#আলোকিত_অন্ধকার
#কলমে_নাঈমা_বিনতে_আয়েশা
১৫ তম পরিচ্ছেদ
_____________________________
-আচ্ছা তারানা, এত গরমের মাঝে তুমি যে এত হিজিবিজি পরে আছো কষ্ট হচ্ছে না?
চারুর প্রশ্নটা শুনে হাসতে থাকে তারানা।
ক্লাসের ফাঁকে তারানার সাথে গল্প করছিল চারু। ইদানীং তারানার সাথে চারুর বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। কথা বলতে গিয়ে প্রসঙ্গক্রমে দেখা যায় চারু তারানা একই বয়সী। তবে এই বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক গড়তে অবশ্য তারানার ভূমিকাই বেশি।
-এখনকার সামান্য গরমের সাথে জাহান্নামের আগুনের বর্ণনা মিলিয়ে দেখলেই বুঝবে এটা কিছুই না। আচ্ছা খারাপ দিক বাদ দিয়ে ভাল দিক দিয়েই বুঝিয়ে বলি।
উমমমম…. আচ্ছা… চারু, ঔষধ খেতে কেমন লাগে তোমার?
-কার ভাল লাগে, শুধু সুস্থ থাকার জন্য খেতে হয়।
চারুর কথা শুনে মুচকি হাসে তারানা,
-দেখো চারু শুধু মাত্র সুস্থ জীবনে যাওয়ার জন্য তুমি বাজে স্বাদের ঔষধটা নির্দ্বিধায় খেয়ে নিচ্ছ, সেখানে এই নশ্বর পৃথিবীতে অল্পসময়ে তুমি অনন্তকালের ভাল থাকার উপায় করে নিতে পারছ, সেখানে তুমি কোনটা বেছে নেবে বলো?
চারু অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে তারানার দিকে। এভাবে সে কখনো ভাবেইনি। আনমনেই বলে উঠে,
-আমার মা খুব ধার্মিক ছিলেন। ছোট্ট বেলায় ভাইয়ের জন্ম দিতে গিয়ে মা মারা যাওয়ার পর, বাবার আরেকটা বিয়ে, সাংসারিক কাঠিন্য সবকিছু মিলিয়ে এসব ধার্মিক বিষয় থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিলাম।
তারপর বিয়ে, ডি…. এপর্যন্ত বলে আচমকাই থেমে যায় চারু। এখনো অব্দি এখানে কেউ জানেনা চারু ডিভোর্সি।
কারণ সমাজের কিছু মানুষ বড্ড সুযোগসন্ধানী। তাদের এড়িয়ে চলতে গিয়ে কিছুটা হলেও মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়।
-কি হলো তোমার?
-কই… কিছু না… আসলে এসবের মাঝে ইসলামের ব্যাপারে কিছুটা উদাসীন হয়ে পড়েছিলাম।
নিজেকে সামলে নিয়ে উত্তর দেয় চারু। তারপর আবার নিজেই বলে,
-এরপর আস্তে আস্তে আবার নিজেকে বদলাতে শুরু করেছি। একবারে পারব না। আচ্ছা তারানা, এইতো আমি লম্বা কামিজ বা বড় আঁচল ছড়িয়ে শাড়ি পরে তার উপর স্কার্ফ পরেই আসি স্কুলে, এটাও তো পর্দা। পর্দা করার জন্য এই বোরখা কেন পরতে হবে?
চারুর ছেলেমানুষী ব্যাখ্যা আর প্রশ্ন শুনে মনে মনে হাসে তারানা। উত্তর দেয়,
-আচ্ছা তুমি পরীক্ষার সময় থাকতে পরীক্ষাহলে তোমার জানা প্রশ্নের এক নম্বর, নাহ… এক নম্বর বেশি হয়ে যাচ্ছে, তোমার জানা প্রশ্নের অর্ধেক নম্বরও ছেড়ে দিয়ে আসো?
-মানে?
ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে চারু।
-আরে বলোই না?
-অবশ্যই না, কোনো পাগলেই এটা করবে না।
-ঠিক বলেছ, পৃথিবীটাও একটা পরীক্ষাক্ষেত্র, আর এর ফলাফল দুনিয়ার যেকোনো কিছুর তুলনায় শত সহস্রগুণ মূল্যবান। তোমার হাতে সময় আছে, তুমি জানো তোমাকে কি করতে এবং তুমি জানো তোমার কৃতকর্মের ফলাফল কি হতে পারে। তখন তুমি তো হাফ নম্বরও ছেড়ে দিতে চাইবে না।
আর এভাবেই পর্দা করছ কিন্তু পরিপূর্ণভাবে পর্দা করছ না, তাহলে কি দাঁড়ালো তুমি সময় থাকা সত্ত্বেও জেনে রাখা প্রশ্নের সিকিভাগ উত্তর দিয়ে বাকি গুলো ছেড়ে দিচ্ছ।
-হুউউউউউউউ বুঝলাম!
