দাম্পত্য সুখ(২য় পর্ব)

0
217

#দাম্পত্য সুখ(২য় পর্ব)
#লাকি রশীদ

অনেক কষ্ট করেও চুপ থাকতে পারলাম না তাই হেসে বলি, “আমার না বুড়ো বুড়ি দের ন্যাকামো দেখলে খুব এলার্জি হয় শাহীন। টিনএজারদের যা মানায় সেটা কিন্তু বুড়ো বুড়িদের মানায় না। কিন্তু, আফসোস !!! এটা অনেকেই বুঝতে পারে না”। শাহীনের মুখ পলকেই লাল, চিবিয়ে চিবিয়ে বলছে,”কি বলতে চাও, বুঝতে পারছি না”।এখানে
ন্যাকামো টা করলো কে”? আমি বলি,”না বুঝলে তো ভালোই, ল্যাঠা চুকে গেল”। সে এবার কঠিন স্বরে বলে,”আমার সাথে হেয়ালি করবে না নদী।যা
বলার স্পষ্ট করে বলো”।

আমি এবার শ্লেষের সুরে বলি,” ৬০ বছরের একজন মহিলা, অনবরত মানুষের খুঁত বের করে
যাচ্ছেন,কারো শরীর মোটা,কারো স্কীন তেমন গ্লো
করছে না….:এটা কি? ১০ বছরের ছোট ভাইদের সামনে লাস্যময়ী ভঙ্গিতে, মাথা, শরীর আর চুল
দুলিয়ে দুলিয়ে বলছেন,”দেখো না, দেশে এসে কতো ফ্যাট জমে গেছে”। ফ্যাট জমে গেছে, তো ভাইয়েরা কি করবে? নাকি তিনি মনে করেন, তুমি ফ্যাটে হাত বূলালেই ফ্যাট ঝরে যাবে”?

শাহীন এবার মেজাজ কন্ট্রোলে রাখতে পারে না,
“নদী এবার কিন্তু বেশি বেশি হচ্ছে। মনে এতো ময়লা নিয়ে থাকো ক্যামনে”? আমি হেসে বলি,”এটা কিন্তু খুব ভালো বলেছো। আমার মা প্রায়ই একটি কথা বলেন,”খারাপ কাজ যে করলো তার লজ্জা নেই,আর যে জন দেখেছে তাকে বকছে লজ্জা নেই বলে”। তুমি ময়লার কাজ করলে এখন আমাকে বলছো, আমার মনে ময়লা” !!! উনি তো তোমার সামনে ই তোমার বৌকে বলছেন,”চেহারা গ্লো করছে না। তুমি সেটার উত্তর না দিয়ে, উনাকে বলছো আপনার স্কীনে তো মাছি বসলেও পিছলে যাবে। মাছি বসবে কেন? তোমার হাতটা উনার গালে দিয়ে দেখতে, পিছলে যায় কি না। তোমার এই অবস্থা দেখে তোমার বোনও বলছে,”দেখো ভাইয়া কেমন গলে গলে পড়ছে। ছিঃ! ছিঃ! ৫০/৬০ বছর বয়সী
নারী পুরুষেরা এমন নির্লজ্জতা করে কি ভাবে?
বয়সেরও তো একটা লেহাজ আছে”।

শাহীন এবার হিসহিসিয়ে বলছে,”তোমরা মেয়েরা
এতো হিংসুটে, তোমাদের মন এতো ছোট, বলার মতো না”। ততোক্ষণে গাড়ি বাসার সামনে দাঁড়িয়ে গেছে। আমি বলি,”হ্যা তাই, তবে একটা কথা মনে রেখো,এ বয়সে এতো চাপ শরীর,মন কোনোটাই নিতে পারবে না। নেমে যাই”। তাকিয়ে দেখি, চোখ দিয়ে ভস্ম করা গেলে, সে তাই করতো। আমি হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে বলি,”হারামী,লোভী পুরুষ
মানুষ” !!!

