এক পশলা বৃষ্টি – পর্ব ৬

0
366

#গল্পঃএক_পশলা_বৃষ্টি
লেখনী ঃ আলো ইসলাম
#পর্ব_৬

আজ তানুর বউভাত।চৌধুরী বাড়ির প্রতিটি কোনায় কোনায় সাজ সজ্জা দ্বারা সজ্জিত হয়ে উঠেছে। তানু অনেক আগেই ঘুম থেকে উঠে গেছে। জাকিয়া আর তাসু আপু এসে তাকে একটা শাড়ী দিয়ে রেডি হতে বলে গেছে।নতুন বউ দেখতে অনেকে আসবে প্রতিবেশীরা তাই। জাকিয়া অবশ্য খুব জ্বালিয়েছে এসে তানুকে কাল রাতে কি হয়েছে এই নিয়ে অনেক মজা ও করেছে।তানু শুধু মুখে লাজুক ভাব নিয়ে ছিল কিন্তু ভেতর টা ছিল একটা ক্ষিপ্ত আর্তনাদ।

তানু রেডি হয়ে নিচে মেনে দেখে সবাই সবার মতো কাজে ব্যস্ত।বউভাতের নানান আয়োজন চলছে।তনয় ভোরে নামাজ পড়তে বের হয়ে আর আসেনি এখনো। তার নাকি সকালে হাটার অভ্যাস আছে তাই হয়তো একবারে হেটে আসবেন বা আড্ডা দিচ্ছেন কোথাও বন্ধুদের সাথে । আমি কি করব কিছু বুঝতে পারছি না তাই দাড়িয়ে সব টা বুঝার চেষ্টা করছি। মা কে (শাশুড়ী মা) দেখলাম রান্না করে কি করছে হয়ত নাস্তা রেডি করছে সবার জন্য। কাজের লোক আছে অবশ্য অনেক। তাও নিজে সব কিছু করছেন তিনি।
আমি সোজা রান্না ঘরে গেলাম মা আমাকে দেখে বললেন তুই রান্না ঘরে কেনো যা গিয়ে বস আমি নাস্তা নিয়ে আসছি হয়ে গেছে প্রায়। আমি বললাম ব্যস্ত হয়ো না তো।কি করছো দাও আমি করে দি। মা মুখে হাসি এনে বললেন বিয়ের পরের দিন কাজ করাই আর সবাই বলুক যে আমি আমার বউমা কে দিয়ে বিয়ের পরের দিন কাজ করাচ্ছি। আমাকে তুই দজ্জাল শাশুড়ী বানাতে চাস তুই। আমি মা এর কথাই ফিক করে হেসে দিলাম।তখনি পায়েল মানে আমার চাচি শাশুড়ী আসলেন রান্না ঘরে। আমাকে দেখে বললেন এই মেয়ে এখানে কি করছো তুমি। আর নতুন বউ এ কেমন করে আছো। আমাদের একটা সম্মান আছে সমাজে। তোমাদের ফ্যামিলির মতো ছোট ঘরের না।আমি কথা শুনে মাথা নিচু করে নিলাম।আর যাই হোক বাবার বাড়ির অসম্মান কোনো মেয়ে মেনে নিতে পারে না।যতই খারাপ না কেনো। তখনি মা বলে উঠলো আহ পায়েল কি হচ্ছে এই সব। ওর সাথে এই ভাবে কথা বলছিস কেনো।ছোট মানুষ বুঝতে পারেনি।
তখন পায়েল চৌধুরী বলে উঠলো আপুই তুমি আর মাথায় তুলো না তো। দেখবে একদিন পায়ে ঠেলে দিবে।আমার চোখ ভরে পানি চলে আসলো তখনি জাকিয়া এসে বললো মা কি হচ্ছে এই সব ভাবির সাথে তুমি এমন ব্যবহার করছো কেনো। পায়েল চৌধুরী রেগে গেলেন জাকিয়ার কথায় তারপর বলে উঠলো এখন তোর থেকে শিখতে হবে আমাকে কার সাথে কেমন ব্যবহার করবো।জাকিয়া আর কথা না বাড়িয়ে আমাকে বললো ভাবি আসো তো এখানে থাকতে হবে না। তখন মা বললেন হ্যা হ্যাঁ ওকে নিয়ে গিয়ে একটু সাজিয়ে দে তো মা।একটু পাশের বাসার ভাবিরা আসবে বউ দেখার জন্য।

__________________

সন্ধ্যায় বউভাতের অনুষ্ঠান তাই আমাকে পার্লার থেকে লোক এসে সাজিয়ে দিচ্ছে।সাথে জাকিয়া তাসু আপু ও আছে তারাও সাজছে।তনয়ের সাথে সারা দিনে আমার একটাও কথা হয়নি আজ। অবশ্য এটা হওয়া স্বাভাবিক। আমরা তো আর আর পাচটা স্বামী স্ত্রীর মতো না।

