#ফ্ল্যাট_নাম্বার_নয়_ছয়পর্বঃ৪+৫+৬

0
484

#ফ্ল্যাট_নাম্বার_নয়_ছয়পর্বঃ৪+৫+৬
#Lamyea_Chowdhury

তাসলিমা হেঁড়ে গলায় মালাকে ডাক দিয়ে বললেন, ‘মালা! চারটা বরফ কুঁচি এক গ্লাস পানিতে ছেড়ে দে।’

তারপর তাকালেন সামনে বসা থাকা শায়েরীর দিকে। শায়েরী হাসি হাসি মুখ করে বললো, ‘আসসালামু আলাইকুম মামানি।’

– ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছিস?

– এই তো মামানি ভালোই আছি।

– তা তো থাকবিই। ভালো থাকার জন্যেই তো ঢাকায় এসেছিস।

শায়েরী সূক্ষ্ম খোঁচাটা বুঝল না তাই এখনও হাসি হাসি মুখ করেই বসে আছে। তাসলিমা এদিক সেদিক তাকিয়ে আবার মালাকে ডাক দিয়ে বললো, ‘কোথায় গেলি! তোকে না বললাম ঠাণ্ডা পানি দিয়ে যেতে?’

– না খালাম্মা, আপনি তো কইলেন বরফ কুঁচি পানিতে ছেড়ে দিতে।

মালার কথা শুনে শায়েরী হেসে ফেলল।

– তোকে না বললাম শুদ্ধ ভাষায় কথা বলবি? প্রহরের উপর নাহয় ইফেক্ট পড়বে। এখন যা পানি নিয়ে আয়।

মালা চলে যেতেই তাসলিমা পায়ের উপর পা তুলে বসলেন। তারপর বললেন, ‘শায়েরী তুমি কি জানো আজকাল হেল্পিং হ্যান্ড এর কত অভাব? গার্মেন্টস হয়ে এখন আর বাসায় কাজ করার মতন মানুষ পাওয়া যায় না। কি যে কষ্ট হয়! এই তো মালা এসেছে বছর খানেক হলো।’

তাসলিমা তুমি করে বলতে শুরু করায় শায়েরী সতর্ক হয়ে বসলো, এর মানে মামানি এখন ইম্পর্টেন্ট কথা বলবেন। ততক্ষণে মালা পানি নিয়ে এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। তাসলিমা পানিটুকু এক-চুমুকে শেষ করে মালাকে ইশারায় সরে যেতে বললেন।। মালা চলে যেতেই তিনি আবার শুরু করলেন, ‘প্রহর যখন ক্লাস টেনে ছিল পাখির মা গ্রামে চলে গেল। আমার অবস্থা তখন নাজেহাল। অফিস, বিজনেস, প্রহরের পড়াশুনা কোচিং এসব সামলাতে সামালাতেই হিমশিম খেয়ে যেতাম। এরপর পাখির মায়ের কাজগুলোও আমাকে করতে হতো। সবদিক সামলে দিনে ২ ঘণ্টাও ঘুমুতে সময় পেতাম না। চোখের নীচে ডার্ক সার্কেল হয়ে বাজে দেখাতো খুব। প্রহর আমাকে ওর সাথে কোথাও নিতে চাইত না। ওর সব বান্ধবীদের সে বলে বেড়াত ওর মা নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মানুষ। আর সেই মায়ের চোখে ডার্ক সার্কেল দেখলে সবাই হাসাহাসি করবে তাই নিতে চাইত না। তোমার মামাও অবস্থা বেগতিক দেখে মালাকে দালাল ধরে বের করে নিয়ে আসল। বুঝতেই পারছ মালা আমার জন্য টু মাচ ইম্পরট্যান্ট, তোমার থেকেও বেশি।’

শায়েরী কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই তাসলিমা ওকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ডোন্ট সে সামথিং স্টুপিড শায়েরী। তোমার হাসা একদমই ঠিক হয়নি। মালা হয়তো বুঝেনি তাই বলে ওকে নিয়ে হাসাহাসি করার কিছুই নেই। আর তোমরা ওর মূল্যও বুঝবে না। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসে ভালো জায়গায় পড়াশুনা করলেই তুমি সোসাইটিতে স্পেশাল কেউ হয়ে যাবে না। তোমার মায়ের তো কাজের লোক নেই তাই এটার গুরুত্ব বুঝো না।’

