যখন_দুজনে_একা ৫৭ পর্ব

0
664

#যখন_দুজনে_একা

৫৭ পর্ব

সাফিয়া বেগম দুপুরে র খাওয়ার পর ঘুমান না । এই সময় তিনি খবরের কাগজ পড়েন কিংবা ব‌ই পড়েন। রুবা প্রায় সময় এই সময়ে শ্বাশুড়ি র সঙ্গে বসে গল্প করে।
রুবাকে রুমে ঢুকতে দেখে সাফিয়া বেগম বললেন,
: আমি ভাবলাম তুমি ঘুমাচ্ছ? এখানে শুয়ে থাকো!
: না মা ঘুমাই নি ইচ্ছে করে ই তাহলে রাতে ঘুম আসতে দেরি হয় , আপনার ছেলে ঘুমিয়ে যায় আমার একা জেগে থাকতে ভালো লাগে না !
: মাহি কখন আসবে ?
: প্রতিদিনের মত রাত হবে আসতে আসতে ! আপনি কি করছিলেন মা?
: তেমন কিছু না একটা ব‌ই পড়ছিলাম!
: আপনার চুল আঁচড়ে দিব ?
: চুলে তেল দিয়ে দাও !
রুবা বাটিতে তেল ঢেলে নিয়ে শ্বাশুড়ি র মাথায় তেল লাগিয়ে দিচ্ছে !
: তুমি যখন আমার মাথায় তেল লাগিয়ে দাও খুব ভালো লাগে রুবা। আমার শ্বাশুড়ির মাথা ও আমি লাগিয়ে দিতাম।
: আমি ও খুব মজা পাই ,আপনি তখন অনেক গল্প করেন।
: তাই ?
: জ্বি মা !
তেল লাগানো শেষে রুবা সাফিয়া বেগম এর ঘরে থাকা মাহির ছোটবেলার ছবি দেখতে বসলো ।
: মা আপনার ছেলে ছোটবেলায় কি করতো , খুব দুষ্ট ছিল ?
: মাহি , মারাত্মক দুষ্টামি করতো ! মাহি আমার অনেক কষ্টের ছেলে। তোমাকে কি বলেছি মাহির সঙ্গে জমজ বাচ্চা ছিল আমার‌?
: তাই নাকি বলেন নাই তো ?
: হুম আমার ফ্যামিলি তে জমজ বাচ্চা প্রত্যেক জেনারেশন এ আছে। দেখছো না তানহা- মানহা ! মাহির সঙ্গে একটা মেয়ে বাবু ছিল কিন্তু সাত মাসের সময় পেটেই মারা যায় । তখন আমাকে নিয়েই আজরাইল আর ডাক্তারের টানাটানি । আট মাসেই মাহি হয়। অনেক ছোট ছিল খুব যত্ন করে রাখতে হয়েছে।
একদিন আমি মাহির দাদিকে বলে ফেলেছিলাম মেয়ে বাবুটা বেঁচে থাকলে একটা ছেলে একটা মেয়ে থাকতো কত সুন্দর লাগতো ফ্যামিলি টা । সে কী রাগ তিনি জানো রুবা !
সারাদিন উনি মাহিকে কোলেই নিতে দেয়নি আমাকে ! বলে কেমন মা তুমি জীবিত বাচ্চা কে কোলে নিয়ে এই কথা বলো!
শিহাব ব্যস্ত করে রাখতো এত মাহিকে আমি যত্ন করতে পারতাম না , মাহিকে রাখতো ওর দাদি আর ওর দাদির একটা বুয়া ছিল উনি। সে জন্যই মাহি ওর দাদির আদর বেশি পেয়েছে আবার দাদির পশ্রয়ে দুষ্টামি ও করতো মারাত্মক , রাগ‌ ও বেশি!
: এখনও আপনার ছেলের রাগ বেশি মা !
: হুম‌ !
: ওর দাদি খুব গোছানো, ফিটফাট সাজ পোশাক সচেতন ছিল মাহিও সেরকম হয়েছে দেখো। ওর কাপড় ওর আলমারি সব নিজে গোছাবে । সব সময় সুন্দর পরিপাটি থাকবে !
