#মালিনী পর্ব ৬+৭

0
538

#মালিনী পর্ব ৬+৭
.
.
কিছুক্ষণ পরেই নেয়ামত উল্লাহর সাথে জিহান বাসায় ফিরলো। ড্রেস না খুলেই খেলায় মেতে গেছে। জেরিন বাসায় না থাকায় যেন একেবারে স্বাধীন হয়ে গেছে! মালিনী তাকে ডেকে ড্রেস খুলে দিলো। ফাহিমা জিহানের জামাকাপড় নিয়ে এলো। গোসল করার কথা বললে সে বললো গোসল করবে না! মলি তাকে বুঝিয়ে খেলার ছলে গোসল করিয়ে দিলো। ফাহিমা খাবার নিলো খায়িয়ে দেওয়ার জন্য। জিহান বললো মলির হাতে খাবে। মলিই তাকে খায়িয়ে দিলো। ফাহিমা গোসল করতে চলে গেলো, এদিকে মলি সোফায় বসে নকশিকাঁথা সেলাই করছে আর জিহানকে গল্প শুনাচ্ছে। জিহান মলির কোলে মাথা রেখে শুয়ে গল্প শুনছে। জিহানের কোনো জিজ্ঞাসা, সারা শব্দ না পেয়ে মলি তাকিয়ে দেখলো জিহান ঘুমিয়ে পড়েছে! কোলে ঘুমিয়ে গেছে এখন কি করবে সে! কারো রুমেও দিয়ে আসতে পারছে না, সোফায় শুয়িয়ে দেওয়ার চিন্তা করতেই আবার ভাবলো এখন নাড়া পরলে ঘুম ভেঙে যাবে! তাই আর নাড়াচাড়া করলো না। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ঘুমন্ত জিহানের মুখে তাকিয়ে রইলো। খুব সুন্দর লাগছে জিহানকে দেখতে। ঘুমের মধ্যেও মুখে হাসি লেগে আছে। মাথা নিচু করে মলি জিহানের মাথার এক কোনে চুমু একে দিলো। ঘাড় বাকা হয়ে আছে বিধায় সোজা করতে গেলো হঠাৎই তার মাথায় ধাক্কা লাগলো। মলি নিজের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে দেখলো ফরহাদ এখানে! জিহানকে কোলে নিতে এসেছিলো আর মলির মাথায় তার মাথা ধাক্কা লেগেছে। মলি দেখলো তার চোখে তাকিয়ে আছে ফরহাদ! মলি দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো, কেননা চোখে চোখ রাখা দায়! কোনো পুরুষ মানুষের দিকে তেমন তাকাতেও পারে না সে। কিন্তু ফরহাদের দিকে তাকিয়ে ছিলো দুএকবার!
কিন্তু মাথায় যে অন্যকিছু ঘুরপাক খাচ্ছে! একবার ঠুসি লাগলে নাকি শিং গজায় মাথায়! যদিও জানে এটা মিথ্যে কথা তবুও সবসময় একবার ঠুসি লাগলে দ্বিতীয়বার দিয়ে এসেছে। তাই এখন আরেকবার না দেওয়া পর্যন্ত মনে শান্তি হচ্ছে না! ফরহাদ খুব সাবধানে জিহানকে মলির কোল থেকে উঠাচ্ছিল, মলি এতো না ভেবে ফরহাদের মাথায় আরেকবার ঠুসে দিলো! ফরহাদের দিকে তাকাতেই দেখলো ফরহাদ চোখ কুচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে! মলি দ্রুত চোখ বন্ধ করে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো! আর মনে মনে হাজার সুরা পড়তে লাগলো! হঠাৎ তার কপালে আলতো স্পর্শ অনুভব করতে পারলো! সাথে সাথেই তার চেহারার কুচকানো ও ভয়ার্ত ভাব দূর হয়ে গেলো! এটা কেমন স্পর্শ ছিলো বুঝতে পারছে না! চোখ খুলে দেখলো ফরহাদ জিহানকে নিয়ে চলে যাচ্ছে। জিহানের হাত ঝুলছে। স্পর্শটা কোমল ছিলো। জিহানের হাত লেগেছে হয়তো তার কপালে! পিচ্চিটার দৈহিক সৌন্দর্য, কথাবার্তা, আচারআচরণ সব ভালো লাগে মলির কাছে। ভাইয়ের ছেলে হৃদয়কে যতটা আপন ভাবে, জিহানকেও ঠিক ততটাই আপন ভাবতে শুরু করে দিয়েছে মলি। এ বাড়িতে দুজন মানুষ তার খুব প্রিয়, এক ফাহিমা আর এক জিহান!
