উধয়রনী #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-০২||

0
598

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-০২||

০৩।
পুরো সপ্তাহ জুড়ে আহি বিশেষ দু’টি দিনের অপেক্ষায় থাকে। সপ্তাহ শেষে ঝড়-বৃষ্টি, রোগ-শোক উপেক্ষা করে সে চারুশিল্পে চলে যায় শুধু এআরকে দেখার জন্য।
এআর, আফিফ রাফাত, আহির প্রথম প্রেম। প্রেম-ভালোবাসা সম্পর্কে আহি তেমন কিছুই জানে না। কখনো ভাবেও নি যে সে প্রেমে পড়বে। তবে আফিফের আঁকা ছবি, তার নিগূঢ় চোখযুগল, তার এলোমেলো চুলগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে আহির ভীষণ ভালো লাগে। এটাকে যদি প্রেম বলে, তাহলে আহি হয়তো প্রেমেই পড়েছে। প্রথম দুই সপ্তাহ আফিফের নাম জানতে পারে নি সে। বাসায় এসে শুধু নামহীন যুবকের নাম কি হতে পারে সেটা ভাবতেই ব্যস্ত ছিল আহি।
সপ্তাহ শেষ হতেই তার অস্থিরতা বেড়ে গেলো। চারুশিল্পে যেদিন ক্লাস থাকে সেদিন কোনো এলার্মের প্রয়োজন হয় না, কারো দরজায় কড়া নেড়ে আহিকে ডাকতেও হয় না। সে নিজ থেকে উঠে ভালো জামা পরে আগেভাগে নাস্তার টেবিলে এসে হাজির হয়ে যায়। খাওয়া-দাওয়ায়ও যেন হুলুস্থুল কান্ড। আহির বাবা-মা মেয়ের আচরণে বরাবরই অবাক হোন। কিন্তু কিছুই জিজ্ঞেস করেন না।

(***)

আজও আহির বাবা, রিজওয়ান কবির মেয়েকে আর্ট স্কুলের সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে যান। আহিও দেরী না করে গাড়ি থেকে নেমে এক দৌঁড়ে ক্লাসে ঢুকে পড়লো। ক্লাসে এখনো তেমন কেউ আসে নি। তার প্রিয় মুখটাও দেখা যাচ্ছে না। তখনই আহির নজর পড়লো টেবিলের উপর রাখা খাতাগুলোর দিকে। আগের সপ্তাহে সবাই তাদের আঁকা ছবিগুলো জমা দিয়েই চলে গিয়েছিল। তাহলে এখানেই তার প্রিয়র খাতাটা থাকবে।
আহি খাতাগুলোর উপরে লেখা নামগুলো দেখে নিলো। এতোগুলো নামের মধ্যে তার প্রিয়র নাম কোনটা, সেটাই বোঝা মুশকিল। ক্লাসে চৌদ্দ জন ছেলে। এখানেও চৌদ্দটা নাম। তড়িঘড়ি করে সে সবগুলো নাম মুখস্থ করে নোট টুকে নিলো। স্যাররা আবার আইডি ডেকে খাতা দেন। নাম ধরে ডাকলে আহিকে এতো কাঠখড় পোড়াতে হতো না। আবার মাঝে মাঝে যার খাতা সে এসে নিয়ে যায়। আর তার প্রিয়র আইডিটাও তার মনে নেই। এখন কখন স্যার আইডি ধরে ডাকবেন, কখন সে তার প্রিয়র নাম জানতে পারবে, এতো ধৈর্য তার মধ্যে নেই। সে তো আজই তার প্রিয়র নাম জেনে ছাড়বে।

(***)

ক্লাসে যেই ছেলেগুলো উপস্থিত ছিল স্যার আসার আগে আহি তাদের সাথে পরিচিত হয়ে নিলো। কিন্তু প্রিয়র কাছে গিয়ে তার সাথে পরিচিত হওয়ার সাহসটা সে পাচ্ছিলো না। কতো সহজই না হতো, একদম তার সাথেই কথা বলে নাম জেনে নেওয়া! কিন্তু এই সহজ কাজটা করতে যাওয়ার আগেই হাত-পা কাঁপছিল আহির। সে নিজেও বুঝতে পারছে না কেন তার সাথে এমন হচ্ছে।

স্যার আসার পর পরই তার প্রিয় পুরুষ ক্লাসে ঢুকে তার পাশের সারিতেই বসে পড়লো। আহি তা দেখে নীরবে হাসলো। ঘুরেফিরে আহির পাশের সারিটাই তার প্রিয় মানুষটার জন্য খালি থাকে। এটাই হয়তো নিয়তি।

(***)

আজকের স্কেচ একটা বটবৃক্ষ। আহি মুখ ছোট করে বটবৃক্ষটির দিকে তাকিয়ে আছে আর মনে মনে ভাবছে,
“এর চেয়ে ভালো আমি পাশের সারিতে বসে থাকা শান্ত চোখের যুবকটির ছবি আঁকি।”

