তুমি সুখের বৃষ্টি হয়ে ঝড়ো – পর্ব ১০

0
333

#তুমি_সুখের_বৃষ্টি_হয়ে_ঝড়ে
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ১০

হার কাঁপা ঠান্ডায় পুরো জমে আছে ধূসর। ভেজা শরীর নিয়ে সে দশ মিনিট হলো বেলকনিতে পায়চারি করছে।চুল থেকে যখনই এক ফোঁটা শীতল জল ঘাড় বেয়ে পিঠে নামছে তখন মনে হচ্ছে। ছেড়ে দে মা কেন্দে বাঁচি।ওয়াশরুমে গরম পানি পেয়ে ইচ্ছে মতো গায়ে ঢেলেছে। আর ভোর বারবার চিৎকার করে বলেছে। পানি শুধু আপনার নয় আমারও।আন্টি বলে গেছে এই পানি দিয়ে যেন দুজনেই ভাগাভাগি করে গোসল করে নেই।কারণ হিটারটা নষ্ট। যেহেতু সকাল সকাল বেরেতো হবে তাই সে আর কারো জন্য পানি গরম করবে না।কিন্তু ধূসর একটা কথাও কানে নেয়নি।আর যাঁর শাস্তি সরূপ এখন ঠান্ডায় জমে যাওয়া।আলমারি লক করে রেখেছে ভোর।অবশ্য এই শাস্তিটা আনতা বেগমই শিখিয়ে দিয়েছে।ভোরকে যেমন ধূসরের খামখেয়ালির জন্য এই শীতের ভোরে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করতে হচ্ছে। সেই জন্য ভোরের গোসল শেষ না হওয়া অবধি ধূসর এই ভেজা শরীরেই থাকবে।এতো কঠিন শাস্তি কেউ ছেলেকে দেয় তাঁর পুত্রবধুর জন্য।সে আমার মা নাকি ভোরের।আজ এর একটা ব্যবস্থা করতেই হবে।কথাটা বলেই বেলকনি থেকে ঘরে এলো ধূসর। সদ্য ভেজা শরীরটা নিয়ে ভোর ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ঘরে এলো।চুল থেকে এখনো ঝর্ণার মতো পানি পড়ছে।ব্যান্ডেজটা কি ভিজেছে।কতবার বারন করেছে মাথায় যেন পানি না দেয় তবুও পানি দিয়েছে। ইসস এখন যদি কিছু একটা খারাপ হয় তখন।নিজের গায়ে জড়িয়ে থাকা তোয়েলোটা দিয়ে তাড়াতাড়ি ভোরের চুল মুছতে শুরু করলো।ভোর সবে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েছে।হঠাৎ পিঠে ঠান্ডা হাতের ছোঁয়া পেতেই পুরো শরীর জমে গেলো।ঠান্ডার থেকে বেশি একজন পুরুষের হাতের ছোঁয়া পেতেই শরীরটা ঝাকিয়ে উঠলো।পিছন ঘুরতে চাইলেও সে পারলো না।কারণ খুব শক্ত করেই ধূসর আঁকড়ে ধরে ভোরের চুল মুছিয়ে দিচ্ছে।ভোর যে ঠিক করে চুলও মুছতে পারে না তা ধূসর বুঝে গেলো।ভালো করে চুল গুলো মুছে দিয়ে যখনই ভোরের ভেজা পিঠে হাত দিতে যাবে তখনই ভোর লাফিয়ে দূরে সরে গেলো।

