আলোকিত অন্ধকার পর্ব-১১

0
261

#আলোকিত_অন্ধকার
#কলমে_নাঈমা_বিনতে_আয়েশা
১১ তম পরিচ্ছেদ
___________________________________
খুব শান্তভাবে বাবার পাশে দাঁড়িয়ে চারু যখন ডিভোর্স পেপার সাইন করছিল, মুখ না তুলেই চারু বুঝতে পেরেছিল ওর বাবার চোখে পানি।
সাইন করা শেষে পেপারটা টেবিলের উপরে রেখে উঠে এলো। আগের মতোই শান্তভাবে নিজের রুমে ঢুকে দরজা একটু ঠেলে দিয়ে শুয়ে পড়ল।
চারু তো কম চেষ্টা করলো না টিকে থাকার! তবুও নামের পাশে ডিভোর্সি স্ট্যাম্প লাগিয়ে দিলো তাহের আর মাহিমা।
বলা যায় একদিক দিয়ে মুক্তিই পেয়েছে নিত্য খোঁটা-গঞ্জনা আর মার খাওয়া থেকে। কিন্তু তারপর ভবিষ্যৎ কি চারুর!
আমাদের এই সমাজ এখনো বাঁকা চোখে তাকায় ডিভোর্সি নারীদের দিকে, একই ক্ষেত্রে পুরুষের বেলায় বলা হয় “ছেলে মানুষের ওরকম একটু হতেই পারে, কোনো ব্যাপার না” হায়রে আমার সুশীল সভ্য সমাজ! হায়রে আমার “নো জেন্ডার ডিসক্রিমিনেশন” বুলি আওড়ানো সমাজ!
অন্তত বুঝা উচিত সমঅধিকার নয় নারীদের প্রয়োজন মর্যাদা।
স্রষ্টা যেমন সৃষ্টির পার্থক্য করেছেন, তেমনি দায়িত্বের পার্থক্য করেছেন। প্রত্যেক কাজের, প্রতিটি ক্ষেত্রকে আলাদা করেছেন। স্রষ্টার থেকে বড় জ্ঞানী আর কে হতে পারে! পৃথিবীকে আলো দেওয়ার দায়িত্ব সূর্যের একার, অন্য নক্ষত্র এসে বলবে না আমাদেরও সূর্যসম অধিকার চাই, তাহলে পৃথিবী ধ্বংস হবে। কোনো পুরুষ সন্তান জন্ম দিবে না, নারীদের একার দায়িত্ব, পিতৃত্বের অধিকার পুরুষের একার। যার কাজ তারই। বোঝা উচিত নিজেদের সীমারেখা, সীমাবদ্ধতা আর নিজেদের অধিকার সম্পর্কে।
তাই এটাই বলা উচিত যে
“সমঅধিকার নয় মর্যাদা চাই”….।
সীমালঙ্ঘন করা কখনোই উচিত না। আল্লাহ বলেন,
ٱدْعُوا۟ رَبَّكُمْ تَضَرُّعًا وَخُفْيَةً إِنَّهُۥ لَا يُحِبُّ ٱلْمُعْتَدِينَ
অর্থঃ তোমাদের প্রভুকে ডাকো বিনীতভাবে ও গোপনতার সাথে। নিঃসন্দেহ তিনি সীমালঙ্ঘনকারীদের ভালোবাসেন না।
সূরা আল আরাফ (الأعراف), আয়াত: ৫৫।
মাহিমা বলেছে চারু নাকি মা হতে পারবে না, তাই সে চারুকে আর ছেলের বউ করে রেখে বংশের প্রদীপ নিভাতে পারবে না।
আচ্ছা মাহিমা কিভাবে জানে চারু মা হতে পারবে না? একবারই ডাক্তারের কাছেই যেতে দিলো না। কি হয়েছে সেটাও জানতে দিলো না।
আচ্ছা না হয় সে মা হতে পারবে না কিন্তু মেয়েরা কি শুধুই সন্তান জন্ম দেওয়ার যন্ত্রের মতো ব্যবহৃত হবে! এক অক্ষমতার কারণে সব ছেড়ে আসতে হবে!
নাহ আর ভাবতে পারে না চারু! কিভাবে বেঁচে থাকবে এই জীবন নিয়ে! পারবে না চারু।
মাথায় কারো হাতের স্পর্শ পাওয়ায় মুখ তোলে ও, তারপর
-বাবা…. বলে কান্নায় ভেঙে পড়ে চারু।
.
একেবারে হালকা গোলাপি রঙের উপর বড় বড় সাদা পাথরের কাজ করা একটা গাউন পরেছে তিন্নি। গলায় ওর সেই হিরের নেকলেস, হালকা মেকআপ, চোখে গাঢ় কাজল, ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক…
চুল গুলো দারুণ স্টাইলে খোঁপা করে গোলাপি সাদা পাথরের লম্বা হেয়ার ক্লিপ দিয়ে আটকে রেখেছে। মুখের দুইপাশে চিকন প্যাঁচানো চুল গুলো ছাড়া ছাড়া ভাবে গাল স্পর্শ করছে।
এতসব সাজ সব মিলিয়ে সুন্দরী তিন্নিকে আরো অসাধারণ করে তুলেছে।
আচ্ছা আতিফের জন্যই কি সে এত সাজাচ্ছে নিজেকে? নিজের মনেই প্রশ্ন করে তিন্নি।
হ্যাঁ হয়তো।
উঠে দাঁড়িয়ে আবার ঘুরে ফিরে নিজেকে দেখে নিচ্ছে। নাহ সব ঠিকঠাক আছে”
হঠাৎ ফোন বেজে ওঠায় সম্বিত ফিরে পেল তিন্নি। রাফিয়া নিচে যাওয়ার জন্য ডাকছে। আংটির বক্সটা হালকা গোলাপি সাদা রঙের হ্যান্ড পার্সে নিয়ে নিলো।
যাওয়ার আগের আরেকবার আয়নার দিকে তাকিয়ে চোখে বুলিয়ে নেয় নিজের উপর।
ভারি গাউন পরে নামতে যথেষ্ট কষ্ট হচ্ছে তিন্নির