এমন ভাবনা মাথায় আসতেই আহির ঠোঁটে বিস্তর হাসি ফুটে উঠলো। সে স্যারের চোখ ফাঁকি দিয়ে স্কেচবুকের একটা পৃষ্ঠা ছিঁড়ে খাতার নিচে রাখলো। তারপর সটান হয়ে বসে ছেঁড়া পৃষ্ঠায় তার প্রিয়র ছবি আঁকতে লাগলো।

চারটা বেঞ্চ আগেপিছে। মাঝখানের সারিতে বসা একটা ছেলে। হাতে পেন্সিল। টেবিলে এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে রাখা বিভিন্ন মানের পেন্সিল আর রাবার। ছেলেটির খাতায় আঁচড় পড়ছে পেন্সিলের। সে ব্যস্ত বটবৃক্ষের শিকড়ে প্রাণ দিতে।

স্যার ঘুমকাতুরে মানুষ। চেয়ারে বসে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ঘুমাচ্ছেন। সময় ফুরাতেই তিনি চোখ খুললেন। এখন বিরতি। সবাই যতোটুকু এঁকেছে তা দেখেই তিনি সংশোধন করবেন। আহি এদিক-ওদিক তাকিয়ে তার ছেঁড়া পৃষ্ঠাটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেললো। স্যার আহির খাতার সামনে এসে ভ্রূ কুঁচকালেন। খাতায় পেন্সিলের হালকা দাগও নাই। আঁকার চেষ্টা করেছে এরও কোনো প্রমাণ নেই। খাতা একদম পরিষ্কার। আহি মুখ ছোট করে স্যারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভীষণ শরীর খারাপ স্যার। চোখ বার-বার ঝাপসা হয়ে আসছে।”

স্যার মাথা নেড়ে বললেন,
“তুমি ছুটি নিয়ে চলে যাও। কাল ভালো লাগলে এসো।”

আহি ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“না, না স্যার। আমি এখানেই থাকি? আসলে বাসায় কেউ নেই। বাবা অফিসে গেছেন। মাও বাসায় নেই।”

“ফোন থাকলে কল দিয়ে বলো।”

“স্যার, শুধু শুধু টেনশন করবে। আমার ভালো লাগছে এখানে। আমি একটু হাত-মুখ ধুয়ে আসি?”

“হুম, যাও।”

আহি একনজর তার প্রিয়র মুখের দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে পড়লো। স্যারের সাথে সে এতো কথা বললো আর এই ছেলে একবারো তার দিকে তাকালো না। এদিকে স্যার কাকে কি বললো তা শোনার জন্য আহি ব্যস্ত হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে থাকে। আর এই ছেলের একমাত্র লক্ষ্য যেন তার খাতা, আর তার আঁকা ছবি।

(***)

বিরতির মধ্যেই আরো কিছু ভাইয়ার সাথে পরিচিত হয়ে নিলো আহি। এখন বাকি চার জন। এর মধ্যে তার প্রিয় মানুষটিও আছে। চারটা নাম সে আওড়াতে লাগলো। সোহেল, জয়, দেবাশীষ আর আফিফ। এর মধ্যে দু’জনের হাতে বাঁধা লাল সুতো দেখেই আহি ধরে নিয়েছে এরাই জয় আর দেবাশীষ। বাকী আছে সোহেল আর আফিফ। এর মধ্যে একজন আসেই নি। এখন কীভাবে সে বুঝবে, কে সোহেল, আর কে আফিফ! একটা নাম জানতে তার কতো কিছুই না করতে হচ্ছে। নিজেকে এক মুহূর্তের জন্য তার পাগল মনে হচ্ছিল। তবুও এই পাগলামো করতেই তার ভীষণ ভালো লাগছে। ক্লাস শেষ হতেই তার ভাগ্য যেন শুভ প্রমাণ হলো। স্যার পেছন থেকে জোর গলায় ডাকলেন,
“আফিফ, এদিকে আসো।”

আহি পেছন ঘুরতেই দেখলো তার প্রিয়ই স্যারের ডাকে সাড়া দিয়েছে। তাহলে প্রিয়র নাম আফিফ? আহি মনে মনে বলল,
“স্যার আগেই যদি নাম ধরে ডাকতেন, শুধু শুধু আমাকে মগজধোলাই করতে হতো না।”

