তুমি সুখের বৃষ্টি হয়ে ঝড়ো – পর্ব ৩

0
377

#তুমি_সুখের_বৃষ্টি_হয়ে_ঝড়ো
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ৩

দেয়াল ঘড়িটা যখন জানান দিলো রাত একটা বেজে গেছে। ঠিক তখন মোর্সেদ বাড়ির গেটে এসে একটি রিক্সা থামলো।রিক্সার সিটে বসে আছে দু’জন তরুণ তরুণী। তরুণের বুকে লেপ্টে আছে তরণী।তরণীর প্রতিটা শ্বাস তরুণের হৃদয় ছুঁয়ে যাচ্ছে।ঘুমে আচ্ছন্ন হওয়া তরণী যেন খুব আড়ামেই আছে।ইচ্ছে করছে না এই আরামের ঘুমটা নষ্ট করতে। কিন্তু সব চাওয়া যে সব সময় পূরণ হয় না।তাই ধূসর চেয়েও পারছে না ভোরকে এই শান্তির ঘুমটা উপহার দিতে।তাই সে আস্তে আস্তে ভোরকে ডাকতে রইলো।কয়েকটা ডাক দিতেই ভোরে একটু নড়েচড়ে উঠলো।কিন্তু তাঁর ঘুম ভাঙলো না।ঘন্টাখানেক আগের ভোরের সাথে এই ঘুমে বিভোর হওয়া ভোরের কোন মিল নেই।চারদিন আগের শক্ত কঠিন মেয়ের মাঝেও আজকের এই নরম তুলোর মতো মেয়ের কোন মিল নেই।অনেক বেগ পেতে হয়েছে ভোরকে শান্ত করতে ধূসরের।অনেকটা সময় ব্যয় হয়েছে ভোরকে স্বাভাবিক করতে।তাইতো তাঁদের ফিরতে ফিরতে এতো রাত হয়েছে। চাইলেই সে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যেতে পারতো।কিন্তু ওই যে সব আশা পূর্ণ হয় না।তাই আবারও ভোরকে ডাক দিলো ধূসর। এবার আর ভোর নড়েচড়ে ঘুমিয়ে পড়েনি।এবার সে জেগে উঠেছে। রিক্সা ওয়ালার ভাড়া বুঝিয়ে দিয়ে ভোরকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো ধূসর। সদরদরজা খোলা ড্রইংরুমের আলো জ্বলছে।তাহলে কি কেউ ভোরের জন্য অপেক্ষা করছে?কারো কি টেনশন হচ্ছে ভোর কেন এখনো বাড়িতে ফেরেনি তাই? কিন্তু ধূসরের সমস্ত ভাবনা ভেঙে দিয়ে কেউ একজন বলে উঠলো।

কোন ভদ্রবাড়ির ছেলে, মেয়ে এতো রাত অবধি বাড়ির বাহিরে থাকে না।

গলাটা খুব চেনা লাগলো ধূসরের।তাই সে গলার স্বর অনুসরন করে সামনে তাকাতেই দেখতে পেলো তাঁর বাবা দাঁড়িয়ে। নিজের বাবা সিরাজুল ইসলামকে দেখে থমকে দাঁড়ালো ধূসর। এতো রাতে তাঁর বাবা এই বাড়িতে।তাও তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এ যে খুব ভালো ব্যপার নয় তা সে ভালোই বুঝতে পারলো।কিন্তু কিছু বলা বা বোঝানোর সময়ও এখন না।কিন্তু তবুও তাঁর বাবাকে বোঝাতে হবে।না হলে যে তাঁর বাবা তাঁকে ভুল বুঝবে। তাই সে কিছু বলার জন্য উদগ্রীব হলেই কোথা থেকে সফিউল মোর্সেদ এবং সমিউল মোর্সেদ বলে উঠলো।

দেখেন ভাই দেখেন নিজের চোখে দেখেন।আমরা ভুল বলেছি নাকি ঠিক।আপনার ছেলে কিভাবে একটা যুবতী মেয়েকে নিয়ে এতো রাতে বাড়ি ফিরছে।লোকসমাজে আমরা মুখ দেখাবো কি করে।আর এই মেয়েকেই বা কি বলবো।যেমন মা তেমনি তাঁর মেয়ে।এই মেয়ের মায়ের বংশে আছে ছেলেদের ফাঁসানো। আপনার ছেলেকেও ছাড় দিলো না।আপনি আপনার ছেলেকে কি করবেন জানি না।কিন্তু আমি যে এই মেয়েকে ঘরে তুলবো না এটাই ফাইনাল।

