#চন্দ্রাবতীর_রাতে #সৌরভে_সুবাসিনী(moon) #পর্বঃ১

0
661

নির্দিষ্ট সময়ের পর জীবনে প্রতিটি বাবার হার্ট বড্ড দুর্বল হয়ে পড়ে। আর সন্তানদের ইচ্ছে অনিচ্ছে সব ত্যাগ করে উনাদের ইচ্ছে মতো এগিয়ে যাওয়াই হয় সে রোগের একমাত্র মেডিসিন। বুকের বা পাশে হাত রেখে অনায়াসে পরিস্থিতি বদলে ফেলার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা হয়তো উনাদের দিয়েছেন।

হাস্যকর লাগলো? হয়তো! এই দেখুন না। আমি এখন বিয়ে করতে চাইছিলাম না বলে হঠাৎ আমার বাবার বুকের ব্যথা বেড়ে গেলো।হৃদরোগের কারণে ইচ্ছের বিরুদ্ধে উনার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করতে হচ্ছে।
এখন মেয়ে হয়ে তো আর বাবার অসুস্থতার জন্য দায়ী হতে পারি না। তাই স্বপ্ন, ইচ্ছে অনিচ্ছে গুলো সব না হয় এই চন্দ্রাবতীর রাতে এই নদীতেই বিসর্জন দিয়ে দিলাম।

নিজের কথা শেষ করে স্মিত হেসে শাওনের দিকে তাকালো আয়েত্রী।
আজ মেয়েটার মন বড্ড খারাপ।মন খারাপের রেশ প্রতিফলিত হচ্ছে মেয়েটার মুখে।
বাইশ বছর বয়সী তরুণীর ভীষণ মন খারাপের দেশে শাওন হয়তো হারিয়ে যাচ্ছিলো। নিজেকে সামলে ধরে আসা গলায় জিজ্ঞেস করলো,

“পালাবেন আয়েত্রী?”

শাওনের এমন প্রশ্নে চমকে উঠেছে আয়েত্রী। কয়েক মূহুর্তের ব্যবধানে নিজেকে সামলে নিতে চাইলেও অনুভূতি চোখ এড়ায় না সামনে বসে থাকা মানুষটার। আয়েত্রীর নিজের অনুভূতি লুকানোর খেলার প্রতিউত্তরে শাওনের মুচকি হাসি। সে হাসি চোখ এড়িয়ে যায়নি আয়েত্রীর। তাইতো দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে পোশাকে লেগে থাকা বালি পরিষ্কার করতে করতে বলল,

“আজ আসি। ”

এক মূহুর্ত অপেক্ষা করেনা আয়েত্রী।দ্রুত পা ফেলে সামনে। একটি বারের জন্য পিছন ফিরেও দেখলো না। এক অদ্ভুত শক্তিতে এই ছেলেটা তাকে বেধে ফেলেছে। কিছুক্ষণ থাকলে হয়তো সত্যি তার সাথে সে পালাতে সম্মতি জানিয়ে দিবে।

মানুষের জীবন বড্ড ঠুনকো। দমকা বাতাসেই পথ হারিয়ে অন্য পথে চলতে থাকে। পাঁচ দিন আগেও এমন ছিলো না আয়েত্রী পরিস্থিতি।পাঁচ দিন আগেও যদি বিয়ের সম্পর্ক আসতো হয়তো আয়েত্রী ছেলের সাথে কথা বলার প্রয়োজনবোধ করতো না। কারণ বাবা যা ভালো বুঝে তাই হবে। কিন্তু আজ মনের গহীন বালুচরে ছোট্ট একটা কুঠুরি দরজার ওপাশে ক্ষীণ আলো পাশে নিয়ে বসে আছে শাওন। এই ক্ষীণ আলো উপেক্ষা করবার মতো শক্তি আয়েত্রী জুগান দিতে পারছে না। কেনো পারছে না সে নিজেও জানে না।

আচ্ছা মাত্র পাঁচটা রাতের পরিচয়ে কি কাউকে সত্যি ভালোবেসে ফেলা যায়?

