#চন্দ্রাবতীর_রাতে #সৌরভে_সুবাসিনী (moon) #পর্বঃ২

0
268

#চন্দ্রাবতীর_রাতে
#সৌরভে_সুবাসিনী (moon)
#পর্বঃ২

পরদিন সকালে সেই ভদ্রলোকের লাশ নদীর পাড়ে ঠিক সেই অবস্থায় পাওয়া যায় যেভাবে আয়েত্রী তাকে রাখতে চেয়েছিলো।

নাভী অবধি নদীর পাড়ের বালিতে দাবিয়ে রাখা।সর্বপ্রথম সকালে মাটি কাটা এক মহিলাদলের নজরে আসে। দূর থেকে দেখে মনে করেছিলো হয়তো কেউ দুটো বাঁশ পাশাপাশি দাবিয়ে রেখেছে। কিন্তু কিছুটা এগিয়ে যেতেই দেখতে পেলো একজন পুরুষ মানুষের দেহ স্পষ্টত্ব। কেনোনা লুঙ্গি কাছাড় দেওয়া ছিল।তাদের চিৎকারের শব্দে
কয়েক মূহুর্তের মধ্যে গ্রামবাসী সবাই একত্রিত হয়ে যায়।থানা থেকে পুলিশ এসে লাশ উঠানোর সময় বেশ হট্টগোল পড়ে গিয়েছিলো। কেনোনা লাশের নাক-মুখ দিয়ে অনবরত শামুক বের হচ্ছিলো। কেমন একটা গা ঘিনঘিন ব্যাপার। যখন মুখ পরিষ্কার করা হলো তখন দেখলো এ সেই ভদ্রলোক যে কাল আয়েত্রীর নানা বাড়ি গিয়েছিল।

এক কানে দুকানে কাল আয়েত্রীর বলা কথা পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো।পুলিশ লাশ নিয়ে চলে যাওয়ার আগে তাই একবার হাজী বাড়িতে এসেছে আয়েত্রীর নানার সাথে দেখা করতে৷

বিছানার সাথে একদম লেপ্টে আছে আয়েত্রী।শরীরে বিন্দু মাত্র শক্তি নেই। তাপমাত্রা চমৎকার স্বাদ নিয়ে ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে।লোকচক্ষুর আড়ালে বার দুয়েক রক্ত বমি হলেও তিন বারের বেলায় পুলিশ অফিসারের সামনেই গড়গড়িয়ে বমি করে দিলো আয়েত্রী।

আয়েত্রী এমন শারীরিক অবস্থা দেখে পুলিশ অফিসার এতটুক নিশ্চিত হলো
“আর যাই হোক। এই মেয়ের পক্ষে খুন করে, বিনা কিছু দিয়ে মাটি না খুড়ে, শুধু শক্তিবলে লাশ দাবিয়ে রাখা সম্ভব নয়।”

আয়েত্রীর প্রথম এমন অসুখ হয় যখন তার বয়স মাত্র সাত বছর।বর্ষাকালে সবার মতন আয়েত্রী গিয়েছিলো নদীতে গোসল করতে। হাটু পানিতে নেমেই খেলছিলো সে।হঠাৎ নদীতে তীব্রটান আসে। পানির টানে আয়েত্রী অনেকটা দূরে চলে গিয়েছিলো। আয়েত্রীর চিৎকার করার কোন অবকাশ ছিল না।কারণ সে প্রায় ডুবেই গিয়েছিলো।সময় মতো আয়েত্রীর মামার নজরে এসেছিলো।সাঁতরে গিয়ে আয়েত্রীর মামা দ্রুত আয়েত্রীর পা ধরে টেনে কোনভাবে পাড়ে নিয়ে আসে সেদিন।কয়েক মুহূর্ত দেরী হলে যেকোন কিছু হতে পারতো। স্বাভাবিকভাবেই বেশ ভয় পেয়ে যায় আয়েত্রী । সেদিন বিকেলবেলায় গা কাঁপিয়ে জ্বর আসে। মধ্যরাত ১-৩.৪৫ অবধি বেশ কয়েকবার রক্তবমি হলে, সে রাতেই আয়েত্রীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো উদ্দেশ্যে নিয়ে রওনা হয় আয়েত্রীর পরিবার।

বিভিন্ন টেস্ট করিয়েও কিছুই সামনে আসে না।কয়েকদিন চিকিৎসার পর আয়েত্রীকে নিয়ে নিজের শহরে ফিরে আসে। কিন্তু বিপত্তি বাধলো ঠিক চারমাস পর।যখন শীতের ছুটিতে আবার নানুর বাড়ি এসেছিলো। কোন একটা কারণে আয়েত্রী একটা গরু দেখে ভিষণ ভয় পেয়ে যায়।রেগেমেগে বলেছিল,

“আমাকে ভয় দেখালি? দেখিস! ওই নদীর পাড়ের বালিতে পড়েই তোর মরতে হবে। ”