আমাকে সাজিয়ে স্টেজে বসিয়ে রেখেছে পাশে তনয় ও বসে আছে। গেস্ট যারা আসছে অনেকে শুভেচ্ছা জানিয়ে হাতে গিফট ধরিয়ে দিচ্ছে আর তনয় তাদের সাথে হাসি মুখে কথা বলে চলেছে।তনয় আড়ে আড়ে তানুকে দেখছে। আসলে অনেক সুন্দর লাগছে তানুকে। না চাইতেও চোখ চলে যাচ্ছে বারবার তাই৷

এর মধ্যে নাবু,নুসু,অনু,নাহিদ, সায়ন,তন্নি,তুরিন আপু,হাবিবা,মেহু,হাফসা,
রনিত আর রহিতা ভাইয়া এসে হাজির। সাথে বাবা,চাচারা।ছোট কাকি মেজো কাকি ও এসেছে।।ওদের দেখে আমি দাঁড়িয়ে যাই আর সাথে চোখ পানিও চলে আসে।মনে হচ্ছে কতদিন যেনো দেখি নাই তারে।আমি ছোট কাকিকে ধরে কেদে দিলাম।তখন জাকিয়া বলছে ভাবি এভাবে কেদো না। তাহলে মানুষ ভাববে আমরা তোমাকে কত কষ্টে রেখেছি।আমি তার কথা শুনে হেসে দিলাম সাথে সবাই হাসছে। আমি সবাইকে বললাম কেমন আছো তোমরা। তারপর নাবু এসে বলছে আপু তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে কিন্তু।তখনি তন্নি বলে উঠলো দেখতে হবে না বোনটা কার।তারপর মিস্টি আমাকে খালামনি বলে জড়াই ধরলো। তনয় সবার সাথে কথা বলে আসছি বলে কোথাই একটা গেলেন।আমি আর সেদিক না ভেবে এদের সাথে কথা বলতে লাগলাম।

এইদিকে রনিত ভাইয়ার চোখ তো খুজছে একজন কে।তাসু আপু কে না দেখতে পেয়ে একটু হতাশ হলেন তিনি। আর অনিক সেতো নাবুকে দেখতে ব্যস্ত।অজান্তে যে নাবুকে তার মনে জায়গা দিয়ে ফেলেছে এটা খুব ভালো করে বুঝতে পারছে অনিক ভাইয়া। আর নাবু তার তো কোনো হেলদুল নেই বিষয়ে।

তখনি তাসু আপু এসে সবাই ভেতরে যাওয়ার জন্য বলে রনিত ভাইয়া কে দেখে থমকে যাই যেনো। নীল পাঞ্জাবিতে অনেক সুন্দর লাগছে রনিত ভাইয়াকে।দুজন দুজনের দিকে এক মনে তাকিয়ে আছে।তাদের যে কেউ দেখছে তাতে যেনো খেয়াল এ নেই।

রনিত ভাইয়া বুকের বা পাশে হাত দিয়ে বুঝার চেষ্টা করছে আসলে তার ভেতরে কেমন ফিলিং চলছে। ২৬ বছর বয়সে কখনো কাউকে দেখে এমন হয়নি তার। কিন্তু তাসু আপুকে দেখে তার হার্টবিট বেড়ে যাই।তাসু আপুর ও এক অবস্থা।

তনয় আমাকে তার বন্ধুদের সাথে পরিচয় করে দিলেন। সবাই অনেক ভালো আর মিশুক টাইপের। তার মধ্যে অন্তর নামে একটা ছেলে সে আমাকে বোনের আসনে থাই দিলো।অনেক ভালো লাগলো তাদের সাথে কথা বলে। এবার আমাদের বাড়ি যাওয়ার পালা। আমাদের সাথে তাসু আপু ও জাকিয়া ও যাবে ঠিক হলো।বেশ ভালো লাগছিল বাড়ি যাব এই ভেবে।

আমরা আমাদের বাড়ি আসতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল।তারপর সবাই সবার মতো ঘরে চলে গেলো আসলে সবাই অনেক ক্লান্ত ছিল তাই আর আজ কেউ আড্ডা দেওয়ার মুডে নেই।

সকালে উঠে আমরা নাস্তা করে বের হলাম উদ্দেশ্য গ্রাম ঘুরে দেখানো তনয়কে।সাথে নাবু,নুসু,অনু,তন্নি,নাহিদ,হাবিবা,হাফসা,রনিত আর রহিত ভাইয়া ও আছে।অনিক ভাইয়া ও এসে যোগ দিয়েছে আমাদের সাথে।আসলে সকালে ফোন দিয়ে ডাকা হয়েছে তাকে।কাল কাজের জন্য আমাদের সাথে আসতে পারিনি তাই।
রনিত ভাইয়া মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে তাসু আপুকে সে মনের কথা বলে দিবে। কিন্তু অনেক ভয়ে আছে যদি রিজেক্ট করে দেই সেই ভয়ে।এমন সময় তাসু আপু একটু জোরেই বলে উঠলো কি এতো ভাবছেন বিয়াইইইই।রনিত ভাইয়া চমকে উঠলো।এই প্রথম তাসু আপু কথা বলেছে তার সাথে মুখে হাসি ফুটে উঠলো। এই দিকে আমি আর তনয় হেটে চলেছি কেউ কারো সাথে কথা বলছি না।আর সবাই আমাদের পেছনে আসছে।

