“চরিত্রহীনের পুত্র, এবং পরিজনেরা” শেষ পর্ব

0
491

“চরিত্রহীনের পুত্র, এবং পরিজনেরা” শেষ পর্ব
(স্বাগতা)

‘সোফার হাতলে ধাম ধাম করে ডান হাত মুঠো করে একের পর এক কিল দিতে দিতে এবার চিৎকার করে বলতে লাগলো সোহেল, “নিজের বাপরে নিয়ে বাইরের মানুষের কাছে জঘন্য সমস্ত কথা শুনতে কেমন লাগে আম্মা তুমি জানো? তুমি কিচ্ছু জানো না!… কিচ্ছু জানো না তুমি!… বাপ-মায়ের নামে কেউ কিছু বললে খুন করে ফেলতে দুইবার ভাবে না কেউ… কিন্তু দোষ যখন থাকে বাপ-মায়ের সত্যি সত্যি? নিজেরে কেউ কিছু বললে কিসসু যায় আসে না আম্মা!… কিন্তু বাপ-মায়েরে বললে কলিজা এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যায়… আরও হাজার বার মরতে হয় যখন প্রতিবাদ করার উপায় না থাকে!…”‘

(শেষ অংশ)
সিমিনদের বাসা থেকে ফেরত এসেছিলো পরের দিন সোহেল। শরীর খারাপ থাকার কারণে পরের দিন অফিসে যেতে পারে নি। বাসায় ফিরে শায়লার নিত্যকার বিলাপ, হা-হুতাশ কিছু সহ্য করতে হয়েছে ওকে। তবে সাজ্জাদ ওকে কিছুই বলেন নি। অবশ্য বাপ-ছেলের কথাবার্তা কবেই বা হয় ওদের তেমন! যদিও সোহেল টের পায়, পুরুষ হিসেবে সাজ্জাদের যে নিবিড় অহঙ্কার, সেই অহঙ্কারের বিচারেই সিমিনের চাইতে সোহেল তাঁর বেশি প্রিয় সন্তান। নিজে একজন পুরুষ, এবং আরও একজন পুরুষের তিনি জন্মদাতা, এই জন্য তিনি ভেতরে ভেতরে অত্যন্ত তৃপ্তি অনুভব করেন। তবে তাঁর বাইরের দুনিয়ার রূপ-রস-ঘ্রাণ নিয়ে বরাবর তিনি যতোটা ব্যস্ত থেকেছেন, তাতে তাঁর নিজের সন্তানদের সময় দেয়ার সময় হয়ে ওঠে নি। আর তাতে ঘরে নিজের সন্তানদের সাথে আর তাঁর কোনও আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে নি। আর তারপর নিজের এই সমস্ত কীর্তি সামনে এসে পড়াতে একটু চুপসে গেছেন বলে সোহেলের মনে হয়। ভিডিও ফাঁস আর মাইশা বাসায় এসে চিৎকার-চেঁচামেচি করে যাওয়ার পর থেকে তিনি একটু সতর্কভাবেই মেশেন সোহেলের সাথে। সোহেল বোঝে, ও নিজেও যেমন ভয়ে আছে যে কবে ওর ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যায়, সাজ্জাদও তেমনই ভয়ে আছেন যে কবে সোহেল ফেটে পড়ে। সিমিন এমনিতেই এই বাসায় কম আসে, আর সেই ঘটনার পরে তো একবারের জন্যও এই বাড়িতে আসে নি। সুতরাং সিমিনের সাথে তাঁর আচরণ সম্পর্কে কিছু ধারণা করতে পারছে না সোহেল। তবে সোহেলের সাথে আগের চাইতেও কথাবার্তা কমিয়ে দিয়েছেন তিনি, পারতপক্ষে ওর সামনেই না পড়ার চেষ্টা করেন। আর তাতেই সোহেল বুঝেছে, আজ বহু বছর যে সোহেল তাঁর মুখের দিকেই তাকায় না, তাঁর সামনে দিয়ে ঘাড় গুঁজে, মাথা নিচু করে চলাফেরা করে তাঁর নিজের ছেলে, সেই তথ্যটা এখনও সাজ্জাদের অজানা।
শরীর একটু সুস্থ হওয়ার পরে সোহেলের পরের কয়েকটা দিন কেটেছে বেশ ব্যস্ততায়। অফিসে নিয়মিত হওয়ার পাশাপাশি ওর ব্যক্তিগত কিছু প্রস্তুতি ছিলো, সেগুলোই সেরেছে। সপ্তাহের শেষের দিকে গিয়ে মা’কে জানালো শুক্রবারে সিমিন আসবে, জামিলসহ, দুপুরে খাবে। শায়লাকে কোনও রান্না করতে নিষেধ করে দিলো সোহেল। ও খাবার অর্ডার করবে। শায়লা মৃদু আপত্তি করেছিলেন, কিন্তু সোহেল কোনও তর্কের অবকাশ রাখে নি, শুধু সিদ্ধান্তটা জানিয়েছে।
শুক্রবার সকালের মধ্যেই সিমিনরা চলে এলো। আলো এ বাড়িতে এলে খুব একটা উপভোগ করে না। ওকে দেখে সিমিন আর সোহেলের নিজেদের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। নানাবাড়িতে কি আনন্দেই না কেটেছে ওদের সময়গুলো তখন! না মা-বাবার সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে কোনও চিন্তা ছিলো, না ছিলো কোনও উদ্বেগ বা বিষন্নতা। নানা-নানী আর মামা-খালাদের অফুরন্ত আদর ছিলো শুধু! তার বিপরীতে আলোর নানাবাড়ির অভিজ্ঞতা নিতান্তই সাদামাটা। বরং সিমিনদের মামাবাড়ি বা খালার বাসায় গেলে আলো উচ্ছ্বল থাকে বেশি। এ বাসার পরিবেশের অস্বাভাবিকতাটা ওই ছোট্ট শিশুও যেন ধরতে পারে, এখানে বাতাস কেমন ভার হয়ে থাকে, রঙের ছোঁয়া নেই যেন বাড়ির আনাচে কানাচে!
জামিল কোনদিনই শ্বশুরের সাথে আলাপ জমানোর মতো কোনও বিষয় খুঁজে পায় না। আজও কুশল বিনিময়ের পরেই সাজ্জাদ সামনে থেকে সরে গেলেন। আর জামিলও মোটামুটি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। আজকে কতদিন পরে ওরা ক’জন একসাথে খাবার খেলো তা ওরা নিজেরাও বোধহয় বলতে পারবে না! শায়লা শুরুতে একটু টেনশনে ছিলেন মেয়ে এসে আবার কিছু বলে টলে কিনা, কিন্তু সিমিন এসে অব্দি তেমন কোনও কথাবার্তাই বলে নি। শরীর খারাপ লাগছে বলে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়েই থেকেছে প্রায় দুপুরের খাবারের আগ পর্যন্ত। তবে এতোদিন পরে খাবারের টেবিলটা ভরা দেখে শায়লার মনের মেঘ কেটে গেলো। বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন তিনি। সাজ্জাদ একটু চেষ্টা করলেন খুশি ফুটিয়ে তুলতে হাবেভাবে, কিন্তু সোহেল তাঁর দিকে তাকিয়ে বুঝে গেলো যে তিনি সহজ হতে পারছেন না। তিনি আন্দাজ করেছেন যে আজকের আয়োজনটা উদ্দেশ্য ছাড়া নয়। কেন যেন তাঁর অস্বস্তিটা দেখে সোহেল মনের গভীরে একধরণের আনন্দ অনুভব করলো। সাজ্জাদের সাথে, সাজ্জাদের কারণে যে অস্বস্তি নিয়ে বেঁচে থাকতে হয় ওদের, তার একটু অনুভব হওয়া দরকার উনারও।
শায়লা খাইয়ে দিতে চেয়েছিলেন আলোকে। কিন্তু সে কিছুতেই রাজী হলো না নানীর হাতে খেতে। সে তার বাবার হাতে খাবে। আজকে তার মায়ের হাতেও খাওয়ার মুড নেই। ছুটির দিনে সেটা তার বাবার দায়িত্ব। আলো কুটুর কুটুর করে গল্প করতে করতে বাবাকে বলছে এই এ্যাত্তো বড় একটা ইলিশ মাছ সে একাই খেয়ে ফেলতে পারবে, আর তারপর মাছের কাঁটাগুলো দেবে পাড়ার হুলোবিড়ালকে। একজনকে দেবে না তাও, যে দু’জন ওদের বিল্ডিং-এর পাশের প্লটের একতলা টিনশেড বাড়িগুলোর ছাদে রোজ দুপুরে মারামারি করে, একজন ছাই-সাদা রঙের আর একজন লাল-সাদা রঙের, সেই দুইজনকেই ভাগ করে দেবে। মা ভাত দিয়ে মেখে দেবে আর সেই ভাত অনেকগুলো হয়ে যাবে, তাই হুলোদের পেট ভরে যাবে। মা তো বলেছে যে বন্ধুদের সাথে খাবার সবসময় ভাগ করে খেতে হয়, তাই হুলোরা যখন দু’জন মাছভাত ভাগ করে খাবে, তখন দু’জন বন্ধু হয়ে যাবে, আর মারামারি করবে না। মোরগপোলাও এর মুরগির রানের মাংস খুলে খুলে অল্প অল্প