তুই আমার অঙ্গারাম্লজান – পর্ব ২১

0
224

#তুই_আমার_অঙ্গারাম্লজান
পর্ব_২১
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা

২৬.
অন্ধকারে ছেয়ে যাওয়া ছাঁদের এক কোণায় নানা আগডুম বাগডুম চিন্তা মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। উল্টোদিকে ফিরে মেরুদণ্ড সোজা করে অবস্থান করা ব্যক্তিটি থেকে কিছু শ্রবণের প্রত্যাশায় আছি। ছাদের একপাশে জ্বালানো আলোয় তার এক ইঞ্চিও নড়নক্ষম পরিলক্ষিত না হয়ে মস্তিষ্কে নানা দুঃশ্চিন্তা খেলে গেলো।

গভীর রাতে আম্মুকে ফাঁকি দিয়ে একা একা ছাদে পা রেখেছি। ভয়েই তো এমনিতেই অস্থির, কখন যেন আম্মুর ভয়াবহ ক্রোধান্বিত ডাক পড়ে যায়।
লিহা আপু যখন চিন্তিত মুখায়বে আমাকে চুপিসারে ডেকে প্রিয়লের সঙ্গে দেখা করতে বললো, তখন তার চিন্তা আমার মধ্যেও সংক্রমণের মতো প্রবেশ করে। আবার শুনলাম সে ছাদে অপেক্ষা করছে।
প্রিয়ল অবাধ ছাড়া হয়ে বাড়ি ভর্তি মানুষ নিয়ে যেখানে সেখানে ডাকার লোক নয়।
হতেও পারে। কয়দিনের পরিচয়ে কতটুকু আর কাউকে চেনা যায়। তবে সে ‘মানুষ পরিবর্তনশীল’ চলিত নীতিবাক্যের পরাক্রমের আওতাধীন না হয়ে থাকলে, আমার দ্বারাই কোনো গুরুতর ভুল সংগঠিত হয়েছে। ভুল না অপরাধ? কোন চোখে দেখছে প্রিয়ল?

আমি খানিক এগিয়ে গিয়ে প্রিয়লের পিছনে গিয়ে দাঁড়াই। তার নিকটস্থ হতেই তার তপ্ত নিঃশ্বাসের নিস্বন কানে ভেসে এলো। সে পিছনে ঘুরে দাঁড়ালো। আবছা আলোতে তার স্থির চাহনি দেখে আমার চিন্তা আরও বৃদ্ধি পেলো। অন্য কেউ হলে ভয় পেতাম। মনে উদ্ভট ও কলুষযুক্ত ভাবনার জায়গা দিতাম। কাছের মানুষ বলেই হয়তো ওই স্থির শীতল চাহনি ভেদ করে বুঝতে পারছি আমার প্রিয়লের মন ভালো নেই।
কষ্টের ফোটা ফোটা দানা আঠালো তরলের মতো তার হৃদয়ে পতিত হয়ে জমাট বাঁধছে। তার পূর্বেই তার হৃদয়ে আমাকে পৌঁছাতে হবে। জমাটবদ্ধ খোপে অনুভূতি বদ্ধপরিকর হলে আমি আমার প্রিয়লকে না ছুঁয়েও তার অনুভূতি বুঝবো কেমন করে? এতোটা দূরত্ব আমি মানবো না।

প্রিয়ল বুঝি তার ছঁদে ছন্দে উত্থিত হওয়া আমার খারাপ লাগাটাও বুঝলো।
আমার বাহুতে সে আলতো করে তার হাত রাখলো। সঙ্গে সঙ্গেই সরিয়ে নিয়ে জিগ্যেস করলো,
”ফাহাদকে তোমার কেমন লাগে?”
বিস্মিত হতে হতে হলাম না। প্রিয়লের কানে কেমন ও কতটুকু কথা আসতে পারে তার ধারণা নিমিষেই করতে পারলাম। বরং আমি আগেই চিন্তাভাবনা করেছিলাম। প্রিয়লকে জানাতে হবে ও শোনার পর তার প্রতিক্রিয়া কি কি হতে পারে তা-ও কল্পনা করেছি।
আমি চোখ-মুখ বিকৃত করে বললাম,
“এচ্ছি লাগে।”
“ওহ।”
ছোট্ট প্রত্যুত্তরের পর আবার জিগ্যেস করলো,
“ভালো লাগে না কেন? ছেলে তো ভালোই।”
প্রিয়লের শান্ত রাগ আমার ভালো লাগছে না। পাগলাটে প্রেমিকের মতো চিল্লাপাল্লা করুক। ফাহাদকে ইচ্ছে মতো গালিগালাজ করুক। আমাকে দোষারোপ করে বুকে চেপে ধরুক। শেষে আমার কাছেই ধরা দিয়ে আমার ভালোবাসা খুঁজুক।