শায়েরীর সব কথা গলায় কান্না হয়ে আটকে আছে। সে আর এক মুহূর্তও এখানে বসে থাকলে চোখের পানিতে বাঁধ দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। মুখ থেকে ‘আজ আসছি’ এই কথাটুকুও আসছে না। না পেরে চলে যাওয়ার জন্য চুপচাপ উঠে দাঁড়াল সে। তাসলিমা সাথে সাথে ধমকে উঠে বললেন, ‘আমার কথা শেষ হয়নি এখনও, চলে যাচ্ছ কেনো?’

শায়েরী আবারো ডিভানে বসলো। তাসলিমা উঠে দাঁড়িয়ে শায়েরীর কাঁধে হাত রেখে বললো, ‘শুনো শায়েরী! নক্ষত্র থেকে দূরে থাকবে। আমার ছেলেকে বশ করার কথা চিন্তায় আনার আগেও হাজারবার ভাববে। নক্ষত্র জাস্ট যায় না তোমার সাথে। কথাটা মাথায় রাখবে।’

শায়েরীর মাথায় টুকা দিয়ে তাসলিমা চলে গেলেন। শায়েরী তখনও নিঃশব্দে সেখানে বসে আছ। তাসলিমা দু’তালায় যেয়ে শায়েরীর মোবাইলে ফোন করলেন। শায়েরী ফোন রিসিভ করে কানের সাথে চেপে ধরে রইল কিন্তু কোনো কথা বলল না। তাসলিমাই বললো, ‘তুমি এখন যেতে পারো আমার কথা শেষ।’

শায়েরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। চোখের পানিও পড়ল কয়েক ফোঁটা। মাথা নিচু করে বাসা থেকে বেড়িয়ে এলো। রিকশার জন্য অপেক্ষা করছে সে। এক চুল হাঁটার শক্তিও আর অবশিষ্ট নেই এখন। সূর্যের তির্যক আলো এসে শায়েরীর চোখে মুখে পড়ছে। নাকটা ঘেমে আছে, কতক্ষণ পর পর হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে নাকের ঘাম মুছায় ব্যস্ত। নক্ষত্র এলো শায়েরীর পিছন পিছন। খালি গায়েই সে দৌড়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াল। তারপর ঝাঁঝাল কণ্ঠে বললো, ‘চোখে দেখো না তুমি? চোখ দুটো পার্সে রেখে শুধু দেহ নিয়ে চলো নাকি?’

শায়েরী কিছু বুঝল না। বুঝার চেষ্টাও করল না। সে জানে নক্ষত্র এখনই ওকে ভীষণরকমের কয়েকটা কথা শুনাবে। তাই সে নক্ষত্রের দিকে ফিরে তাকালো না। নক্ষত্র একটা কাঠের বাক্স দেখিয়ে বললো, ‘জানো এটা আমার কত পছন্দের? আমার কলেজের ক্যামিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট এর হ্যাড স্যার আমাকে এটা গিফট করেছিলেন, স্যার এখন আমেরিকায়। আর তুমি এটাকে নিজের দেহ দিয়ে ঠেলেঠুলে পা দিয়ে মারিয়ে চলে এলে? তার উপর জবাবও দিচ্ছ না, কতক্ষণ ধরে ডাকছিলাম। ঢাকা এসে বেশি বার বেড়েছে তাইনা? পাখা গজিয়েছে আরকি! আমার সাথে ভাব ধরো? মুরোদ আছে তোমার? হুম কি হলো কথা বলো না কেনো?’

শায়েরী শান্ত স্বরে বলল, ‘স্যরি আমি খেয়াল করিনি।’

– খেয়াল করনি মানে কি? সেন্টার টেবিলে রাখা ছিল এটা।

– বললামই তো ভাই দেখিনি।

– একদম ভাব ধরবে না, আমার সাথে ভাব ধরার মুরোদ নেই তোমার, মনে রাখবে কথাটা। ডেম কেয়ার ভাব দেখালে খবর হয়ে যাবে। ইচ্ছে করে আমার প্রিয় জিনিসটাকে ফেলে দিয়ে পা দিয়ে মাড়ানো তাই না?