সৌন্দর্য ও পেয়েছে দাদির গায়ের রং ,ঘন চুল !
: ওকে তো আপনার মত লাগে আমার কাছে মা !
: না ওর দাদীর ছবি দেখেছো না কত সুন্দরী ছিলেন তিনি ! মাহির ছোটবেলায় গায়ের রং দাদির মত ছিল !
: এখন নেই !
: হুম, শিহাবের সব কিছু নিয়ে আমি ব্যস্ত থাকলে কি হবে শিহাব ওর বাবার প্রতি বেশি দূর্বল ছিল। ওর বাবার কাছে সব শেয়ার করতো আর মাহি এসে সারাজীবন আমার কাছে বলবে তার কি লাগবে, কি সে করেছে বা করবে! আমি কিন্তু সব আদর শিহাব কেই বেশি দিসি , পড়াশোনা , ও কি খাবে , কখন কোন স্যারের কাছে পড়বে। মাহি পড়তোও একা একা । টিচারের কাছে কি পড়ছে খবর ও রাখতাম না।
বিশ্বাস করবে না আমি মাহির যত্ন‌ই নেই নাই। কিন্তু দেখো আমার সেই ছেলে এখন কত কেয়ারিং, রেসপনসিবল !
: জ্বি মা !
: বুঝলে রুবা আমি ছেলেটার যত্ন নেই নি তুমি ওর খুব যত্ন করবে ! একটু রাগী কিন্তু ওর মন সবচেয়ে সুন্দর।
: আমি জানি মা আপনার মাহির মত মানুষ হয় না !
সাফিয়া বেগম মনে মনে বললেন , এই ছেলে কে সারাজীবন তিনি অবহেলাই করেছেন । সব মায়েদের ছেলেকে বর সাজা দেখতে শখ থাকে তিনি মাহিকে সেই সুযোগ টাও দেননি। এখন আর সেসব সম্ভব না !
: আচ্ছা রুবা তোমাকে একদিন বলেছিলাম না সব গয়না গুলো পড়ে ব‌উ এর মত সেজে আমাকে দেখাবে ! আমি আমার মাহির ব‌উ সাজে দেখব তোমাকে !
: আমি একদিন সেজেছিলাম মা বলে রুবা ওর মোবাইল এ ছবি দেখালো ।
: তাই , দেখি !
খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে ! মাহি গেঞ্জি পড়া কেন ওকেও বর সাজিয়ে ছবি তুলতে ?
: মা আপনি কি যে বলেন ও বর সাজবে , কারণ ছাড়া ছবি তোলার মানুষ ও !
সাফিয়া বেগম আর রুবা হাসছে !
:আমার ছেলেটা কাপড় কি পড়বে কেনার বিষয়ে খুব সচেতন। তার আলমারি ভর্তি স্যুট, পাঞ্জাবি, শার্ট, প্যান্ট , ঘড়ি, কাফলিন কত কিছু । কত সাজে তাকে দেখেছি কিন্তু আমার এত সৌখিন ছেলেটা কে বর সাজে দেখতে পারলাম না ! একটা শেরওয়ানি পড়ে পাগড়ি পড়া মাহিকে দেখাই হলো না । একটা পুরনো পাঞ্জাবি পড়ে ছেলেটা বিয়ে করলো !
এটা ভাবলেই এত মনটা উদাস হয়ে যায় রুবা জানো !
রুবা মাথা নিচু করে শ্বাশুড়ির কথা গুলো শুনছে ।
: তুমি ছবিটা আমার মোবাইল এ দাও!
: ঠিক আছে দিচ্ছি মা!
: অনেক সুন্দর লাগছে তোমাকে রুবা ! সাফিয়া বেগম রুবার মাথায় হাত রাখলো ! মাহি রুবাকে নিয়ে আর রুবাও মাহির সঙ্গে সুখে আছে এটা দেখেই তিনি শান্তি পাচ্ছেন। দুই জন নাইবা সাজলো বর আর ব‌উ !