মলি কাথা সেলাই করছে। ফাহিমা নামাজ পড়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,
– জিহান কোথায় মলি?
– আন্টি, ঘুমিয়ে পড়েছে। ছোট সাহেব এসে উনার রুমের দিকে নিয়ে গেছে।
ফাহিমা ফোন কানে দিয়ে বললো,
“জিহান ঘুমাচ্ছে ফরহাদের সাথে। আল্লাহ হাফেজ।”
মলি বুঝতে পারলো জেরিন ফোন করেছে হয়তো! জিহানকে রুমে রেখে ফরহাদ নিচে এলো। ফাহিমা প্লেটে খাবার নিয়ে মলিকে বললো ,
– মলি, একটু প্লেটটা রেখে আয় তো। আমি বাটি নিয়ে আসছি।
– আচ্ছা।

[100%গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি,আমাদের পেজের সবগুলো গল্প আপনার ভালো লাগবে।প্লিজ লাইক & ফলো দিস পেইজ। https://www.facebook.com/SeraGolpo500/]

টেবিলে থেকে ফরহাদ শুনতে পেয়ে বললো,
– মা, খাবারের প্লেট যেনো পরিষ্কার হাতে ধরে।
মলি কয়েক কদম এগিয়ে এসেছিলো। ফরহাদের কথা শুনে প্লেট নিয়ে আবার ফিরে এসে ফাহিমাকে বললো,
– আন্টি, মাফ করবেন। প্লেট আপনি নিয়ে যান প্লিজ। অন্য কোন কাজ থাকলে বলুন, আমি করে দেবো। ফাহিমা প্লেট নিয়ে টেবিলে এসে বললো,
– এসব কি ধরনের কথাবার্তা ফরহাদ! মানুষকে সরাসরি এভাবে কষ্ট দেওয়ার কোনো মানেই হয়না!
– মা আমি কাউকে কষ্ট দেইনি! সিম্পল একটা কথা বললাম, এতে এতো রিয়েক্ট করার কি আছে! পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ইমানের অঙ্গ সেটা কি তোমার অজানা! পরিষ্কার হাতে প্লেট ধরতে বলেছি এটাই কি আমার অপরাধ হয়ে গেলো!
– ওর হাত পরিষ্কার না অপরিষ্কার সেটা তুই জানলি কিভাবে?
– জানিনা বলেই তো আগে থেকে সাবধান করে দিয়েছি।
তারা মা ছেলে কথা বলছে আর এদিকে মলি তাদের পাশ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেছে।
– মেয়েটা কিন্তু এমন আচরণে কষ্ট পেয়েছে, ফরহাদ।
– আশ্চর্য! আমি তো কাউকে কষ্ট দেওয়ার জন্য কিছু বলিনি! এমন সিম্পল কথায় কষ্ট পেলে আমার কি করার!
ফাহিমা ছেলের কথায় আর কথা বাড়ালো না। ফরহাদের খাওয়া শেষ হতেই সে বাইরে এলো। দেখলো, মলি দোলনায় বসে দুলছে আর বাগানের দিকে তাকিয়ে আছে। ফাহিমা কাছে এসে বললো,
– মলি, চল ভাত খাবি।
– না, আন্টি। আমি রুটি কলা এনে খায়েছি দোকান থেকে।
– রাগ করেছিস না, ফরহাদের কথায়?
মলি হেসে বললো,
– কি বলেন আন্টি! রাগ কেন করবো! আমি মোটেও রাগ করিনি। আর ছোট সাহেব তো ঠিক কথাই বলেছেন। এখানে রাগ করার মতো কিছুই নেই!
– তাহলে, চল আমার সাথে খাবি।
– আন্টি আমি এই মাত্র রুটি কলা এনে খেয়েছি।
পাশ থেকে কলার খোসা নিয়ে আবার বললো,
– আন্টি, এই যে দেখুন।
– তুই রুটি কলা কেন খেতে গেলি! আমি ভাত রান্না করেছি তোর জন্য! তোর সাথে খাওয়ার জন্য আমিও বসে আছি!
