তুমি সুখের বৃষ্টি হয়ে ঝড়ো – পর্ব ১১

0
332

#তুমি_সুখের_বৃষ্টি_হয়ে_ঝড়ো
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ১১

সর্দার বাড়ির গেটে এসে পরাপর তিনটা গাড়ি থামলো।একে একে সেই গাড়ি থেকে নেমে এলো সবাই। সব শেষে নেমে এলো ভোর।তাঁর শীতল চোখ দু’টো কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে রইলো চারিদিকে। এক তলা একটি বাড়ি। কতটা সুন্দর তাঁর বর্ননা করা যাবে না।গেটের দুই দিকে ফুলের বাগান।মাঝখানেই রয়েছে হাঁটা চলার পথ।বিশাল উঠোন। উঠোনের মাঝেই একটি আমগাছ। যাকে ঘিরে রয়েছে ইট সিমেন্টের স্থাপনা। হলুদ সাদা রঙের বাড়িটা এক তলা।বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই দেখা যায় একটা খোলা বারান্দা।সেখানেও রয়েছে বিভিন্ন ফুলের এবং ঔষধের গাছগাছালি।বিশাল এক লোহার গেইট ঠেলে ঢুকতে হয় ঘরের ভেতর।তারপরেই দেখা যাচ্ছে সোফাসেট।একটি বিশাল আকারের দেয়াল ঘড়ি।তাঁর পাশেই রয়েছে আল্লাহু লেখা সঁপিজ।চারিদিকে আভিজাত্যের ছোঁয়া। দেয়াল থেকে খসে পড়ছে বালির গুঁড়ো। কিন্তু তবুও বাড়ির একটুও সৌন্দর্য নষ্ট হয়নি।পুরো বাড়িতেই রয়েছে আদর,যত্ন আর ভালোবাসা। কোন বাড়িটা অবহেলায় আর কোনটা অতি যত্নে আছে তা বাড়ির ইট দেখলেই বোঝা যায়।আর সব থেকে বড় আশ্চর্য হচ্ছে। এই পুরো বাড়ির যে রুমেই তুমি যাও না কেন? ড্রইং রুমেই তোমায় ফিরে আসতে হবে।কারণ সব দরজার শেষ ড্রইং রুমে।বিষয়টা ভোরের কাছে খুব ভালো লাগলো।এখানে লুকোচুরি খেলা যাবে খুব সুন্দর। বাড়িটা ঘুরেফিরে দেখতে দেখতে সে যে সবার থেকে আলাদা হয়ে গেছে তা ভোর একটুও খেয়াল করেনি।হঠাৎ তাঁকে কেউ ডাকতেই ভোর পিছু ফিরে চাইলো।পিছু ফিরতেই দেখতে পেলো।একজন গম্ভীর মানুষ দাঁড়িয়ে।সাথে তাঁর শাশুড়ী এবং শ্বশুর। মুরুব্বির বয়স কত হবে।সত্তর কিনবা আশি। কিন্তু আসল বয়সটা আন্দাজ করতে পারছে না ভোর।কিন্তু সেই মানুষটা তাঁকে এমন ভাবে দেখছে যেন তাঁর অপেক্ষাতেই ছিলো সে।উনাদের থেকে ভোরের দূরত্ব খুব বেশি দূর নয়।তাই ভোর দেখতে পেলো লোকটার চোখে জল ছলছল করছে।মানুষটা কাঁদছে কেন এটারি কোন কারণ বুঝলো না ভোর।তাই সে হাসি মুখে সামনে এগিয়ে গিয়ে লোকটাকে সালাম জানালো।লোকটা ভোরকে বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো।সাথে আনতা বেগমও। তাদের কান্নার গতি দেখে ভোরের কাছে মনে হলো এই কান্না জমিয়ে রাখা কান্না।যা আজ ঝড়ে পড়ছে। কোন বিষেস কারণ খুঁজে পেলো না কান্নার জন্য। তখনই ধূসর বললো—