একদিন নিজের বোনের কথায় তিনি অনেক চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন।
তিনি মাহিকে জানেন , মাহি ওর প্রতি ভালোবাসা , আগ্রহ টেনে নেয়ার এক দারুণ ক্ষমতা রাখে তাই মাহিকে নিয়ে চিন্তা ছিল না । কিন্তু রুবা অনেক কষ্ট আর চঢ়াই উতরাই সহ্য করে এসেছে তাই রুবাকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছিল বেশি !
: রুবা চলো ঘুরে আসি বাহির থেকে, শপিং ও করলাম আমরা দুজন ?
: এখন ?
: হুম , কেন তোমার ইচ্ছে করছে না ?
: সেরকম কিছু না , ঠিক আছে মা চলেন যাই আমি আপনার ছেলেকে ফোন দিয়ে বলে দেই!
: যাও রেডি হয়ে আসো।

সাফিয়া বেগম আর রুবা শপিং করতে যাওয়ার ঘন্টা খানেক পর মাহি বাসায় চলে আসছে। মা আর রুবা বাসায় নেই যাওয়ার আগে রুবা ফোন দিয়েছিল ওকে । তার মাইগ্রেন এর পেইন শুরু হয়েছে বলেই ওদের সঙ্গে জয়েন করেনি হসপিটাল থেকে সোজা বাসায় চলে এসেছে। তার খুব ইচ্ছে করছিল মা আর রুবার সঙ্গে ঘুরতে।
নিজের রুমে যাওয়ার আগে মাহি লিভিং রুমের সোফায় শুয়ে রইল।
: ভাইজান ঠান্ডা পানি দিব , লাইলি বুয়া রুমে এসে দাঁড়ালো!
: না আদা চা দাও !
বুয়া চা নিয়ে এসে দেখে মাহি ঘুমিয়ে গেছে! সে চা নিয়ে আবার কিচেনে চলে গেল!
সন্ধ্যায় মাহি ঘুম ভেঙ্গে দেখে সামনের সোফায় নিঝুম বসে ম্যাগাজিন এর পাতা উল্টাচ্ছে !
উঠে বসতে বসতে মাহি বলল,
: তুই কখন এসেছিস?
: আধ ঘন্টা হবে , তুই ঘুমাচ্ছিস দেখে ডাকি নাই !
: মা আর রুবা তো শপিং এ গেছে ?
: আমি তোর সঙ্গে কথা বলতে এসেছিলাম !
: আমার সঙ্গে কি কথা, জরুরি কিছু?
: হ্যাঁ জরুরি কথা !
মাহি একটু অস্বস্তি নিয়ে তাকালো নিঝুমের দিকে !
: খুব বিরক্ত হচ্ছিস মাহি ?
: সেরকম কিছু না ! এই মুহূর্তে তোকে এখানে আশাকরি নাই ! আচ্ছা বল কি বলবি ?
: এখানে বলব ?
: তাহলে আর কোথায় যেতে হবে তোর কথা শুনতে ?
: না কোথাও যেতে হবে না , এখানেই বলা যাবে!
: এক কাজ কর নিঝুম বসে চা খা আমি একটু ফ্রেস হয়ে আসি রুম থেকে , এখানেই বস !
: চিন্তা করিস না তোর রুমে চলে আসব না !
: আমি আসছি বলে মাহি উঠে চলে গেল , যাওয়ার সময় বুয়াদের চা দিতে বলল!
রুমে ঢুকেই মাহি প্রথমে রুবাকে ফোন দিল !
: কোথায় তোমরা?
: ডিসিসি তে !
: কতক্ষণ লাগবে আসতে ?
: মা কেনাকাটা করছে , ছোট মামিও আছে সঙ্গে!
: ঠিক আছে ,আমি অপেক্ষা করছি তোমার জন্য !
: তুমি আসবে ?
: না রেস্ট করতে ইচ্ছে করছে মাথা যন্ত্রণা করছে! আর একটা কথা নিঝুম আসছে বাসায়!
: গল্প করো তোমরা, আমরা হয়তো এখান থেকেই বাসায় চলে আসব !
: তাড়াতাড়ি আসো রুবা, মিস করছি তোমাকে!
: আসছি, ফোন রাখি?
: লাভ ইউ!
মাহি অনেকটা সময় লাগিয়ে গোসল শেষ করলো। সে আসলে নিঝুমের সঙ্গে কথা বলতে অস্বস্তি ফীল করছে!