পোলাওয়ের সাথে মেয়ের মুখে দিতে দিতে জামিল মেয়েকে কথা দিলো অত্তোবড় ইলিশ মাছটা সে শিগগিরই কিনে আনবে, সেটা আলো আর হুলোরা তিনজন মিলে ভাগাভাগি করে খাবে তারপর। পোলাওয়ের সাথে জালি কাবাব ছিলো অর্ডারে। সাজ্জাদ দেখলেন যে কাবাব ভেঙে মেয়ের মুখে দেয়ার আগে জামিল ভালো করে দেখে নিচ্ছে প্রতিবার যে ভেতরে কাঁচা মরিচের টুকরো আস্ত রয়ে গেছে কিনা। আলো বলে চলেছে, একটা সাদার উপরে কালো ছাপ দেয়া মাম্মাম বিড়াল দেখেছে সে, তার নাকি ৩টা বেবি বিড়াল আছে, একটা একদম সাদা, একটা পুরো লাল, আরেকটা ছাই রঙের ডোরাকাটা। ওরা তো আলোর মতো ছোট, তাই ওদের কাঁটা দিয়ে ভাত দেয়া যাবে না। ওদের জন্য তাই নিজের মায়ের কাছে আবদার পেশ হলো এবার, ওদেরকে মুরগি দিয়ে পোলাও মেখে দিতে হবে। মা যখন বললো যে বিড়ালকে ঘি দিয়ে ভাজা পোলাও দেয়া ঠিক না, ওদের লোম পড়ে যায়, পেটে গন্ডগোল হয়, তখন খুব চিন্তায় পড়ে গেলো আলো। পোলাও তার খুব পছন্দ! এরকম একটা সুস্বাদু খাবার বেবি বিড়ালগুলো খেতে পারবে না?! আলোর কথাই জমিয়ে রেখেছে খাবারের টেবিল। সবার মনোযোগই আলোর দিকে। হাসছে তার বিরাট সমস্ত প্রোজেক্টের পরিকল্পনা শুনে।
কিন্তু এর মধ্যে সাজ্জাদের গলা বার বার কেন শুকিয়ে যাচ্ছে তিনি বুঝতে পারলেন না। খাবারের টেবিলে আলোর সাথে মৃদুস্বরে গল্প করতে করতে জামিলকে খাওয়াতে দেখে হঠাৎই সাজ্জাদের কেমন হিংসা হলো। তাঁর মনে পড়লো না সিমিনের সাথে এমন কোনও স্মৃতি। জামিলের কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে মেয়ের পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কে সে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল। মেয়ের পছন্দের মাছ যে ইলিশ, সেটা জেনেই সে কথা চালাচ্ছে মেয়ের সাথে। সাজ্জাদের মনে প্রশ্ন এলো, বাচ্চারা কোন বয়স থেকে মাছ খাওয়া শুরু করে? মনে করার চেষ্টা করলেন সিমিন কি খেতে পছন্দ করে। মনে করতে পারলেন না। এমনকি সোহেলের পছন্দও মনে পড়লো না তাঁর। তিনি কখনও ছেলে বা মেয়েকে নিজের হাতে খাওয়ান নি। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বেশি মাখামাখি তাঁর কাছে বরাবর মনে হয়েছে তাঁর পৌরুষের সাথে মানায় না। কিন্তু আজকে তাঁর সামনে তিনি একজন পরিপূর্ণ পুরুষকে দেখছেন, যার পৌরুষ আরও সমৃদ্ধ, আরও সৌন্দর্য্যময় হয়ে উঠেছে তার পিতৃত্বের মায়ায় মিশে। তিনি টের পাচ্ছেন তাঁর অস্বস্তিটা হচ্ছে এটা দেখে, বা এটা বুঝে যে এই পুরুষ, যে নিজের সন্তানকে গভীর মমতায় আগলে আছে, যে তার স্ত্রী’র প্রতিটা প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের দিকে খেয়াল রাখছে, তাকে কিছুতেই তিনি কোনও পুরুষের থেকে কম বলতে পারছেন না, তার পৌরুষ নষ্ট হচ্ছে বলে তাকে তুচ্ছ ভাবতে পারছেন না।
জামিল আর আলোকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে বাপ-মেয়ের বন্ডিং খুব সুদৃঢ়। আলো বাবাকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছে, এ তার পরম নির্ভরতার জায়গা! ঠিক তেমনই জামিল ধৈর্য্য নিয়ে মেয়ের সাথে কথা চালিয়ে যাচ্ছে, এতোটুকু বিরক্তি নেই, ওর পুরো দুনিয়া যেন আটকে আছে ওই ছোট্ট মানুষটাতে!
খাওয়া দাওয়ার পর সবাই মিলে এসে বসলো বসবার ঘরে। সিমিন চা বানিয়ে নিয়ে এসেছে। এমনিতে চা বিকেলেই খাওয়ার কথা, কিন্তু সোহেল মৃদুভাবে সবাইকে বলেছে ড্রয়িং রুমে গিয়ে একটু বসতে। তাই দুপুরের বিশ্রাম বাদ রেখে সবাই বসেছে। আলোকে দেখে বোঝা যাচ্ছে চোখে ঘুম তার। ক্লান্ত। এমনিতেও এই বাসায় সে বিশেষ কিছু করার মতো পাচ্ছে না। বাবার কোলের কাছে গিয়ে মোচড়ামুচড়ি করছে সে। এক হাতে চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে আরেক হাতে মেয়েকে কোলে তুলে নিলো জামিল। সিমিনকে বললো, “আলো মনে হয় ঘুমাবে। আমি ওকে নিয়ে তোমার ঘরে গিয়ে বরং ঘুম দিয়ে দেই।… আর আমার হয়তো কানে একটু ইয়ারফোন থাকবে… একটা লাইভ প্রোগ্রাম দেখবো… যখন ফিরতে চাও ডাক দিও…”। বাবার কোলে চড়ে মাথাটা কাঁধে এলিয়ে দিলো আলো। এক হাতে বাপের কাঁধ জড়ানো, আরেক হাতে চোখ ডলছে। সিমিন মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো জামিলকে। জামিল চলে গেলো সিমিনের ঘরে।
জামিল ঘর থেকে চলে যাওয়ার পরে ঘরের ৪ টা মানুষের মুখে কোনও কথা রইলো বেশ খানিকক্ষণ। শায়লার নিঃশ্বাস একটু দ্রুত চলছে। তিনি বুঝেছেন ছেলে-মেয়ে কিছু বলবে বলেই বসেছে। তা না হলে তাঁদের ৪ জনের এভাবে বসে চা খাওয়ার চল এ বাসায় নেই বললেই চলে। সোহেল নিজের চা নিজে বানিয়ে নেয়, নিজের ঘরে বসেই খায়। বিকেলের নাস্তা কিছু তৈরি হলে কখনও কখনও শায়লা প্লেটে করে কিছু নিয়ে ওর ঘরে গিয়ে দিয়ে আসেন যদি ও বাসায় থাকে। নিজের ইচ্ছায় সোহেল বসেই না মা-বাবার সাথে। তাঁরাও যে ডাকেন তাও না অবশ্য।
চায়ের কাপ হাতে সাজ্জাদ একটু অন্যমনষ্ক হয়ে আছেন। সেই তখন থেকেই তিনি নিজের স্মৃতির ভেতর হাতড়ে চলেছেন। হ্যাঁ, অনেক নারীর সাথে একান্তে সময় কাটানোর অনেক গোপন সুখের স্মৃতি তাঁর আছে, কেউ তাঁকে সময় দিয়েছে নিজের ইচ্ছেয়, কেউ কোনও স্বার্থে, কেউ বা নিতান্তই বাধ্য হয়ে। কফিশপ, রেস্টুরেন্ট, রিসোর্ট থেকে শুরু করে বেডরুম পর্যন্ত অনেক জায়গায় অনেকের সাথে তাঁর স্মৃতি। কিন্তু তারা কেউ কি তাঁর নিজের? কিছুটা সময়ের আনন্দ, একটু থ্রিল, সাময়িক সঙ্গ, এই তো! একান্ত নিজের মানুষ তো তারা হতে পারে নি! তিনিও নন তাদের জন্য আপন কেউ। আপন কে তাহলে? তাঁর নিজের স্ত্রী? সহধর্মিনী, সংসারের অংশীদার, চলার উঁচু-নিচু পথের সাথী? তাঁর নিজের সন্তান? আমৃত্যু যাদের নিজের অংশ বলে তিনি দাবী করতে পারেন? কিন্তু তাহলে এদের সাথে তাঁর স্মৃতি কোথায়? সুখের, কিংবা দুঃখের? এদের সাথে কেবল ঘরে এক ছাদের নিচে তাঁর জন্য রয়ে গেছে এক অস্বস্তিকর দূরত্ব, আর ক্রমাগত বিশ্বাসঘাতকতার স্মৃতি! তাঁর সন্তানদের স্কুল-কলেজের নাম হয়তো চেষ্টা করলে মনে পড়বে তাঁর, মনে পড়বে ওদের রেজাল্টও, কিন্তু দিনে-রাতের সম্পর্কে এক পরিবার, ভলোয়-মন্দয় একসাথে একটি একক হয়ে ওঠার স্মৃতি তো নেই! সম্পর্কের নাম আছে ঠিকই, কিন্তু কেউ কি কারও একান্ত আপন হতে পেরেছেন তারা ৪ জন? তিনি হওয়ার চেষ্টাই কি করেছেন?