ঠিক আছে বাকিটা আমি পারব।

আচ্ছা, এবার অন্তত আলমারিটা খুলে দিন।আমি আর পারছি না।কথাটা শেষ করেই একটা হাঁচি দিলো।ভোর গোপনে একটা হাসি দিলো যা ধূসরের চোখ এড়ালো না।তাঁর কষ্ট হচ্ছে আর এই মেয়েটা কিনা মজা নিচ্ছে। দেখে নিবে সময় বুঝে ঠিক কোপ দিবে।আজ আমাকে শাস্তি দেওয়া দুই শাশুড়ী পুত্রেরবউ।আমার সময় আসবে।কথা গুলো বিরবির করেই আলমারির কাছে গিয়ে দাঁড়াল ধূসর। ভোর নিজের লাগেজ থেকে চাবিটা বের করে আলমারি খুলে দিয়ে নিজে তৈরি হওয়ার জন্য বেলকনিতে চলে গেলো।তাঁর শাড়ির কুচিটা সুন্দর হয়নি সেটাই ঠিক করতে হবে।কিন্তু ধূসরের সামনে করা যাবে না।তাই সে এখন বেলকনিতে যাবে।ভোর যেতেই ধূসর একটি সাদা রঙের টিশার্ট আর কালো জিন্স পড়লো।সাথে শীতের একটি জেকেট।চুল টাকে একটু এদিক ওদিক করে ভোরের উদ্দেশ্যে বললো–

আমি নিচে যাচ্ছি পাঁচ মিনিটের মধ্যে নিচে আসুন।না হলে রেখে চলে যাবো।– ভোর ধূসরের কন্ঠ শুনে বললো।

এই আপনি এতটা খারাপ কেন? একটা মেয়ের শাড়ি পড়তেই তো কমপক্ষে দশ মিনিট লাগে।সেখানে পাঁচ মিনিটে কীভাবে তৈরি হব।

আমি দেখিয়ে দেই কিভাবে?

হ্যা দেখান

ওক্কে,কথাটা বলেই দ্রুত পায়ে ধূসর বেলকনিতে এলো।এসেই ভোরকে কোন কথা না বলেই কোলে তুলে নিলো।হঠাৎ এমন কান্ডে ভোর ভয় পেল।ধূসর ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে ভোরকে কোলে তুলেই ঘরে চলে এলো।দাঁড় করিয়ে দিয়ে সে আলমারির কাছে গিয়ে একটা কালো বোরকা নিয়ে এলো।বোরকটা বিছানার এক কোণে রেখে ভোরের ভেজা চুল গুলো খোঁপা করে একটি ক্লিপ মেরে দিলো।মুখে একটু স্নো লাগিয়ে দিলো।আগে থেকেই এক জোরা কানের দুল ভোরের কানে ছিলো তাই নতুন করে কোন কানের দুল পড়ালো না।বোরকাটা পড়িয়ে দিয়ে হেজাব এক কোণা করে বেঁধে দিলো মুখ খোলা রেখে।তারপর আয়নার সামনে নিয়ে গিয়ে বললো।

চার মিনিট তেইশ সেকেন্ড। পুরো পাঁচ মিনিটও লাগেনি।এবার দেখলেন পাঁচ মিনিটে কিভাবে মেয়েরা তৈরি হয়।আমার সাথে কোথায় যেতে হলে ঠিক এভাবেই তৈরি হতে হবে।এরথেকে বেশি সময় নিলে আমি কাউকে আমার সাথে নেই না।

ভোর বরফের মতো জমে গেলো ধূসরের কান্ডে।আসলে উনি কেমন।কি করতে চায় কি করে।তা হয়ত সে নিজেও জানে না।চোখ তুলে একবার আয়নায় তাকালো।না তাঁকে খুব একটা খারাপ দেখাচ্ছে না।বরংচ খুব সুন্দর লাগছে।এতো ফাস্ট কাউকে তৈরি করতে সে আগে কখনো দেখেনি।কিনবা কোন মানুষ মাত্র পাঁচ মিনিটে তৈরি হয়েছে তাও হয়ত ভোর দেখেনি।কিন্তু তাঁর সেই না দেখা ঘটনাটা তাঁর সামনে হয়েছে এবং তাঁর সাথেই হয়েছে। ভাবা যায়।