শায়েরী ধরা গলায় বললো, ‘আমি সবকিছুই তো ইচ্ছে করে করি। তাই সরি বললাম। আপনি প্লিজ আর আমাকে জ্বালাবেন না। আমার সবকিছুতে আপনারা সবাই দোষ দেখেন। আমার আর কি করার আছে? আর ভাব ধরার যোগ্যতা যে আমার নেই মামানি আমাকে অনেক আগেই জানিয়ে দিয়েছেন। আপনি কোনো রাজপুত্র না যে আমি আপনাকে বশ করব আর আমিও কোনো বিশেষ কেউ না, না মিথ্যে অহংকারী যে ভাব ধরব। সমস্যা কি আপনাদের বলুন তো?’

শায়েরী আর দাঁড়ালো না। শায়েরীর মনে হচ্ছে ইশ্ পৃথিবীটা এত নিষ্ঠুর কেনো? ডেকে নিয়ে এসে এত অপমান! এত্ত অপমান! মাকে ফোন করে কিছু বললেও মাও তাকেই কথা শুনাবে। আসলেই এত জ্বালাময় কেনো সব? এত কষ্টের কেনো?
শায়েরী বিড়বিড় করে পড়ল,
” পুষ্পাশ্রম “।
সূক্ষ দৃষ্টিতে আশ্রমের ভিতরটা যতদূর পারল দেখলো সে। কি মনোরম, কি শান্তিময় ছাউনি। মনের অজান্তেই শায়েরী বারকয়েক বলল,
” এত স্নিগ্ধতা! এত স্নিগ্ধরুচি! সবকিছু এত শান্তিময় কেনো? ”
ভিতরে যাওয়ার ইচ্ছাটা আর দমিয়ে রাখতে পারল না, ধীর পায়ে ভিতরে গেল সে। সঙ্গে নিল খানিক দ্বিধা,খানিক ব্যাকুলতা আর অনেকটা আগ্রহ আর জানার তীব্র ইচ্ছা। ভিতরে আসার আগে মনে হয়েছিল এ হলো শান্তির বাগান আর এখন মনে হচ্ছে এটা সাক্ষাৎ নরক! হাবিয়ার আগুন এতে দাউদাউ করে জ্বলছে কেননা এটা বৃদ্ধাশ্রম। এই পুষ্পাশ্রম কোনো শান্তির বাগ নয়, এই আশ্রম কিছু অকৃতজ্ঞ, পাপী সন্তানদের নরক। আর জ্বালানী হলো অসহায়, বৃদ্ধ, মা – বাবাদের চোখের জল। এই চোখের জলগুলো একটাও বৃথা যাবে না, একটাও না! শায়েরীর মনটা এমনিতেই অনেক খারাপ ছিল। তাই মামার বাসা থেকে এলোমেলো পথে পা ফেলে হেঁটে চলছিল। পাশ দিয়ে দুই একটা রিকশা গিয়েছেও বোধহয় কিন্তু ঝাপসা চোখে শায়েরী সেটা দেখেইনি হয়তো। হঠাৎ করে আশ্রমটা চোখে পড়ায় বেশ লাগছিল তার কিন্তু মুহূর্তেই আবার মন খারাপ হয়ে গেল। একজন সন্তান কীভাবে পারে তার বাবা মাকে বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে যেতে? একটুও বুক কাঁপে না ওদের? মন ভালো করতে এসে উল্টো মন আরো খারাপ হয়ে গেল। ইশ্ মন হলো সাংঘাতিক এটম বম্ব! সবচেয়ে বাজে জিনিস! মন খারাপের কারণ থাকে না, থাকলেও তা বলা যায় না। আচ্ছা মনটাকে ফেলে দিলেই তো হয়। শায়েরী আনমনে বলল,
” আসলে মন বলে তো কিছু নেই, যা আছে তা হলো অনুভূতি। আর অনুভূতির চেয়ে জঘন্য, নৃশংস, নিষ্ঠুর আর কিছুই নেই। অনুভূতির হেরফের জীবনের তাশ উড়িয়ে নেয়। ”