– আন্টি, ভাত খাওয়ার জন্য তেমন জায়গা ছিলো না পেটে। পায়েস খেয়েই পেট ভরে গেছে। কলা খেতে ইচ্ছে করছিলো তাই এনে খেয়েছি। আপনি খেয়ে নিন প্লিজ। আপনাকে তো আবার ওষুধ খেতে হবে।
ফাহিমা মলিকে সাথে নিয়ে ঘরে এলো। মলি কাথা সেলাই করছে আর ফাহিমা তার সাথে গল্প করতে করতে খাচ্ছে।
বিকেলে পানি দেওয়ার জন্য বাগানে এলো মলি সাথে জিহানও এসেছে। জেরিনের অনুপস্থিতিতে সারাদিন মলির সাথে ঘুরে ফিরে খেলা করে কাটালো জিহান। ফাহিমার মতো জিহানেরও ভালো লাগে মলির সাথে সময় কাটাতে। মেয়েটার মাঝে কেমন যেন মায়া কাজ করে যদিও সেটা সবার চোখে পড়ে না। জিহানকে নিয়ে প্রথমে সবগুলো ফুল ছুয়ে দিলো মলি। ফুলের সাথে কথা বলে কিছুক্ষণ খেলা করলো দুজনেই। মলির চোখ বারবার ফরহাদের বারান্দার দিকেই যাচ্ছে! ফরহাদ যেন তাকে বাগানে অযথা সময় নষ্ট করতে না দেখে সেই ভয়ে সে সাবধান!
ফুলের সাথে খেলা শেষ করে মলি জিহানকে দোলনায় বসাতে গেলো। সেখানে দেখলো, পাকা কলার বড় এক ফানা রাখা আছে! এখানে কলা রাখলো কে! দু’একটা দেখা যাচ্ছে পাখি না হয় কাক নষ্ট করে ফেলেছে! এমন খোলা আকাশের নিচে কলা ফেলে রাখে কেউ! জিহান তাকে প্রশ্ন করলো,
– আন্টি, এখান কলা রেখেছে কে?
– জানি না তো বাবা! দাড়োয়ান ভাই রেখেছে হয়তো। চলো জিজ্ঞেস করে আসি।
মলি দাড়োয়ানের কাছে এসে বললো,
– জহির ভাই। দোলনার উপর কি আপনি কলা রেখেছেন?
– না।
– তাহলে কলা রাখলো কে! পাখি ঠোকর দিয়ে দুইটা নষ্টও করে ফেলেছে দেখা যাচ্ছে।
– ছোড ভাইজান দেখছিলাম একটু আগে কলা লইয়া ঢুকছে বাড়িতে। তাইলে উনিই ভুলে রাখছে হয়তো।
– ওহ্, আচ্ছা।
মলি পানি দেওয়া শেষ করে জিহানকে নিয়ে ভেতরে এলো। জিহানের হাতেই কলার ফানা। বাড়িতে ঢুকতেই দেখলো ফরহাদ পরিপাটি ভাবে সেজেগুজে কোথাও যাওয়ার জন্য ফাহিমার কাছে বিদায় নিচ্ছে। তাদের দেখে ফাহিমা ও ফরহাদ একবার কলার দিকে তাকাচ্ছে আবার মলি আর জিহানের দিকে তাকাচ্ছে। কলা নিয়ে জিহান এগিয়ে এসে বললো,
– চাচ্চু, তুমি কলা কিনে এনেছো?
– হ্যাঁ।
– দোলনায় রেখে এসেছো কেন! দেখো তো, পাখি দুইটা কলা নষ্ট করে ফেলেছে!
– ওহ, ভুলে রেখে এসেছিলাম! পাখির ইচ্ছে হয়েছে কলা খেতে তাই খেয়েছে। আরও যার ইচ্ছে হবে সে খাবে! বলা তো যায় না কার কখন ইচ্ছে হয়ে যায়!
ফরহাদ মলির দিকেই তাকিয়েছে বিধায় মলির মাথায় হোচট খাচ্ছে ফরহাদ কি তাকেই বললো কথাগুলো! ফরহাদ ফাহিমাকে বললো,
– মা, আমি আসছি।
– আচ্ছা, দ্রুত ফিরিস।
জিহান বলে উঠলো,
– চাচ্চু তুমি কোথায় যাও?