-আরেকটা কথা তুমি জানতে চাইছিলে না যে শাড়ি, সালোয়ার-কামিজে পর্দা হয় কিনা… আমি বলব না যে এসব পোশাকে পর্দা হয়না। কিন্তু ওই যে বললাম পরিপূর্ণ পর্দার একটা বিষয় আছে। তুমি শাড়ি বা যেকোনো পোশাক পরো না তাতে তোমার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আকর্ষণীয় ভাবে দৃষ্টিগোচর হবেই। এটা কিছুটা হলেও পর্দার সাথে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে।
এ ক্ষেত্রে তুমি যদি বোরখা বেছে নাও সেটা অন্য পোশাকের তুলনায় অনেক বেশি উত্তম হবে। যেমন ভাবে তুমি অবশ্যই তোমার পরীক্ষার হলে তোমার সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করবে, এটাও ঠিক তেমনি।
তবে তুমি যদি বোরখা ব্যতিত ওইরকম খুব ঢিলা পোশাক বেছে নিতে পারো যা পরলে পর্দার সাথে সংঘাত হবে না তা তুমি পরতে পারো।
তারানার কথা শেষ হতেই ক্লাসের ঘন্টা পড়ে যায়।
-তারানা থাকো আমার ক্লাস আছে এখন। তোমার কাছ থেকে আরো জানার ইচ্ছে করছে। ক্লাস শেষ করে আসি।
-আপাতত আল্লাহ হাফেজ।
মুচকি হেসে চারু আল্লাহ হাফেজ বলে ক্লাস নেওয়ার উদ্দেশ্যে যায়।
চারুর সম্পর্কে আপন মনে ভাবতে থাকে তারানা। চারু মেয়েটা অনেক চাপা, কি যেন বলতে গিয়েও থেমে গেল! চারু কি তবে ডিভোর্সি? হালকা হাসি ফুটে উঠল তারানার চোখেমুখে। পরক্ষণেই আবার নিজেই নিজেকে ধমক দেয়, সে না জেনেই অনুমান করছে কেন! যেকোনো বিষয়ে অনুমান করতে আল্লাহ কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন।
জোর করেই নিজের মনটাকে অন্য ভাবনায় সরিয়ে নেয় তারানা।
.
-নিধি তুই রোজ রাত করে বাড়ি ফিরবি আর আমি তোর বাবাকে ঢেকে ঢেকে পারবো না।
সালিহার কথা শুনে সরু চোখে তাকায় নিধি,
-ওয়েট, ওয়েট মা! তুমি কি ভেবেছ৷…চারু আপুর মতো আমাকেও শাসন করিয়ে বসিয়ে রাখবে? যদি তাই ভেবে থাকো তবে খুব ভুল ভাবছ!
আর আমি এমন কিছু করছিনা যাতে পৃথিবী অশুদ্ধ হয়ে যাবে। আর এটা ভাববে চারু আপুর মতো তোমার সব কথা আমি মিনমিন করে শুনবো… আর তাছাড়া তোমারই তো মেয়ে আমি!
এভাবে মাকে আরো কিছুটা কথা শুনিয়ে নিধি খাবার টেবিল থেকে উঠে যায়।
চারুর স্বভাবের একেবারেই বিপরীত নিধি। উড়নচণ্ডী মনোভাব আর অতিরিক্ত অন্যায় স্বাধীনতা নিধিকে তার সীমানা অতিক্রম করতে শিখিয়েছে অনেক আগে।
সালিহা বিরক্তিমাখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন নিধির চলে যাওয়ার দিকে। শান্তি খুঁজে পাননা আর কোথাও। রিহান বাড়িতে ফেরে রাত করে আবার বেরিয়ে যায় বেশ সকালে, অবশ্য সবদিন না। প্রশ্ন করলে কখনো কাজের অজুহাত দেয় কখনো চুপ করে থাকে।
কথা বলার মানুষ নেই। আগে অন্যায় দশকথা চারুকে শোনালেও চুপ করে থাকত,
নিধিকে ভাল কথা বললেও তেতে ওঠে একেবারে!
-ধুর!, বলে না খেয়েই উঠে যান সালিহা। ঘরে যাওয়ার সময় স্পষ্ট শুনতে পান নিধির হাসি আর ফিসফিস কথা, কিন্তু এই মূহুর্তে আরেক দফা ঝগড়া করার আগ্রহ পাচ্ছেন না তিনি। তবুও দরজায় একবার নক করেন,
-নিধি ঘুমাসনি?
জিজ্ঞাসা করতেই ভিতর থেকে চুপ হয়ে যায় নিধি। সালিহা চুপচাপ হেঁটে ক্লান্ত শরীরটাকে এলিয়ে দেন বিছানায়।
কথায় আছে, অপরের জন্য কুয়া কাটলে নিজেকেই সেই কুয়ায় পড়তে হয়। চারুকে শাসন করতে গিয়ে, চারুর খারাপ চাইতে গিয়ে নিজের মেয়েকেই প্রশ্রয় দিয়েছেন মাত্রাতিরিক্ত। এখন নিজের কাটা কুয়াতে নিজেই ডুবতে বসেছেন সালিহা।
.