ভোর উনি কে জানেন?আপনার মায়ের বাবা।আর এই যে যাকে এতোদিন শাশুড়ী বলে জানতেন সে আপনার খালামনি।অনেক কষ্টে এই এক সপ্তাহ মা’কে সামলেছি আর পারছি না।আজ আপনার দায়িত্ব এই মানুষ দু’টোকে সামলানোর। আপনাকে আপনার আপনজনের সাথে দেখা করানোই ছিলো আমার আর বাবা-র উদ্দেশ্য। এই জন্যই দেশের বাড়িতে আসা।ভোর যেন ধাক্কা খেলো মনের সাথে। তাঁর এতো আপনজন থাকতে নিজেকে একা মনে হয়েছে এতোদিন। যাঁর গায়ে মায়ের গন্ধ আছে বলে মনে হয়েছে। আসলে সত্যি তাঁর গায়ে মায়ের গন্ধ আছে।যাকে মনে হয়েছে মায়ের মতো সে কেন আগলে রাখছে। আসলে সে আমার মায়ের বোন।বোনের রেখে যাওয়া আমানত সে আগলে রেখেছে। তাঁর মায়ের এতো বড় একটা বটবৃক্ষ থাকতে তাঁর মা’কে সইতে হয়েছে এতো কষ্ট। এতোবড় সম্পদের মালিক হওয়ার পরেও তাঁর মা’কে সমপ্তির জন্য অত্যাচার সইতে হয়েছে। না এই মানুষ গুলো তাঁর আপন কিছুতেই হতে পারে না।শেষ মুহূর্তেও তাঁর মা’কে সইতে হয়েছে অসয্য যন্ত্রণা।যাঁরা আমার মায়ের কষ্টের ভাগিদার হয়নি তাঁরা কখনোই আমার কষ্টের অংশীদার হতে পারে না।কিছুতেই না।আঁকড়ে ধরা হাতটা আপনাআপনি ছুটে গেলো।কাউকে কিছু না বলেই বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।অনেকটা পথ দৌড়ে এসে সে কোথায় এসে থামলো সে নিজেও জানে না।কিন্তু জায়গাটা একটা নির্জন বাগান।এখানে রয়েছে অসংখ্য ফলের গাছ।একটি গাছের তলায় বসেই চিৎকার করে কাঁদতে রইলো ভোর।বুকটা ক্রমশই ভারি হয়ে উঠলো।এতো আপন মানুষের ভিড়ে কখন জানি ভোর হারিয়ে যায়।একি শহরে তাঁর আপন মানুষ ছিলো অথচ মা’কে কষ্ট পেতে দেখেছি একা।নিজের কষ্ট গুলো কাউকে বলার মতো সঙ্গী ছিলো না।ছিলো না কাউকে জড়িয়ে ধরে কান্নার জন্য একটা মানুষ। আর আজ যখন সেই মানুষটা নেই তাঁর সূত্র ধরেই কত আপনজন পেয়েছে ভোর।আজ কি করবে আপনজন দিয়ে। কোন দরকার নেই সেই আপনজন দিয়ে। অসময়ে যাঁদের পাশে পায়নি সময়ে পাশে রেখে কি লাভ।এসব কথা যখন ভোর ভাবছে তখন মনে হলো কেউ তাঁকে পিছন থেকে ধরেছে।ভোর পিছন ফিরতেই সেই বৃদ্ধলোককে দেখতে পেলো।জল ভরা চোখ সরিয়ে সামনে তাকালো ভোর।লোকটা বুঝতে পারলো অনেক অভিমান ঘৃণা জমে আছে ভোরের বুকে।তাই তাঁর হাতে থাকা লাঠিটা পাশে রেখে সেও ভোরের পাশে বসে পড়লো।ভোর সব দেখেও কোন রিয়াক্ট করলো না।তখন লোকটা ভোরের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বললো–