প্রিয়ল তখন দুই হাতে আমার বাহু শক্ত করে চেপে ধরলো। ধারালো গলায় রাতের নিস্তব্ধতা ক্ষত-বিক্ষত করে বলে ওঠলো,
“তার সঙ্গে তোমার বিয়ের আলাপ-আলোচনা চলছে। মামীকে জিগ্যেস করতে সে-ও বললো। আমার এসব সহ্য হচ্ছে না ফাবলীহা। আমার মনে হয় বাড়ির প্রত্যেকটা ব্যক্তি তোমাকে ফাহাদের ভবিষ্যৎ অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে কল্পনা করছে। সেটাতে আমার কোনো সমস্যা নেই। আমার বাসা থেকে প্রস্তাব পাঠিয়ে, ফাহাদদের দমিয়ে বাকি ব্যবস্থা করা যাবে। কিন্তু সবার কেন মনে হচ্ছে তুমিও এতে রাজি?”
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
তার দিকে তাকিয়ে বললাম,
“আমার বয়স কতো বলুন। সতেরো চলছে। আমার যে বিশেষভাবে কোনো সিদ্ধান্ত থাকতে পারে এটা কেউ কল্পনাই করতে পারে না। এমনকি আমার মামা-বাবাও নয়। ধীরে ধীরে, নতুন নতুনভাবে আমার মা বুঝতে পারছে পশুর মতো সহজে বাগে আনার মতো মেয়ে আমি নই।”
তাচ্ছিল্য হেসে বললাম,
“রক্ত কথা বলে। কিন্তু মেয়ে বলে তারা মেয়ে-রক্ত হিসেবে মানে না। এই মুহূর্তে, এইখানে দাঁড়িয়ে আমি যে কথাগুলো বলছি এগুলোও তাদের নিকট বড় বিস্ময়! আমি ছোট এবং ছোট মেয়ে মানুষ। যার সঙ্গে বিয়ে-শাদির কথা হবে, তার প্রতি সেক্সুয়ালি এট্রেকট্রেড হবো। তার সঙ্গে বসা-শুয়ার কল্পনা করবো। এটাই সবাই ধরে নিয়েছে প্রিয়ল!”
ফু করে নিঃশ্বাস ছেড়ে ধীর গলায় বললাম,
“আমার সবচেয়ে কাছের মানুষজন কে বলুন তো। আপনি আসার আগে? আমার বাপ-মা। কিন্তু আমার বাপ জানে না, আমার মা জানে আমার ভেতরে কোনো সিদ্ধান্ত আছে, কোনো পরিকল্পনা আছে; কোনো সত্তা আছে!”
বিতৃষ্ণা নিয়ে বললাম,
“আমার বাপের সঙ্গে আমার বহুত ভালো সম্পর্ক। বহুত মধুর সম্পর্ক। এই মধুর সম্পর্কের খাতিরে উনি জানেন আমি ভালো জোকস বলতে পারি। বোকা বোকা প্রশ্ন করতে পারি, উদ্ভট-অনুর্বর কর্ম ঘটাতে পারি। কিন্তু উনি জানেই না আমার কিছু স্বপ্ন আছে। সেগুলো ডানা মেলে উড়তে চায়। উনি জানে না উনার একরোখা ও বদ্ধ পরিকল্পনায় আমার কষ্ট হয়। আবছায়া মন আত্নহত্যা করতে গান গায়। উনি শুধু জানে বিয়ের কথা শুনলে আমি লজ্জায় রাগ করি। আমার মা জানে, মা নেউটা তাকে ছাড়া থাকতে পারবো না বলে বিয়ের কথা শুনে আমি কেঁদে ভাসাই।”
প্রিয়লের একদৃষ্টে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ছাদের লাগানো বাল্বটির দিকে তাকালাম। কেমন কেঁপে কেঁপে আলো দিচ্ছে।
কম্পিত আলোর মতো কম্পনযুক্ত গলায় বললাম,
“এই যে আপনার আর আমার অনাকাঙ্ক্ষিত সম্পর্ক, এই ব্যাপারেও আমি মুখ ফুটে বলতে পারিনি কারণ আমি তো.. বাহ্যিকভাবে মনে হওয়া সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো আমি; আজ নিষ্ফলা মেয়ে সন্তান হওয়ার অপরাধিত্বে অপরাধী। আর তা আপনজনের কাছে প্রকাশ করতে বড় লজ্জা আমার।”