নিঝুম নিজেই তার আর মাহির জন্য চা বানাতে শুরু করলো ! চা বানানোর ফাঁকে বুয়াদের সঙ্গে গল্প করছে ।
: কি খাবে এখন তোমাদের ভাইজান?
: ভাবি পুডিং বানায় রাখছে !
: মিষ্টি খাবার খায় মাহি ?
: এইটা দিয়া বানাইলে খায় !
: ও স্টিভিয়া ! রুবা রান্না করে মাহির জন্য ?
: সব তো করতে পারে না, নাস্তা বানায়‌ , ভর্তা বানায় ! তয় খুব চেষ্টা করে ভাবি ফরিদা হাসছে!
: মাহি তো খুব একটা খেতে পছন্দ করে না !
: হুম ভাইজান তো ছোটবেলা থেইকা খায় কম ! ভাবি রান্নাঘরে আসলে রাগ হয় ভাইজান ! মাঝে কয়দিন হাবিজাবি রান্না করতে বলতো !
: কেন ?
: ইচ্ছা করছে মনে হয় !
: ভাবি এমনে মানুষ টা খুব শান্ত কিন্তু রান্নাঘরে আসলে অস্থির করে !
: ও আচ্ছা তাড়াহুড়া করে নিঝুম হাসলো !
: একদিন ভাবি চা ফালায়া পা পুড়ছে ভাইজান কি রাগ সবার সাথে !
: কেন রুবা তো ভালো চা বানাতে পারে !
: তখন তো অনেক অসুখ ছিল দাঁড়াইয়া থাকতে পারতেছিল না , এত বারন করলাম তাও ভাইজানের জন্য নিজেই চা বানাইব জিদ করছে !
: মাহি কিছু করতে দেয় না রুবাকে ?
: না যতক্ষণ বাসায় থাকে ভাইজান, ভাবি কিছু করতে পারে না আম্মার সঙ্গে গল্প করার সময় ও ভাবি রে সামনে বসায় রাখব উঠলেই ডাকতে থাকে !
আপনে আগে কত আইতেন এখন আসেন না কেন?
: ব্যস্ত থাকি , তোমার ভাইজান বিয়ে করছে এখন এসে গল্প করলে তোমার ভাবি রাগ করবে না ?
: ভাবি এমন মানুষ‌ই না, কারো উপর রাগ করে না !
আফা একটা কথা ক‌ই , বড় ভাইজানের চেয়ে ছোট ভাইজান ভাবি রে যত্ন আত্তি বেশি করে , অনেক বাসনা করে ! বড় ভাইজান কথা কম ক‌ইত, বেশি সময় আব্বার সাথে চেম্বারে থাকত কিন্তু খুব ভালা আছিল ভাবির সাথে খুব ভালা ব্যবহার করতো। আর ছোট ভাইজান ভাবিরে সামনের ছাদে ব‌ইসা গান শুনায়, পাখির খাঁচার কাছে নিয়া যায়, ছাদে ব‌ইসা গল্প করে বাসায় থাকলে সারাক্ষণ ভাবিরে চোখের সামনে বসায় রাখে। ভাবির কপাল জামাই ভাগ্য খুব ভালা !
: খুব সুন্দর বলছো বুয়া !
লাইলি বুয়া বলল,
: তয় ভাবি ছোট ভাইজান রে ভয় ও পায় , রুবা ব‌ইলা ডাক দিলে উইড়া যায়! পা পুড়ছে যখন ভাইজান রে কয় নাই ভয়ে ।
: তাই নাকি !
: হুম ! না জিগায় কোথাও যায় না ! ভাইজান ও ভাবিরে খুব ক্ষ্যাপায় এই রুমে টিভি দেখতে বসলে দুজন রিমুট নিয়া যুদ্ধ করে সারাক্ষণ । ভাবি কিছু দেখতে বসছে ভাইজান বদলায় দেয় তারপর শুরু হয় রিমুট টানাটানি ! ভাইজান নিজে কিছু দেখে না আবার ভাবিরেও কিছু শান্তিতে দেখতে দেয় না ! ভাবি আম্মার কাছে বিচার দেয় নয়তো উইঠা চ‌ইলা যায় তখন আবার ডাইকা বসায় ! পুলাপানের মত ভাইজান ভাবির সাথে দুষ্টামি করে।
: ভালোই তো মজা তোমাদের বাসায় !