– ফ্রেন্ডদের সাথে একটু দেখা করতে।
– আমিও যাবো তোমার সাথে।
– তুমি গিয়ে কি করবে। তাছাড়া একটু পরেই আমি ফিরে আসবো। তুমি বাসায়ই থাকো।
– না, আমিও তোমার সাথে যাবো।
– ওকে, জুতা চেঞ্জ করে এসো।
জিহান দৌড়ে চলে গেলো। জুতা পড়ে আবার দৌড়ে এলো। বের হতে যাবে এমন সময় জেরিন আর জেনিফা বাসায় ফিরলো। জেনিফা বললো,
– কোথায় যাচ্ছো, ফরহাদ?
ফরহাদ কিছু বলার আগেই জিহান বললো,
– আমি আর চাচ্চু ঘুরতে যাচ্ছি আন্টি।
– তাই নাকি! আমিও যাবো তোমাদের সাথে। নিবে আমাকে?
উত্তরের আশায় জিহান ফরহাদের দিকে তাকালো। জেনিফা আবার ফরহাদকে বললো,
– ফরহাদ, আসবো তোমাদের সাথে?
– এই মাত্রই না বাইরে থেকে এলে!
– তোমার সাথে তো আর যাইনি!
– ওকে, চলো।(https://www.facebook.com/profile.php?id=100058759920318)
জেনিফা খুশি হয়ে ফরহাদের সাথে আবার বেরিয়ে গেলো। তার পরপরই মলি ফাহিমার কাছে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলো। ফাহিমা আগেই পায়েস রেখে দিয়েছে বক্সে। যাওয়ার সময় মলির হাতে সেটা তুলে দিলো। ঘর থেকে বের হতেই দেখলো, জিহান ফরহাদের হাত ধরে লাফাতে লাফাতে হাটছে আর জেনিফা পাশাপাশি হাটছে। পুরো একটা পরিবার মনে হচ্ছে তাদের। পেছনে হাটতে হাটতে মলি এই পরিবারের দৃশ্য দেখছে। গেইটের বাইরে বেরিয়ে তারা একদিকে চলে গেলো আর মলি অন্যদিকে হাটতে লাগলো। বাসায় ফেরার পথে হৃদয়ের জন্য কিছু চকলেট কিনে নিলো মলি।
সন্ধ্যায় অসুস্থ বাবাকে খাওয়ানোর জন্য এলো মলি। মা পাশেই বসে কাথার মুড়ি ভেঙে দিচ্ছে। খেতে খেতে তার বাবা বললো,
– ভার্সিটিতে ভর্তি হবি নারে মা?
– না, বাবা।
– কেন?
হঠাৎ করেই তার মায়ের উক্তি,
– কেন আবার! জানেন না! অনেক পড়ছে, আর পড়ন লাগতো না! গরিবের ঘরে জন্ম নিছে কাম কইরা খাওয়ার লাইগা, পড়াশোনার লাইগা না! এতো ভার্সিটি ফার্সিটি লাগতো না। পোলাপাইন দুইডা আমার অভাবের সংসার টানতে টানতে এই বয়সেই জীবন তেজপাতা কইরা দিছে! সারাদিন কামে লাইগা থাকে! তাও পোষাইতে পারে না! একটার পরে একটা মরার উপর খাড়া লাইগাই থাকে!
প্রথমে গলায় তেজ থাকলেও শেষ মুহূর্তে সেটা কান্নাজড়িত হয়ে গেছে! এখনই হয়তো হুহু করে কান্না শুরু করে দিবে, তাই তার আগেই মলি থামিয়ে দিলো,
– মা চুপ করো তো তুমি! বাবার ভাষা আর তোমার ভাষায় কতটা তফাত আছে তুমি জানো! এতো বছরেও বাবার কাছে ঠিকমতো কথা বলাটা শিখতে পারলে না!
মলির মা আর কিছু বললো না। আঁচলে চোখ মুছে নিজের কাজ করতে লাগলো। মলি বাবাকে খায়িয়ে দিয়ে ওষুধ খাওয়ালো। হৃদয়কে সাথে নিয়ে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো মলি।




“মালিনী”
পর্ব- ৭
(নূর নাফিসা)
.
.