আজকে সাজ্জাদের কেবলই মনে হচ্ছে যে তাঁর বিচারসভা বসেছে এখানে। যে কান্ড তিনি ঘটিয়েছেন তাতে একথা মনে হওয়াটাও আসলে অবাক হওয়ার মতো কিছু না। জীবনে যতোবার অন্যায় করেছেন, বিভিন্ন মেয়েদের সঙ্গে নানান সময়ে নানা জায়গায় সময় কাটিয়েছেন, প্রতিবার তিনি অনুভব করেছেন উত্তেজনা। এ্যাডভেঞ্চারের রোমাঞ্চকর শিহরণ। নিষিদ্ধ কিছু সবার চোখের আড়ালে করতে পারায় এক ধরণের সাফল্যের আস্বাদ নিয়েছেন। নিজেকে সবার চাইতে বেশি চতুর বলে মনে হয়েছে। সাহসী মনে হয়েছে। নিজে অলস হয়ে বসে থেকে যখন শায়লাকে বাধ্য করেছেন ভাইদের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য আনতে, তখন সকলকে ধোঁকা দিতে পারার আর বোকা বানানোর আনন্দে নিজেকে বিজয়ী মনে হয়েছে। কিন্তু আজকের এই অনুভুতির সাথে তিনি অপরিচিত। ইতিপূর্বে যখনই ধরা পড়েছেন, তখন নিজেকে তিনি এই বলে স্বান্তনা দিয়েছেন যে অতি সাবধানী মানুষেরও ভুল হয়! তাঁকে আরও সাবধান হতে হবে। আর মনে মনে এই ভেবে হেসেছেন যে এ তো মাত্র একটা! তাঁর সমস্ত কীর্তির খবর কে রাখে? একশো বারের মধ্যে একবার ধরা পড়লেই কি আর না পড়লেই কি! কিন্তু এখন তাঁর মনে হচ্ছে যে সবাই সব কিছু জেনে বসে আছে। তাঁর ছেলে-মেয়ে এখন জানে যে তিনি কি বলে মেয়েদের ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেন। এরা এখন জানে তিনি কি দৃষ্টিতে মেয়েদের দিকে তাকান, কোন কথা বলে মেয়েদের মন নরম করে আনেন। এরা জানে যে মাইশার জন্য তিনি কি কি ছেলেমানুষী করেছেন, আরও কোন মেয়ের জন্য কতোটা পাগলামি করেছেন ঘরে স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে এমনকি নাতনী থাকা স্বত্তেও, এরা জানে যে মাইশা এই বাড়িতেই এসে কি পরিমাণ হেয় করে গেছে তাঁকে সকলের সামনে! মাইশার প্রিন্ট করা মেসেজ, ছবি হয়তো ওরাও দেখেছে। অস্বস্তি হচ্ছে তাঁর। প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে। আজকে শায়লার দিকে বার বার চোখ যাচ্ছে তাঁর। আকাশী নীল পিওর সিল্ক শাড়ি পরেছে শায়লা। বরাবরই একটু ভারী গহনা তাঁর পছন্দ। আজকেও বেশ ভারী একটা স্বর্ণের হার পরেছেন, সাথে মানানসই স্বর্ণের দুল, হাতে চুড়ি, চোখে কাজল। ছেলে-মেয়ে-জামাই-নাতনী সকলে আসার আনন্দে নিজেকে গুছিয়ে সামনে এসেছে সে। রান্নার ঝামেলা নেই বলে, আর পরিবেশনের দায়িত্বটাও আজকে ছেলে-মেয়ে তুলে নেয়ার কারণে আজকে ক্লান্তি নেই তাঁর চোখেমুখে, বেশ ফ্রেশ দেখাচ্ছে। আজকে অনেকদিন পর মনে হলো সাজ্জাদের যে তাঁর স্ত্রী দুর্দান্ত সুন্দরী! নানী হয়ে গেছে অথচ বয়সটা যেন ছুঁতেই পারে নি তাঁকে! ৫০ এর দোরগোড়াতেও এখনও তরুণী লাগে দেখতে।
অন্যদিকে তাঁর মেয়ে! সিমিন!। গম্ভীর মুখটার দিকে তাকালে কেন যেন নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে যায় সাজ্জাদের। সিমিন দেখতে ওর দাদীর মতো হয় নি, কিন্তু ব্যক্তিত্বের দিক দিয়ে অনেকটাই। গেরুয়া রঙের সূতির সালোয়ার কামিজ পরণে। বাঁ হাতে কালো চামড়ার চিকন বেল্টের একটা ঘড়ি, ডায়ালটা সোনালী, ওভ্যাল শেইপের। আর কোনও অলঙ্কার নেই, অথচ কি স্নিগ্ধ! সাজ্জাদ জানেন না যে আলোর কারণে সিমিন অন্য গহনা খুব একটা পড়ে না। যখন তখন মায়ের কোলে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে মেয়ে, নিজেরও হাত-পা কেটেছে, মায়ের গলার চেইনও ছিঁড়েছে, চুড়ি বাঁকা করে ফেলেছে, কানের দুলে টান খেয়ে কানের লতি ছিঁড়তে ছিঁড়তে ছেড়ে নি। সুতরাং মেয়ে বড় না হওয়া পর্যন্ত গহনা পরে থাকার চিন্তা বাদ দিয়েছে সিমিন। বিয়ের আগে মেয়েটা একদম হালকা পাতলা ছিলো, সাজ্জাদের মনে পড়ে। মা হওয়ার পরে একটু ভারী হয়েছে গালগুলো। ছেলেটা? মুখে দু’দিনের না কামানো দাড়ি, কাঁচাপাকা মেলানো। বয়সটা অনেক বেশি দেখাচ্ছে ওর। সোহেল দেখতে অনেকটাই ওর বড় মামার মতো। আতিফের কথা মনে পড়তেই একটা সূক্ষ্ম শীতল শিহরণ অনুভব করলেন সাজ্জাদ। ওই মানুষটার ব্যক্তিত্বের ওজনের সামনে বরাবরই একটু সমঝে চলেছেন সাজ্জাদ, সেই ছাত্রাবস্থা থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত। সোহেল তাঁর নিজের ছেলে, তাঁর ঔরসজাত সন্তান, অথচ ওর চোখেমুখে সেই ভারীক্কিটাই চোখে পড়ে সাজ্জাদের বারবার। সহজ হতে পারেন না তিনি নিজের সন্তানের সামনেও।
সাজ্জাদের শুধু মনে হচ্ছে এরপরে কিছু ঘটতে চলেছে। অতি চালাক মানুষ যখন নিজের তৈরি ফাঁদে নিজে পড়ে যায় কোনও এক বেহিসাবী চালে, তখন কি তাঁর এমন লাগে? তাঁর জীবনের পুরুষদের কথা মনে হচ্ছে বার বার, তাঁর শ্যালক, সম্বন্ধী, বোনেদের জামাইরা, এমনকি নিজের ছেলে বা তাঁর মেয়ের জামাই। এদের কেউ কি তাঁর মত স্বভাব ধারণ করে? এদেরও কি গোপন কোনও জীবন আছে? এরাও কি স্ত্রীকে বঞ্চিত করে অন্য কোথাও সুখ খুঁজতে যায়? এরা কি জানে নারী নিয়ে খেলতে, ওদের মোহের ফাঁদে ফেলতে, ওদের আকর্ষণ করতে এবং ওদের প্রতি আকর্ষিত হতে কতোটা তীব্র ভালো লাগা কাজ করে তাঁর? শরীর থেকে শরীরে বারে বারে ডুব দিতে নেশা লাগে কি এদেরও? নারীর লজ্জা, ভয়, বিব্রতভাব, প্রথম প্রেমে পড়ার দৃষ্টি, চটুলতা, আবেদন, ব্রীড়া, এই সব কিছু নিয়েই যেমন তাঁর ছিনিমিনি করতে ভালো লাগে, তাঁর আশেপাশের পুরুষদেরও কি তাই? এই পুরুষেরা কি কেউ ধর্মীয়, সামাজিক বন্ধনের মানে বোঝে? সেটাকে সম্মান করে, নাকি সবার সবটাই অভিনয়? কমিটমেন্ট, লয়্যালটি, নিদেনপক্ষে ভালবাসার মানে বোঝে? ভালবাসতে জানে এরা? এরা কি এক নারী নিয়েই সংসার করে আসছে? কিভাবে? স্বাদবদলের ইচ্ছা হয় নি এদের কারও? প্রেমের প্রথম দিকের নেশা কেটে যাওয়ার পরেও এরা কি নিয়ে পড়ে থাকে এক নারীতে আটকে? অথবা তাঁর পরিবার এবং পরিচিত নারীদের মধ্যেই কি কেউ আছে যে বহু পুরুষে আসক্ত? যার চরিত্রের কোনও বাঁধ নেই?