পাঁচ দিন আগে……..

ডিসেম্বরের কোন এক শীতের বিকেলে ছাদের ভাঙা কার্ণিশে বসে কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনছিলো আয়েত্রী। গল্পের নায়িকাদের মতো ওর বই পড়ার খুব একটা শখ নেই, না আছে রবীন্দ্র সঙ্গীত শোনার অভ্যেস। তাইতো ইদানীং কালের গানগুলো বেশ আনন্দের সাথে শুনছিলো। সেই মুহূর্তে ওর মায়ের কথা শুরু হলো।
ভদ্র মহিলা বিগত একমাস যাবত বাবার বাড়ি যাবে বলে মনস্থির করেছেন কিন্তু দুই সন্তানের জন্য আজ যাই, কাল যাই করে যাওয়া হচ্ছে না।আয়েত্রী, আয়াত দুজন সন্তান নিয়ে একটা সুখী পরিবার এহমাদ খান -রেহনুমা বেগমের। ছেলে-
মেয়েই সব এই দম্পতির। প্রথম সন্তান হিসেবেই হোক কিংবা অন্য কোন বিশেষ কারণ থাকার দরুন ভদ্রলোক মেয়েকে কোথাও একা ছাড়েনি এতদিন। তাই মেয়েও কিছুটা ঘরকুনো স্বভাবের। তাই বলে নিকট আত্নীয়ের বাড়িতে যাওয়া তো বাদ দেওয়া যায় না।

কিন্তু মেয়ে নারাজ৷ সে যাবে না। এই নিয়ে বাক-বিতন্ডা চলছিলো খান দম্পতির। শেষমেষ রাগ করে ফোন মেয়ের হাতে দিয়ে চলে গেলেন রেহনুমা বেগম।ফোন হাতে নিয়ে কান থেকে হেডফোন সরিয়ে আয়েত্রী বাবার সাথে কথোপকথন শুরু করার উদ্দেশ্যে বলল,

“বাবা বলো!”
“মায়ের কি মন খারাপ?”
“আসলে আমি যেতে চাচ্ছি না।তুমি তো জানো নদী আমাকে কতটা টানে। অথচ নানুবাড়ি গেলে আমাকে নদীতে নামতে দাও না।রাতে বাহিরে বসে চাঁদ দেখতে দাও না। আজ বাবা চন্দ্রাবতীর রাত। আগামী সাত দিন চন্দ্রাবতীর জ্যোৎস্না উঠবে। এসময় নানু বাড়ি আমি কিভাবে যাই বলো?”

“আচ্ছা সমস্যা নেই। তুমি যাও ভালো লাগবে। তোমার বোনেরা সবাই আসবে। দেখবে এই জ্যোৎস্নার রাতের কথা আড্ডায় আড্ডায় তোমার মনেই থাকবে না। ”

বাবার কথা ফেলে দেওয়ার মতন মেয়ে আয়েত্রী না। তাই রাজী হয়ে যায়। অনিচ্ছাসত্ত্বেও যেতে হচ্ছে।
শহর থেকে যেতে সময় লাগে মাত্র ৩০মিনিট। পরিবারের জন্য একদম রিজার্ভ সিএনজি পাঠিয়ে দিলেন এহমাদ সাহেব।স্ত্রী কে কল দিয়ে বার বার করে কিছু মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন। তবুও যেনো শান্তি পেলেন না মনে।কেমন এক নাম না জানা ভয় ঘিরে আসছে চারপাশ।

নানুবাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে আসরের আজান পড়েছে। তাই দ্রুত নামাজ পড়ে নিতে হলো সবাইকে। এই নিয়ম আয়েত্রী কে মানতেই হয়। নামাজ এবং নিয়ম করে কোর-আন শরীফ পড়তে হয়। যেদিন গুলো নিজে পড়তে পারে না সেদিনগুলো মা যখন পড়ে তখন শুনতে হয়৷ না হলে আয়েত্রী মোটেও সুস্থ থাকে না।মাঝেমধ্যে অনিয়ম হলে তো নাক-মুখ দিয়ে রক্ত অবধি চলে আসে।তাই হয়তো বাবার এত চিন্তা মেয়েকে নিয়ে।