আপনার চিন্তা করা শেষ হলে এবার চলুন আমরা যাই।

হু

বললাম আপনার চিন্তার জগৎকে বলুন বাকিটা পড়ে চিন্তা করবো।এখন বেরোই।

ভোর ঘোরের মাঝেই বললো–হুম

তারপর ধূসর ভোরের হাত ধরেই নিচে নেমে এলো।ভোর তখনও তাঁর ভাবনার জগত থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেনি।মোটামুটি সবাই নিচে অপেক্ষা করছে।শুধু রুপা,বৃষ্টি, আর সুইটি বাকি।ওরা এলেই সবাই এক সাথে বেরুবে।ভোরকে ওমন উদাস থাকতে দেখে আনতা বেগম বললো–

কি হয়েছে তোমার–

ভোর কোন উত্তর দিলো না।

সেটা দেখে আনতা বেগম আবারও বললেন–

ভোর কি হয়েছে কি ভাবছ

ভোর কোন রকম বললো। কিছু না।

তখনই রূপা বললো–

আরে চাচি বুঝতে পারছ না।ভাইয়া তাঁর আধুনিক পাঁচ মিনিটের সেই টেকনিকটা ভাবির উপর প্রয়োগ করেছে।আর ভাবি সেই টেকনিক দেখে আশ্চর্য হয়ে ভাবনার জগতে ডুবে আছে।কথাটা বলেই রূপা হেঁসে দিলো।সাথে বাড়ির সবাই যোগ দিলো।ভোর সেটা দেখে খুব লজ্জা পেলো।কোন রকম আনতা বেগমের পিছনে লুকালো।তা দেখে আনতা বেগমও ভোরকে আড়াল করে নিলেন।তারপর সবাই একে একে বাড়ির বাগানে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির সামনে এলো।শুরু হলো ঝগড়া। কে কোন গাড়িতে যাবে।এটা নিয়ে প্রায় দশমিনিট সবাই ঝগড়া করলো।যখনই সফিক ইসলাম এলেন সবাই ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো।তারপর তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন কে কেন গাড়িতে যাবে।

সাফিয়া বেগম, আনতা বেগম, সুইটি এবং তাঁর ভাই সফিন আর তিনি এক গাড়িতে যাবে।মেঘ,বৃষ্টি রূপা এক গাড়িতে।আর ভোর,ধূসর তাঁরা আরেক গাড়িতে।সফিক ইসলামের উপরে কেউ আর কথা বলতে পারলেন না।কিন্তু তাঁর এই সিদ্ধান্তে আর কেউ খুশি হোক বা না হোক ধূসর খুব খুশি।অন্তত তাঁর কষ্ট তাঁর বাবা তো বুঝলো।

————

সবার গাড়িটা চলে যেতেই ধূসর গাড়ি সার্ট দিলো।গাড়ির শা শা শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না।পিনপতন নিরবতা গাড়িতে।গাড়ির কাঁচটা খোলা তাই বাতাসে ভোর চোখ খুলে তাকাতেই পারছে না।ধূসর লক্ষ করে গাড়ির কাঁচ লাগিয়ে দিলো।ভোর কিছুই বললো না।এতটা নিরবতা হয়তো কোন অচেনা মানুষের সাথে জার্নি করলেও হয় না।অথচ ধূসর জীবন সঙ্গী নিয়ে জার্নি করছে ভাবা যায়।ভোর খুব অস্থিরতার মাঝে আছে।একে তো গাড়িতে তাঁর উপর ধূসরের সাথে। তাঁদের বাড়িতে গাড়ি থাকলেও সে কখনো গাড়িতে চলাচল করেনি।তাই তাঁর শরীর খারাপ লাগছে।হঠাৎ শরীরের মাঝে একটু পরিবর্তন ঘটতেই ভোর চমকে উঠলো।আল্লাহ এমন অবস্থায় না ফেললেও পারতো।এখন উপায়।বসা অবস্থায় মোড়ামুড়ি শুরু করলো ভোর।ধূসর দেখেও না দেখার ভান করে রইলো।কতক্ষন ভোর মুখ বুজে থাকতে পারে সেও দেখতে চায়।তখনই ভোর বললো।

প্লিজ একটু রূপা আপুকে ফোন করুন।ধূসর শুনেও বললো।কি?

