তুই আমার অঙ্গারাম্লজান – পর্ব ২২

0
162

#তুই_আমার_অঙ্গারাম্লজান
পর্ব_২২
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা

২৭.
সোফায় বসে বাটি হাতে আয়েশ করে কমলা খাচ্ছি। ফ্রিজ থেকে মাত্র নামানো বলে মুখে দিতেই ভেতর চিনচিন করে ওঠলো। একের পর এক কমলার কোটা উদরে স্থান নিয়ে উদরপূর্তি করতে পারলেও মন ভর্তি করতে পারছে না। মন ভরানোর জন্য প্রয়োজন সোয়ামীর গরম গরম চুম্বন।
সতর্ক চোখে ভ্রু নাচিয়ে এদিক ওদিক দৃষ্টি বুলালাম। কোথায়, কার খাটের তলায় পড়ে আছে কে জানে।
তখন ফাহাদ তার ছোট্ট দেহটা নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। মাথা নিচু অবস্থায় চোখে মুখে সংকোচিত ভাব।
আমি চমকে ওঠলাম। এমন কুণ্ঠিত দৃশ্য খুব পরিচিত বোধ হচ্ছে।
আমি আমার বাটি সামনে বাড়িয়ে সেধে বললাম,
“খাবে নাকি ফাহাদ ভাই?”
“না ভাবি।”
বাড়ানো অবস্থাতেই আমার হাত স্থির হয়ে গেলো। চোখ দুটো অক্ষিগোলক থেকে বের হয়ে ফাহাদকে একবার প্রদক্ষিণ করলো।
আমি ভুল শুনেছি ভেবে জিগ্যেস করলাম,
“কি?”
ফাহাদ একই কুঞ্চিত ভঙ্গিতে জবাব দিলো,
“আপনি খান ভাবি।”

ঝনঝন করে কিছু পড়ার শব্দ পাওয়া গেলো।
মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম, ফাহাদের মায়ের হাত থেকে খাবার সহ কাচের বাটি পড়ে গেছে। সেই শব্দে আম্মু, মানসুরা খালা, আব্বু-চাচ্চুও ছুটে এলো। সেইসাথে তারা নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
আমি মেকি হাসি দিয়ে জিগ্যেস করলাম,
“তুমি আমাকে ভাবি ডাকছো কেন ভাই?”
সে উত্তর দিলো,
“ভাই হিসেবে তো বোন ডাকা উচিত। কিন্তু আমার অনেক ইচ্ছা।”
মোজাম্মেল চাচ্চু তৎক্ষণাৎ দূরে দাঁড়ানো থেকে জিগ্যেস করলেন,
“কি ইচ্ছা?”
ফাহাদ সেইদিকে তাকালো না। আমার দিকে মনোযোগ রেখে বললো,
“আপনাকে আমার ভাবি বানাবো, ভাবি। আমি স্বপ্ন দেখেছি, ভাবি। খুব গভীর স্বপ্ন, ভাবি। আপনাকে ভাবি না বানালে আমি বানর হয়ে যাবো, ভাবি। তা-ও আবার মেয়ে বানর, ভাবি।”
আমি মাথা হালকা কাত করে পেছনে তাকালাম। সবার বিস্ফোরিত দৃষ্টি ফাহাদের দিকে নির্দিষ্ট!
বিস্ফোরণ ঘটিত দৃষ্টি আমারও। তবে তাতে একাধিক কারণ নিহিত বলে।
দাঁত বের করে অনুচ্চ গলায় বললাম,
“নাইস তো।”