: ভাবি খুব ভালা গো কোন দিন মুখ কালা ক‌ইরা কথা কয় নাই ! দুজন ঘুরতে গেছিল বিদেশ বাসাডা এত খালি ছিল । আম্মা অস্থির হ‌ইয়া গেছিল দুই জনরে ছাড়া।
: খালাম্মা রুবা কে অনেক ভালোবাসে !
: হ আফা এমন শ্বাশুড়ি জীবনে দেখি নাই । তয় ভাবি ও আম্মা রে ছাড়া কিছু বুঝে না।

মাহিকে দেখে দুই বুয়া চুপ করে গেল হঠাৎ !
: চা হয়নি এখনও ?
: আমি বানালাম চা মাহি !
: কেন বুয়ারা তো ভালো চা বানাতে পারে তোর কষ্ট করার কি দরকার ছিল !
মাহি লিভিং রুমের সোফায় গিয়ে বসলো!
: এমনি বানালাম, কেন আমার হাতের চা খেলে কি সমস্যা হবে তোর ?
: সে রকম কিছু বলি নাই , তোর কষ্ট করার দরকার ছিল না সেটাই বললাম! আচ্ছা কি কথা বলতে চাইছিস বল!
: আজ তিন মাস আঠারো দিন পর তুই আমার সঙ্গে কথা বলছিস মাহি ! এত দিন কি অপরাধ করলাম আমি যে তুই কথাই বলা বন্ধ করে দিলি আমার সঙ্গে জানতে পারি ?
: তোর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে তো মনে হয় !
: না মাহি , ঐটা কথা ছিল না । ফোন দিলে ধরিস না ফোন, বাসায় এসেছি আমাকে দেখে তুই রুমের দরজা লক করে বসে থাকিস নয়তো বের হয়ে যাস !
: কোথায় এই যে দিব্বি তোর সামনে বসে আছি , চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মাহি বলল !
:মাহি প্লিজ এত অপমান করিস না !
: আশ্চর্য তোকে অপমান কেন করতে যাব নিঝুম, হ্যাঁ আমি তোকে এড়িয়ে গেছি কারন একটা সময় আমার মনে হলো সবাই কে তার নিজের জীবনে নিজের মত ভালো ভাবে থাকতে দেয়া উচিত। তোর মত একটা ইন্ডিপেন্ডেন্ট মেয়ের কারো গাইডলাইন এর প্রয়োজন নেই। আমি একদিন নিয়াজের পক্ষে কথা বলে টের পেয়েছি আমার এতটা কথা বলা ঠিক হয়নি। আর তুই ও চাইছিলি আমার মোহ থেকে দূরে থাকতে আমি এই জিনিস টা আমার বিয়ের পর থেকেই চাইছিলাম সে জন্যই তোর সঙ্গে দূরত্ব রক্ষা করতে চেয়েছি।
: তাই বলে এভাবে ফোন ধরিস না, কোথাও দেখা হলে সেখান থেকে কেটে পরিস!
: কাজ থাকলে যাব না ! ফোন ধরি নাই ইচ্ছে করে, ঐ তোর ভালোর জন্য ই!
: আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি মাহি !
: কি ?
: আমি নিয়াজ কে বিয়ে করব !
: আমাকে বলতে আসছিস কেন ?
: তোকে বলব না তো কাকে বলব !
: আশ্চর্য আমি কি তোর গার্ডিয়ান নাকি ?
: তুই বলবি সবাই কে আর নিয়াজের সঙ্গে ও কথা বল !
: না আমি কারো সঙ্গে কথা বলতে পারব না , তোর জীবন তুই ডিসিশন নিবি তুই হ্যান্ডেল করবি কিভাবে কি করবি ?
: একদিন না নিজে দ্বায়িত্ব পালন করতে চাইলি !
: সব দিন আর এক হয় নাকি !
: প্লিজ মাহি এত প্যাঁচানো কি হয়েছে বুঝলাম না !