বলছি একটু রূপা আপুকে ফোন করুন।

ওদের গাড়ি আমাদের অনেক সামনে।এখন কি করে ফোন করবো।কি হয়েছে বলুন আমায়।

আসলে, আমার।

ধূসর কিছু একটা বুঝে বললো–
আপনি ঠিক আছেন।কি হয়েছে বলুন আমায়।

মানে?

বুঝতে পেরেছি।সামনে একটা ছোট্ট শপিংমল আছে।কিন্তু সেখানে চেঞ্জিং রুম আছে কিনা জানি না।গিয়ে দেখতে পারি।চলুন।তারপর ধূসর গাড়িটা একপাশে দাঁড় করিয়ে ভোরকে বললো অপেক্ষা করতে।ধূসর পনেরো মিনিট পর ফিরে এলো একটি সাদা রঙের মোড়ানো একটা প্যাকেট নিয়ে।ভোরের হাতে দিয়ে বললো।

আমি আপনার স্বামী। সম্পর্কেটা স্বাভাবিক না হলেও বন্ধু ভাবতেই পারেন।এই স্বাভাবিক বিষয়টা এতটা সিরিয়াস নেওয়া কিছু নেই।আর এই বিষয়টার জন্য রূপাকে কল করলে ওরা শুধু শুধু মজা করতো আপনায় আর আমায় নিয়ে।আর এটা বলতে এতটা লজ্জা পাওয়ার কি আছে।যাইহোক চলুন। ধূসর ভোরকে নিয়ে চেঞ্জিং রুমে সামনে দাঁড়াল ।

আপনি চেঞ্জ করে আমায় কল করবেন।আমি একটু ঔষধের দোকান থেকে আসছি।

এই না

কেন সমস্যা।

আসলে এখানে আমি একা

আচ্ছা, আপনি যান আমি এখানে অপেক্ষা করছি। ভোর চলে যেতেই ধূসর এক ছুটে ফার্মেসিতে গিয়ে একটা প্যারাসিটামল এবং রেব ২০ মি.গ্রা. কিনে নিয়ে এলো।ভোর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার আগেই ধূসর নিজের জায়গায় স্থীর হয়ে দাঁড়ালো। হাতে একটি ফ্রেশ পানি।ভোর বেরিয়ে আসতেই ভোরের হাতে ঔষধ আর পানি ধরিয়ে দিলো।

এটা খেয়ে নিন।

কিসের ঔষধ

খেয়ে নিন,অনেকটা পথ জার্নি করতে হবে।এই অবস্থায় এতো ঝাঁকি শরীর নিতে পারবে না।অসুবিধা হতে পারে।

আপনি কি করে জানেন এই সময়ে ঝাঁকি শরীর নিতে পারবে না।

আপনি বড্ড প্রশ্ন করেন।কিন্তু সঠিক প্রশ্ন না উল্টো প্রশ্ন।

কিন্তু

ভয় নেই আমি কথা বলেই এনেছি। খেলে সমস্যা হবে না।

ভোর ধূসরের হাত থেকে নিয়ে ঔষধ গুলো খেয়ে পানির বোতল ধূসরের হাতে ধরিয়ে দিলো।তারপর দু’জনেই গাড়িতে গিয়ে বসলো।আবার গাড়ি ছুটতে রইলো আপন গতিতে। আর ভোর অবাক হয়ে ভাবতে রইলো।সত্যি মানুষটা সবার থেকে আলাদা।

চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here