“এই ফাহাদ কি বলছিস এসব!”
আন্টির চিৎকারে ফাহাদ থতমত খেলো। গাল চুলকিয়ে হাঁসফাঁস করে বললো,
“যা শুনছো তা-ই বলছি।”
প্রিয়ল তখন শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে ডাইনিং রুমে এসে দাঁড়ালো। আমি প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালাম।
আন্টি তেতে উঠে বললেন,
“তুই কি কিছু খেয়েছিস? মাতাল হয়ে গিয়েছিস? ফাবলীহাকে তুই ভাবি ডাকবি কেন? তোর ভাবি নাই!”
ফাহাদ আমার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে বললো,
“সম্ভব হলে তো ভাবিকে আমার ভাবিই বানাতাম। এখন আমার নিজের ভাই দ্বারা যেহেতু সম্ভব নয়..”
ফাহাদ প্রিয়লের দিকে এগিয়ে গেলো। তার হাত চেপে ধরে বললো,
“ভাইয়া, আপনি তো আমার আপন ভাইয়ের মতো। আপনি ভাবিকে বিয়ে করবেন?”
প্রিয়ল থতমত খেয়ে হাত গুটিয়ে নিতে চাইলো। থেমে থেমে বললো,
“আমি কিভাবে? মানে.. কি বলছো ফাহাদ..”
ফাহাদ আকুতি ভরা কণ্ঠে বলে ওঠলো,
“প্লিজ প্লিজ ভাইয়া, প্লিজ! প্লিজ আপনি ফাবলীহা ভাবিকে বিয়ে করুন।”
মিহি আন্টির পাশে দাঁড়িয়ে ভয়ার্ত গলায় বললো,
“ফাহাদকে তো গাজাখোর ভাবিনি মামী। আচও করতে পারিনি। সে কবে থেকে এসব সেবন করছে?”
আন্টি তখন চিৎকার করে ওঠলেন,
“ফাহাদ!”
ফাহাদ ওসবে পাত্তা না দিয়ে প্রিয়লকে রাজী করানোর চেষ্টায় লেগে থাকলো। তাকে টেনে এনে আমার পাশাপাশি বসিয়ে দিলো। অশ্রুসিক্ত গলায় বললো,
“মাশাল্লাহ! কি সুন্দর লাগছে। কারও নজর না লাগুক।”