শায়েরী এখানে আর এক মুহূর্তও থাকবে না, এক মুহূর্ত ও না। থাকলে ওর মন খারাপের পর যদি কিছু থেকে থাকে সেটা হয়ে যাবে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে শায়েরী আশ্রম থেকে বের হওয়ার জন্য গেইটের দিকে পা বাড়াল। সাথে সাথে গেইটের সামনে একটা বিএমডাব্লিউ আই এইট গাড়ি এসে থামলো। কালো রঙের স্পোর্টস কারটা দেখে শায়েরী বিস্মিত হয়ে চেয়ে রইল। তার ধারণা ছিল বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে এই মডেলের স্পোর্টস কার চালানোর অনুমোদন নেই। গাড়ি দেখে যতটা না বিস্মিত হলো তারচেয়ে বেশি বিস্মিত হলো গাড়ি থেকে দুরুককে নামতে দেখে। ব্লু জ্যাকেটের চেইনটা বুক পর্যন্ত টানা ছিল,চেইনটা খুলে ফেলল সে। তারপর পকেট থেকে সানগ্লাস বের করে চোখে দিয়ে গাড়ির ভিতর তাকিয়ে কি যেন ইশারা করল। তারপর জ্যাকেটের দুই পকেটে দুই হাত দিয়ে হাঁটা শুরু করল। গাড়ির ভিতর থেকে তিনটা ছেলে বেরিয়ে এলো দুরুকের পিছন পিছন। শায়েরী বিড়বিড় করে বলল,
” হায় আল্লাহ্‌ আমি মরে যাব! এখনই আমি মরে যাব। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাঃ। ”
শায়েরী যখন একাধারে বিড়বিড় করছে তখন দুরুক একজন লোককে ডেকে বলল,
” আমার নানীর সাথে দেখা করতে এসেছি। ”
” জ্বি এখনই ব্যবস্হা করছি। ”
লোকটা ঝড়ের মতন দৌড়ে গেল। শায়েরীর যেন হঠাৎ টনক নড়ল। শায়েরী দাঁতে দাঁত চেপে দুরুকের দিকে এগিয়ে গেল। দুরুক তখন ওর সাথে আসা বাকি তিনজনের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। শায়েরী দুরুকের সামনে যেয়ে দাঁড়াল, তারপর বলল,
” এক্সকিউজ মি! ”
দুরুক কথা বন্ধ করে শায়েরীর দিকে তাকালো। তারপর হাসি হাসি মুখ করেই বলল,
” ইয়েস মিস? ”
” আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিল। ”
দুরুক পকেট থেকে ডান হাতটা বের করে সানগ্লাস খুলতে নিতেই শায়েরী চিৎকার করে উঠল,
” না, না গ্লাস খুলবেন না, প্লিজ গ্লাস খুলবেন না। আমি কথা বলে চলে যাওয়ার পর আপনি যা খুশি তাই খুলুন। ”
মনে মনে বলল,
“এই ছেলে আমি তোমার চোখে ডুবে গেলে তুমি কি আমাকে টেনে তুলবে? আমি তো সাঁতার জানি না। এত কাছ থেকে তোমার চোখ দেখা মাত্রই আমি জ্ঞান হারাব, তোমার বুকে লুটিয়ে পড়ব। কিংবা তুমিই আমাকে আঁকড়ে ধরবে। কি বিচ্ছিরি কাণ্ড! তারচেয়ে বরং তুমি সানগ্লাসই পরে থাকো। ”
দুরুক অবাক হয়ে বলল,
” যা খুশি তাই খুলব? ”
শায়েরী শক্ত হয়ে বলল,