: কি প্যাচাচ্ছি আমি ? আমি বিয়ের আগে তোকে জিজ্ঞাসা করে ডিসিশন নিসি নিঝুম, তাহলে ?
তুই তোর মত ডিসিশন নে , আমাকে এসবের মধ্যে রাখিস না !
তুই আমার জন্য নিয়াজ কে বিয়ে করতে চাইছিস তোর জন্যে ও না এমনকি নিয়াজের প্রতি আগ্রহী হয়েও না ! শোন তুই বলিস না তুই আমার চেয়ে পাঁচ মাসের বড় , ঠিক কিন্তু তোর কথা শুনেই আজও বুঝি তোর আসল কথা কোন টা ! আর তুই অন্যকে বুঝাতে চাস কোন টা বলে !
এই যে নিয়াজকে বিয়ে করবি এই কথাটা বলতে আমার কাছে ছুটে এলি , এটা আমাকে বলার তো দরকার নেই! তোদের দুজনের ব্যাপার এটা ! আমাকে খুশি করতে হবে কেন , ঐ দিন নিয়াজের কথা বললাম দেখে?
কোন প্রয়োজন নেই?‌ তুই ভালো না বাসলে বিয়ে করতে আগ্রহী হচ্ছিস কেন ?
: তুই কি রুবাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিস ? তুই করতে পারলে আমি পারব না কেন? কি জানি একদিন আমিও তোর আর রুবার মত সুখী হয়ে গেলাম!
: নিঝুম আমার আর রুবার বিষয়টা সম্পূর্ণ আলাদা, আমাদের হাতে অপশন ছিল না ! আর বিয়ের পর আমরা এই সম্পর্ক টা কে ভালোবেসেছি তারপর নিজেদের ! এডজাস্টমেন্ট বলে আমরা যেভাবে খুশি সেভাবে হ্যান্ডেল করি নাই নিজেদের ।
রুবা আমার মনের মত হয়ে উঠেছে। আমি রুবার চাওয়ার সঙ্গে নিজেকে বদলেছি ! কিন্তু তুই তো বিয়ের সম্পর্ক টা শুরুই করতে চাইছিস কাউকে দেখানোর জন্য যে ,দেখ আমি তোর কথা রাখলাম !
আমি তোকে বলছি তোকে বিয়ে করতেই হবে ? নিয়াজ কেই করতে হবে ? তুই বললি , নিয়াজ তোকে প্রোপোজ করছে ! তখন আমি বলেছি , নিয়াজ ভালো ছেলে! এতেই তুই কি বললি, আমি তোকে নিয়াজের ঘাড়ে গছাতে চাইছি!
: সরি আমার মাথা কাজ করে নাই!
: এখনো করছে না । যখন নিজে কারো প্রতি ফীল করতে পারবি আমার মতে তখন বিয়ে করা উচিত। নিয়াজের জীবন নষ্ট করার অধিকার তোর নেই। মনে মনে পুষে রাখবি একজন কে আর বিয়ে করে সংসার আরেকজনের সঙ্গে ভালো ভাবে করতে পারবি না ! সে জন্য আমি শুরু থেকেই আমার মন কে বদলে নিয়েছি নিঝুম !
: কি করব বল?
: আমাকে কেন প্রশ্ন করছিস ? তোর যথেষ্ট বুদ্ধি আছে !
: মাহি রাগ করছিস ?
: না আশ্চর্য রাগ করব কেন ?
মাহি মোবাইল বের করে রুবা কে কল দিল,
: কোথায় তোমরা , এত সময় লাগছে কেন ?
: বাসার কাছেই চলে আসছি !
: ঠিক আছে আসো!
মাহি ফোন রেখে নিঝুম কে বলল,
: শোন তুই যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে কিভাবে নিজের জীবন টা সুন্দর হবে তুই জানিস ! একটু আবেগ গুলো সরিয়ে চিন্তা করে দেখ ঠিকই বুঝতে পারবি তোর কি করা উচিত! এটাই আমার সাজেশন!
নিঝুম চুপচাপ বসে রইল কিছুক্ষণ !
: উঠি তাহলে !
: মা আর রুবা চলেই আসছে কাছাকাছি দেখা করে যা , ব্যাপার টা খারাপ দেখায় এভাবে চলে যাবি !