রাত বাজে এগারোটা, ঘরে ঢুকে দেখি, এরা সবাই মাত্র খেতে বসেছে। আমি বলি,”কি ব্যাপার? এতো দেরি তে খাচ্ছ কেন তোমরা”? বন্যা বলছে,
“দাদু বললো আরেকটু দেখি,তোর মা এলে না হয়
সবকিছু গরম করে দিবে”। আমি হতবাক,রাইস কুকারে ভাত রেঁধে গেছি, আমি WARM এ দিয়ে রেখেছি যাতে ঠান্ডা না হয়। তরকারি গুলো বাটি
তে রাখা…. মাইক্রোওয়েভ এ সামান্য গরম করে
নিলেই কাজ শেষ। আমার শাশুড়ির তাও মনে হচ্ছে,বৌ এই কাজ থেকে ই বা রেহাই পাবে কেন?
এরা আমাকে ভাবে কি? আড়চোখে দেখি শাহীন
গাড়ি গ্যারেজে রেখে ভেতরে ঢুকছে। আমি এই সুযোগে শাহীনের সামনে ওর মার এসব কূটনীতি
বলতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু, কোথায় যেন বিবেক বাঁধা দিল। তাই,আর কিছু না বলে রুমে ঢুকে পড়ি।

শাওয়ার নিয়ে আসতে ই শাহীন বলে,”এসে ই তুমি
ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লে যে? আমারো তো প্রয়োজন থাকতে পারে। একবার জিজ্ঞেস করবে না? আশ্চর্য্য” !!! হেসে বলি,”আমি তো আর প্রতি
দিন ওয়াশরুম দখল করে বসে থাকি না। একদিন না হয়, কষ্ট করে অপেক্ষা করলে, আমি তো সব সময় করি তা, অসুবিধা টা কি”? শাহীন এবার নিশ্চুপ। ডাইনিং স্পেসে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না, কিন্তু না গেলে বুঝা যাবে না, ওখানে টেবিলের অবস্থা কি? গিয়ে দেখি পরিপাটি টেবিল ও তরকারির বাটিও ফ্রিজে ঢুকানো। খুশি খুশি পায়ে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ি। বুদ্ধি করে এশার নামাজ পড়ে গিয়েছিলাম,নয়তো এখন অলসতায় ধরতো। কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়েছি, আবেশে চোখ লাগবে লাগবে, হঠাৎ বুঝি শাহীন জড়িয়ে ধরে বলছে,”ফিরো এদিকে, কথা আছে”। ঘুম ঘুম চোখে বলি,”কাল কথা হবে, এখন ঘুমাও তো”।

পরদিন বৃহস্পতিবার ছিল, সকালে উঠে ই দেখি
প্রচন্ড মাথা ব্যথা ও বমি বমি ভাব। কোনো মতে নাস্তা রেডি করে, টেবিলে দিয়েছি। রাফি বন্যাকে
স্কুলে দিয়ে এসেছে। ওরা নাস্তা করছে, আমি টলতে টলতে কোনো মতে ওয়াশরুমে ঢুকতেই বমি শুরু হয়েছে। শব্দ পেয়ে শাহীন এসেছে,পেইন
কিলার দুটো খেয়ে, শুয়ে পড়ি। লম্বা এক ঘুম দিয়ে উঠে দেখি,বেলা দশটা বাজে। তার মানে,২
ঘন্টা ঘুমানোয় শরীর টা ঝরঝরে লাগছে। বের হতে ই দেখি, আমার শাশুড়ি বুয়াকে দিকে বাসন ধোয়াচ্ছেন। আমাকে দেখে বললেন,”তুমি আবার উঠে এলে কেন? খিদে পেয়েছে”? আমি বলি,”না,
শুধু শুধু শুয়ে থাকবো কেন? মাথা ব্যথা টা এখন আর নেই মা। রান্না টা শেষ করে ফেলি”।