বাচ্চার এমন কথায় কেউ কান দিয়েছিলো না।কিন্তু সে দিন বিকেলবেলায় গরুটা নদীর পাড়ের চোরাবালিতে আটকে যায়। পুরো গ্রামের মানুষ চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারেনি। অথচ সে জায়গায় আগে কখনো চোরাবালি ছিলো না।এমনকি আর কখনো চোরাবালির মতো কিছুই হয়নি সেখানে। ঠিক আগের মতই শক্ত মাটি।
মনে হয় শুধু মাত্র আয়েত্রীর কথা রাখতেই নদীর পাড়ে সে বিকেলে নদীর বালি চোরাবালিতে পরিণত হয়েছিলো।

সে রাতেও ধুম করে জ্বর আর রক্তবমি।আয়েত্রীর নানু কি মনে করে কবিরাজ নিয়ে এলেন।কারণ তার ধারণা ছিলো হয়তো কেউ ওকে বান মেরেছে।তাই এমন রক্তবমি হচ্ছে।কিন্তু কবিরাজ বলল এমন কিছুই না।না আছে কোন খারাপ জ্বীনের প্রকোপ।

কবিরাজ চলে যাওয়ার পর কাকতালীয় ভাবে আয়েত্রীর নানার এক বন্ধু বাড়ি আসে। উনি বেশ নাম করা আলেম।আয়েত্রীকে দেখে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শুধু বলেছিলেন,

“কোন জ্যোৎস্নাময় রাতে মেয়েকে একা ছাড়বে না।যে অবধি মেয়ে নিজের ভালো নিজে না বুঝবে।নামাজ,কোর-আন পড়ায় যেনো কোন ভাবেই অনিয়ম না করে। যেহেতু মেয়ে মানুষ ঋতুবর্তী হবেই।সে দিন গুলো তাকে নিয়ম করে কোর-আন তেলাওয়াত শোনাবে।
মনে রেখো! এই মেয়ে যেনো ভুলেও রাগের বশে কাউকে কিছুই না বলে।না হলে ওর মুখের কথা তো ফলে যাবে কিন্তু বিনিময়ে ওর শারীরিক শক্তি শেষ করে দিবে।কারণ ও শারিরীক ভাবে যতটা দ্রুত দুর্বল হবে ঠিক ততদ্রুত ওর রুহ্ সে নিয়ে যাবে। তোমার মেয়ে বড্ড ভুল সময়ে সেদিন নদীতে নেমে পড়েছিলো মা! তোমার মেয়েকে পানি থেকে দূরে রেখো।”

সেরাতে যখন ভদ্রলোক আয়েত্রীর নানা বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছিলো বেশ চিন্তিত লাগছিলো। কিছু একটা হয়তো তাকে খুব চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলো।
পরদিন সকালে ভদ্রলোকের লাশ পাশের গ্রামের রেল লাইনের উপরে খণ্ডিত-বিখণ্ডিত অবস্থায় পাওয়া যায়।

ধীর পায়ে নানার রুমের দরজায় কড়া নাড়লো প্রত্যাশা। সালাম দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সে। নাতনীর উদ্দেশ্যে হাজী সাহেব বললেন,

“কিছু বলবে?”

আমতা আমতা করে প্রত্যাশা গতকাল বিকেলের সবকিছু বলল।
প্রত্যাশার কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন হাজী সাহেব।আয়েত্রী এমন শারীরিক পরিবর্তন দেখে কিছুটা আঁচ করেছিলেন উনি।

তবে কি দীর্ঘ পনেরো বছরেও সে আয়েত্রীর পিছু ছাড়েনি?

মেয়ের শিউরে বসে আছেন এহমাদ সাহেব। আয়েত্রী এই অসুখের জন্য দেশ-বিদেশের কম ডাক্তার দেখায়নি উনি।কিন্তু সবার এক কথা।রিপোর্ট নরমাল।অথচ মেয়েটা জ্যোৎস্না রাতে কেমন একটা পাগলের মতন ব্যবহার করে।অনেকে বলে জ্বীনে ধরেছে।রুকাইয়াহ্ করিয়েছিলেন মেয়ের। কিন্তু জ্বীনের প্রকোপ নেই। তবে মেয়ের এমন ব্যবহারের কারণ এখনো অজানা। পনেরো বছর আগের সেই হুজুরের এত চিন্তার বিষয় কি ছিলো?উনি কি কিছু বুঝতে পেরেছিলেন? জানা হয়নি। উপায় ছিলো না।কারণ ভদ্রলোকের লাশ পরদিন পাওয়া যায় রেললাইনে।

বিছানায় শুয়ে আয়েত্রী কাল রাতের ওসব উদ্ভট কথা চিন্তা করছিলো।
ছেলেটা আত্নহত্যা করতে যায়নি।
আয়েত্রী যখন জিজ্ঞেস করলো কেনো এসেছেন তাহলে?

সে বলেছিলো
“আপনি মেয়ে হয়ে এত রাতে এখানে কি করেন?”