রুবা আর সাফিয়া বেগম শপিং শেষ করে বাসায় এসেছে। সাফিয়া বেগম নিঝুম কে দেখে খুব খুশী হলেন!
: মা তোমরা কি এত শপিং করলে এত সময় লাগলো , মাহি বিরক্ত হয়ে আছে?
সাফিয়া বেগম হেসে বললেন,
: অনেক দিন পর আমরা দুজন শপিং এ গেছি বুঝতে হবে তোমাকে মাহি !
নিঝুম রাতের খাবার খেয়ে যাবি কিন্তু !
: না খালাম্মা আব্বু কে ওষুধ খাওয়াতে হবে আমার !
: তোর মা একদিন খুব ওষুধ খাওয়াতে পারবে!
: রুবা কেমন আছো তুমি ?
: আপু ভালো আছি তুমি ভালো আছো , রুবা মাহির পাশে এসে বসলো!
: কি শপিং করলে তোমরা ব‌উ শ্বাশুড়ি দেখি, নিঝুম বলল ?
রুবা শপিং গুলো খুলে দেখালো নিঝুম কে আর মাহিকে !
: সব তো দেখি মা রুবার জিনিস , আমার জন্য কিছু কিনলে তোমরা , মাহি বলল?
: তোমার জন্য কর্নফ্লেক্স এনেছি আমরা , বলে রুবা হাসলো !
: ভাগ্য আমার রুবা , থেঙ্কস !
সবাই হাসছে মাহির কথা শুনে ।‌

ডিনার করে নিঝুম চলে গেল । রুমে ঢুকে রুবাকে মাহি প্রশ্ন করলো,
: আমি যখন বললাম নিঝুম এসেছে তোমার খারাপ লাগে নি কিংবা টেনশন হয়নি ?
: খারাপ লাগবে কেন আর টেনশন‌ই বা করতে যাব কেন ?
: আমি আর নিঝুম এখানে একা ছিলাম !
রুবা মাহির কাছে এসে দাঁড়ালো ,
: বলো একা ছিলে তো কি হতো ?
: তোমার মনে কোন ভাবনা আসেনি মাহি আর নিঝুম আপু বাসায় আছে !
রুবা মুখ কালো করে ফেলল
: একথা বলছো কেন , আমাকে দেখে তাই মনে হয়েছে মাহি ? প্লিজ বিশ্বাস করো আমি এসব কিছু ভাবিনি ! তোমাকে নিয়ে আমি কখনো এরকম কিছু কোনদিন হয়তো ভাবতে পারবো না ! ছিঃ ছিঃ আমার চেহারা দেখে তাই মনে হয়েছে তোমার । রুবা দুই হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলল!
মাহি কিছুই বুঝতে পারছে না তার দুষ্টামি তে রুবা এভাবে কেন রিয়েক্ট করছে !
: এই রুবা কি হলো তুমি কাঁদছো কেন !
: আমি এরকম কিছু ভাবিনি বিশ্বাস করো প্লিজ!
: আমি তো দুষ্টামি করে বলেছি সোনা ! তুমি এত সিরিয়াসলি নিয়ে নিবে আমি বুঝিনি !
মাহি রুবাকে জড়িয়ে ধরে হাসছে রুবা মাহির বুকে কেঁদেই যাচ্ছে !
: এই কান্না থামাও , রুবা সরি ,সরি বলছি আমি !
থামো প্লিজ !
অনেক অনুরোধে র পর মাহি রুবাকে শান্ত করলো!
রুবা চোখের পানি মুছলো , আর কোন দিন এভাবে বলো না মাহি !
: প্রমিজ আমি এভাবে বলবো না কিছু ! পাগলের সঙ্গে পাগলামী করব আর , বলে মাহি হাসলো!
: একটা কথা বলতে চাইছিলাম তোমাকে ?
মাহি রুবাকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিল !
: বলো রুবা আমি শুনছি !
: মার খুব শখ ছিল তোমাকে নতুন বর সাজে দেখার , আজ মা মন‌ খারাপ করে আফসোস করছিল খুব !
: তো এখন কি করতে হবে ? শেরওয়ানি পড়ে পাগড়ি মাথায় দিয়ে বর সাজতে হবে ?