-বাবা মেরো না, মেরো না!
আতিফ কোনো কথা না শুনে গাড়ি ড্রাইভ করেই যাচ্ছে, গাড়ি বাচ্চা মেয়েটিকে মরণ ধাক্কা দিতেই…
-আহ! জোরে চিৎকার করে ঘুম ভাঙে আতিফের।
তিন্নির মুখে নিজেদের বাচ্চা মেয়ে নিয়ে শোনার পর থেকেই প্রায়ই এই ধরনের স্বপ্ন দেখে আতিফ, কখনো বাচ্চাটিকে ছুরি নিয়ে মারছে, কখনো উঁচু বিল্ডিং থেকে ধাক্কা দিচ্ছে একেক সময় একেকভাবে একই স্বপ্ন দেখছে।
একবার ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর আর ঘুমাতে পারে না আতিফ, চোখ বন্ধ করলেই বাচ্চাটির আত্মচিৎকার শুনতে থাকে আর অস্পষ্ট একটা চেহারা ভাসতে থাকে। আস্তে আস্তে ইনসমনিয়া হয়ে যাচ্ছে ওর।
-হায় আল্লাহ, এ কি হলো আমার!
দু’হাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কাঁদতে থাকে আতিফ।
তিন্নিরও ঠিক একই অবস্থা। তবে একটু ভিন্ন… শেষের দিকে তিন্নি কুমকুমকে একেবারেই কাছছাড়া করতে চাইত না।
যাওয়ার দিন কুমকুমকে নিয়ে কান্না শুরু করে দেয় তিন্নি।
তুর্য, রাইয়্যানাসহ তিন্নির বাবা মা ভেবেছিল হয়তো এমনিই খারাপ লাগছে ভাইয়ের মেয়ের জন্য।
কিন্তু তিন্নি যখন কুমকুমকে কিছুতেই যেতে দিতে রাজি হচ্ছিল না আর ওকে চেপে ধরে চিৎকার করে কান্না শুরু করে তখন সবাই অবাক হয়ে যায়!
ভয় পেয়ে কুমকুমও কান্না শুরু করে। ফ্লাইটের সময় এসে যাওয়ায় শেষে একপ্রকার ধস্তাধস্তিই শুরু হয়ে যায় কুমকুমকে নিয়ে।
তিন্নির বাবা কুমকুমকে নিয়ে তুর্য আর রাইয়্যানার কাছে দিয়ে দ্রুত ওদের পাঠিয়ে দেন। ভালভাবে বিদায় নেওয়া হয়না ওদের।
এদিকে তিন্নির একই আর্তনাদ,
-আমার মেয়েকে দিয়ে যা! ভাইয়া দিয়ে যা!
টিনা কিছুতেই বুঝতে পারছেন না তিন্নির এই উদ্ভট পাগলামির মানে কি! তিন্নি দৌড়ে আবার দরজার দিকে এগিয়ে যেতে চাইলে না পেরে কয়েকটা চড় মারেন তিন্নির মুখে।
-কি শুরু করেছিস তুই!
মায়ের দিকে তাকিয়ে তিন্নি আচমকায় খাটে বসে পড়ে ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলে। টিনা বুঝতে পারলেন তিন্নি কিছুই বলার বা বোঝার অবস্থায় নেই এখন। মেয়ের দু’বাহু ধরে শুইয়ে দেন তিনি। কিছুক্ষণের মাঝেই তিন্নি ঘুমিয়ে পড়লে চিন্তিত মনে নিজের ঘরের দিকে যান টিনা।
(চলবে)
(নেক্সট/ন/N/F বাদে গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি। কেউ যখন প্রশ্ন করে মন্তব্যের জন্যই কি লিখো? তখন আমার উত্তরটা এমন, “আমি লিখি নিজের ভাল লাগার জন্য। কিন্তু যখন আমি সেটা অন্যদের সাথে শেয়ার করব(পোস্ট করার মাধ্যমে) আমি অবশ্যই অন্যদের মতামত জানতে চাইব”
আফসোসের বিষয় দুইতিন ঘন্টা সময় দিয়ে এক একটা পর্ব লিখেও আপনাদের মন্তব্যটা খুব চেয়েচিন্তে জেনে নিতে হয়। আমি ভাল বলতে বলছি না শুধু অনুভূতি বা ভুল-ত্রুটি বা ঠিকঠাক লিখছিনা বা গল্প নিয়ে আপনার মতামত। কিন্তু খেয়াল করলাম এটাতেই সবার কৃপণতা! এটা আমার অভিযোগ আর চরম দুঃখের বিষয়ও বটে। কিছু বলার নেই! -নাঈমা বিনতে আয়েশা)