সকালে মলি কাজে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হওয়ার সময় দরজায় আটকে তার জামা ছিড়ে গেলো! ” ওফ্ফ! কোনো কাজে গেলেই একটা না একটা বাধা এসে পড়ে! কাপাল থেকে কি এই বাধা নামক জিনিসটা মুছবে না কখনো!” বিরক্তি নিয়ে মলি ঘরে এসে জামাটা চেঞ্জ করে নতুন জামা পড়ে নিলো।
এ বাড়িতে আসতেই দেখলো জিহান ফারদিনের সাথে বের হচ্ছে স্কুলের জন্য। মলিকে দেখে জিহান দৌড়ে এলো তার কাছে। ফারদিন বললো,
– কোথায় যাচ্ছো জিহান? স্কুলের লেট হয়ে যাচ্ছে!
– আসছি আব্বু।
জিহান মলির কাছে এসে মলিকে নিচু হতে বললো। মলি তার কথামতো নিচু হতেই কানে কানে ফিসফিস করে বললো,
– আন্টি, আজকে কি আবার পিঠা এনেছো তুমি?
মলি অবাক হয়ে তাকালো তার দিকে। জিহান আবার বললো,
– কাল দাদু একটু দিয়েছিলো আমাকে, অনেক মজা তোমাদের পিঠা!
মলির চোখ ছলছল করছে! জিহানের কপালে চুমু দিয়ে বললো,
– আজ তো আমি আনিনি, বাবা। তাছাড়া তোমার আব্বু আম্মু তো খেতে দেখলে বকা দিবে তোমাকে!
– আবার আনলে তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে দিবে। তাহলে আর দেখবে না! হুম? স্কুলে যাবো, গুড বাই।
মলি হেসে বিদায় দিলো। জিহান দৌড়ে গিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লো। বাচ্চাটা অজান্তেই তার মনে জায়গা করে নিয়েছে। এতো মায়াবী মানুষ সবাই হয়না কেন! পৃথিবী খুবই বৈচিত্রময়! কারো দোষগুনের সাথে কারো মিল রাখেনি সৃষ্টিকর্তা! চোখের পানি মুছে আজ বাগানের দিকেই আগে গেলো মলি। ব্যাগটা দোলনায় রেখে বাগানের ধারে আসতেই দেখলো বাগানের মাটি ভেজা! আজও পানি দিয়ে দিয়েছে! তাহলে আর তার আসার কি দরকার ছিলো! ভেতরে না গিয়ে সামনে থাকা সাদা গোলাপ গাছের বড় গোলাপটা স্পর্শ করে গন্ধ শুকলো!
“খুব মিষ্টি সুবাস তাহার,
মিটবে না কভু তৃপ্তি!
সাদামাটা রূপে তাহার,
বাগান করেছে দীপ্তি!”
মলি হেসে গোলাপের চারদিকে থাকা ছোট গোলাপ এবং কলি গুলো স্পর্শ করলো। তারপর বাড়িতে প্রবেশ করলো মলি। ফাহিমা সোফায় বসে তসবিহ পড়ছে। পাশে বসে ছিলো জেনিফা ও জেরিন। ফাহিমাকে সালাম দিয়ে মলি সোফার অন্যদিকে বসতেই জেনিফা বললো,
– মালিনী, বড়দের সম্মান দিতে শেখা হয়নি তোর? সবার সাথে বসে পড়লি এভাবে!
– সরি মেডাম।
মলি সাথে সাথে সোফা থেকে নেমে ফ্লোরে বসে পড়লো। ফাহিমা বললো,
– জেনিফা, তুমিও দেখছি বড়দের সম্মান দিতে জানো না! এখানে তোমার চেয়েও বড় মানুষ আছে সেটা কি তোমার খেয়াল নেই!
– আন্টি, পরিবারের সদস্য তো একসাথে বসতেই পারে। তাই না! তার সাথে বাইরের লোকের কি সম্পর্ক!
– তুমি কিন্তু এখনো এই পরিবারের সদস্য না জেনিফা! সুতরাং তুমি যেমন বাড়ির মেহমান মলিও তেমন এ বাড়ির মেহমান।
– আন্টি মালিনী তো কাজ করতে এসেছে, আর আমি তো বেড়াতে এসেছি!
– মলি কিন্তু তোমার উপর কোনো কথা বলেনি, কিন্তু তুমি আমার সাথে তর্ক করছো! এতে কি প্রমাণিত হলো জানো? সম্মান জিনিসটা মলি তোমার চেয়েও বেশি জানে!