আমাদের থেকে দৃষ্টি বিকর্ষণ করে সে আমার আব্বুর কাছে দৌঁড়ে গেলো। তাকে গিয়ে টেনে আমাদের সামনে নিয়ে এলো।
বললো,
“দেখুন আঙ্কেল। কতো সুন্দর লাগছে না? এক্কেবারে মনিকাঞ্চন যোগ। তাই না?”
ফাহাদের এমন লাফ ঝাঁপ মারা দেখে আব্বু বুঝি ভয়ই পেলো। ঢোঁক গিলে হাসার চেষ্টা করে বললো,
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। ভালো।”
ফাহাদ আবার প্রিয়লের হাত ধরে বললো,
“করবেন ভাই? বিয়ে করবেন? বিয়ে না করলে কিন্তু আমি ছাদ থেকে লাফ দেব।”
প্রিয়ল হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
“এতো করে বলছে যেহেতু, তখন আর কি করার।”
আমি চোখ ছোট করে তার দিকে তাকালাম।
আন্টি এসে ঠাশ করে ফাহাদকে একটা থাপ্পড় লাগালো।
“অসভ্য ছেলে! পাগল হয়ে গিয়েছিস? ফাবলীহা তোর কোন জন্মের ভাবি হয়?”
ফাহাদ হাটু গেড়ে বসে আমার পা ছুঁয়ে নমনীয় গলায় বললো,
“ভাবি নয়, এ তো আমার মায়ের মতো।”
আমি আর প্রিয়ল বাদে বোধহয় উপস্থিত সবাই ‘আসতাগফিরুল্লাহ’ বলে চিৎকার করে ওঠলো। আমি কান চেপে ধরলাম।
আন্টি ফাহাদকে ধরে লাথি, উস্টা, কনি দিতে লাগলেন।
“কি খেয়েছিস তুই সত্যি করে বল। ওই ক্ষ্যাপাটে রাজুর পাল্লায় পড়েছিস না? ওর দলের সঙ্গে মিশে এটা ওটা গিলছিস না?”
ফাহাদ বুক ফুলিয়ে বললো,
“মেরে আমাকে রক্তাক্ত করো। কিন্তু ফাবলীহা ভাবি আমার ভাবিই রবে।”
“হারামজাদা! এসব ফিল্মি ডায়লগ আমার সাথে মারাস? ছাগলের বাচ্চা!”
ফাহাদের মাথায় ঠুনডা মারতে মারতে আন্টি তাকে ভেতরের ঘরে নিয়ে গেলেন।
প্রিয়ল তখন আমার পাশ থেকে উঠে নাচতে নাচতে বাহিরের দিকে গেলো। এমন ভাব, সে সত্যিই ফাহাদের আবদার রাখতে আমাকে বিয়ে করতো। আর ফাহাদকে বানর হওয়া থেকে বাঁচাতো।
আম্মু তখন আমার সামনে এসে কোমরে হাত রেখে ভ্রু কুঁচকে দাঁড়ালো।
আমি সন্দিহান গলায় জিগ্যেস করলাম,
“হোয়াট?”
আমি উল্টো সন্দেহবাতি গলায় জিগ্যেস করলেন,
“তোকে সবাই ভাবি ভাবি করে কেন? যেখানে যাস সেখানেই দেখি মানুষ ভাবি ভাবি বলে হোল্লা করে।”
আমি কপট রাগান্বিত গলায় বললাম,
“আশ্চর্য! সুন্দরী এবং বিবাহ উপযোগী মেয়ে। এমন মানুষকে সবাই বিবাহিত হিসেবে দেখতে চাইতেই পারে। অথচ তোমরা, ছ্যাহ! মেয়ের জন্য পছন্দ করো গানজুটি, পাগলাগারদের পাবলিক, ল্যাঙড়া-লুলা। ছ্যাহ, ছ্যাহ! থু!”
আম্মুর ভ্রুকুটি সরে গিয়ে আড়ষ্টতা দৃশ্যমান হলো।
আব্বুর দিকে তাকাতে তিনি কাচুমুচু করে অন্য দিকে তাকালেন।
তাদের মুখভঙ্গি দেখে বললাম,
“কি হলো? এখন মুখের বুলি নিশ্চল কেন? ভাগ্যিস! বরিশালের পাগল অন্তত ধরে এনেছিলে। কয়দিন পর তো দেখা যাবে হিজড়া ধরে এনে বলতে, নে মা। নম্র-ভদ্র ছেলে। ফুফুর সঙ্গেও চোখে চোখ রেখে কথা বলে না। সুন্নত পালনে বিছানায় ঘুমায় না, ডাইনিং টেবিলে ভাত খায় না। কিন্তু তলে তলে একটু পর্ণ এডিক্টেড।”
আম্মু বলে ওঠলো,
“ছিঃ, ছিঃ, নির্লজ্জ মেয়ে! এসব কি ধরণের ভাষা?”
আমি অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম,
“খারাপ ভাষা? তওবা পড়বো? তোমাদের পায়ে ধরে সালাম করবো মাতা-পিতা?”
আম্মু চোখ রাঙালে আমি উল্টো চেঁচিয়ে ওঠলাম,
“বিয়ে দেবে, সংসার করবে অথচ আমি এইটিন প্লাস কিছু জানতে পারবো না? বলি, জামাইয়ের সঙ্গে কি ধানক্ষেতে ধান বানবো? মাটিতে ষোলো ঘর কেটে এক্কাদোক্কা খেলবো?”
আব্বু মুখ কালো করে চলে গেলেন।
আমি গলা উঁচিয়ে ডেকে ওঠলাম,
“এই এই, মহাশক্তিধর পিতা! খাড়য় তুমি!”
আম্মুও যেতে নিলে আমি তার হাত ধরে আটকালাম,
“সিমরানের আবেগী বাপের বউ! তুমি দাঁড়াও।”
আম্মু মুখ গম্ভীর করে দাঁড়ালেন।
আমি আফসোস করে বললাম,
“সিমরানের আসল বাপ তো সিমরানকে বিয়ে শাদি দিতে চায়নি। আর আমার নকল সিমরানের বাপ মেয়েকে দেওয়ার জন্য অস্থির। এইজন্য নকল জিনিস ডেঞ্জারাস। আবার এক নকলের মাল আরেক নকল পছন্দ করে এনেছে।”
“হয়েছে? তর্কাতর্কি শেষ?”
আম্মুর কথায় মাথা নাড়িয়ে বললাম,
“নোপ! তুমি এখন আমার দেবর ওরফে ফাহাদকে আমার সামনে নিয়ে এসো।”
মানসুরা খালা এসে হাসলেন। পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,
“মা-মেয়ে ঝগড়াঝাটি পরে কর তো দেখি।”
আমার মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,
“আপনি একটু আমার সঙ্গে আসুন আপা।”
আম্মু তখন খালার সামনেই বললো,
“শোন, তোর বাপের নাচুনির জন্য আমি মত দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। নাহলে আমার এই ফাহাদ ছেলেকে একদম পছন্দ না! এই বাড়িই পছন্দ না। আপা আপনি রাগ করতে পারেন। কিন্তু আমি এই ঘরে আমার মেয়েকে দিতে চাই না।”
আমি ভেটকি মেরে বললাম,
“এখন আমার ইমোশনাল হয়ে চিৎকার করে মাটিতে মোচড়া-মুচড়ি করতে ইচ্ছে করছে। তুমি রাজি না। আবার নিজের পতীকে খুশি করবার জন্য মেয়েকে কেটে ভাসিয়ে দিতে উদ্যত। তোমাগো পাদের লজিক!”