উনি কেমন সন্দেহের চোখে চেয়ে বললেন,”মাথা ঘুরালে চুলার কাছাকাছি যাওয়ার দরকার নেই বৌমা। কি থেকে কি হয় আবার।এ সময়ে সাবধান
থাকতে হয়”। আমি হাসবো না কাঁদবো ভাবছি, বলি,”আমার প্রচন্ড মাথা ব্যথা থাকায়, বমি এসেছে মা। অন্যকিছু না”। উনি ভ্রু কুঁচকে বলেন,
“তুমি সিওর অন্যকিছু না”? আমি বলি,”হ্যা মা সিওর”। মুহুর্তেই মুখ কালো করে বলেন,”ধ্যাত,
আমি আরও কতো খুশি হয়েছিলাম”। পায়ে পায়ে হেঁটে সোজা উনার রুমে।

ছুটা বুয়া হাসছে আর বলছে,” খালাম্মা কত্তো খুশি হইয়া, আফনের ননদ, আফনের আম্মা হক্কল রে ফোন দিয়ে কইছে,আফনের বাইচ্চা অইবো। এখন আফনে আইস্যা তার সব আশা ভাইঙ্গা ফেলাইছেন”। আমি ধমক দিয়ে বলি,”চুপ করে কাজ করো তো। বেশি কথা বলো তুমি”।

চিকেন আর মাছ, দুই চুলায় দুই তরকারি বসাতে ই মায়ের ফোন,”কি রে বমি কমেছে”? আমি এই প্রসঙ্গে কথা বলতে ই অস্বস্তিবোধ করছি। কিন্তু, মা ছাড়লে তো। বলি,”শোনো মা এসব আমার শাশুড়ির কথা !!! ৩ টা বাচ্চা নিয়ে ই রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছি। মাথা ব্যথা থাকায় বমি হয়েছে, আর কিছু না। দয়া করে আবার বাবাকে বলতে যেও না”। একটু পরে আমার ননদের ফোন,”এই
ভাবী, মাথায় দোষ ধরছে,কি করছো এটা”? আমি বলি,”আরে ভাই,এসব কিছু না। এসব মায়ের মনগড়া কথা”। ফোন রেখে বিরক্ত লাগছে, কি যে এক অবস্থা !!! ভদ্রমহিলার তিন তিনটা নাতি নাতনি ঘরে মজুত, তবুও ভালো মতো না জেনে সারা শহর ঢাক ঢোল পিটাচ্ছেন।

শুক্রবার নামাজ থেকে এসে খেয়ে, সারা দিন শাহীন ঘুমিয়ে কাটালো। সন্ধ্যার পর আলমারি খুলে আমি আগামীকাল গেট টুগেদার এ যাবার
শাড়ি সিলেক্ট করছি। শাহীন চা খেয়ে খবরের কাগজ পড়ছে। হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,”কি করো”? বললাম,”কালকে কোন শাড়ি পরবো, সেটা দেখছি”। সাথে সাথে ই চিৎকার করে বিছানা থেকে নামল,”মানে? বললাম না রিয়াদের সাথে মাছ ধরতে যাবো। একটা দিন কনসিডার করো”‌। আমি শান্ত স্বরে বলি,”একটু মনে করে দেখো, সেদিন বলেছিলাম,গেট টুগেদারে আমি যাবোই। তোমরা বাসায় কে থাকবে, ঠিক করে নিও”। সে দ্বিগুণ চেঁচিয়ে বললো,”তার মানে তোমাকে কথা শুনানো ই যাবে না। তোমার ইচ্ছে মতো তুমি চলবে”? আমি হেসে বলি,”এখনো তো চলিই নাই। তুমি যা বলেছো,তা ই শুনেছি”।

আসল কথা হলো, আমার শাশুড়ির একবার হার্ট
আ্যটাক হয়েছে। ডাক্তার বলেছে উনি যেন একা কোথাও না থাকেন। তাই, কেউ একজন সবসময় বাসায় থাকতে হয়। উনি কারো বাসায় যেতেও চান না। একমাত্র পাশের ফ্ল্যাটের খালার সাথে উনার বন্ধুত্ব।