নারী সাজ্জাদের কাছে কোনও সম্পর্কের নাম ধরে আসে না, উপস্থিত হয় স্রেফ উপযুক্ত অথবা অনুপযুক্ত, পছন্দসই অথবা অপছন্দনীয় খেলার সামগ্রী হিসেবে। কিন্তু তাহলে, সিমিন? ওকে কি বলবেন? ওর বয়সীদের প্রতিও তাঁর আকর্ষণ তো দুর্নিবার! তাহলে কি কেবল আত্মজা বলেই সে… তাহলে কি বাকি পুরুষরাও ওর প্রতি…?! আর ভাবতে পারেন না সাজ্জাদ।
নিজের ভাবনায় নিজেই চমকে উঠছেন বারবার আজকে সাজ্জাদ। কেমন হবে যদি তাঁর মেয়ের জামাইও মেয়েকে রেখে বাইরের নারীতে আসক্ত হয়? কলিগ বা হাসপাতালের নার্স, কারও সাথে অপ্রীতিকর অবস্থায় ধরা পড়ে যদি কোনদিন? তিনি কি তাকে সাবাসী দেবেন? তাঁর মেয়ের জামাইয়ের এমন কোনও ভিডিও যদি বাজারে আসে, তিনি কি দেখে মনে মনে খুশি হবেন যে এমন পুরুষ তাঁর মেয়ের স্বামী? গলা শুকিয়ে আসছে বার বার তাঁর। তাঁর বড় দুলাভাই কি কখনও বড় আপাকে রেখে অন্য কোনও নারীর সাথে রাত কাটিয়েছেন? মেজো আপার স্বামী, মাহফুজ কি তাঁর অফিসের কোনও মহিলা কর্মীকে কামনা নিয়ে স্পর্শ করেছেন? অথবা ছোট বোন শাহানার স্বামী? যদি করে থাকেন, আর যদি তাঁর বোনেরা সে কথা কোনদিন জানতে পেরে থাকে তাহলে তাঁরা কি করেছেন? তাঁরাও কি শায়লার মতোই সব কিছু সহ্য করে রয়ে গেছেন স্বামীর ঘরে? সময় যতোটা পার হচ্ছে, ততোই তাঁর অস্থিরতা বাড়ছে। কি যেন হবে, কি যেন হতে চলেছে। এই অনুভূতিটা থেকে কিছুতেই মুক্তি পাচ্ছেন না তিনি! তাঁর মায়ের পেটের বোনেরা কি তাঁকে ঘৃণা করে? শায়লার ভাই, আতিফ, রাদীফের স্ত্রী’রা কি তাঁর কাছ থেকে ইচ্ছা করেই দূরে থাকে? ওরা কি তাঁকে ভয় পায় যে উনি তাঁদেরকেও ভোলানোর চেষ্টা করতে পারেন? নায়লা, তাঁর একমাত্র শ্যালিকা তাঁকে দেখতে পারে না, আর সেটা সে গোপনও রাখে নি। সামনাসামনিই বলেছে। আচ্ছা, বাকি সবাইকে কি তাঁর মতোই দেখা যায় না? খুব সাধারণ! বোঝার কোনও উপায়ই নেই যে কে কোন ধরণের অন্যায়ের সাথে জড়িত! তাঁকে দেখে তো মনে হয় না যে তিনি অসৎ একজন মানুষ। তাহলে কি বাকিরাও কেউ খুনী, কেউ ঘুষখোর, কেউ চোরাচালানকারী, কেউ নারীব্যবসার সাথে জড়িত? সবাই কি তাঁর মতোই? নিশ্চয়ই বাকিদেরও কোনও না কোনও গোপন পাপ, গোপন অন্যায় আছে! একা তিনিই শুধু খারাপ, এটা ভাবার কোনও কারণ আছে কি? পৃথিবীতে কি কেউ সম্পূর্ণভাবে শুদ্ধ? তেমনটা কি হয়? সবাইই অন্যায় করে নিশ্চয়ই! কিন্তু সবাই তাহলে যার যার অন্যায় আর একটু ভালোভাবে ঢেকে রাখতে জানে। হ্যাঁ, এটাই ঠিক। সবাই তাঁর চাইতে ভালো করে লুকাতে জানে। সুখ চায় না কে? আর ন্যায়ের পথে থেকে, পাপ না করে কি সব সুখ অর্জন করা যায়? নিশ্চয়ই না! তাঁর ছেলে? সোহেল? সোহেলও কি গোপনে কোনও অন্যায় করে চলেছে? কোনও মেয়েকে…
নিজেকে পাগল পাগল লাগছে সাজ্জাদের। নিজের অপরাধবোধ, লজ্জা, গোপন সমস্ত কীর্তি আর কথা সবার সামনে চলে আসার শঙ্কা, এবং ছেলে-মেয়ের কাছে অপমানিত হওয়ার আশঙ্কা, নিজের পক্ষে যুক্তি, নিজের ডিফেন্স, সব কিছু একসাথে হয়ে তাঁর মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় হয়েছে। সব চাইতে বেশি যেটা কষ্ট দিচ্ছে, সেটা হলো ওরা এই মুহূর্তে কি ভাবছে সেটা জানতে না পারা।
***
বাবার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে ছিলো সোহেল। তাঁর মুখের প্রতিটা রেখার পরিবর্তন দেখছিলো। তিনি যে নিজের চিন্তায় মগ্ন, সেটা বুঝতে পারছিলো। আর সেখান থেকে এক ধাক্কায় ফিরে আসাটাও নজরে এলো। আর তখুনি মুখ খুললো ও, “আম্মা, আমি কিছু বলার জন্য তোমাদের এখানে বসতে বলছি…”।
সাজ্জাদ-শায়লা, দু’জনেই দৃশ্যত উসখুস করে উঠলেন। সোহেল কয়েকটা সেকেন্ড একটু সময় নিলো পরের কথাটা বলতে, “আমি এই বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছি… মেস ঠিক করেছি… আপাতত সেখানেই উঠবো… পরে উপযুক্ত রুমমেট বা হাউজমেট কাউকে পেলে ছোটখাটো কোনও ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে নেবো…”।
প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন শায়লা, “এগুলা কি বলিস? তুই মেসে উঠবি মানে কি? … নিজের বাসা থাকতে মেসে গিয়ে উঠবি কি কারণে? এমনও না যে তোর অন্য শহরে চাকরি… একই শহরে চাকরি করে বাপ-মা’রে ফেলে মেসে গিয়ে উঠবি কেন?”
সোহেলের চোয়ালের হাড় উঠছে-নামছে। দাঁতে দাঁত চেপে রেখেছে। কিন্তু নিজেকে সংযত করলো ও। আজকে রাগা যাবে না। রেগে কথা বলতে গেলে যা বলতে এসেছে, যা বলতে চায়, বুকের যে পাথরের ভার ও নামাতে চায়, তার কিছুই বলতে পারবে না। আজকে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারানো চলবে না সোহেলের। বড় করে শ্বাস নিলো, বললো, “কারণ যে তুমি জানো না তা তো না আম্মা!… তারপরেও জানতে যখন চাচ্ছো, পরিষ্কারভাবেই বলতিসি, এই অপমান, এই বদনামের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে, আর সবচাইতে বড় কথা, বাসার এই অসুস্থ পরিবেশে আমি আর টিকতে পারতিসি না… আমার নিজের স্পেস দরকার আম্মা…”।
ব্যস, লেগে গেলো আগুন। পাথর হয়ে বসে আছেন সাজ্জাদ, আর ধাঁই করে রাগ চড়ে গেছে শায়লার। শুরু হয়ে গেলো তাঁর চিৎকার, “অসুস্থ পরিবেশ? কি বলতে চাস? তোদের আমরা অসুস্থ পরিবেশে বড় করসি? হ্যাঁ? রক্ত পানি করে বাচ্চাকাচ্চা মানুষ করার পরে এখন তারা বলে কিনা আমরা সুস্থ পরিবেশ দিতে পারি নাই?… আর কিসের অপমান? হ্যাঁ? কিসের বদনামের কথা বলিস?… তোরা জানিস না যে তোদের বাপের শত্রুর অভাব নাই? মানুষ মানুষের উন্নতি সহ্য করতে পারে না… বিনা কারণে তোদের বাপের বদনাম করে… এই বিপদের সময়ে মা-বাবার পাশে থাকার বদলে তুই বলিস ঘর ছেড়ে চলে যাবি?… এই দিন দেখার জন্য বুকের দুধ খাওয়ায় বড় করলাম? … কোথায় বুড়ো হলে ছেলে-মেয়ে বাপ-মা’র অবলম্বন হয়… তা না একজন তো আমার খবরই নেয় না বছর ঘুরে গেলেও… আরেকজন এখন বলতে আসছে সে আলাদা থাকবে!… আল্লাহ!… কি অপরাধ করসি তোমার কাছে?…”।
অন্য সময় হলে সাজ্জাদ শায়লার প্রতিক্রিয়াটা ভীষণ উপভোগ করতেন। শায়লার উপর তাঁর প্রভাব কতোখানি, সেটা দেখে তৃপ্ত হতেন। কিন্তু আজকে তিনি স্তব্ধ হয়ে আছেন। একটু আগের অস্বস্তি এখন আতঙ্কে রূপ নিয়েছে।
শায়লা কিছুক্ষণ চিৎকার করে একা একাই থেমে গেলেন। সোহেল আর সিমিন দুইজনেই চেয়ে আছে তাঁর দিকে। চোখের দৃষ্টি ওদের কি ভীষণ শীতল! জমে গেলেন তিনি ওই দৃষ্টির সামনে।
সোহেল যখন কথা বললো তখন ওর দৃষ্টির চাইতেও শীতল ওর কন্ঠ, “আপু! তুমি না আব্বার ভিডিও দেখো নাই এখনও বলছিলা! দেখবা?”
বজ্রপাত হলো ঘরের ভেতর। সাজ্জাদের চোখ বিস্ফারিত। শায়লা কেঁপে উঠলেন সোহেলের কথা শুনে। সিমিন নিজেও বোধহয় সোহেলের এই কথাটা আশা করে নি এই সময়। একটু থমকালো সেও, যদিও বুঝতে দিলো না। উত্তরও দিলো না ওর কথার। অবশ্য সোহেল অপেক্ষা করেও নেই ওর উত্তরের। ও প্রশ্ন করেছে সিমিনকে উদ্দেশ্য করে, কিন্তু চোখ সরায় নি মায়ের উপর থেকে। ঘরের সকলকে একটু সময় দিয়ে আবার বলতে শুরু করলো, “আম্মা কি যেন বলছিলে? আব্বা অনেক উন্নতি করেছে… আর কি যেন? ওহ… সবাই ভীষণ হিংসা করে আব্বার উন্নতিতে, তাই না? আচ্ছা এই কথা তো তুমি সব সময়েই বলো… কখনও তোমাকে জিজ্ঞেস করা হয় নাই… কি কি উন্নতি করে ফেলছে আব্বা? একটু বলো তো?… আমাদের ভাইবোনের জানা দরকার আছে…”।
কথাগুলো বলে সত্যি সত্যি উত্তরের প্রত্যাশায় বসে রইলো মায়ের দিকে তাকিয়ে সোহেল। শায়লা বুঝলেন, আবার ভুল করেছেন তিনি। মিথ্যা দিয়ে নিজেকে স্বান্তনা দেয়া যায় হয়তো, কিন্তু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লেই মিথ্যার দেয়াল ঝুরঝুর করে ধ্বসে পড়ে। নিজেকে হয়তো বুঝ দেয়া যায়, কিন্তু বাকি পৃথিবীর কোনও ঠেকা নেই যে তাঁর মিথ্যায় বুঝ মানার। হাজার বার ভেবেছেন, ছেলেটার সামনে এসব আর বলবেন না, কিন্তু কিছুতেই নিজেকে আটকাতে পারেন নি। ওদের ছোটবেলায় এগুলো খুব সহজেই বুঝিয়ে দেয়া যেতো ওদের, কিন্তু এখন ওরা পূর্ণবয়স্ক, এই সমস্ত সস্তা যুক্তিতে ওদের আটকানো যায় না। এখন কি বলবেন তিনি? কি জবাব দেবেন ছেলের প্রশ্নের?
মায়ের চুপ করে থাকা দেখেও আজকে থামলো না সোহেল। তাড়া দিলো আবার, “কই বলো আম্মা? আব্বা কি কি উন্নতি করে ফেলছে? আমরা ছেলে-মেয়ে হয়ে এতো কথা জানলাম, দেখলাম শুনলাম আব্বা সম্পর্কে, আর এই কথা জানবো না?”
