই সেইদিনের পর থেকে। আতিফ বলেছিল দেশের বাইরে বাবার সাথে তাই কথা বলতে পারছে না। তাই চাপ দেয়নি যদি খারাপ কিছু হয়ে যায়!
-কি রে তিন্নি, সারপ্রাইজ দিলাম তোকে, আরেকটা সারপ্রাইজ কাল ফিরে বলব।
-হ্যাঁ মা
মায়ের কথায় কোনোরকমে টেনে টেনে উত্তর দেয় তিন্নি।
সারপ্রাইজ নিয়ে ভাবনা করার মানসিকতা এখন নেই। ড্রয়ার থেকে ষাট হাজার টাকা বের করে রাঁধুনী আর কাজের মেয়েটাকে ভাগ করে দেয়।
এতটাকা একবারে দেখে ওরা আকাশের চাঁদ হাতে পায়।
-কি খুশি তো?
মাথা নাড়ায় দুইজনেই।
-এখানকার কোনো ঘটনা কেউ জানবে না তো?
-আপনের নুন খাইছি আফা, নিমকহারামি করুম না!
রাঁধুনী কথায় মাথা নেড়ে সায় দেয় স্বল্পভাষী কাজের মেয়েটা।
-যা তোরা দূরে অন্য কোথাও কাজ খুঁজে নে। কাল খুব ভোরে চলে যাবি। পারবি না?
মুখ চাওয়াচাওয়ি করে দুজনে।
তারপর বলে,
-আইচ্ছা আফা, আগে বাড়িত যাই তারপর কাজ খুঁজে সেইহানে যামুনে।
-হ, হ
আবার সায় দেয় কাজের মেয়েটা।
-বেশ যা এখন তোরা।
ওদের পাঠিয়ে দিয়ে বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে শুধু বলে,
“ক্ষমা করিস আমার কিছুই করার নেই!”
বাবুটাকে ফিডিং পর্যন্ত করায়নি তিন্নি। উঠে কাজের মেয়েটাকে বাবুর দেখাশোনা করতে বলে মোবাইল নিয়ে ছাদে চলে যায়।
.
আজ সালিহার কাছে যা নয় তাই শুনেছে চারু। পরীক্ষা শেষ। বাড়িতে একপ্রকার বেকার বসে চারু। এটাই সালিহা সহ্য করতে পারছে না কোনোভাবে যখন তখন কথা শুনাচ্ছে চারুকে।
-আর পারছি না আমি
বিড়বিড় করে কথাটা বলে কাঁদতে থাকে চারু।
-আর না… অনেক হয়েছে, অনেক সহ্য করেছি আমি!
এরপরের ঘটনা তো পাঠকের জানা।
চারুর আত্মহত্যা আর তিন্নির বাচ্চাটাকে রাস্তায় ফেলে যাওয়া…!
এবার কি করবে চারু?
হয়তো শুরু হবে নতুন কোনো গল্পের…
(ক্ষমা করবেন আমি বেশ ব্যস্ত ছিলাম, সাধ্যমতো চেষ্টা করছি গল্প কন্টিনিউ করার, পেরে উঠছি না। আশা করি ভুল বুঝবেন না। কেমন লাগছে গল্পটা তা জানাতে অবশ্যই ভুলবেন না। -নাঈমা বিনতে আয়েশা)