” শুনোন! পনেরো কোটি টাকার গাড়ি নিয়ে ঘুরতে পারেন আর নানীকে বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে রাখেন? একটুও বুক কাঁপে না, কষ্ট হয়না আপনাদের? আপনার মা – বাবা কি মানুষ? আর আপনিও বা কেমন? দয়া করে আপনার মা- বাবাকে নরকের আগুন থেকে মুক্তি দিন। আমার বাবা তিন বছর ধরে প্যারাইলাইজড্, বিছানায় পড়ে আছে। তাও তো আমরা ফেলে দিইনি, দিয়েছি কি? কিন্তু আপনারা যারা বড় লোক, সমাজপতি তারা হলে কবে নার্সিংহোমে ফেলে রাখতেন। সুস্হ স্বাভাবিক মানুষকেই তো আপনারা বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেন। আসলে আপনাদের মতন মানুষদের মায়ের কোলে, বাবার আদরে বড় হওয়ার কথা ছিল না,কথা ছিল অনাথ আশ্রমে বড় হওয়ার। কেননা যারা পরিবারের প্রবীণদের বৃদ্ধাশ্রমে নির্বাসিত করে তাঁদের স্হান অবশ্যই অনাথ আশ্রমেই হওয়া উচিত ছিল। তাই নয়কি?”
দুরুক তুরি বাজিয়ে বলল,
” ওয়েট! ওয়েট! ওয়েট! শুনোন মিস যাই হোন না কেনো। মধ্যবিত্ত ছেলেটা মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে চায় না বুঝি? আলবাত চায়, আরো বেশি করে চায়। কিন্তু পকেটে মাল নেই বলে পারে না। মধ্যবিত্ত ছেলেটারও তার বউয়ের সাথে বৃদ্ধ মা- বাবাকে নিয়ে প্রতিদিন ঝগড়া হয়। আর মেয়ের মা-বাবা হলে তো কপাল আরো বেশি খারাপ। সমস্যা ধনী,গরীব কিংবা ক্লাসে না, মানসিকতায়। এটা ডেভেলাপ করা জরুরি। আমার মতে উচ্চবিত্তদের মা- বাবা বৃদ্ধাশ্রমে পড়ে পড়ে কাঁদে তা ঠিক কিন্তু মধ্যবিত্তদের মা- বাবার মতন ঘরের ভেতর অপমানিত হতে হয় না, প্রতিদিন কথাও শুনতে হয় না। ”
একদমে কথাগুলো বলেই দুরুক শায়েরীর মাথায় গাট্টা মারতে গেল, শায়েরী দ্রুত সরে যেতেই দুরুক দুই হাত আত্মসমর্পণের মতন করে বলল,
” ওহোহো সরি, আর হবে না, বাই দা ওয়ে আমার নানী এই বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন না, তিনি বৃদ্ধাশ্রমে ডোনেশন দেন। ”
এর মাঝেই যে লোকটা দুরুকের নানীর কাছে দৌড়ে গিয়েছিল সে লোকটা এবার বিদ্যুৎগতিতে ফিরে এসে বলল,
” দুরুক বাবা! ফুলতরী মেডাম এর ৪টার পর মিটিং আছে, তাই এখনি দেখা করতে হবে পরে সময় পাবেন না। ”
দুরুক কথাটা শোনা মাত্রই দ্রুত পা চালাল আর শায়েরী নিজের কপালে হাত রেখে বলল,
” শায়েরী তোর জ্বর এসে গেল বুঝি, একটু পর তোর মৃত্যু! নিশ্চিত মৃত্যু! ”
তারপর নিজেই নিজেকে প্রবোধ দিল ধুর সামান্য জ্বর হলে কেউ মরে? মরতে হলো প্রেমে পড়তে হয়, প্রেমে পড়তে হয়!”
….
পর্বঃ৬
রাতে সত্যি সত্যি শায়েরীর জ্বর এলো। আদুরী সেবা করল কম বকল বেশি।
” কি দরকার ছিল এই রোদে এতটা পথ হেঁটে আসার?কেউ কোনো কথা শুনালেই ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদা অভ্যাস হয়ে গেছে,স্যান্ডেল নেই? স্যান্ডেল খুলে মুখের উপর ছুঁড়ে মারবি। তা না ইনি কথা গিলে আসেন। কিরে এখন কথা বলিস না কেন? মৌন এত ভালো রান্না করে তাও তোর খেয়ে সাধ মিটে না যে মানুষ বাড়ি নিয়ে অপমান করলেও সেই অপমান চুপচাপ হা করে খেয়ে আসিস? ”