ভাইয়ের সাথে গলা মেলালো সমিউল মোর্সেদ।আর ঘৃণার দৃষ্টিতে চেয়ে রইলে ভোর।মানুষ কতটা নিকৃষ্ট হতে পারে তা এই বাড়িতে সে জন্ম না নিলে জানতে পারতো না।আর কতটা নিচে নামবে তাঁরা সেটাও জানে না ভোর।তাঁকে খারাপ বলছে তাতে ভোরের বিন্দুমাত্র আফসোস নেই।কিন্তু ধূসরকে।আমার সাথে না-হয় তাঁদের শত্রুতা কিন্তু ধূসর। ধূসর কি করেছে। না আর মুখ বুজে থাকলে চলবে না।এবার কথা বলতেই হবে।

আঙ্কেল এক তরফা বিচার কখনোই করা উচিৎ নয়।কখনো কখনো শূন্য চোখে আমরা যা দেখি তা সত্যি না-ও হতে পারে।আর সবাই যে সত্যি বলে তা-ও কিন্তু না।আমাদের মাঝে লুকিয়ে থাকে মানুষ নামের জানোয়ার গুলো।কিন্তু আফসোস কি জানেন।মানুষ গুলো আর অমানুষ গুলো দেখতে ঠিক একি রকম।তাই আমাদের চিনতে অসুবিধা হয়।কথায় আছে কি বলেন তো।জানোয়ার বললে মানুষ রেগে যায় আর বাঘের বাচ্চা বললে খুশি হয়।অথচ তাঁরা ভুলে যায় দুটোই পশু।তাই নিজের ছেলেকে অন্যের কথায় ভুল বুঝবেন না।আমি খারাপ তাই আমার কথা আপনাদের ভাবতে হবে না।আমাকে এরা জায়গা না দিয়ে কোথায় যাবে।এই বাড়ির মালিক আমি।তাঁরা চাইলেও আমাকে তাড়িয়ে দিতে পারবে না।কারণ এতে তাঁদের আমও যাবে সাথে ছালাও।আপনি উনাকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে যান।আর আপনাকে বলছি যখন তখন কেউ ফোন করলেই আমাদের বাড়িতে আসবেন না।কারণ এই বাড়িতে মানুষের থেকে অমানুষের আনাগোনা বেশি।

ভোর, বলেই চিৎকার করে উঠলো সমিউল মোর্সেদ।

দয়া করে আর আপনার কন্ঠকে বাজাবেন না।ওই কন্ঠটা আমার কাছে কুকপক্ষীর মতো ভয়ংকর লাগে।আপনি কুকপক্ষীর থেকেও ভয়ংকর।

কথাটা শেষ করতে পারলো না ভোর তাঁর আগেই সমিউল মোর্সেদ ভোরের গালে চড় উঠালেন।কিন্তু সেই চড় ভোরের গালে পড়ার আগেই একটি শক্ত হাত ধরে ফেললো।ভোর চোখ বুজে নিয়েছিলো যখন তাঁর বাবা চড় তুলেছিলো।কিন্তু যখন বুঝলো চড়টা তাঁর গালে পড়েনি।তখন সে চোখ খুললো এবং দেখলো তাঁর বাবা-র হাত ধরে রয়েছেন সিরাজুল ইসলাম। লোকটা যে ঠান্ডা মাথায় কাজ করে তা ভোর কয়েক মিনিটেই বুঝে নিলো।তিনি সমিউল মোর্সেদের হাতটা নামিয়ে দিয়ে বললো–

সব জায়গায় গায়ের জোর চলে না।কোথাও কোথাও মাথা কাজে লাগাতে হয়।এই কথা বলেই ধূসরের দিকে তাকালেন সিরাজুল ইসলাম।

মাওলানা সাহেব অপেক্ষা করছে অনেকক্ষণ। তাঁকে আর বসিয়ে রাখলে চলবে না।চলো ধূসর। বাড়িতে ফিরতে হবে।কথা গুলো বলেই সিরাজুল ইসলাম ভোর এবং ধূসরের হাত ধরে সোফায় বসিয়ে দিয়ে মাওলানা সাহেবকে বললেন বিয়ে পড়াতে।ধূসর ভোর যেন কয়েক মুহূর্তে বরফের মতো জমে গেলো।বুঝতে পারলো না, কি হচ্ছে আর কি হবে।কিছু বলতে চেয়েও যেন ধূসর কিছু বলতে পারলো না।আর ভোর সে তো পুরো বরফের মতো জমে রইলো।মাওলানা সাহেব বিয়ে পড়াতে শুরু করলো।ধূসর কিছু বলতে পারলো না।তাই সে বসা থেকে দাঁড়িয়ে পরলো।

অসম্ভব আব্বু আমি এই বিয়ে করতে পারবো না।

সিরাজুল ইসলাম কঠিন চোখে তাকালো ধূসরের দিকে।ধূসর সেই চাহনি অসম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বললো–

