তুই আমার অঙ্গারাম্লজান – পর্ব ২০

0
200

#তুই_আমার_অঙ্গারাম্লজান
পর্ব_২০
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা

২৪.
তপ্ত দুপুরে বড়দের গম্ভীর আলোচনায় ব্যস্ততা ও ছোটরা ভাত ঘুম দেবার পর মধ্যস্থলে অবস্থিত কিশোর-কিশোরী থেকে যুবক-যুবতী বয়সী ব্যক্তিবর্গ সোফা ও ডাইনিংয়ের মাঝখানের স্পেসে গোল হয়ে বসলো। ফায়াজ ভাইয়ার সঙ্গে ফাহাদেরও কিছু বন্ধু উপস্থিত। আর আছে বিশাল কাজিন মহল।
আমি সোফায় গল্পের বই হাতে বসে আছি। কিন্তু দৃষ্টি তাদের দিকে। সোফার অন্যপাশে বসে আছে মিহি ও তার পাশে সাকেরা।

বর্তমান আলোচনার বিষয়বস্তু কার কার প্রেয়সী আছে তা নিয়ে।।
ফায়াজ ভাইয়ার এক বন্ধু তার জীবনের দুঃখের কথা বলতে লাগলো। দুই বছর ধরে জম্পেশ প্রেম করার পর বের হয়, তার প্রেমিকা আগাগোড়া একজন পুরুষ মানুষ। প্রেম করে তার থেকে টাকা-পয়সা নানা জিনিস হাতিয়ে নিতো তার বারো প্রেমিকাকে তুষ্ট করার জন্য। প্রেমিকা নয়, প্রেমিকা বানানোর উদ্দেশ্য সফল করতেই নানা তার আহাজারি। পরে ওই ছেলেকে তুলে নিয়ে খোজা করার প্রচেষ্টা করা হয়। পরে ভাইয়ার কাছ থেকে কান্নাকাটি করে মাফ চেয়ে বিদায় হয়। তবে বিদায় দেওয়ার আগে ওই ভাই সেই লোকটিকে ভালোমতো দাগা দিয়ে দেয়। তবে কি দাগা তা আর উল্লেখ করেননি।
ভাইটির দুঃখময় উপাখ্যানে কেউ দুঃখিত হলো না। তাকে নিয়ে টিটকারি করতে লাগলো।
ফাহাদ মিচকা বাদরটা হেসে বললো,
“ছেলে ছেলে ট্রায়াল মেরে দেখেনই না ভাই। আজকাল তো ভালো মনের মেয়ে পাওয়াই মুশকিল।”
ফাতিন তার সঙ্গে সঙ্গে বললো,
“দেশে মেয়ে সংখ্যা এতো বেশি হয়েও যদি ফেইক আইডির সঙ্গে আহময়, উহময় ঘনিষ্ঠতা করতে যায়, তাহলে ভালো মনের মেয়ে গাছ থেকে পেয়ারার মতো টুপ করে পড়বে।”
ফাহাদ কাষ্ঠহাসি দিয়ে ফাতিনের দিকে এক নজর তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। মুখের থমথমে ভাবটা প্রকাশ করেও করলো না।
ধূর্ত!

এরপর সবাই প্রিয়লের দিকে জেঁকে বসলো।
বিহান ভাইয়া জিগ্যেস করলো,
“তা প্রিয়ল তোমারটার দাওয়াত পাবো কবে?”
প্রিয়ল হেসে বললো,
“দাওয়াত পাওয়ার সুযোগ নেই ভাই।”
“কেন, কেন?”
“বিয়েশাদি সেরে ফেলেছি। বউ ছোট বলে আপনার মতো বিবাহযোগ্য সন্তানসন্ততি লাভ করতে পারিনি। বউয়ের কাছে গেলেই আমাকে কেক ভেবে কামড় মারে, নাহলে প্রজাপতি ভেবে খামচি মারে।”
বিহান ভাইয়া ভ্রু নাচিয়ে জিগ্যেস করলো,
“তাহলে গতকাল খাবার টেবিলে মেয়ে চাইলে কেন?”
প্রিয়ল দীর্ঘশ্বাস ফেলে হতাশার ভঙ্গি করে বললো,
“বড়দের সামনে কি আর এসব দুঃখের দীর্ঘশ্বাস প্রকাশ করা যায়। আর বিয়েটাও খুব গোপনভাবে করা। আপনারা আমার অন্তরের মানুষ বলে শেয়ার করলাম।”
ফায়াজ ভাইয়া চেঁচিয়ে ওঠলো,
“বাটপার!”