মৌন বিরক্ত হয়ে বলল,
” এখন তো একটু চুপ কর। আর কত বলবি? ”
শায়েরী ম্লান হেসে বলল,
” আমি যে জ্ঞান দেই তাই এখন প্রতিশোধ নিচ্ছে। আহ্ কি অসহায় আমি! সবাই সুযোগসন্ধানী। ”
শায়েরীর কথা বলার ভঙ্গিটায় কি যেন ছিল, তিনজনই একসাথে হেসে ফেলল। সারারাত শায়েরী এক ফোঁটাও ঘুমায়নি আর ওদের দুজনকেও ঘুমোতে দেয়নি। রাত বাড়ার সাথে সাথে শায়েরীর জ্বরটাও বেড়েছে, মৌন অনেকটা সময় ধরে মাথায় পানি ঢালার পর যখন জ্বর একটু কমলো শায়েরী শোয়া থেকে উঠে বসে বলল,
” আমার ফোনটা দে। ”
মৌন বলল,
” এখন থাক না দোস্ত, সকালে কথা বলিস। এত রাতে কি কেউ জেগে আছে? ”
” যা বললাম তাই কর। ”
শায়েরী ফোন হাতে নক্ষত্রের নাম্বার ডায়াল করল। নক্ষত্র তখন জেগেই ছিল, বইয়ে মুখ গুঁজে পড়ছিল। সামনে পরীক্ষা, ডিপার্টমেন্টে ফার্স্ট হতে না পারলে মা নিশ্চিত বাথরুমে ফেলে পিটাবে তারপর বাড়ি থেকেও বের করে দিতে পারে। ইন্টারে বাংলায় প্লাস মিস হওয়ায় নক্ষত্র মায়ের মারের চোটে সরষে ফুল দেখেছিল। তারপর দৌড়ে বাথরুমের ছিটকিনি আটকে বাঁচতে চাওয়ায় মা আরো রেগে গিয়েছিল। বাথরুমে ফেলেই চড় থাপ্পর সব মেরেছে। সময় পাল্টেছে কিন্তু মা একটুও পাল্টায়নি, সামনে পাল্টাবে বলেও মনে হয় না। রেজাল্ট ভালো না হলে এবারো যে তাই করবে নক্ষত্র শিউর। রাত সাড়ে তিনটার দিকে শায়েরীর মোবাইল থেকে কল আসতে দেখে নক্ষত্র বেশ অবাক হলো। শায়েরীর সাথে মোবাইলে তেমন একটা কথা হয়না তার। সেও ফোন দেয় না আর শায়েরীও বিশেষ দরকার ছাড়া কখনোই ফোন করে না। অন্য যেকোনো সময় হলে কমপক্ষে দশ বারোবার কল করার পর সে কল রিসিভ করতো কিন্তু এত রাতে কল করেছে নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ কিছু।
” হ্যাালো! বলো কি হয়েছে। ”
” কি আর হবে? ”
তারপর কিছুটা সময় দুজনেই চুপ করে রইল। শায়েরীরই শুরু করল,
“নক্ষত্র ভাই তোমার মায়ের একটা ছেলে হয়েছে। পুরাই খেচর আর বেয়াদব ছেলেটা। ”
নক্ষত্র অবাক হয়ে কানের সাথে মোবাইল ধরে আছে । সে এতটাই অবাক হয়েছে যে কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। নিশ্চুপ হয়ে শায়েরীর কথা শুনে যাচ্ছে।
” তোমার মা কি মনে করে জানো? মনে করে উনার ছেলে রাজপুত্র। আসলে ঠিকই তো মনে করেন। এত বড় জাঁদরেল মহিলা তাঁর ধারণা কি ভুল হতে পারে? কখনোই পারে না। তুমি সত্যি সত্যি রাজপুত্র, মশারি রাজ্যের রাজপুত্র, খেচর একটা!আয়নায় একবার নিজেকে দেখো কেমন বিচ্ছিরি লাগে তোমায়। এই বলো তো আজ পর্যন্ত কোনো প্রপোজাল পেয়েছ? স্কুল,কলেজ, ভার্সিটির কত মেয়ের সাথে একসাথে উঠাবসা করেছ কিন্তু পেয়েছ? পাওনি আর পাবেও না। কেননা তুমি খেচর। শার্ট একটা পরো চৌদ্দ বছরের পুরোনো, এখান দিয়ে কুঁচকে থাকে, ওখানে দিয়ে উল্টে থাকে। এই যে তোমার জাতীয় পোশাক ক্যাপ। এই ক্যাপটাও তো উল্টা পরো। আসছে আমার রাজপুত্তুর! ”