আমি যন্ত্রণার ভয়ে এই ১৮ বছর কোনো কিছুতেই জোর খাটাইনি। তাছাড়া, ছেলে মেয়েরা বড় হয়ে গেছে, এদের কানে মা বাবার ঝগড়া ঢুকুক,এসব ভাবলেই আমার কেমন যেন বাধো বাধো ঠেকে। বাসায় চিৎকার চেঁচামেচি হয় না বললেই চলে। আমি সযতনে এড়িয়ে যাই বলে, শাহীন এটার ই সুযোগ নেয়। এ পর্যায়ে আমার শাশুড়ি”কি হয়েছে
রে” বলে রুমে ঢুকেন। ভদ্রমহিলার সামান্য বোধ বুদ্ধির এতো অভাব, ছেলের রুমে নক্ না করে ঢুকেন কিভাবে, সেটাই আমি বুঝিনা। উনার ছেলে সবকিছু মাকে বলল। স্বাভাবিক ভাবে ই তার মা
সুযোগ পেয়ে, দ্বিগুণ মাত্রায় আমাকে বকতে আছেন। আমি যেন আজ সর্বনাশের খেলা দেখতে বসেছি। কিছু না বলে, চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি।

পর্দার নিচে দিয়ে ৩ ছেলে মেয়ের পা দেখা যাচ্ছে।
হঠাৎ শাহীন মেয়ে কে ডেকে ফোন দিয়ে বললো, “তোর নানি কে ফোন দে তো। মা তুমি উনাকে কমপ্লেইন দাও যে, উনার মেয়ে আমার কথার অবাধ্যতা করছে”। কথা শেষ হয়নি রাফি চিৎকার করে উঠলো,”খবরদার বাবা, মার এগেইনস্টে কোনো কমপ্লেইন ও বাড়িতে যাবে না। মা এতো বছর সার্ভিস দিচ্ছে এ সংসারে, একটা দিনের জন্য ছুটি চাইতেই, তুমি এরকম করছ কেন? তুমি তো প্রতি সপ্তাহে ই মাছ ধরতে যাও। একদিন তুমি
না গিয়ে, মাকে যেতে দিলে কি এমন দুনিয়া সুদ্ধ উল্টে যাবে”? শাহীন তেড়ে এসেছে ওর দিকে,
“বেয়াদব ছেলে, বাবা কে খবরদার বলছে? আমি বলেছি যাবে না,ব্যস যাবে না। আর একদিন দেখি
আমার সাথে বেয়াদবি করতে…..হাত কেটে গলায়
ঝুলিয়ে দিবো”।

ছেলেও ত্যাদড়ের মতো বলছে,”আমাকে যা ই করো, তবুও বলবো তুমি কিন্তু ভুল করছো বাবা”। শাহীন এবার রাফির দিকে তেড়ে গিয়ে চড় মারার চেষ্টা করতেই, আমি তাদের দুজনের মধ্যে দাঁড়িয়ে
যাই। একটু দূরে রাহি করুণ মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে ধমক দিয়ে বলি,”হা করে দেখছিস্ কি? রাফি কে নিয়ে রুমে যা”। মহা ত্যাদড় ছেলে, রাহির টানাটানি তে যাচ্ছে আর বাপের দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলছে,”শোনো বাবা, মা
এর কাছে তোমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত । মা না থাকলে তোমার সংসার, ছেলে মেয়ে কিচ্ছু ঠিক
মতো চলতো না। জলে ভেসে যেতো। তোমার মা কে তুমি কি দেখো, না আমার মা দেখে বাবা? সংসারে শুধু টাকা দিলে ই সুন্দর হয় না বাবা”।