শায়লা যেন মরিয়া হয়ে উঠলেন, “কেন? তোরা চোখে দেখিস না? কতো টাকা বেতন পায়… তারপর… তারপর…”
শায়লা কথা খুঁজতে খুঁজতেই সোহেল প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, “টাকা? তাই তো! কিন্তু তাহলে আমাদের বাসার টেলিভিশন, সোফা, খাট, এগুলো সব মামাদের দেয়া কেন আম্মা? … আর কয়েক মাস আগেই না তুমি বড় মামার কাছে টাকা চাইলে সংসার খরচের জন্য? ওই যে… আমার চাকরি হওয়ার ঠিক আগ দিয়েই?… মাঝে মাঝেই তো চাও, তাই না? আপার বিয়ের খরচ সব তাঁদেরই করা… আমার পড়ার সময় টিউশন ফি দেয়ার জন্যেও তো মামাদের বলতে হয়েছে… তারপর ছোট আন্টি দিয়েছে লাস্ট সেমিস্টারেরটা, মনে আছে? তোমার তো কোনও ইনকাম নেই… তো আমার আব্বার যদি এতোই ইনকাম, এতোই টাকা, তাহলে বারবার মানুষের কাছে চাইতে যেতে হয় কেন আম্মা? এমনকি সেগুলো শোধ করতেও তো কোনদিন দেখি না তোমাদের!… তাইলে আব্বার এতো এতো টাকা সব যায় কোথায়?”
শায়লা কল্পনাও করেন নি যে সোহেল সরাসরি এভাবে আক্রমণ করে বসবে। যা যা বলেছে, তার একটা কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই তাঁর। তবু নিজের তৈরি মিথ্যার জাল কেটে বের হয়ে আসা কি এতোই সহজ? শায়লা তোতলাতে তোতলাতে বলার চেষ্টা করলেন, “ম্মমানে… কখনও কখনও… ক…ক্ক…কখনও তো মানুষের হাতের অবস্থা…ম… ম্মানে সব সময় তো এক রকম থাকে না… আত্মীয়স্বজন তো বিপদে আপদেই কাজে আসে… তাই না?” দুর্বল শোনালো তাঁর গলা।
“আচ্ছা?”, সোহেলের গলায় কৌতুক, “সেই জন্যই তুমি গত পরশু আমি যখন বললাম যে আজকে মামা-খালা-ফুফু সবাইকে বাসায় আসতে বলি, তখন না করলা… তাই না? প্রয়োজন না পড়লে কাউকে মনে করার আর দরকার হয় না, নাকি?”
থতমত খেয়ে গেলেন শায়লা, গত বুধবারের ছেলের সাথে তাঁর কথোপকথন মনে পড়ে গেলো। সোহেল বাসায় সবাইকে ডাকার কথা বলতেই দুশ্চিন্তার রেখে ফুটেছিলো তাঁর চোখেমুখে, “কিন্তু এখন যে অবস্থা… তোর বাবা… এর মধ্যে লোকজন বাসায় ডাকা… ওই ভিডিও… সবাই তো সবকিছু জানে এমনিতেই!… কে এসে আবার কি কথা বলে…”।
উনার কথা শেষ হতে দেয় নি সোহেল। গলার স্বর কঠিন হয়ে উঠেছিলো, “এমন কাজ কেন করেন তাহলে? এমন কাজ কেন করেন যে কাজ করলে মানুষের সামনে দাঁড়াতে লজ্জা করে?… আত্মীয়-স্বজন কারও সামনে মুখ দেখানো যায় না? করার সময় মনে ছিলো না যে লোকে জানলে লজ্জার ব্যাপার হবে? কথা শুনতে হবে?”
শায়লা চমকে উঠে দ্রুত সামলে নিয়েছিলেন, স্বরে ক্ষোভ ফুটিয়ে বলেছিলেন, “আবার শুরু করলি এসব? নাহয় একটা ভুল করেই ফেলছে… কিন্তু তোর তো বাপ সে, তাই না? এভাবে বলিস কেন?”
রুক্ষভাবে হেসে উঠেছিলো সোহেল, “একটা মাত্র? মাত্র একটা? তাও আবার ভুল? ভালোই বলছো!… আর আমি কবে কি বলি তারে? নাকি তুমি ওই ‘একটা ভুলের’ কল্পনার মতো এটাও কল্পনা করে নিসো যে আমি তারে কথা শুনাই?…”
সেদিনের কথা মনে পড়তেই এবার শায়লা চুপ হয়ে গেলেন। কথা খুঁজে পাচ্ছেন না। মাথার ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সোহেল একের পর এক কথায় তাঁকে আটকাচ্ছে। কি বলবেন তিনি? সোহেল বলে উঠলো, “আব্বা কে এমন মহান মানুষ আম্মা? আমেরিকার প্রেসিডেন্ট? ভুল করে এই মোহাম্মদপুরের বাসায় এসে পড়সেন? নরওয়ের রাজা? আরব শেখ?… নাকি আম্বানি? সালমান এফ রাহমানের মতো ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট? ইলন মাস্ক? দুনিয়াশুদ্ধু মানুষ শুধু তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রই করে যাচ্ছে! তাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে… কেন আম্মা? একটু বুঝায় বলো তো আমারে!… দুনিয়ার মানুষের কি ঠ্যাকা পড়সে সারাক্ষণ তারে নিয়ে হিংসা করার? কি আছে তার?”
শায়লা চুপ। সোহেল দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করলো। এবার তার কন্ঠ আগের চাইতেও কঠিন, “মিথ্যা দিয়ে আর কতদিন চালাবা আম্মা? আমার বয়স ২৮, আপুর বয়স ৩২… আমাদের দুগ্ধপোষ্য শিশু মনে হয় তোমার? … সেই মিরপুরের বাসা ছাড়ার সময়ের মতো যা তা একটা কিছু বুঝায় দিলেই বুঝবো?… তুমি নিজেও জানো আম্মা যে এটা তোমার একটা অসুখ… কিন্তু অসুখের নিয়ন্ত্রণটা যদি তোমার নিজের হাতে না থাকতো, আমি তাইলে তোমারে কোনও দোষ দিতাম না আম্মা… এই অসুখটা তুমি নিজে নিজের ভেতর জিইয়ায় রাখসো… এর প্রতিকার করার কোনও চেষ্টা করো নাই… বাড়তে দিসো দিনকে দিন… আমি আর আপু তোমারে কাউন্সেলিং-এর জন্যেও নিয়ে যাইতে চাইসি… তুমি কো-অপারেট করো নাই… শুনো নাই আমাদের কথা… তাইলে কি বুঝবো আমরা? তুমি যা বলো বা যা করো সেটা তুমি বুঝেই করো… আর যেটা করো সেটা অনুচিত জেনেও করতে থাকো… মিরপুরে চোরের মতো মধ্য রাত্রে বাসা পাল্টানোর টাইমে আমারে আর আপুরে বুঝ দিসিলা যে আব্বার অনেক শত্রু আব্বার বিরুদ্ধে মিথ্যা কথা রটাচ্ছে, এই বলে আমারে বাইরে খেলাও বন্ধ করে দিসিলা… অথচ যেটা করা তোমার উচিৎ ছিলো তোমার সেইটা হলো আব্বারে শক্ত করে ধরা… এবং যে অন্যায় সে করসে তার শাস্তির ব্যবস্থা করা… তা না করে…”
সোহেলের কথা শেষ না হতেই হাউমাউ করে আছড়ে পড়লেন শায়লা। এলোমেলো কথা দিয়ে বলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন যে সাজ্জাদের কোনও দোষ নেই, এই সময় তার কথার মাঝ দিয়ে ধমকে উঠলো সিমিন, “যেমন আব্বার কোনও দোষ ছিলো না ঝুমুর যেদিন আমাদের বাসায় এক রাত থাকসিলো, ওইদিনও, তাই না আম্মা?”
থমকে গেলেন শায়লা। চোখ বড় বড় করে চেয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। অবাক হয়ে বোনের দিকে চেয়েছে সোহেলও। জিজ্ঞেস করলো, “ঝুমুর আপু? সেই তোমার কলেজের ফ্রেন্ড?”
মাথা নেড়ে সায় জানালো সিমিন। চোখ দিয়ে আগুন ঝরছে। সাজ্জাদ স্থানুর মতো বসে আছেন। সোহেল আবার প্রশ্ন করলো, “ঝুমুর আপুর কি হইসে?”