তখন আমার কানে মিহির কথা এলো। মিহি মুখ কেমন করে বলে ওঠলো,
“উফ বিরক্ত লাগছে।”
সাকেরা তাকে জিগ্যেস করলো,
“কেন?”
মিহি কাঠ কাঠ গলায় বললো,
“প্রিয়ল ভাইয়ের মুখে অন্য মেয়ের কথা শুনে মেজাজটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।”
সাকেরা দন্তবিকাশ করে জিগ্যেস করলো,
“প্রেমে পড়েছো, হুম?”
মিহি ভ্রু নাচিয়ে জবাব দিলো,
“কেন, পড়তে পারি না?”
আমার তখন মন চাইছিল রান্নাঘর থেকে ডাল ঘুটনিটা নিয়ে আসি। এই মেয়ের কান ফুরে গুঁতা মেরে ঢুকাই। ফাজিল কোথাকার!

এরমধ্যে কে যেন জিগ্যেস করলো,
“তো ফাহাদ তোমার কি অবস্থা? ভাই বিয়ে করে ফেলছে। তোমার চরকি ঘুরবে কবে?”
আমি নড়েচড়ে বসলাম। এই ছাগল মে মে করে ঘাস খাওয়ার বস্তু। এ আবার কি গতি করবে? এর কাজই হলো অন্যের বউয়ের পিছনে লাইন মারা।

ফাহাদ লাজুক হেসে জবাব দিলো,
“পছন্দ একজন আছে। বলা যায় বাড়াবাড়ি রকমের পছন্দ।”
ফাহাদের এমন আকস্মিক বার্তা ও আগ্রহী প্রকাশভঙ্গি দেখে সবাই হৈ হৈ করে ওঠলো।
প্রিয়ল জিগ্যেস করলো,
“তো সে কে?”
“সে এখন এখানেই আছে। অর্থাৎ এই বাড়িতেই বর্তমানে অবস্থান করছে।”
সবাই আরেক দফা হোল্লা করে ওঠলো।
প্রিয়ল হেসে বললো,
“তাহলে আমাদের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দাও। তা না করে বড় ভাইদের মাঝখানে বসে শুধু তাদের প্রেমকাহিনী গলাধঃকরণ করছো।”
ফাহাদ কিছুক্ষণ পূর্বের মতো প্রিয়লকে অনুকরণ করে বললো,
“আর কাউকে দেখাই আর না দেখাই আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। কারণ আপনি আমার অন্তরের মানুষ।”
প্রিয়ল হেসে ফেললো।

আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ফাহাদের দিকে তাকিয়ে আছি। সে পিছনে মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে সামনের দিকে ফিরে।
আমি সোফার উপর পা তুলে আয়েশ ভঙ্গিতে ফাহাদকে গালাগাল শুরু করলাম।
মিহি ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে ফিরে জিগ্যেস করলো,
“কি বিড়বিড় করছো?”
“বিড়ালের লোতা লোতা মুত্র, ছাগলের কোষ্ঠকাঠিন্য গু, সারসের ভক করে দেওয়া বমি!”
“পাগল হয়ে গেছো?”
আমি চোখ রাঙিয়ে ওর দিকে তাকালাম। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। এই মেয়ে আর একটা কথা বলবে তো নাক বরাবর ঘুষি মারবো।
মিহি ভ্রু কুঁচকে জিগ্যেস করলো,
“কি? এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”
আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
“তোমার মুখ থেকে আর একটা শব্দ শুনবো তো নাক ফাটিয়ে দেব। বিশ্বাস না হলে ট্রাই করে দেখতে পারো।”
মিহি প্রথমে রাগান্বিত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে ছিল। আমার শান্ত ভঙ্গির নিশিত দৃষ্টিতে সে থেমে গেলো। ভীত চোখে তাকালো।
সাকেরা চকিত গলায় জিগ্যেস করলো,
“ফাবলীহা আপু, তুমি রেগো যাচ্ছো কেন!”
আমি তার দিকে তাকিয়ে মুহূর্তে মুখায়ব পরিবর্তন করে হাসি দিয়ে বললাম,
“রাগিনি।”
মিহি আর কিছু বললো না।