সবার সাথে আড্ডায় মেতে উঠেছে আয়েত্রী। পাঁচ বোন ওরা। সবাই সমবয়সী না হলেও খুব একটা পার্থক্য নেই।

প্রত্যাশা,আয়েত্রী সমবয়সী। বাকী তিনজন আবার ওদের থেকে বছর তিনেকের ছোট। প্রতীক্ষা, মানহা,মালিয়াত ওরা তিনজন সমবয়সী। প্রত্যাশা, প্রতীক্ষা দুই বোন। আয়েত্রীর বড় খালার মেয়ে এবং মানহা, মালিয়াত বড় মামার মেয়ে৷ ছোট মামা এখনো অবিবাহিত। এদিকে আয়েত্রীরা দুই ভাই বোন। আয়াত-আয়েত্রী।

সন্ধ্যেবেলা সবার আড্ডা জমে উঠেছিলো নানুর ঘরের বারান্দায়। বনেদি পরিবারে বাড়ি যেমন হয় ঠিক তেমন। তবে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বদলেছে বাড়ির আনাচে-কানাচেতে।

আড্ডার ব্যাঘাত ঘটালোএকজন লোক। বাহির বাড়িতে এসে খুব চেঁচামেচি করছে। মাগরিবের নামাজ পড়ে আয়েত্রী নানা সবে মাত্র বাড়িতে প্রবেশ করেছে। লোকটাকে চেঁচামেচি করার কারণ জিজ্ঞেস করলে উনি বললেন,

“আমি আপনার দোকানে যাইয়া কইছি আমারে এইডা দিতে। দিছেও কিন্তু অন্য একদিন একজনে একটা নিছিল হেইডা ভালো ছিলো না তাই কইছি আপনার সাথে আমার কথা আছে। ক্যান আপনি হাজী মানুষ হইয়া দোকানে ডিফিড জিনিস রাখছেন। এই কথা আমি আপনেরে জিগাইছি। আপনে ছিলেন না আপনার দোকানের কর্মচারী আমার লগে টেই ধইরা কইলো পরে নাকি সে ফেরত দিয়া ভালোডা নিছে। খারাপ জিনিস আপনারা রাইখা দিছেন। আমিও জানি কিন্তু আমার কথা হইলো আপনার কর্মচারী উত্তর দিবো ক্যান? জিগাইছি আপনারে। একেক টা ছোট লোক।এই কথা কওয়াতে টিটিকারী মাইরা আপনার কর্মচারী আমারে কয় বড়লোক ভাই আমাদের ভুল হইলে মাফ করিয়েন কিন্তু এখন ধান্দার সময় ভেজাল করিয়েন না।
ক্যান আপনি খারাপ জিনিস রাখবেন আর আমরা কইলেই দোষ? তারপর তাদের চোটপাট কি? মনে হয় আমারে গিলা খাইবো। যতসব ছোটলোকের কারবার।

ভদ্রলোকের কথাশুনে আয়েত্রী নানা মৃদু হেসে মাথা দুলিয়ে বললেন,

” আচ্ছা ভাই বুঝলাম।আপনি বসেন।আপনি যখন দোকানে গিয়েছিলেন তখন আমি ছিলাম না তাই ওরা উত্তর দিয়েছে। এটা দেওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু আপনি যে এইযে জাত তুলে কথা বললেন এখন তো আমি চাইলে ফেরত দিতে পারি তাই না? ”

লোকটা বলল,
“এটা আপনার শিক্ষা। তাই আপনি দেন নাই। বা জাত তুলেন নাই। ”