ভেবেছিলাম আম্মু ধমকে উঠে সপাৎ করে লাগাবেন। কিন্তু তিনি রাগান্বিত হলেন না।
আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“তোর বাপকে এবার আমি শায়েস্তা করবো। হিন্দি ছবি দেখতে দেখতে বন্ধুর ছেলের সঙ্গে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার ঢঙ অনুসরণ করছে। ঢঙ আমি ময়লা পানির সঙ্গে মিশিয়ে যদি তোর এই বাপকে না খাইয়েছি।
আর এই বয়সে কোনো বিয়ে ফিয়ে না। করলে একেবারে আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে সাত-আট বছর পর।”
আম্মু আমার কপালে চুমু দিয়ে চলে গেলো।

এতো ভালো হতে কে বলেছে? সাত-আট বছর পর বিয়ে দেবে মানে? স্বামী-স্ত্রী তো দিব্যি আমাকে একা রুমে ফেলে রেখে ঘুমায়। গভীর রাতে একা ঘুমানোর কষ্ট কি তারা বুঝে?
ভূতকে কার্টুন হিসেবে কল্পনা করে, ভেতরে ভয় চেপে রেখে ঘুমানোর যন্ত্রণা তারা জানে! মাঝেমধ্যে তো কোল বালিশকে দেখলেও আঁতকে ওঠি, আল্লাহ এডা কেডা শুইতা আছে!

একজন পছন্দ করে আনে প্রতিবন্ধী, আরেক জনের তো পছন্দ করার সিস্টেমও নষ্ট। প্রিয়লের মতো সুন্দর ছেলেটাকে কি তাদের নজরে পড়লো না? মন চাইলো না এমন ভদ্র একটা ছেলের সঙ্গে নিশ্চিন্তে মেয়ের বিয়ে দেওয়া যায়?
আমার বাপ-মা দুজনের টেস্টই ওয়াক ওয়াক, ওয়াক। এইজন্য দুজন দুজনকে পছন্দ করেছে, আবার এতো বছর ধরে সংসার করছে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here