আমি জানি নানু তুমি আমার উপর অনেক রেগে আছো।কিন্তু তুমি কি জানো আসলে কে বেশি অপরাধী। নানু তোমার মায়ের এই অবস্থার জন্য তোমার মা দায়ী। আমি বা তোমার খালামনি এসব বিষয়ের কোন কিছুর সাথে অবগতি নই।আমরা তোমার মা’কে হাজারবার বারন করেছিলাম।কিন্তু তোমার মা আমাদের কোন কথা শোনেনি।তাই তো এই অকাল মৃত্যু তোমার মা’কে গ্রহন করতে হয়েছে। আর সব থেকে বড় সত্যি তোমার মায়ের হায়াত ওই অবধি সীমাবদ্ধ ছিলো।এটা ভেবো না আমার মেয়ের জন্য আমার কষ্ট হচ্ছে না।আমি কখনোই আমার কষ্ট কাউকে দেখাতে পারি না।মেয়ে হারানোর শোক আমি সেদিন পেয়েছিলাম।যেদিন তোমার মা আমাকে সবার সামনে অপমান করে এক কাপড়ে আমার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলো।এতে অবশ্য ওরও কোন দোষ ছিলো না।ইনু সব সময় সম্মান হারানোর ভয় পেত।আর সেটাই হলো যেটাকে ও ভয় পেত।নানু জীবনের চাকা কোন দিকে ঘুরবে তা আমি তুমি কেউ জানি না।আমি ওকে অনেক বার বলেছিলাম ওই নরক জীবন থেকে ফিরে আসতে।কিন্তু ও কখনোই ফিরে আসার জন্য রাজি হয়নি।এতো আরাম আয়েশ জীবন জাপান ছেড়ে ওই কষ্টে ভরা জীবনকে ইনু বেছে নিয়েছিলো।যখন ওকে একটু বেশি জোর করছিলাম তখন ও আমাদের না জানিয়ে ধরা ছোঁয়ার বাহিরে চলে গিয়েছিলো।তাই চাইলেও আমরা পারিনি ওকে আগলে রাখতে।আমি জানি না নানু তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে কিনা।আজ,যে বললে তুমি সব বিশ্বাস করতে সেই নেই।তাই আমি আর কিছু বলতে চাই না।তুমি থাকো।মন শান্ত হলে ঘরে এসো।তোমার মা হারানোর কষ্টটা কিন্তু আমার সন্তান হারানোর থেকে বেশি না।আমানুল সর্দার চলে যেতেই ধূসর গিয়ে পাশে বসলো।ভোর সব নিরবে দেখে গেলো আর চোখের জল ফেলে গেলো।

ভোর খালামনি সেদিন বিকালে আমার সাথে দেখা করেছিলো,যেদিন ভোররাতে তিনি মা-রা যান।কথাটা শোনা মাত্র ভোর একটু শব্দ করে উঠলো।কিন্তু সেই শব্দের কেমন আওয়াজ তা ধূসর বুঝতে পারলো না।তাই ভোরের ঘাড়ে হাত দিয়ে বলতে রইলো।

আপনার মায়ের সাথে ওইদিনই আমার প্রথম দেখা।এর আগে আমি কখনো তাঁকে দেখিনি।তিনি কতটা অবহেলিত ছিলো সেদিন তিনি আমায় বলেছিলো।আপনার কথাও বলেছেন।সেদিন তিনি আপনার দায়িত্ব আমার উপর সঁপে দিয়ে গিয়েছিলেন।আর দিয়েছিলেন একটা ডায়েরি। বলেছিলেন আপনি যেদিন সত্যের মুখোমুখি হবেন সেদিন ওটা দিতে।সেদিন আমার কার জন্য কষ্ট পাওয়া উচিত ছিলো আমি জানি না ভোর।কিন্তু এতটুকু বলতে পারি। আমার মা বা নানা এসবের জন্য অপরাধী নয়।প্লিজ আপনি তাঁদের ভুল বুঝবেন না।আপনি আপন মানুষের থেকে কষ্ট পান আমি এটা চাই না।আপনার ওই চোখে আজকের পর থেকে কোন মেঘের ভেলা দেখতে চাই না।আপনার মুখে পড়বে না কোন বিষাদের ছায়া।ঠোঁটে থাকবে না মিথ্যা হাসি।এখন থেকে যা পাবেন।যতটুকু পাবেন।তা আগলে রাখবেন। এটা ধরুন।আজকেই জীবন থেকে সব অতীতের কষ্ট ধুয়েমুছে ছাফ করুন।ডায়েরিটা ভোরের হাতে গুঁজে দিলো ধূসর। এক মনে ডায়েরির দিকে চেয়ে রইলো ভোর।কি আছে এই ডায়েরিতে।কি অপেক্ষা করছে এরমাঝে ভোরের জন্য। কোন সত্যির মুখোমুখি হতে চলেছে ভোর।

চলবে,,

গল্পে এখন মোড় ঘুরবে।অপরাধী শাস্তি পাবে।ভোর ধূসরের সম্পর্কে ফাটল ভালোবাসা দু’টোই হবে।সবাই তৈরি তো?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here