সিমিন জবাব দিলো মা-বাবার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে, “কিছু হয় নাই… হইসিলো… তখনও মিরপুরে আমরা… আমাদের বাসায় একরাত থাকতে আসছিলো… আমার খুব ভাল বন্ধু ছিলো ও…”। পরের কথাগুলো বলতে গলা আটকে এলো ওর। কয়েকবার মুখ হা করেও বলে উঠতে পারলো না। তারপর নিজের সমস্ত মনের জোর একত্র করে বললো, “আব্বার হাতে তখন নতুন মোবাইল… সবার হাতে হাতে তখন এই জিনিস নাই… আব্বা মোবাইলের ভাইব্রেশন দেখাইতে গেসে ওরে… ওর বুকের উপর মোবাইল রেখে…”, আরও কিছু বলার জন্য মুখ খোলা থাকলেও আর আওয়াজ বেরুলো না সিমিনের গলা দিয়ে। চোখ বেয়ে নেমে এলো অবাধ্য অশ্রু।
সোহেলের মুখ হা হয়েই রয়ে গেলো। সাজ্জাদের মাথা নেমে এলো বুকের কাছে। দৃষ্টি মাটিতে। শায়লা বোধহয় আরেকবার চিৎকার করার জন্য মুখ খুলছিলেন কেবলই, সিমিন তখন কথা বললো, “সেদিন রাত্রে কি কান্নাটা যে কানছিলো ঝুমুর!… আমি কতোবার জিজ্ঞেস করসি… কি হইসে… কিছুতেই বলে নাই… এরপর আমার সাথে আর আগের মতো মিশতো না… আমি একদিন জোর করে ওরে চেপে ধরাতে শেষ পর্যন্ত গিয়ে ও আমার কাছে স্বীকার করসিলো যে কি হইসিলো… কিন্তু আমি ওরে সেদিনও বিশ্বাস করতে পারি নাই পুরোপুরি… ওর সাথে আমার সম্পর্কটাই এর পরে নষ্ট হয়ে গেলো… আমি ওর কথা বিশ্বাস করলাম ওইদিন, যেদিন আমরা মিরপুর থেকে পালালাম… তারপরে আর লজ্জায় কোনদিন ওর কাছে মাফ চাইতেও যাইতে পারি নাই আমি…”।
শায়লার গলা দিয়ে ঘড়ঘড় করে আওয়াজ বের হয়ে আসলো, প্রায় গোঙানির মতো করে বলে উঠলেন, “ওই মেয়ে…”, কিন্তু তাঁর কথা শেষ করতে দিলো না সিমিন, “ওই মেয়ে কি, আম্মা?… কি ওই মেয়ে? ওই মেয়ে খারাপ? সব দোষ ওই মেয়ের? তোমার জামাইয়ের কোনও দোষ নাই, এইটাই তো বলবা?… সেই রাত্রে তুমিও দেখসিলা ঘটনাটা, তাই না? ঝুমুর বলছিলো আমারে… তুমি দেখসিলা… আর এখনও তুমি অস্বীকার করেই যাবা যে এই লোকের কোনও দোষ নাই, তাই না?… আমার বাপ যদি চরিত্রহীন হয় আম্মা, তুমি একটা অমানুষ!…”, আর কিছু বলতে পারলো না সিমিন, ভেঙে পড়লো কান্নায়।
সোহেল এতোক্ষণ হতবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো বোনের দিকে, এবার ঘুরে তাকালো মা-বাবার দিকে। চোখ একদম লাল। চাপা গর্জনের মতো হয়ে বেরোলো ওর কথাগুলো, “আম্মা… আল্লাহর ওয়াস্তে মিথ্যা বলাটা বন্ধ করো এবার… আমাদের কাছেও… নিজের কাছেও… আর খবরদার অজ্ঞান হবা না!… কিচ্ছু হয় নাই তোমার… বছরের পর বছর এতোকিছু যখন সহ্য করে আসতে পারসো, আজকের আমাদের কথাগুলিও সহ্য করতে পারবা তুমি… সহ্য করতে হবে তোমার…”।
সাজ্জাদের কানে সব কথাই ঢুকছে, কিন্তু পানির নিচে থাকলে শব্দ যেমন ভোঁতা হয়ে কানে আসে, সেইভাবে আসছে। কানের ভেতর ঝিঁঝিঁ পোকার মতো আওয়াজ হয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে ক্রমাগত। মাথা ঝিম ঝিম করছে। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা। কিছু একটা যেন তাঁর মনে আসি আসি করে আসছে না। ওদের কথা শুনতে শুনতেই তিনি ডুবে গেলেন সেই কথাটা মনে করার চেষ্টায়।
চোখ ভর্তি পানি নিয়ে ছেলের দিকে অসহায় হয়ে চেয়ে রইলেন শায়লা। তাঁর সমস্ত কলাকৌশল আজকে অকেজো। হাত-পা বাঁধা পড়ে গেছে তাঁর।
সোহেল বলতে থাকলো, “মিরপুর থেকে আসার আগে বাসার সামনে খেলার সময় ওই পাড়ার ছেলেগুলো আমারে কি বলছিলো আমি তোমারে বাসায় এসে বলছিলাম না আম্মা? তুমি বলছিলা আব্বারে? তুমি বলছিলা তারে যে ওরা কি ভাষায় কথা বলে আমার কলার ধরে আমারে চড় মেরে চলে গেসলো? বলো নাই, তাই না? … আমি তোমারে এসে বলছিলাম যে ওই মহিলা… ওই মাইশার সাথে আব্বার সম্পর্ক চলে… তুমি কি বলছিলা? বলছিলা যে আমি ছেলে হয়ে বাপের নামে এগুলা কেমনে বলি… মনে আছে? যতোবার, যতো কিছু এসে আমি আর আপু তোমারে বলার চেষ্টা করসি… তুমি তার কিছুই কি কানে নিসো আম্মা?… কারে রক্ষা করসো তুমি? আমারে আর আপুরে তো রক্ষা করতে পারো নাই!… করতে চাওও নাই… তুমি শুধু বাঁচাইতে চাইসো তোমার স্বামীরে… পারসো? তুমি তার সম্মান রক্ষা করার চেষ্টা করসো কিন্তু তারে এইটুকু বুঝতে দাও নাই যে তার কারণে আমরা প্রতি পদে পদে প্রতিটা জায়গায় কি পরিমাণ অসম্মানিত… ক্যান আম্মা? আমরা কি তোমার কেউ ছিলাম না? আমাদের মান সম্মান থাকতে নাই? সন্তান বলে তোমাদের সমস্ত কিছু আমাদের জন্য জায়েজ?… সব কিছু এই একটা লোকই তোমার জন্য? … পাড়ায়, প্রতিবেশীদের সামনে… আত্মীয়স্বজন সবার সামনে… আপুর শ্বশুরবাড়িতে… সমস্ত জায়গায় লোকে হাসছে আমাদের উপর, ছি ছি করসে!… কোনদিন কিচ্ছু আসছে গেছে তাইতে তোমার?… আর যার জন্য এতো কিছু… সে নিজে কি বিন্দুমাত্র দাম দিসে তোমারে?… নিজের সম্মান নিজে রক্ষার জন্য কি করসে সে?”
হাঁপাতে হাঁপাতে থেমে গেলো সোহেল। ওর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে রীতিমতো। অনেকদিনের গুছিয়ে রাখা কথাগুলিও এখন আর গুছিয়ে বলতে পারছে না ও। ক্ষোভ, আক্ষেপ, কষ্ট এসে গলা চেপে ধরছে। শায়লা চিৎকার করে উঠলেন, “কি করতাম তাহলে আমি? কি করতে পারতাম? তালাক করতাম? ব্রোকেন ফ্যামিলির ছেলেমেয়ে হয়ে বড় হইতি তোরা? সেইটা ভালো হইতো?”
জবাব নিয়ে বসেই ছিলো যেন সিমিন, শায়লার চাইতেও জোরে চেঁচিয়ে বলে উঠলো, “এই সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসতে পারতা তুমি আম্মা!… আমাদের নিয়ে আলাদা হয়ে গিয়ে আমাদের একটা সুস্থ জীবন দিতে পারতা তুমি!… কম খাইতাম!… কম পরতাম!… কিন্তু আমরা অন্তত জানতাম যে এই চরিত্রের জন্য এর সাথে সম্পর্ক রাখি নাই আমরা… একটা সাধারণ সম্মানের জীবন পাইতাম! ইজ্জত থাকতো!… মাথা উঁচু করে বলতে পারতাম আমরা অন্যায়ের সাথে কম্প্রোমাইজ করি নাই!… অন্যায়কারীর সাথে সম্পর্ক রাখি নাই!!!”
ফ্যালফ্যাল করে মেয়ের দিকে চাইলেন শায়লা। উত্তর জোগালো না মুখে। সিমিন বলতে থাকলো, “আসলে আম্মা তুমি তারে প্রোটেক্ট করো নাই… করসো তোমার নিজেরে… টানাহ্যাঁচড়া করে… জোর করে একটা নষ্ট হয়ে যাওয়া সম্পর্ক টিকায় রাখসো কারণ তুমি নিজের কাছে নিজে স্বীকার করতে চাও নাই যে এটা শেষ!… তুমি নিজেরে নিজে লজ্জার হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করসো… হাজার বার তোমারে বলা হইসে তুমি নিজে কিছু করো!… শুনো নাই তুমি… কারণ বাইরে লোকের সামনে গেলে যদি তোমার তোমার স্বামীর নামে কথা শুনতে হয়!… ওই একটু আগে সোহেল বললো না! যে বাসায় কাউরে আসতেও বলতে চাও না তুমি! কারণ তুমি নিজেও জানো যে সবাই সব কিছু জানে… পাছে তারা এসে কিছু বলে তোমারে!… সেইজন্য তুমি কাউরে বাসায় আসতে বলতেও চাও না!… তুমি নিজেরে প্রোটেক্ট করসো আম্মা!… কিন্তু একবারের জন্যেও আমাদের কথা ভাবো নাই… আমরা কি করে খাবো? দুনিয়ায় কিভাবে চলবো? লোকের সামনে কিভাবে যাবো? কিচ্ছু ভাবো নাই তুমি!…”
শায়লার দিকে চাইলেন সাজ্জাদ। চোখে পানি আর আগুন নিয়ে শায়লা তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি তাকাতেই ঝাঁপিয়ে এসে পড়লেন শায়লা তাঁর উপর। এলোপাথাড়ি কিল, ঘুষি মারতে মারতে চিৎকার করে বলে যেতে লাগলো অবোধ্য সমস্ত কথা, “আমি বলি নাই তোমারে?… বলি নাই শুধরাইতে?… বলি নাই এইসব ছেড়ে দাও?… ছেলেমেয়ে বড় হইতেসে!… বলি নাই?… কি করি নাই তোমার জন্য?… আমার বাপ কি করে নাই? আমার ভাই কি করে নাই?… কি দিতে বাকি রাখসে?… কি করতে বাকি রাখসি আমি তোমার জন্য? আজকে আমারে কথা শুনায় কেন তোমার ছেলেমেয়ে?… তোমার মা আমারে বলে আমি ব্যক্তিত্বহীন!… তোমার প্রেমিকাদের ডাকো!… শুনে যাক আমার বাচ্চাকাচ্চা আমারে আজকে কি ভাষায় কি বলে!… সব দোষ আমার?… ডাকো ওদের? আরও লাগবে?… আরও করবা? … আর কতো করবা???… আআআহ… আহাহাহাহাহা…”, হাউ হাউ করে কাঁদছেন শায়লা, কেউ থামাতে আসলো না তাঁকে, না সোহেল, না সিমিন।
ক্লান্ত হয়ে সাজ্জাদের কাঁধ আঁকড়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন শায়লা। সাজ্জাদ পাথর হয়ে বসে। সোহেল বললো, “সেই শিরিনরে তুমি যখন ঘর থেকে বের করে দিলা আম্মা, শিরিন আব্বার নামে তোমার কাছে বলছিলো বলে, তুমি এসে আমারে একটা কথা বলছিলা, মনে পড়ে? তোমার ঘরে অবিবাহিত জোয়ান ছেলে… তারে নিয়ে কিছু বললেও তুমি নাকি মেনে নিতা!… তাই আম্মা? তুমি কি বুঝে বলছিলা যা বলছো?… আমার চরিত্র খারাপ হইলেও তুমি মেনে নিতা? সত্যি?… তাই কি চাইসিলা? আমিও আমার বাপের মতো হই?…”
শায়লা আহাজারি করতে করতে বলে উঠলেন, “চুপ কর সোহেল!… চুপ কর!… আমি আর সহ্য করতে পারতিসি না!… আমি আর নিতে পারতিসি নাআআআআ!…”
আবার গর্জে উঠলো সোহেল, “নিতে হবে তোমারে আম্মা!… নিতেই হবে!… আমারে সহ্য করতে হয় রোজ!… আপুরে সহ্য করতে হয়!… রাস্তায় বাইর হইলে পোলাপান টোন কাটে আমারে দেখলে!… ওই দোকানদার মাসুম আমারে বলে যে ভালো ঘরের মেয়েরা আমার সাথে কথা বলতে ভয় পায়! পাছে আমিও আমার বাপের মতো ওদের উপর ঝাঁপায় পড়ি!… বাড়িওয়ালা আমার হাতে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেয় কারণ আমার বাপের প্রেমিকা ঘরে এসে সবার সামনে চিল্লাফাল্লা করে গেসে!… আপুরে আপুর কলিগ ডেকে ওর বাপের ভিডিও দেখায়!!!…” কথা আটকে গেলো ওর। সোফার হাতলে ধাম ধাম করে ডান হাত মুঠো করে একের পর এক কিল দিতে দিতে এবার চিৎকার করে বলতে লাগলো সোহেল, “নিজের বাপরে নিয়ে বাইরের মানুষের কাছে জঘন্য সমস্ত কথা শুনতে কেমন লাগে আম্মা তুমি জানো? তুমি কিচ্ছু জানো না!… কিচ্ছু জানো না তুমি!… বাপ-মায়ের নামে কেউ কিছু বললে খুন করে ফেলতে দুইবার ভাবে না কেউ… কিন্তু দোষ যখন থাকে বাপ-মায়ের সত্যি সত্যি? নিজেরে কেউ কিছু বললে কিসসু যায় আসে না আম্মা!… কিন্তু বাপ-মায়েরে বললে কলিজা এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যায়… আরও হাজার বার মরতে হয় যখন প্রতিবাদ করার উপায় না থাকে!… তোমার বাপরে কেউ কোনদিন লুইচ্চা বলে নাই মুখের উপর… বলে নাই যে মেয়েমানুষ দেখলেই তোর বাপের সুড়সুড় করে!…”, আরও কিছু বলতে গিয়েও আবার আটকে গেলো সোহেলের কথা। কিন্তু দ্রুত সামলে নিয়ে সোহেল আবার বলে উঠলো, “নাকি বলছে আম্মা? আমাদের দাদার চরিত্র তো সুবিধার ছিলো না সেটা জানি, কিন্তু আমাদের নানা, মানে তোমার বাপেরও কি চরিত্র খারাপ ছিলো?”