শায়েরীর কথা কেমন জড়িয়ে যাচ্ছে। তাও শায়েরী বলে চলেছে,
” তুমি কতটা ভালো মানুষ আমার জানা আছে। ঐ যে গতবছর রিনা আপুর হলুদে শাড়ি পরলাম না? তখন তুমি যেয়ে তোমার প্রাণপ্রিয় ফুফুর কাছে বিচার দিলে। আমি নাকি কোমর দেখিয়ে শাড়ি পরেছি। চোখে বেশি দেখো তাইনা? আমার পিছনে লেগে থাকা শুধু? তোমার জন্য কতগুলো বকা খেয়েছিলাম জানো? তোমার কথা শুনে মা আমাকে বৌভাতে রিনা আপুর বরের বাড়ি যেতেই দেয়নি। সবাই তোমরা কত মজা করেছ আর আমি দরজা আটকে ঘরে বসে কেঁদেছি। আমি তো হিজাবই খুলি না আর মায়ের কাছে তুমি এত বড় মিথ্যে কথা বললে? মিথ্যাবাদী, অহংকারী ছেলে কোথাকার! ”
” তোমার শরীর খারাপ বোধহয়, কথা কেমন জড়িয়ে আসছে তুমি শুয়ে পড়ো এখন। আমি ফোন রাখছি। ”
” খবরদার ফোন রাখবে তো খবর করে ফেলব। সত্যি সত্যি
কোমর দেখিয়ে শাড়ি পরব। ”
নক্ষত্র ফোন রাখলো না।
শায়েরী বলল,
“তোমার ফুফু তো নিজের মেয়ের চেয়ে ভাইপোকে বেশি বিশ্বাস করে। কত বললাম আমি ওভাবে সেজেগুজে গেলে তো আম্মা দেখতেই পেতো কিন্তু আম্মার খালি এক কথা, আম্মা না দেখলে কি হয়েছে আম্মার গুণধর ভাইপো তো দেখেছে। জামদানী শাড়ি এরকমই তো হয়। তোমার ফুফু নিজেই তো আলমারি থেকে জামদানি বের করে পরতে দিলো। অথচ তোমার কথা শুনে আমাকেই আবার ঘরে আটকে রাখলো। বাহ্ কি দারুণ না? এই হিংসুটে বলো তো তুমি আসলে কি দেখেছ? দূরবীক্ষণ যন্ত্র লাগিয়ে দেখেছ? আমার আশেপাশে তো কখনোই থাকো না কিন্তু চোখ রাখো কি করে? আন্দাজে একটা কথা বলে আমাকে বকা শোনাও, তাইনা? আমাকে একটু আনন্দে থাকতে দেখলেই তোমার হিংসে হয়, জ্বলে বুঝি?”
কথা বলতে বলতে শায়েরীর বড্ড তেষ্টা পেয়েছে। হাত বাড়িয়ে সাইড টেবিল থেকে গ্লাস হাতে নিয়ে দেখল গ্লাসে পানি নেই।
” মৌন পানি দে তো একটু, বহু বছরের জমানো কথা তো… ”
মৌন পানি এনে দিতেই শায়েরী একচুমুকে পানি শেষ করল। তারপর আবার বলতে শুরু করল,
” শুনো তোমাকে আমার জীবনেও ভালো লাগেনি, আর লাগবেও না তাহলে তোমাকে আমি কেনো বশ করব বলোতো? তোমাদের টাকার জন্য? হুহ্ তাহলে মামানীর ধারণা ভুল। আমার বরের থাকবে বিএমডাব্লিউ আই এইট, স্পোর্টস কার। যেগুলো তুমি খালি টিভিতেই দেখেছ। ওহ্ ভাই ভালো কথা আমাদের দেশে কি এই গাড়ি চালানোর অনুমোদন আছে? তুমি তো আবার সবজান্তা শমসের তা এটা বলো তো।