২৫.
সাকেরা বারান্দায় বসে খাতায় আঁকিবুকি করছিল। আমি তার পাশে গিয়ে বসলাম। আমাকে দেখে সে কেমন শক্ত হয়ে বসলো। সর্তক চোখে খাতার দিকে তাকালো। আমিও তাকালাম। তাকিয়ে দেখলাম, সাদা পৃষ্ঠার পুরোটায় এলোমেলোভাবে কলমের আচড় তোলা।
“কি ব্যাপার? কি করছিলেন আপামণি?”
সাকেরা দাঁত বের করে বললো,
“কিছু না। টাইম পাস।”
আমি হেসে বললাম,
“আচ্ছা? টাইপ পাস?”
তার খাতা নিতে নিতে বললাম,
“দেখি তো তোমার হাতের লেখা।”
সাকেরা স্বল্প মুহূর্তের দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে খাতাটা খানিক এগিয়ে দিলো।
আমি পৃষ্ঠা উল্টে তার খাতা দেখলাম।
“বাহ, সাকেরা! তোমার লেখা তো অনেক সুন্দর।”
তখন সে খাতাটি টেনে নিয়ে হেসে বললো,
“থ্যাংকিউ, থ্যাংকিউ।”
আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। সে যেমন আচমকা কেড়ে নিলো, আমি তেমন আচমকা কেড়ে এনে ভ্রু নাচালাম।
“কি ব্যাপার বল তো। কিছু একটা আপামণি লুকাচ্ছে মনে হচ্ছে।”
সাকেরা হাসার চেষ্টা করে বললো,
“কিছু না।”
আমি উল্টে-পাল্টে তার খাতা দেখলাম। সন্দেহজনক কিছু খোঁজে পেলাম না। পূর্বের পৃষ্ঠাটি বের করে চুপ করে বসে রইলাম। কিছুক্ষণ বাদে আমি হেসে ওঠলাম।
“ভালোবাসি!”
সাকেরা লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসলো।
আমি তাকে জ্বালাতন করে বললাম,
“খাতায় ভালোবাসি ভালোবাসি লেখা হয়। এমনভাবে লেখা হয়েছে যে কেউ বুঝতেই পারবে না।”
সাকেরা ঠোঁট উল্টে বললো,
“যাও আপু। এমন করো না। এভাবেই লিখেছি।”
আমি তার গাল টেনে বললাম,
“আমাকে আপু ব্যতীত আর কিছু ডাকলে আমি এই খাতা সবাইকে দেখাবো। আর বানিয়ে বানিয়ে বলবো তুমি প্রেম করো।”
সাকেরা কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো,
“আর ভাবি ডাকবো না। আমার খাতা দাও।”
“উঁহু, এটা আমার কাছে থাকবে। তোমাকে বিশ্বাস নেই।”
“আপু!”
সাকেরা তার খাতার জন্য আমার পিছন পিছন ছুটলো। আমি খিলখিল করে হাসতে হাসতে তার থেকে দূরে পালালাম।

একজন খানিক দূর থেকে দুজন অসম বয়সী কিশোরীদের প্রাণোচ্ছল হাসি-উচ্ছাস চোখ ভরে দেখছিলো। দুজনের মধ্যে একজনের দিকে ফাহাদের গভীর দৃষ্টি। পাশে দাঁড়িয়ে আরেকজনও তাদের অবলোকন করছিলো। তার প্রেয়সীর উপর অন্য কারও অন্যরকম দৃষ্টি ঠাহর করে সে এগিয়ে এলো।
প্রিয়ল ফাহাদের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তাকে জিগ্যেস করলো,
“অনেক সুন্দর, তাই না?”
ফাহাদ মৃদুভাবে জবাব দিলো,
“হুম।”
“পছন্দ হয়?”
ফাহাদ চমকে প্রিয়লের দিকে তাকালো।
হেসে মাথা নিচু করে ফেললো। পরক্ষণেই মাথা তুলে বললো,
“এটাই আমার পছন্দের মানুষ। ফাবলীহার সঙ্গে আমার পারিবারিকভাবে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। ভাইয়ার বিয়ের পরেই আমাদের কথাবার্তা ওঠবে। ফাবলীহাও আমাকে পছন্দ করে। কিন্তু মেয়ে মানুষ তো। একদমই প্রকাশ করতে চায় না।”
ফাহাদের চোখে মুখে লজ্জা। তার শ্যামবর্ণ চিপচিপে গড়নের লজ্জার ভঙ্গিমা দেখে তার পাশে দাঁড়ানো মানুষটির শিরা-ধমনীর বহমান রক্ত যেনো ফেঁপে ওঠলো। আকস্মিক আক্রোশে ত্বক ফেঁটে বের হতে চাইলো।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here