“সোহেল!!!” প্রচন্ড চিৎকার দিয়ে ঘুরে ছেলের দিকে তাকালেন শায়লা। পরমুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে গেলেন। ঘোলা দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন সাজ্জাদও। মুখের রঙ কষ্টে বেগুনী হয়ে গেছে। সোহেলের ঠোঁটে নিষ্ঠুর হাসি, চোখে পানি। পিতা সম্পর্কে এমন বিশ্রী কথা নিজের সন্তানের মুখে একবারের জন্য শুনেই শায়লার যে প্রচন্ড উপলব্ধি হলো, উনি সামলাতে পারলেন না, এলিয়ে পড়লেন সোফাতে। জ্ঞান হারান নি, কিন্তু মানসিক শেষ শক্তিটুকু জবাব দিয়েছে তাঁর। সাজ্জাদের হাত তখনও আঁকড়ে ছিলেন, শরীরের ভর ছেড়ে দেয়াতে সাজ্জাদ উনার দিকে কাত হয়ে গেলেন, কিন্তু হাত ছাড়ানোর কোনও চেষ্টা দেখা গেলো না তাঁর ভেতর। সোজা হয়েও বসলেন না, কাত হয়েই রইলেন। তাঁর চোখে কোনও ভাষা নেই। উনি সজ্ঞানে আছেন নাকি নেই, সেটাও বোঝা গেলো না।
কতোটা সময় চলে গেছে এই ৪ জন জানে না। কোনও কথা ছাড়া মূর্তির মতো এরা বসেই রইলো একে অন্যের উপস্থিতির সাক্ষী হয়ে। বিষাক্ত বাতাস ঘরের ভেতর পাক খাচ্ছে। অন্য ঘরে জামিল কান থেকে ইয়ারফোনটা কিছুক্ষণের জন্য নামিয়েছিলো। শেষের কয়েকটা কথা শোনার পর স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলো সেও। নিস্তব্ধতাটা কানে আসতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার কানে গুঁজে দিলো ইয়ারফোন। এই ৪ জনের ব্যক্তিগত সময়ে নিজের প্রবেশাধিকার রোধ করলো যেন। হাতটা নিয়ে রাখলো ঘুমন্ত মেয়ের মাথার উপর।
দীর্ঘ সময় পরে শায়লা খুব ধীরে ধীরে বললেন, “আজকে এই জন্য আসছিস তোরা? মা-বাপের বিচার করতে? বিচার হইসে? কি শাস্তি দিবি?”
বিদ্রূপের হাসিতে ঠোঁট বাঁকালো সোহেল, “শাস্তি তো আমি আর আপু পাচ্ছি জন্ম থেকে!… তোমাদের কি শাস্তি দিবো? মা-বাপের ভুল বা অপরাধ ধরতে যাওয়াটাই তো আমাদের অপরাধ… মাঝে মাঝে মনে হয় আমরাও যদি তোমাদের মতো হইতাম… ভালো হতো… এগুলা ডিল করতে সুবিধা হইতো… ধরো এক মেয়ের রুম থেকে আব্বা বাইর হইতো তারপরে আমি ঢুকতাম!… অথবা আমি বের হইলে আব্বা!… আব্বার উপযুক্ত ছেলে হইতে পারতাম বোধহয় তাইলে…”
গলা ভেঙে গেছে শায়লার, প্রায় ফিসফিস করে বললেন, “মাফ কর সোহেল!… মাফ কর আমারে!… আর বলিস না… আল্লাহর দোহাই লাগে আর বলিস না!…”
হাসতে হাসতে ব্যঙ্গ ছুঁড়ে দিলো সোহেল, “এতো অবাক হচ্ছো ক্যান আম্মা? তুমি কি ভাবতেসো এই রকম হয় নাই?… হইসে তো!… ভার্সিটিতে আমার সাথে পড়তো দীপ্তি… খুব পছন্দ করতাম ওরে… তোমার ছেলের বউ বানাবো ভাবসিলাম… তুমি জানো আব্বা কি করসে?… ওরে বলছে যে ওর গলার তিল নাকি খুব সেক্সি!… হাহাহাহা… কি মজা না আম্মা? আমরা বাপ-ব্যাটা দুইজনেই…”, হোহো করে উন্মাদের মতো হাসতে লাগলো সোহেল।
সাজ্জাদ মুখ তুলে তাকালেন ছেলের দিকে। এই প্রথম তাঁর চেহারায় তীব্র গ্লানি দেখা গেলো। নির্লিপ্ততা ছিঁড়ে এই প্রথমবার অভিব্যক্তি ফুটলো চোখে। কিছু বলার চেষ্টা করলেন, ঠোঁট কেঁপে উঠলো, স্বর ফুটলো না।
শায়লা বিড়বিড় করে বলছেন তখন, “ওই এক ভিডিও… একটা ভিডিও সব শেষ করে দিলো!… ওই মাইশা!… কই তোরা এই সময়ে বাপ-মা’র পাশে থাকবি… তা না করে আজকে বাপ-মায়েরেই কাঠগড়ায় তুলছিস!”
সিমিন মুখ খুললো এবার, কন্ঠ শান্ত “আমরা সারাজীবনই তোমাদের পাশেই ছিলাম আম্মা!… আফসোস এইটাই যে আমাদের কষ্টে আমরা তোমাদের পাশে পাই নাই কোনদিন!… আমাদের কথা ভাবলে আব্বা কোনদিনও এই সমস্ত কাজ করতে পারতো না… তুমি কোনদিনও সব সহ্য করে তারে আঁকড়ায় ধরে থাকতা না… ওই ভিডিও কিছুই শেষ করে নাই আম্মা!… তোমার কি ধারণা ওই ভিডিও দেখে আমরা প্রথম জানতে পারসি আব্বা সম্পর্কে? ভুল… আব্বা যা যা করসে… তার সবই কোনও না কোনভাবে আমাদের কান পর্যন্ত ঠিকই পৌঁছাইসে আম্মা! কিছুই আড়ালে থাকে নাই… গাজীপুরে রিসোর্টে গেলো! জামিলের চাচাতো ভাই দেখলো!… কোনও এক মহিলা ছিলো সাথে, কে সেটা আর রাফি মানে আমার দেবর, চিনে নাই… রাতারগুল গেলো!… দেখলো আমার কলিগ, বনি… ও তখন হানিমুনে… সে আবার আব্বারে চিনে নাই… চিনছে মাইশাকে… মাইশা তার কেমন দুরসম্পর্কের চাচী হয়… তখন মাইশার হাজবেন্ড অলরেডি মারা গেছে, কাজেই বনির কাছে তেমন অস্বাভাবিক লাগে নাই তার সাথে অন্য পুরুষমানুষ দেখে, কিন্তু মাইশা নতুন বিয়ে করসে কিনা সেটা জিজ্ঞেস করাতে ওই মহিলার মুখের ভাব দেখে ওর সন্দেহ হয়… বনি ছবি তুলে নিয়ে আসছিলো মাইশা আর আব্বার সাথে… হানিমুনের গল্প করতে করতে আমাকে সেই ছবি দেখাইসে… আমি আর মুখ ফুটে বলতে পারি নাই যে সেই লোক কে!…”
শায়লা প্রায় শোনা যায় না এমন ভাবে বললেন, “আমারে তো বলিস নাই!”