– সরি আন্টি!
জেনিফা উঠে চলে গেলো। জেরিন ও উঠে চলে যেতে যেতে বললো,
– মা, এই মালিনী আসার পর থেকেই আপনার আচরণ খুব ভিন্ন দেখছি! আপনি আমাদের কোনো প্রধান্য দিচ্ছেন না, উল্টো মালিনীর পক্ষে যুক্তি খাটাচ্ছেন।
– আমি কারো পক্ষে যুক্তি খাটাচ্ছি না জেরিন। সত্যটা স্বীকার করতে শেখো।
– হ্যাঁ, এতো পড়াশোনা করে আজও মুর্খই রয়ে গেছি আমি! আরও কতো কিছু শিখতে হয় কে জানে!
জেরিন রেগে চলে গেলো। ফাহিমা মলিকে বললো সোফায় উঠে বসতে। মলি বললো,
– না আন্টি, নিচেই ঠিক আছি আমি। এখানে বসে কাথা সেলাই করতে বেশি সুবিধা হবে।
– তুই তো দেখছি সত্যিই বড়দের কথা অমান্য করছিস!
মলি তারাতাড়ি সোফায় উঠে পড়লো। ফাহিমাকে বললো,
– আন্টি, জেরিন মেডাম কিন্তু রাগ করেছে খুব! আমার পক্ষে কথা না বললেই ভালো হতো আপনার। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বাইরের কাউকে নিয়ে ঝগড়া ঠিক না আন্টি। আমি জেনিফা মেডামের কথা বলছি না কিন্তু জেরিন মেডাম তো আপনার ছেলের বউ। বউ শ্বাশুড়ির মধ্যে মিল না থাকলে তো সংসার সুখী হয়না আন্টি! আর যাইহোক, আপনাদের মাঝে মিল থাকাটা জরুরী!
– সবাই তোর মতো ভাবে না রে মলি! নিজ স্বার্থে অটল। এ নিয়ে ভাবতে হবে না তোর। সব জায়গায়ই একটু রাগারাগি আছে, আমাদের মধ্যেও আছে। আবার খুব তাড়াতাড়িই মীমাংসা হয়ে যায়। তাছাড়া ফরহাদের বাবা বলেছিলো জেনিফার সাথে ফরহাদের বিয়ে দিবে। এখন তো আমি চাইলেও আমার সাথে ঝগড়া করবে না জেরিন! একটু পরেই দেখবি সব রাগ ফুরিয়ে গেছে।
– হ্যাঁ আন্টি, আংকেলের পছন্দ আছে বটে! জেনিফা মেডামকে কিন্তু ছোট সাহেবের সাথে মানাবে খুব! জেরিন মেডামকেও কিন্তু মানিয়েছে বড় সাহেবের সাথে! পারফেক্ট জুটি।
ফাহিমা দেখলো মাত্রই জেনিফা এসেছে। অর্থাৎ আগের কথাবার্তা না শুনলেও মলির বলা শেষ কথাগুলো শুনেছে সে। ফাহিমা নিজ স্থান হতে উঠে এসে মলির পাশে বসতে বসতে বললো,
– হুম। দেখি তোর কাথার ডিজাইনটা! আমারও খুব ইচ্ছে করে তোর মতো কাথা সেলাই করতে। ছোট বেলা চারুকারু পরীক্ষাতে রুমালে নকশা করে নিয়ে যেতাম স্কুলে! এখনো মন পড়ে দিন গুলো!
– হ্যাঁ আন্টি, ফেলে আসা স্মৃতি ভুলা যায় না সহজে! একটু আবাস পেলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে!
– হুম।
জেনিফা এসে বললো,
– আন্টি, বসবো?
– হুম। বসো।
– সরি আন্টি।
– কেন?
– আপনার কথার উপর কথা বলেছি। তাই!