প্লিজ আব্বু আপনি বোঝার চেষ্টা করুন।এই বিয়েটা হলে কারো ভালো হবে না।বিষেস করে ভোর।তিনি এই বিয়েতে কখনো রাজি ছিলো না।সে এক প্রকার বাধ্য হয়ে রাজি হয়েছিলো তাও তাঁর মায়ের জন্য। এখন যখন তাঁর মা বেঁচে নেই তাহলে শুধু শুধু কেন তাঁর মনের বিরুদ্ধে সে এই বিয়ে করবে।

দেখেছেন ভাই।আপনার ছেলে কতটা ব্যয়াদপ। দুপরেও ঠিক এমন ব্যবহারি আমাদের সাথে করেছিলো।চরম ব্যয়াদপ একটা ছেলে।আপনার ছেলের কাছে এমনটা আশা কখনো করিনি।

আর একটা মিথ্যা বললে জিহ্বা টেনে ছিঁড়ে দেবো।

ধূসর। চিৎকার করে উঠলো সিরাজুল ইসলাম। কিন্তু তাতেও যেন ধূসর ঠান্ডা হলো না।সে রেগে ফেটে পরছে।মানুষ এতটা জঘন্য কি করে হয়।ছি্।তবুও সিরাজুল ইসলাম ধূসরকে জোর করে আবারও বসিয়ে দিলেন এবং মাওলানা সাহেবকে বললেন বিয়ে পড়াতে।এতো কিছু ঘটে যাওয়ার পরে-ও ভোর চুপ করেই রইলো।সে নিজের জীবনের সাথে ঘটে যাওয়া এতো অপ্রিয় ঘটনা যেন মেনে নিতে পারছে না।কথায় আছে অল্প শোকে কাতর। অধিক শোকে পাথর।ঠিক তেমনটাই হলো ভোরের সাথে। সে যে এখন একটি পাথরে পরিনত হয়েছে।অনেক চেষ্টা করেও ধূসর বিয়ে আটকাতে পারেনি।তাঁকে কবুল বলতেই হয়েছে। আর ভোর সে তো তাঁর সাথে হওয়া সব অন্যায় মাথা পেতে নিয়েছে।ভোর কবুল বলেই এক মুহূর্তও ওখানে বসেনি।সোজা নিজের ঘরে চলে গেছে। দশমিনিট পরেই সাথে করে একটি লাগেজ নিয়ে ফিরেছে। সে জানে তাঁকে এই বাড়ি থেকে তাড়ানোর জন্য তাঁর বাবা চাচ্চুর এই প্ল্যান। কিন্তু সে ফিরবে এই বাড়িতে। আজ তাঁকে যতটা অসম্মান করে তাড়িয়ে দেওয়া হলো তাঁর চার গুন সম্মান নিয়ে সে এই বাড়িতে প্রবেশ করবে।শুধু সময়ের অপেক্ষায়। যখন ভোর লাগেজ নিয়ে নিচে নেমে এলো।তখন ধূসর আরেক দফা অবাক হলো। কারণ এমনটা ধূসর কখনো ভাবেনি।সব কিছু গুছিয়ে যখন সিরাজুল ইসলাম তাঁর ছেলে এবং পুত্রবধূকে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলো।তখন সমিউল মোর্সেদ বলে উঠলো–

অবশেষে আপদ বিদায় হলো।

ঠিক তখনই টুপ করে এক ফোঁটা চোখের জল মোর্সেদ বাড়ির সদর দরজায় পড়লো।আর তখন সিরাজুল ইসলাম বললেন–

আপদ নাকি লক্ষী বিদায় করলেন তা সময় বলবে।আমি বা আপনি নন।এই কথা বলেই ভোরের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন।সোনা মা চিন্তা করিস না।আজ যতটা অপমান পেয়ে এই বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছিস।সেই বাড়ি একদিন তোর হবে।আজ যতটা কষ্ট নিয়ে এই বাড়ি থেকে তোকে বেড়িয়ে যেতে হচ্ছে তাঁর চৌগুন সুখ নিয়ে এই বাড়িতে ফিরবি।মনে রাখিস আল্লাহ ছাড় দেয় ছেড়ে দেয় না।তোর দীর্ঘশ্বাসের মূল্য এদের দিতে হবে।দিতে হবে তোর চোখের প্রতিটা ফোঁটার দাম।যেদিন তোর কদর বুঝবে সেদিন যেন বাবা চাচা বলে ছেড়ে দিস না।তোর সাথে হওয়া তোর মায়ের সাথে হওয়া অন্যায়ের হিসেব তোকেই নিতে হবে।কথা গুলো বলেই ভোরকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়ে এলো সিরাজুল ইসলাম।

চলবে,,

অনুপ্রেরণা মূলক কমেন্ট করুন। লেখার আগ্রহ্য বেড়ে যায়।বিশ্বাস করুন আপনাদের অনুপ্রেরণা মূলক কমেন্ট অনেক সুখ আছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here