জবাব দিলো সোহেল, এলিয়ে পড়ে আছে ও এখন সোফার উপরে, “বলে কি হইতো আম্মা? তুমি তো সেই একই কথা বলতা!… সব ওই মহিলাদের দোষ!… আমাদের আব্বার কোনও দোষ থাকতেই পারে না!… তারপর আব্বা বাসায় ফিরলে আব্বার সাথে অশান্তি করে কান্নাকাটি করে আবার আমাদের বলতা…”, কথার মাঝেই কথা থামিয়ে দিলো সোহেল, আর কি বলার আছে ওর?
ভাঙা গলায় সিমিন আবার বলতে শুরু করলো, “বার বার! বার বার আব্বা একই কাজ করেই গেছে করেই গেছে!… সে ভাবে মেয়েরা তো সব ভয় পায়!… এসব কথা কাউরে বলবে না!… এবার? এবার কি হলো, দ্যাখো! কতো আর ভয় দেখায় চুপ করায় রাখা যায়? কতো ভয় আর পাবে মেয়েরা? আর এবারের কথা নাহলে ছেড়ে দিলাম… মানুষ হুজুগে পড়ে চিল্লাচিল্লি করতেসে… দুইদিন পরে নতুন ইস্যু পেলে এটা ভুলেও যাবে… কিন্তু আব্বা কি শোধরাবে? তার কাজ থামবে?… আম্মা কিভাবে এতো কিছু সহ্য করো আমি জানি না… আর সত্যি বলতে জানার আগ্রহও আমার নাই… কিন্তু সোহেল-আমার একটা জীবন আছে… সমাজে আমাদেরও চলতে হয়… হ্যাঁ, আমার শ্বশুরবাড়ির লোক ভালো… কিন্তু তাই বলে তো সবার মুখ আমি বন্ধ করতে পারি না! … একটা চাকরী করি… সেখানে রেপুটেশনের একটা ব্যাপার আছে… আব্বা বিয়ে করতো!… তোমারে ছেড়ে গিয়ে আরেকটা বিয়ে করতো!… সেটাও না টিকলে আরও একটা করতো… লিভ-ইন করলেও করতো! তাও একজনের সাথে থাকতো! মাইশারে ভালো লাগসিলো তারে নিয়ে থাকতো!… কিন্তু পরিবার থাকা স্বত্তেও… পরকীয়া!… হাজারে হাজারে মেয়েদের সাথে ফোন, টেক্সট, চ্যাট! উহ!…”, দুই হাতে নিজের মাথার চুল খামচে ধরলো সিমিন। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত সময় নিয়ে সিমিন আবার বলতে লাগলো, “আব্বার যে দোষ… অনেক অনেক পুরুষ মানুষই এই দোষে দোষী… শুধু পুরুষ না, অনেক মেয়েরাও আছে… এরা কি ভেবে এই রকম কাজ করে আমার জানা নাই… পরিবার-পরিজন-আত্মীয়-স্বজন… কারও কথা কি একবারের জন্যও ভাবে কিনা আল্লাহ জানেন… আর তাদের পরিবারই বা তাদের চরিত্রের স্খলণ কিভাবে প্রশ্রয় দেয় তাও আমি জানি না… জানি না কেন বলবো? নিজের আম্মারেই তো দেখলাম!… কিন্তু আমার ধৈর্য্য আর সহ্যের সীমা শেষ… আমার পক্ষে আর সম্ভব না…”, কান্নায় বুজে গেলো সিমিনের গলা।
সোহেল তুলে নিলো বোনের ফেলে রাখা কথার সূতো, কথা বলতে গিয়ে ওর হার্টবিট যেন ঠোঁটের ডগায় চলে এসেছে, প্রতিটা কথার সাথে ফোঁপাচ্ছে ও, নিচু গলায় নিজের মনেই প্রলাপ বকার মতো করে বলতে লাগলো, “আমিও আর পারবো না… আমারে মাফ করে দাও আম্মা… দরকার লাগলে ডাক দিও… আসবো… কিন্তু আমি আর নিতে পারতিসি না… আমি আর এই বাসায় থাকতে পারবো না… আমি আর তোমাদের সাথে থাকতে পারবো না… তোমাদের যা খুশি করো… আমি দেখতেও আসবো না… জানতেও চাই না!… আমারে একটু বাঁচতে দাও… চরিত্রহীনের সন্তানের পরিচয় নিয়ে আমি আর বাঁচতে চাই না আম্মা!… আমারে মুক্তি দাও… মাফ করে দাও আমারে…মাফ করে দাও এইবার…”।
বিধ্বস্ত শায়লা চুপ করে বসে রইলেন ছেলে-মেয়ের দিকে শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে। একটা আঙুল তোলার শক্তিও আর পাচ্ছেন না তিনি। একটা শব্দও বলার মতো নেই তাঁর আর।
বিমর্ষ এক চক্রে পাক খাচ্ছে ৪ জন। একে অন্যের থেকে মুক্তি পেতে একে অন্যের সামনেই মাথা খুঁড়ে মরছে। তবু চাইলেও কেউ কাউকে অস্বীকার করতে পারছে না। সম্পর্ক থেকে মুক্তি খোঁজার মধ্যেই রয়ে গেছে তাঁদের সম্পর্কের স্বীকারোক্তি।
***
সাজ্জাদের হুট করেই মনে পড়লো যা এতোটা সময় ধরে মনে করার চেষ্টা করছিলেন তিনি। এতো সমস্ত কথার মধ্যেও হাতড়ে হাতড়ে ফিরছিলেন যা মনে করার জন্য। স্পষ্টভাবে কানে বেজে উঠলো তাঁর শ্বশুরের কথাগুলো, “পারলে নিজেকে শোধরায় নিও… তা না হলে জীবনে কোনও একদিন এমন কোনও পরিস্থিতি বা প্রশ্নের সামনে না পড়তে হয় যেখানে তোমার সেই পরিস্থিতির চাইতে বা প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চাইতে মৃত্যু শ্রেয় বলে মনে হবে!… সুন্দরী-শিক্ষিতা বউ আছে তোমার… দুইটা ফুটফুটে বাচ্চা আছে!… টাকাপয়সার অভাব নেই… পরিবারের তেমন কোনও ঝুটঝামেলা নেই… তোমার জীবনটা কিন্তু অতোটাও খারাপ না, তাই না? যে তোমাকে বাইরে বাইরে সুখ খুঁজতে যেতে হবে!… সন্তানের সাথে এই সময়গুলো হেলায় হারায়ো না!”
নিজের মনে নিজেকে প্রশ্ন করলেন তিনি, আজকেই কি সেই দিন? এই দিনটা কি দেখতে পেয়েছিলেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ঝানু ব্যবসায়ী, তাঁর শ্বশুর? সেজন্যই কি বলেছিলেন কথাগুলো?
পর মুহূর্তেই তাঁর চোখের সামনে থেকে শ্বশুরের চেহারাটা মুছে গিয়ে ভেসে উঠলো আরেকটা দৃশ্য।
সিমিনের তখন কয়েক মাস বয়স। কি গুবলু গাবলূ একটা বাচ্চা ছিলো তাঁর মেয়েটা! ওরা তখনও নানা বাড়িতেই থাকে। উনি সেখানে গিয়ে দেখেন সিমিন খুব কাঁদছে। কেউ থামাতে পারছে না। উনি গিয়ে কোলে তুলে নিলেন। সিমিন তাঁকে চেনে, কিন্তু বাসার বাকিদের মতো নিয়মিত দেখে না বলে তাঁর কোলে গিয়ে কেমন একটু অবাক হয়ে চেয়ে রইলো তাঁর দিকে কান্না ভুলে। কেবল ঘাড় শক্ত হয়েছে মেয়ের, টলমল করে তবু তখনও, কেমন চমকে চমকে ঘাড় ফেরায় সে। বাপের চোখ, ভুরু, কান, নাক, সব এক এক করে দেখছিলো। সাদা একটা সুতির জামা পরা, দুই হাতে ওর নানীর দেয়া দু’টো স্বর্ণের চুড়ি ছোট্ট ছোট্ট। চোখে কালো কাজল দেয়া ছিলো, কান্নার চোটে ছড়িয়ে গেছে। কপালের এক কোণে বড় কাজলের টিপ। কালো কালো বড় বড় চোখ দু’টো দিয়ে দেখছিলো তাঁকে। তারপর ডান হাতের ৫টা আঙুল ছড়িয়ে খপ করে ধরে ফেললো তাঁর নাক। তারপর মেয়ের কি হাসি! উপস্থিত সবাই হেসে ফেলেছিল খিলখিলিয়ে সেই হাসির শব্দে।
মনে পড়ছে তাঁর, সোহেল হাঁটতে বেশ সময় নিয়েছিলো ছোটবেলায়, অন্য বাচ্চাদের চাইতে একটু দেরিতে হাঁটতে শিখেছিলো তাঁর ছেলে। আতিফ, সোহেলের বড় মামা একদিন সোহেলের দুই হাত নিজের দুই হাতে ধরে হাঁটা শেখাতে শেখাতে সাজ্জাদকে দেখতে পেয়ে বলেছিলেন, “এই নাও… ধরো তোমার ছেলের হাত… হাঁটা শেখাও…”। সোহেল আতিফের দিকে মুখ করে ছিলো তখন, তাঁর দিকে ছিলো ওর পিঠ। ওর পেছন দিক থেকেই ঝুঁকে এসে দুই হাত ধরেছিলেন, সোহেল চলে গিয়েছিলো তাঁর দুই পায়ের ফাঁকে। ছোট্ট ছোট্ট দুই হাতে মুঠো করে ধরেছিলো তাঁর দুই হাতের তর্জনী, তারপর কাঁপা কাঁপা পায়ে দুই পা হেঁটে সে কি হাসি ছেলের!
উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন সাজ্জাদ! আছে! তাঁরও আছে স্মৃতি! জামিলের সাথে এবার তিনিও পাল্লা দিতে পারবেন! কিছুটা তো আছে!
স্মৃতির ছবিগুলো চোখের সামনে থেকে ধোঁয়ার মতো আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে সাজ্জাদের। সোহেল আর সিমিনের সেই হাসির শব্দটা একাকার হয়ে যাচ্ছে ওদের কান্নার আর প্রলাপের শব্দে মিশে।
সাজ্জাদ ভেবেই যাচ্ছেন, আরেক বার!… আরেকটা বার…?
সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here