প্রিয়ল আমার গালে হাত রাখলো। মেঘবৎ তার চাহনি আর রূদ্ধ গলার সংমিশ্রণে আওড়ালো,
“আমার সঙ্গে তোমার অনাকাঙ্ক্ষিত সম্পর্ক? এটা জোরজবরদস্তি? আমার জবরদস্তির ফল আজ তুমি আমার সঙ্গে?”
প্রিয়লের চোখে যন্ত্রণা দেখলাম।
আমিও যন্ত্রণা নিয়ে বললাম,
“প্রিয়ল প্লিজ! কেউ আমাকে বুঝে না। আপনি অন্তত!”
আকুতির ইতি না টেনে ইতিহাসের ইতি টানার বাক্য বললাম,
“আমি সবসময় মা-বাবার সেরা সন্তান হতে চেয়েছিলাম। রিলেশন বলুন, অন্য কর্মে সংযুক্ত বলুন। কোনো কিছুর মাধ্যমে তাদের ছোট করতে চাইনি। ফলে ছোট আমিই রয়ে গেলাম। দায়িত্ব পালন আর টাকা-পয়সা খরচ। দায়িত্ব, দায়িত্ব আর টাকা, টাকার মাঝখানে ভালোবাসা পিষ্ট হয়ে স্যান্ডউইচ হয়ে গেলো।
প্রিয়ল, আপনি আমার জীবনে এসেছেন বলেই আমি বুঝতে পারছি যেটাকে আমি ভালোবাসা বলতাম, যাদের ভালোবাসা ভাবতাম– পুরোটাই ছিল একটা ভ্রম। উচ্চ বংশ ও সামগ্রী বিলাসিতার মাঝখানে আমি যে নিজেকেই ভালোবাসতে পারিনি। অথচ আমি বাবা-মায়ের একমাত্র কন্যা হয়ে কতশত টাকা উড়াই, তাদের সঙ্গে কত ঠাট্টা করি, কতো হাস্যোজ্জ্বল সম্পর্ক!”
প্রিয়ল আচমকা আমাকে তার আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে।

“বিশ্বাস করুন। বাপ-মায়ের অগোচরে কোনো পুরুষকে এভাবে জড়িয়ে ধরতে চাইনি। বাট আই লাভ ইউ। নট দ্যাট ফাহাদ চিকস!”
প্রিয়ল হেসে বললো,
“তাহলে তো বৈধভাবে বিয়েটা সেরে ফেলতেই হয়। বিশ্বাস করো তো আমায়?”
আমি তার বুকে মাথা রেখেই বললাম,
“বিশ্বাস আছে। আর এই বিশ্বাসটুকু অর্জন করার জন্য আপনাকে অভিনন্দন।”
প্রিয়ল হেসে আমার কপালে ঠোঁট ছুঁয়ালো।
খানিক বাদে বললো,
“তোমার যদি বিয়ে নিয়ে ভীতি থাকে, যদি মনে হয় আমার সঙ্গে থেকে, এখন বিয়ে করে সবকিছু গুছিয়ে উঠতে পারবে না, তবে বলতে পারো।”
আমি ঠাট্টার স্বরে বললাম,
“সমস্যা থাকলে বিয়ে করবেন না?”
“এহ, ঢঙের কথা বলো না। তুমি ইতিমধ্যেই আমার বউ। বউ মানে বউ। সারাজীবনের জন্য। তোমার এডজাস্টমেন্টের প্রবলেম হলে যেভাবে আমি পরিকল্পনা করেছি তা আরেকটু পরিমার্জন করতে হবে। কিন্তু তাই বলে ভেবো না, তোমার বড় হওয়ার অপেক্ষায় আমি দেবদাস হয়ে বসে থাকবো।”
প্রিয়ল আমার থুতনিতে হাত রেখে মুখ খানিক উপরে তুলে বললো,
“আমি তোমার স্বপ্নের ডানা কাটবো না ফাবলীহা। কিন্তু তুমি আমার হৃদয় খাচা থেকে মুক্তি চাইলে কঠোরভাবে বন্দি করবো। আমি কিন্তু এতোটাও জেন্টলম্যান নই।”

আমি তার বুকে আবার মাথা ঠেকালাম।
প্রিয়ল আমার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে ক্রোধিত গলায় বললো,
“এই ফাহাদের একটা ব্যবস্থা নিতে হবে। শালার বিয়ের শখ এমনভাবে ঘুচাবো আমি।”
আমি মাথা তুলে ভ্রু কুঞ্চিত করে জিগ্যেস করলাম,
“আবার ন্যাংটা করে দেবেন না তো?”
প্রিয়ল চোখ টিপে হাসলো।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here