“ওরা শুধু উত্তর দিয়েছে। এটা ওদের দায়িত্ব।
তাহলে ভাই ব্যাপারটা কি দাঁড়ায়? জাত তো আপনি তুলেছেন আগে। ওরা না।”

“ও বুঝছি। আপনিও এক। আসলেই আপনি এমন হইলে আর কি? ”

কথা বলে অপেক্ষা করেনা লোকটা।পা বাড়ায় বাড়ির বাহিরের দিকে।স্পষ্টত
লোকটি যুক্তিতর্কে না পেরে চলে যাচ্ছিলো এবং আয়েত্রীর নানা কে যা ইচ্ছে বলছে।
আয়েত্রী বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে লোককে উদ্দেশ্য করে বলল,

“মনে হচ্ছে এই ব্যাটার লুঙ্গি কাছাড় দিয়ে উল্টো করে নদীর বালুচরে দাবিয়ে মেরে রেখে দেই। ”

ওর কথা শুনে বাকী সবাই হাসলেও প্রত্যাশা যেনো থম মেরে বসে পড়েছে।কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। হঠাৎ গলাটা অজানা তৃষ্ণায় ফেটে যাচ্ছে। ভীত চোখে আয়েত্রীর দিকে তাকিয়ে ধমকের সুরে বলল,

“আহ্!আয়েত্রী হচ্ছেটা কি? এসব আর কখনো যেনো না শুনি।”

রাতে আয়েত্রী মা-নানুর মধ্যিখানে শুয়ে আছে। ঘুম আসছে। কেনো জানি না নানু তার আঁচলের সাথে আয়েত্রী হাত বেধে রেখেছে। আস্তেধীরে শরীরের উপর থেকে মায়ের হাত সরিয়ে দিয়ে আয়েত্রী হাতের বাঁধন ছাড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। গ্রিলে তালা লাগানো দেখে এক দফা হতাশ হলে পুনরায় পুরো দমে চাবি খুঁজতে শুরু করে। একসময় চাবি পেয়ে সন্তদর্পণে বেরিয়ে আসে বাড়ি থেকে।

ঘড়ি জানান দিচ্ছে রাত তখন একটা বাজে। মাথার উপর এক ফালি চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। মাথায় হুডি উঠিয়ে আয়েত্রী পা বাড়ায় নদীর দিকে।চারিপাশে নীরবতা।কোথাও একটা পাখিও শব্দ করছে না। শুধু হালকা বাতাস বইছে। নদীর পাড়ের খানিকটা দূরেই পাকা সড়ক।সেখানে দাঁড়িয়ে আছে আয়েত্রী। আবছা আলোয় কুয়াশার মাঝে আয়েত্রী একটা অবয়ব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলো।নীল পাঞ্জাবী পড়ে কেউ একজন নদীর পাড় থেকে পানির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
আয়েত্রী মস্তিষ্কে প্রথম যে কথা এলো তা হলো ছেলেটা আত্নহত্যা করতে যাচ্ছে।
হ্যাঁ! আত্নহত্যা করতে যাচ্ছে। তা না হলে এত রাতে নদীর পাড়ের পানিতে কেনো নামবে?
আয়েত্রী দ্রুত দৌড়ে ছেলের হাত ধরে ফেলে।

আহ্!কি ঠান্ডা স্পর্শ !
পরক্ষণেই চিন্তা করলো স্পর্শ ঠান্ডা হওয়াই স্বাভাবিক কারণ এই শীতের রাতে শুধু পাঞ্জাবী পড়ে আছে ছেলেটা।
হাত ধরে টেনে পাকা রাস্তায় নিয়ে আসতে আসতেই আয়েত্রীর মনে হচ্ছিলো কিছু একটা যেনো তার শরীরের সব উষ্ণতা শুষে নিচ্ছে।

চলবে
#চন্দ্রাবতীর_রাতে
#সৌরভে_সুবাসিনী(moon)
#পর্বঃ১

#ছবিয়ালঃবাঁধন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here