তনয় আমাকে বললেন তোমাদের গ্রামটা কিন্তু অনেক সুন্দর। কি স্নিগ্ধ বাতাস।সবুজের সমাহার। অনেক ফ্রেস লাগছে জানো।আমি শুধু হু বলে তাকে দেখতে লাগলাম অনেক সুন্দর লাগছে তাকে।একটা মানুষ এতো সুন্দর হয় কি করে।আমরা গ্রাম ঘুরে চলে আসছি।তারপর হাসি মজা দিয়ে কেটে গেছে আমাদের সময়। তনয় সবার সাথে অনেক ভালো ব্যবহার করেছে।মানুষটা কে যত দেখছি তত মুগ্ধ হচ্ছি। অবশেষে ফিরে আসলাম আমরা চৌধুরী বাড়িতে।

__________________

আমাদের বিয়ের আজ একমাস পার হয়ে গেছে। এর মধ্যে তাসু আপুকে রনিত ভাইয়া প্রপোজ করেছে তাসু আপু ও গ্রহণ করেছে।কারণ আপু ও যে ভাইয়াকে ভালবেসে ফেলেছিল।আর নাবু ও অনিক এদের মধ্যে তো টম জেরির মতো লেগেই থাকে।অবশ্য অনিক ভাইয়া নাবুকে পছন্দ করে কিন্তু প্রকাশ করিনি তাই।

আমি ভোরের নামাজ পড়ে ছাদে এসে প্রকৃতির সুন্দর রুপ উপভোগ করছি।সকালে এই পরিবেশ টা সত্যি অনেক মুগ্ধকর। আর এতো ফ্রেস একটা মুহুর্ত। মন খারাপ থাকলে ও যেনো ভালো হয়ে যাই। আমি ছাদে দাঁড়িয়ে ভেবে চলেছি আমার আর তনয়ের সম্পর্কের কথা। তনয় একজন আদর্শ স্বামী হিসেবে সব দায়িত্ব পালন করে। বাইরের মানুষের কাছে আমরা সুখি দাম্পত্য দেখাই ঠিকি কিন্তু বন্ধ ঘরে আমরা বন্ধু ছাড়া আর কিছু না।তখনি আমি পিছে কারো উপস্থিতি অনুভব করলাম।পেছন ফিয়ে দেখি তনয় এসে দাঁড়িয়েছে। এই সময় তিনি ছাদে আসেন না।নামাজ পড়ে হেটে তবেই বাড়ি ফিরেন তারপর অফিসে যান এই তার রোজকার রুটিন।

আমি তনয়ের দিকে একবার তাকিয়ে আবার সামনে ঘুরে দাড়ালাম।তখনি তনয় বলে উঠলো তানু তুমি কি পড়াশোনা করতে চাও।আমি সাথে সাথে তার দিকে ঘুরে তাকাই।আর বিস্ময় চোখে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করতে থাকি আমি কি ঠিক শুনলাম।চোখে আমার পানি চিকচিক করছে। তনয় আবার ও বলে উঠলো কি হলো বলো। আমি জানি তোমার পড়াশোনা করার অনেক ইচ্ছে আছে।আসলেই আমার পড়াশোনা করার খুব ইচ্ছে ছিল।কিন্তু বাবার নিয়মের বেড়াজালে সে আশা আর পুর্ন হয়ে উঠেনি।
আমি নিজেকে স্বাভাবিক করে বললাম আপনি কি করে জানলেন আমার পড়াশোনা করার ইচ্ছে আছে। তনয় কিছুখন চুপ থেকে বললেন সেটা না হয় না জানলে এখন বলবো একদিন।

আমি সব ব্যবস্থা করে এসেছি একটা কোচিং সেন্টারে কথা বলেছি।তোমার রেজাল্ট অনেক ভালো। তাই কোনো অসুবিধা হবে না।তুমি কোচিং থেকে পড়ে ইন্টার এক্সাম দিয়ে ভার্সিটি ভর্তি হবে একবারে।আমার খুশি তে নিজেকে কেমন যেনো পাগল পাগল লাগছিল। আসলে কতটা খুশি হলে মানুষের এমন অনুভূতি আসে আমার জানা নেই।আমার রোদ্য প্রখর দিনের মাঝেও যে #এক_পশলা_বৃষ্টি এসে ধরা দিবে ভাবিনি কখনো……

চলবে….

(রিচেক হয়নি।ভুলক্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষে বিবেচনা করবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here