জন্মদিনের কেক রাখা টেবিলকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছি সবাই। হোটেল থেকে নেমে সেদিকে এগোলে লাগল তিন্নি। আজ শুধু আতিফ নয় সবাই বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে তিন্নির দিকে। অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে।
এই মেয়েকে না পেলে যেন জীবনটাই ব্যর্থ বলে মনে হলো দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেগুলোর। তিন্নির সম্পূর্ণ খেয়াল আজ আতিফের দিকে।
হাঁটতে আসলেই অসুবিধাই হচ্ছে ওর। একবার তো মনে হলো পড়ে যাবে, এত ভারি সাজগোজ আর এদিকে সবার চেয়ে থাকা। রীতিমতো লজ্জায় পড়ে যাচ্ছে ও।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে আতিফ এগিয়ে গেল তিন্নির দিকে তারপর খুব স্মার্টলি তিন্নির দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“হেইই বিউটি কুইন মে আই হেল্প ইউ?”
মুচকি হেসে দ্বিধাহীনভাবে নিজের হাত বাড়িয়ে দিলো তিন্নি,
“ওহ সিউর, হোয়াই নট!”
আতিফের শক্ত মুঠোর মাঝে নিজের একহাত রেখে অন্যহাতে গাউন ধরে হাঁটতে লাগল তিন্নি। রাফিয়া আতিফের আজকের রূপ দেখে রীতিমতো অবাক। তিন্নির মুখে যতটুকু শুনেছে, আতিফ বড়লোক বাবার একমাত্র ছেলে, খুবই ভদ্র বিশেষত মেয়েদের ব্যাপারে। কিন্তু একদিনেই সেই ছেলে নিজেকে পুরো পালটে ফেলল!
অবশ্য তিন্নিরও শোনা কথা আতিফের ফ্রেন্ড দের কাছে থেকে। কি জানি! কি কপালে রেখেছে আল্লাহ!
হৈ হুল্লোড় করে কেক কাটা হলো। সবাইকে কেক খাওয়ালো তিন্নি। সবার থেকে গিফট নিতে আর আনন্দে মেতে ছিল তিন্নি। হঠাৎ নিজের নাম শুনে সামনে তাকালো তিন্নি, তাকালো সবাই।
-একবার এদিকে আসবে তিন্নি?
টেবিলের সোজাসুজি ঠিক সবার সামনে দাঁড়ানো আতিফ ডাকলো।
অবাক হয়ে তিন্নি ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে আতিফের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। যতক্ষণ তিন্নি হাঁটছিল আতিফের চোখ তিন্নির দিকে নিবিষ্ট হয়ে আছে। চোখ নামিয়ে নেয় তিন্নি,
-হ্যাঁ বলো?
হঠাৎই হাঁটু গেড়ে তিন্নির সামনে বসে পড়লো আতিফ,
-বৃদ্ধ হতে চাই তোমার সাথে!
একরাশ বিস্ময়ে দুহাতে মুখ ঢেকে আতিফের দিকে চেয়ে রইল তিন্নি!
চোখেমুখে আরো একটু ভালবাসার ছাপ এঁকে আতিফ তার হাতে থাকা ডায়ামন্ডের আংটির বক্সটা এগিয়ে ধরল তিন্নির দিকে,
-উইল ইউ ম্যারি মি তিন্নি?
তিন্নি এখনো মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অদূরে দাঁড়িয়ে সবাই, অনেকের হাতেই ফোন বা ক্যামেরা উঠে এসেছে। তারই মাঝে অনেকেই চেঁচিয়ে বলতে লাগল,
“তিন্নি প্লিজ সে ইয়েস!”
যেন কোনো সিনেমার শুটিং হচ্ছে।
কেবল কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল রাফিয়া। সবার দিকে তাকালো তিন্নি। আনন্দে বিস্ময়ে কথা বলতে পারছে না সে। আতিফের ডাকে সম্বিত ফিরল তিন্নির।
“তিন্নি! উইল ইউ বি মাই বেটার হাফ?”
আর ভাবলো না তিন্নি, হাত বাড়িয়ে দিলো আতিফের দিকে। তিন্নির হাতে আংটি পরিয়ে হাতে চুমু দিলো আতিফ। অভাবনীয় ঘটনাতে তিন্নির মনে হতে লাগল সে কোনো ঘোরের মাঝে আছে। ঘোর কাটিয়ে আতিফের দিকে তাকিয়ে কোনোমতে বলল,
-একটু দাঁড়াও!
আতিফ অবাক হয়ে তাকালো তিন্নির দিকে কেকের টেবিলে রাখা নিজের পার্স থেকে আংটিটা নিয়ে আসলো তিন্নি। হাসতে হাসতে বলল,
-তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে আমি নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে গিয়েছি, এটা তোমার জন্য।
আতিফের হাতেও আংটি পরিয়ে দিলো তিন্নি। সবাই এই ফিল্মি স্টাইলটা উপভোগ করল রাফিয়া ছাড়া।
কোনো এক অজানা আশঙ্কার কালো ছায়া গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে থাকল তার মুখে। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। এখন কিছুই করার নেই ওর। কে জানে কি অপেক্ষা করছে তিন্নির জন্য।
আতিফের ঠোঁটে লেগে থাকে সেই দুর্বোধ্য রহস্যময় হাসি!

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here