– প্রয়োজনীয় জবাব দেয়া যায় কিন্তু অপ্রয়োজনীয় বা অতিরিক্ত কিছু বলা ঠিক না জেনিফা! তাছাড়া তোমাদের কোন বুঝ দিতে চাই না! কাউকে কিছু জানাতে গেলেই খারাপ হয়ে যাই। তার চেয়ে নিজের মতো করে চুপচাপ থাকি সেটাই ভালো।
– আন্টি, আপনি বড়। ভুল হলে শেখানোর অধিকার আছে আপনার। বড়দের থেকেই তো শিক্ষা গ্রহণ করবো আমরা।
– ছোটদের থেকেও অনেক শেখার আছে জেনিফা। জিহানের কাছেও আমি অনেক কিছু শিখেছি আবার দেখো মলির কাছেও নকশি কাথা শিখছি। সব গুন সবার কাছে থাকে না। কিন্তু আমাদের সমস্যা একটাই, আমরা অন্যের দোষ খুজে বেড়াই, কিন্তু তাদের গুনগুলো সহ্য করতে পারিনা!
– জ্বি আন্টি, ঠিক বলেছেন। মলি, দেখি তোর কাথাটা।
জেরিন এসে বললো,
– মা, দুপুরে নাকি অফিস থেকে কিছু লোক আসবে বাবা ও ফরহাদের সাথে। রান্নাবান্না কি করবো?
ফাহিমা উঠে যেতে যেতে বললো,
– কি আর করবে! ফ্রিজ থেকে মাছ, মাংস নামাও।
মলি অবাক হয়ে আছে! একটু আগেই দেখলো ছোট খাটো এক ঝগড়া হয়ে গেলো আবার এখনই দেখছে জেরিন একদম স্বাভাবিক! ফাহিমার কথার শতভাগ মিল পাচ্ছে মলি। ফাহিমা ও জেরিন কিচেনে চলে গেলো। জেনিফা বসে মলির কাথা দেখতে লাগলো। দুতিনমিনিট পরেই জেরিন ডাকলো মলিকে।
– জি ম্যাডাম?
– পেয়াজগুলো একটু কেটে দে তো। আমি রান্না বসাই।
– আচ্ছা।
ফাহিমা বললো,
– মলিকে কাটতে হবে না। পেয়াজ তুমি কাটো জেরিন। আমি রান্না বসাচ্ছি।
– আচ্ছা তাহলে।
– মলি, তুই বরং ফরহাদের রুমে কফির কাপটা রেখে আয়। তারপর তোর কাথার কাজ কর। যেটাতে তোর লাভ হবে।
– আচ্ছা আন্টি।
মলি কফি নিয়ে বের হয়ে দোতলায় যাচ্ছিলো। জেনিফা বললো,
– কোথায় যাচ্ছিস মালিনী?
– ছোট সাহেবের কফি।
– ফরহাদ গোসল করছে এখন।
– আন্টি বলেছে রুমে রেখে আসতে।
– আচ্ছা, যা।
ফরহাদ গোসল করছে শুনে মলি তারাতাড়ি সিরি দিয়ে উঠতে লাগলো। আর কারো অনুমতি না নিয়ে রুমে এসে তারাতাড়ি কফির কাপটা টেবিলে রাখলো। বাথরুমের দরজার দিকে তাকিয়ে বললো, “ছোট সাহেব, আপনার কফি রেখেছি টেবিলে।” তারাহুরো করে আবার বের হতে যাওয়ার সময় খেলো ধাক্কা! সামনে তাকিয়ে দেখলো ফরহাদ তার সামনে দাড়িয়ে! সে তো বাথরুমে না, তাহলে মলি আসার আগেই বেরিয়ে এসেছে সে! হাতে তোয়ালে, মাথার ভেজা চুল এলোমেলো, গায়ে নেই কোনো শার্ট বা টিশার্ট, পড়নে আছে শুধু প্যান্ট! দেহ যে ঠান্ডা সেটা ধাক্কা খেয়েই অনুভব করতে পেরেছে মলি। “সরি” বলে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই ফরহাদ ওপাশে চেপে তার পথ আটকালো! মলি বড় বড় চোখ করে তাকালো এবার তাকালো ফরহাদের মুখের দিকে। ফরহাদ মাথা মুছতে মুছতে বললো,
– অন্ধ?
মলি মাথা নেড়ে জবাব দিলো “না”!
– তাহলে ধাক্কা লাগলো কেন? ইচ্ছে করে না?
– ন..না, মানে আমি বাথরুমের দরজার দিকে তাকিয়ে হাটছিলাম!
– হোয়াট! বাথরুমের দরজায় কি! নাকি এটা দেখার ইচ্ছে হচ্ছিলো বাথরুমে কে কি করছে!