: দারুন লাগবে তোমাকে কিন্তু ! তোমাকে স্যুট পড়লেও খুব সুন্দর লাগে !
: তাই বুঝি ?
: হুম , তুমি আমাদের বিয়ের পর পর তোমার বন্ধু না কার বিয়েতে ব্ল্যাক স্যুট, প্যান্ট হোয়াইট স্লিম ফিট শার্ট , টাই পড়ে গেলে । আমি মায়ের ঘরে বসে ছিলাম তুমি যখন ঢুকলে ঘরে আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম !
: হুঁ আমি তাকাতেই আপনি চোখ সরিয়ে নিয়েছিলেন।
: হুম লজ্জা লাগছিল খুব ! তুমি একদিন বর সাজলে মা কে দেখালে কেমন হবে বলো তো?
: তুমি মা কে বলো তাহলে আমি একা কেন সাজব তোমাকে ব‌উ সাজাক, ফুল দিয়ে বাসর ঘর সাজিয়ে দিক , লোকজন দাওয়াত দেই ! ষোলো কলাই পূর্ণ হোক !
ফুল দিয়ে সাজানো ঘাটে বাসর করবো কিন্তু রুবা !
: এত কিছুর দরকার নেই তুমি শের‌ওয়ানি পড়ো খালি !
: আমি একা কেন পড়ব ! তুমিও পড়বে , বাসর খাট ও লাগবে আমার মাহি হাসছে!
: দুষ্টামি হচ্ছে মাহি ?
: হুঁ দুষ্টামি করছি রুবা !
: আমি কিন্তু সিরিয়াস ছিলাম !
মাহি রুবাকে পাশ ফিরে জড়িয়ে ধরে বলল,
: সব কিছুর একটা সময় থাকে রুবা , ঐ যে লালনের গানে বলে না সময় গেলে সাধন হবে না ! যখন যেটা করার কথা তখন সেটা না করলে পরবর্তী তে এই কাজ করাটা ঠিক ও না , ভালো ও লাগে না দেখতে এবং শুনতে !
মা কে বলব আমি, এসব ছোটখাটো বিষয়ে মন খারাপ না করতে। আমার ভাগ্যে এভাবে ই বিয়ের সাজ ছিল এটা মেনে নিতে হবে ! বিয়ের সাজটা বড় কিছু না রুবা , এই বিয়েটা তে আমি কতটা সুখী সেটাই সবচেয়ে বড় !
রুবা আমার তোমার বিয়ের সাজ যেমন ই থাকুক তুমি আমি সুখী কিনা বলো ? তোমার মনে দুঃখ আছে কি পড়েছিলে বিয়েতে তাই নিয়ে ?
: না মাহি !‌‌ আমি তো ভুলেই গেছি কি শাড়ি পড়েছিলাম ঐ দিন !
: আমার মনে আছে কমলা রঙের একটা শাড়ি পড়েছিলে তুমি! দাম ও হয়তো বেশি না !
হয়তো স্বাভাবিক বিয়ে হলে কি হত দুই ,আড়াই লাখ টাকা দিয়ে মা কিনতো একটা শাড়ি !
সুখ কি দামী শাড়ির ভাঁজে থাকে , নাকি শের‌‌ওয়ানির পকেটে ? না , সুখ কপালে থাকে ‌রুবা !
: এই কপালে লিখা আছে আমি আর তুমি সুখী , তাই আমার আর কিছুর দরকার নেই !
কি ঠিক বললাম কিনা বলো ?
: ঠিক বলেছো আমি তো সেজন্য ই আতংকে থাকি এত সুখ আমার সহ্য হবে তো । রুবা মাহির বুকের ভেতর নিজেকে জড়িয়ে নিলো!
: আতংকের কথা আসছে কেন আবার রুবা !
: শোন আমাদের নাতি নাতনির বিয়ের সময় আমি তুমি ,ব‌উ আর বর সাজব কেমন ! মাহি হাসছে।
: হুম এখন সাজলে হাস্যকর হবে তখন সাজলে চরম হাস্যকর হবে ,বলে রুবাও জোরে জোরে হাসছে !

( চলবে )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here