নক্ষত্র ধীর গলায় বলল,
” আছে। ”
শায়েরী হাসি হাসি মুখ করে বলল,
” বাহ্ দেখলে তো। তাহলে গাড়ির মালিকও নিশ্চয় বাংলাদেশে আছে। আর আমাদের দেশটা তো ছোটই তাহলে ওকে খুঁজে পেতে আমাকে বেশি বেগ পেতে হবে না নিশ্চয়! তোমাদের কম দামি গাড়িতে চড়ার জন্য আমি মরে যাচ্ছি না খেচর ভাই। তোমার মাকে কথাটা বলে দিও, বাই বাই টাটা। ”
শায়েরী খট করে ফোনটা কেটে দিয়ে শোয়ে পড়ল। নিমিষেই ঘুমে তলিয়ে গেল সে। বহুবছরের জমানো কথাগুলো আজ শায়েরী বলে দিয়েছে তাই এমন শান্তির ঘুম ঘুমোচ্ছে। মৌন আর আদুরীও লাইট অফ করে শোয়ে পড়ল। শায়েরীর ঘুমে যেন ব্যাঘাত না ঘটে তাই ওরা ফিসফিস করে একজন আরেকজনের সঙ্গে কথা বলতে লাগল। প্রথমে আদুরীই বলল,
” আমার কি মনে হয় জানিস শায়েরীর নক্ষত্র ভাই শায়েরীর মিসটেরিয়াস প্রেমিক। ”
মৌন বলল,
” আমি ভাবছি অন্য কথা। ”
আদুরী কৌতূহলী হয়ে বলল,
” কি কথা? ”
” আমি ভাবছি শায়েরীও কি নক্ষত্রের মিসটেরিয়াস প্রেমিকা কিনা। ”
” মানে? ”
” মানে হলো শায়েরী নক্ষত্রকে কোন চোখে দেখে সেই কথা। এজ আ কাজিন ব্রাদার অর জানে জিগার পরাণের লাভার। ”
” নক্ষত্রের আজুকে ছাই দিয়ে ধরতে হবে নাহয় পেট থেকে কথা বের করা অসম্ভব। ”
মৌন আদুরীর কথায় সম্মতি জানালো,
” একদম ঠিক বলেছিস। দেখলি না আজ জ্বরের চোটে কত কথা বলল আর আমরাও পাশে থাকায় শুনতে পেলাম। বছরখানেক আগের কথা তাও এই মেয়ে আমাদের কিচ্ছু বলেনি। সবকিছু লুকিয়ে রাখে মেয়েটা। ”
” হুম কাল সকালেই সব লুকানো বের করে ছাড়ব। আমাদের কাছ থেকে লুকানো! এত বড় সাহস! ”
” এই যে ওর মামী ওকে কতগুলো কথা শুনালো কিছুই তো এসে বলল না। ভাগ্যিস যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিল মামী ওকে ফোন করে যেতে বলেছে তাই সেখানে যাচ্ছে। আমার সিক্সথ সেন্স তখনি বলছিল নিশ্চয় কোনো ঘাপলা আছে। ”
” হুম শায়েরী আসার পর আমি তো ওর চেহারা দেখেই বুঝে গিয়েছি তার উপর চোখ মুখ লাল হয়ে কি অবস্হা করে এসেছে। ”
শায়েরী ঘুমের মাঝে পাশ ফিরায় মৌন বলল,
” চল এখন ঘুমিয়ে পড়ি বাকিটা সকালে দেখব। এখন শায়েরী ঘুমোচ্ছে আমরাও ঘুমাই। ”
” ওকে গুড নাইট। ”
” হুম গুড নাইট, সুইট ড্রিমস। ”
চলবে….
.
একশত ভাগ গ্যারান্টি দিলাম আপনাকে শারীরিক মানসিক সহ মনে প্রাণে সব দিক দিয়ে ভাল রাখবে এই পেজ এর লেখাগুলো
বিভিন্ন ধরনের নতুন নতুন ভালবাসার গল্প, জোকস, প্রেমের কাহিনী পেতে এখনি পেজটি লাইক দিয়ে একটিভ থাকুন, আর পড়তে থাকুন মন ছুয়ে যাওয়া অসাধারণ কাহিন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here