এসব কি ধরনের কথাবার্তা বলছে ফরহাদ! ছি! ভাবতেই কেমন লাগছে! মলি এর উত্তর কি দিবে ভেবে পাচ্ছে না! চুপচাপ চলে যেতে নিলে ফরহাদ আরও চেপে বললো,
– এখানে কেন এসেছো?
– টেবিলে আপনার কফি।
– কফি টেবিল খাবে?
– না, আপনি।
– তাহলে টেবিলকে দিলে কেন?
মলি ফরহাদের হাতে কাপ দেওয়ার জন্য পেছনে ফিরে এসে কফির কাপ নিলো। আবার ঘুরতে গেলেই দেখলো তার খুব কাছে দাড়িয়ে আছে ফরহাদ! আর আস্তে আস্তে অনেকটা উপুড় হয়ে যাচ্ছে তার দিকে! এমনিতেই পুরুষ মানুষের সাথে তেমন কথা বলে না তারউপর এতো কাছে কেউ দাড়িয়ে আছে এখন তো গলা দিয়ে তার কোনো কথাই বের হচ্ছে না! সে ধপাস করে খাটে বসে পড়লো! কাপ নড়ে কফি একটু পরেও গেছে! ফরহাদ যেন তার আরও কাছে চলে আসছে! এভাবে এগোচ্ছে কেন ফরহাদ! মলি চোখ খিচে বন্ধ করে মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো! হঠাৎ দুরত্ব অনুভব করতে পেরে চোখ খুলে তাকালো মলি। দেখলো ফরহাদ তার দিকে তাকিয়েই শার্টের বোতাম লাগাচ্ছে! এই শার্ট নিয়েছে তাহলে খাট থেকে!
এভাবে শার্ট নেওয়ার কোনো মানে হয়! সে সরে দাড়ালে কি নিতে পারতো না!
ফরহাদ শার্ট পড়তে পড়তেই বললো,
– আজ ড্রেস পরিষ্কার মনে হচ্ছে। কোনো প্রোগ্রামে দাওয়াত আছে নাকি আজ! নাকি বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান আছে?
মলি মুখ মলিন করে বললো,
– জামা ছিড়ে গেছে, তাই নতুন জামা পড়েছি।
– হুহ্! যা হয় সব ভালোর জন্যই হয়! এতোদিন পর ড্রেস চেঞ্জ হলো! চলাফেরারও কোনো ঠিক নেই! যার তার সাথে ধাক্কা খায়! কে জানে, হয়তো কাল আবার দেখবো ছেড়া জামা সেলাই করে পড়ে এসেছে!
এখন নিজের উপরই রাগ হচ্ছে! জামা ছেড়ার কথা তাকে কেন বলতে গেলো! মলি মুখ মলিন করে কাপ নিয়ে উঠে দাড়াতেই ফরহাদ হাত থেকে কাপ নিয়ে বললো,
– অর্ধেক কফি ফ্লোরকেই খায়িয়ে ছাড়লো! এসব অকর্মের ঢেকি দিয়ে কাজ করায় কেন মা!
মলি মনে মনে ফুসতে ফুসতে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। বাইরে পা ফেলতে পেরে যেন হাফ ছেড়ে বাচলো সে! ফরহাদ তো তার জানই নিয়ে নিচ্ছিলো মনে হচ্ছিলো! তাছাড়া কেমন করে যেন বলছিলো, দাওয়াত আর বয়ফ্রেন্ডের কথা! আশ্চর্য, মানুষ কি দু তিনদিনের জন্য জামা কিনে! সবাইকে কি নিজেদের মতো ধনী মনে করে তারা! তাদের মতো চলতে গেলে আর কপালে ভাত জুটবে না! এসবের জবাব দিতে হবে পরকালে! তখন দেখা যাবে অহংকার কোথায় থাকে!
মলি জেনিফার কাছে চলে এলো নকশিকাঁথা সেলাই করতে। জেনিফা নকশিকাঁথা নিয়ে দুচারটা কথা বললো মলির সাথে। তাছাড়া সেও নতুন জামা সম্পর্কে বললো। ওসব পুরাতন জামাকাপড় পড়ে যাতে বাইরে না বের হয় সেসব সম্পর্কে কিছু বললো। একটু স্মার্টভাবে চলাচলের পরামর্শ দিলো।
সবই শুনছে মলি, কিন্তু জেনিফা আজ এতো ভালো ব্যবহার করছে কেন তার সাথে সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here