“ওসব বাদ দিন। জানেন না আত্নহত্যা মহাপাপ! কেনো নিজের জীবন এভাবে…”

“ওয়েট মিস আয়েত্রী। আপনাকে কে বলেছে আমি আত্নহত্যা করতে যাচ্ছিলাম?”

“তাহলে কি এত রাতে নদীর পানিতে ডুবকি লাগাতে যাচ্ছিলেন?”

“হোয়াট দিস ডুবকি? বাই দি ওয়ে আপনি এত রাতে এখানে কেনো?”

“এইতো একটু ঘুরতে এলাম আরকি।”

“রাত ১ টা বেজে সতেরো মিনিট। এত রাতে একটা মেয়ে একা ঘুরতে বের হয়, আবার এই শীতের রাতে আজকে প্রথম দেখলাম।”

“হয়তো হয় না।তবে আমি হয়েছি। কেনো জানেন? ওই যে মাথার উপর এক ফালি চাঁদ উঁকি দিচ্ছে! সে চাঁদের আলোয় দেখুন নদীর পানি ঝলমল করছে। এমন জ্যোৎস্না গা মাখতে কার না ভালো লাগে?
আমি অন্তত অন্য সবার মতো এই চন্দ্রাবতীর রাত মিস করতে পারবো না। ”

“চন্দ্রাবতীর রাত! হুহ্ আজ তো সদ্য চন্দ্রাবতী সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আমার। ”

হালকাস্বরে বলল সামনের অপরিচিত ব্যক্তি। কয়েক মূহুর্ত অপেক্ষা করে আয়েত্রী সামনের মানুষকে জিজ্ঞেস করলো,

“আপনি আমার নাম জানেন কিভাবে? আমি তো চিনি না আপনাকে! ”

“আপনি পল্লবী ফুপুর ছোট বোন আরাধ্যা ফুপুর মেয়ে। সামিউল চাচার ছোট বোনের মেয়ে। আপনাদের এই গ্রামে কে না চিনে? পাঁচ বোন হিসেবে আপনারা তো গ্রামে খ্যাত। ”

বিচক্ষণের সহিত মাথা দুলিয়ে আয়েত্রী উত্তর দিলো,

“অহ আচ্ছা।বাই দি ওয়ে। আপনি এখানে কি করছেন?”

“আপনি জ্যোৎস্না গায়ে মাখতে বেরিয়েছিলেন আর আমি আমার টানে….. ”

“ঠিক বুঝলাম না।অহ হু বুঝেছি সিগারেট। তাইতো? ”

“যা মনে করেন। ”

“সিগারেট তো ঘরে বসেও টানা যায়। ”

“হয়তো! ”

“আপনার নাম জানা হলো না। ”

“শাওন। ”

কথা বলতে বলতে কখন রাত ২.৫৫ বেজেছে আয়েত্রী বুঝেই নি।কিন্তু শাওন এবার তাগিদে দিচ্ছিলো। কারণ সে জানে আয়েত্রীর অল্পতে জ্বর, ঠান্ডা লেগে যাচ্ছে তাই অবস্থা হয়ে যায়।
আয়েত্রীকে শাওন বাড়ির গেট অবধি দিয়ে তারপর নিজের বাড়ি চলে যায়। কিন্তু এ এলাকায় শাওনকে আয়েত্রী দেখেছে বলে মনে করতে পারছে না।পরক্ষণেই ভাবলো হয়তো লেখা পড়ার সুবাদে দূরে কোথাও থাকে আর তাছাড়া সে নিজেও তো বাড়ি ছেড়ে খুব একটা বের হয় না। তাই হয়তো চিনতে পারছে না।

দিন শেষে আয়েত্রী অনেকটা সুস্থবোধ করছে৷ কিন্তু মাথাটা প্রচন্ড ভার হয়ে আছে। ছোট মামার রুমে পড়ার টেবিলে বসে ছিলো। হটাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। পাশে থাকা মোমবাতি জ্বালিয়ে জানালা খুলে দেয় আয়েত্রী। এখান থেকে কবরস্থান স্পষ্ট দেখা যায়। জানালায় থাকা অফ হোয়াইট কালারের পর্দা বাহিরের মৃদু বাতাসে উড়ছিলো। ঢং ঢং করে ঘড়ি জানান দিলো রাত একটা বেজে গেছে। সাথে সাথে মোমবাতি ধপ করে নিভে গেলো।

চাঁদের হালকা আলোয় আয়েত্রী অনুভব করছে কেউ একজন খুব আলতো স্পর্শে তার হাত স্পর্শ করছে। হাত ধরে টেনে মৃদু পায়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে রুম থেকে বাহিরে বারান্দায়,বারান্দা থেকে দুয়ার, দুয়ার থেকে গেট পেরিয়ে পাকা সড়ক।তারপর নদীর পাড়ের দিকে………

চলবে

#ছবিয়ালঃনূর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here