ওরা চলে যেতেই বন্যা ও আমার শাশুড়ি চলে গেলেন। শাহীন আমার পাশে এসে বলছে,”ছেলের কাছে বাবা কে ভিলেন বানিয়ে এবার তুমি খুশি তো”? আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবি, এক সপ্তাহ পর, ছেলে দুটোর পরীক্ষা। আমার মাথায় কোন ভূত যে সওয়ার হয়েছে আল্লাহ মালুম। আমার এতো বছরের কষ্ট, পানিতে ভেসে যাবে।
নিজেই সাদা পতাকা তুললাম। আমার পক্ষ থেকে ই না হয় শান্তি আসুক। আগামীকাল আর গেট টুগেদারে যাচ্ছি না।

রাতের ডিনারের পর, সবকিছু গুছিয়ে রুমে যাবো,রাফি এসে বলছে,”আজকে তুমি আমাদের সাথে ঘুমাও মা। দুটো সিঙ্গেল বেড আছে, একটা তে তুমি শুয়ে পড়ো,অন্যটাতে আমি ও রাহি না হয় শুবো”। রাহি পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমি হেসে বলি,”কেন? বাবা কে ভয় পাচ্ছিস, আমাকে বকা দিবে ভেবে? বাবা কিচ্ছু করবে না,তোরা নিশ্চিন্ত মনে পড়ে ঘুমোতে যা”। দুজনে নিজেদের রুমে যাবার আগে,আমায় জড়িয়ে ধরে বলছে,”তোমার কোনো চিন্তা নেই মা। আমরা দুজন সবসময় তোমাকে দেখে রাখবো,দেখো”। রাফি শক্ত ধাঁচের মানুষ, কিন্তু রাহি হলো কান্নার সম্রাট। কিছু হলেই ঝরঝর করে চোখ দিয়ে পানি ঝরতে থাকে।

রাতে দুই ভাই সজাগ থেকে পড়ে,তাই কফি,মগ,
দুধ,চিনি,কেক সবকিছু গুছিয়ে রাখি। দরকার মতো দুজনে বানিয়ে নিয়ে যায়।

রুমে গিয়ে দেখি, শাহীন চোখের উপর হাত দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। আস্তে করে ব্যালকনির দরজা খুলে, চেয়ারে বসে পড়ি। ষ্ট্রীট লাইটের টিমটিমে আলো ছাড়া, দূর দুরান্ত পর্যন্ত কোনো কিছুরই যেন অস্তিত্ব নেই। অনেক টা আমার জীবনের ই মতো। দুই ঈদে আর এনিভারসারি তে ৩টি শাড়ির টাকা দিয়ে ই শাহীনের দ্বায়িত্ব শেষ। আর বোকার মতো আমি তার বাবা,মা, সংসার দেখতে দেখতে
জীবনের দুই তৃতীয়াংশ সময় ই শেষ। প্রথমেই প্রতিবাদ করলে পানি এতো দূর গড়াতো না। এখন আর কি ই বা হবে? সে তো আমাকে “টেকেন ফর গ্ৰানটেড” ই ভাবছে। তারপরও আজকে হয়তো শেষ পর্যন্ত যেতাম, কি হয় দেখার জন্য। হঠাৎ ছেলেদের পরীক্ষার কথা মনে পড়ে গেল। কম দিন নয় তো,১৮ টা বছরের ফল পেতে হলে, এখন
চুপচাপ ই থাকা ভালো।

সকালে ঘুম থেকে উঠে, টেবিলে নাস্তা দিয়েছি সবার,এরমধ্যে কলিং বেল বাজলো। আমি রাফি কে বলি,”খুলে দেখতো বাবা কে এলো”? সে এসে বললো,”বড়ফুপা এসেছে মা”। আমি রাহি কে ডেকে দিতে বলি। শাহীন বের হয়ে কথা বলছে উনার সাথে। রাহি কে নিয়ে এতো বছর ধরে এই এক ঝামেলা। ওর বাবার সাথে কথা বলতে, রাতে থাকতে বা সময় কাটাতে ও নারাজ। প্রথম প্রথম
জোর করে আমি পাঠাতাম। পরে ওর অনীহা দেখে, ওর বাবা নিজেই আসা কমিয়ে দিয়েছেন।

আগে যখন ছুটির দিনে বাসায় নিয়ে যেতে চাইতেন, তখন আবার বায়না ধরতো,”মামস ছাড়া
যাবো না”। একদিন গিয়ে এরপর থেকে আমার শাশুড়ি কে পাঠাতাম, সাথে রাফি যেতো। আমার
ভীষণ অস্বস্তি লাগতো, ওর বাবা আবার ভাবতে পারেন,আমিই মনে হয় যেতে দিচ্ছি না। একবার এসে সে বলল,”আমি ও বাসায় যেতে চাই না। কারণ,আন্টি আমাকে ভয় দেখিয়েছিল, দুষ্টুমি করলে ওয়াশরুমে আটকে দিবে। তারপর ই তো,
তোমার কাছে থাকবো বলে ফোন দিয়েছিলাম মামস”।

সেদিন পাগলের মতো ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে ছিলাম। মানুষ এত্তো খারাপও হয় !!! ৫ বছরের একটা বাচ্চা কে, ওয়াশরুমে আটকে দেবার ভয় দেখাতে পারে? কেন সবকিছু না জেনে ওকে, বাসায় যেতে জোর করেছি ভেবে…. নিজেই
অপরাধ বোধে ভুগেছি। বুকের ভেতরে নিয়ে ওকে,
হাউমাউ করে কেঁদেছি আর বলেছি,”মামস তুমি বড় না হওয়া পর্যন্ত, আর কক্ষনো তোমাকে ও বাসায় যেতে জোর করবে না। মাফ করে দাও বাবা, বুঝি নি আমি”। তারপর, ওর বাবা কে বলেছি,”বাসায় না গিয়ে আপনার সাথে বাইরে ঘুরলেই ও মনে হয়, কম্ফোর্টেবল ফিল করবে”।

আমি দেখা করতে যেতেই ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে গেছেন। আগে এসব করতেন না, রাহি আমার কাছে আসার পর থেকে ই উঠে দাঁড়ান। বসতে বলে আমিও বসি। বললাম,”কি ব্যাপার ভাই?
আপনি তো আমাদের ভুলেই গেছেন”। মৃদু হেসে উনি বললেন,”আপনাকে তো চাইলেও ভাবী ভুলা
যাবে না। আমি আপনার জন্য অনেক দোয়া করি।
আপনি ছিলেন বলে ই আমার ছেলেটা এতো শান্তিতে,স্বস্তিতে বেঁচে আছে”। ‌আমি বলি,”এসব
আপনার ভুল কথা। আল্লাহর রহমত ছাড়া, আজ
পর্যন্ত কেউ কি ভালো থাকতে পেরেছে? আমি তো
জাষ্ট একটা ওসিলা মাত্র”। রাহি তখনো আসেনি। গলা তুলে ডাক দিতেই,পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ালো। আমি শাহীন কে ইশারায় উঠে আসতে বলি। বাবা ছেলে মিলে কিছুটা সময় কাটাক। যদিও বেশির ভাগ সময়,বাবা ই কথা বলে যান, ছেলে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকে। কিছুক্ষণ পর, নাস্তা খেয়ে উনি চলে যান।

শাহীন কাপড় পড়ছে আর বলছে,”আজ তো তুমি খুশি তে ডগমগ, সকাল বেলায় ই যা একখানা প্রশংসা বাক্য শুনলে”। আমি মৃদু হেসে বলি,”হ্যা,
কৃতজ্ঞতা প্রকাশ আবার সবার দ্বারা হয় না। কিছু কিছু ভালো মানুষের কর্ম হচ্ছে বিনীত কৃতজ্ঞতা জানানো। অনেকেই মনে করে, সেটি দুর্বলতা”।

বন্যার হাত পায়ের নখ এতো লম্বা করে রাখে,যা আমার দুচোখের বিষ।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here