এবার আহি তার টুকে নেওয়া নোটটি খুলে মুচকি হাসলো। এলোমেলো ভাবে লেখা, আফিফ রাফাত। এক রাশ ভালো লাগা ছেয়ে গেলো আহির মনে। সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতেই মনে করার চেষ্টা করছিল সকালে যখন এই নামটি হুড়োহুড়ি করে টুকে নিচ্ছিলো, তখন তার হাতটা কি একবারো কেঁপেছিল? ঠোঁট চেপে হাসছে আহি। সিঁড়ি বেয়ে উঠার সময় একটা ছেলে তার দিকে তাকিয়েই উঠছিল। আহি তাকে দেখেই হাসি গিলে ফেললো। দুই সিঁড়ি লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে নিজের মাথায় নিজেই গাট্টা মেরে বলল,
“তুমি আমাকে পাগল করে দেবে এআর৷”

০৪।

বিশাল ডুপ্লেক্স বাড়িতে মাত্র পাঁচজন মানুষের বাস। আহির বাবা-মা আর আহি, সাথে থাকেন মুনিয়া খালা ও তার মেয়ে চুনি। মুনিয়া খালা আহিদের বাসায় কাজ করেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর আহির বাবা মুনিয়াকে তাদের বাসায় থাকার ব্যবস্থা করে দেন। সেই থেকে মুনিয়া তার মেয়ে চুনিকে নিয়ে এই বাড়িতেই আছে। সারাদিন এই বিশাল ডুপ্লেক্স বাড়ি পরিষ্কার করতেই ব্যস্ত থাকে মুনিয়া। চুনি ছোট মানুষ, আট কি নয় বছর বয়স। এই বয়সেই সে বসে বসে হিন্দি সিরিয়াল দেখে সময় পার করে। আহির মা, মিসেস সালমা ফাওজিয়া বইপোকা। তিনি রান্না-বান্নার কাজ সেরে নিজের লাইব্রেরিতে গিয়ে সময় কাটান। আর আহির বাবা, রিজওয়ান কবির ব্যস্ত থাকেন নিজের ব্যবসার কাজে। আহি সারাদিন নিজের ঘরে বসে কি করে না করে তা কেউ দেখতে আসে না। রিজওয়ান কবির নিজেই মেয়েকে এই স্বাধীনতা দিয়েছেন। প্রাইভেসি শব্দটার সাথে আহি ছোটবেলা থেকেই পরিচিত। শিল্পপতি বাবার একমাত্র কন্যা অল্প বয়সেই ফোন, ল্যাপটপ সবই হাতে পেয়ে যায়। নিজের ঘরে নিজের মতো থাকতেই সে অভ্যস্ত। এমনকি স্কুলে যাওয়ার আগে নিজের ঘরে সে তালা লাগিয়ে যায়। সেই ঘরে প্রবেশের অধিকার কারো নেই। উলটো কেউ যদি ভুলেও পা রাখে তাকে আহির রোষাগ্নিতে পড়তে হয়। সালমা ফাওজিয়া মেয়ের কাজে বিরক্ত হোন। কিন্তু মেয়ের বাবা যেখানে মেয়েকে আস্কারা দিয়ে রেখেছেন, সেখানে তিনি কিছু বললে উল্টো স্বামীর কাছ থেকেই তার বকা খেতে হয়। এমনিতেই স্বামীর সাথে তার বনিবনা হয় না। কিছু বলতে গেলেই হয়তো সংসার বাঁচানো দায় হয়ে যাবে। তাই তিনি চুপ করে থাকেন। কারণ তার মেয়ে আর যাই করুক, পড়াশুনা ঠিকই করছে। পরীক্ষায়ও ভালো করে। তাই তিনি মোটামুটি আহির ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তামুক্ত আছেন।

(***)

আহি আর্ট স্কুল থেকে এসেই ব্যাগ থেকে সেই স্কেচটি বের করে তার ক্যানভাসের সাথে আটকে রাখলো। বার কয়েক সেই স্কেচটিতে হাত বুলিয়ে পেন্সিল হাতে নিয়ে নিচের অংশে লিখলো, “এআর।” নামটি লিখতেই তার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো।

প্রথম প্রেম হয়তো এমনই হয়। কোনো আশা নেই, কোনো হতাশা নেই, কোনো স্মৃতি নেই, শুধু ভালোবাসতেই ভালো লাগে।

আহির ঘরটি ভালোই বড়সড়। সেই ঘরে আসবাবপত্রের চেয়ে আহির শখের জিনিস বেশি। ঘরের একপাশ দখল করে নিয়েছে তিন-চারটি কাঠের ইজেল। ইজেলের উপর ক্যানভাস রাখা। অন্যপাশ দখল করে নিয়েছে পুরোনো পত্রিকা দিয়ে মোড়ানো আহির আঁকা ছবি। দক্ষিণের জানালা বরাবর খাট। পুরোনো দিনের বাড়িগুলোর মতো গ্রিল ছাড়া জানালা। আহি প্রতিদিনই খোলা চুল জানালার বাইরে বের করে দিয়ে ঘুমায়। তবে নিচেই দারোয়ান চাচার ঘর। আবার দিন-রাত সময় ভাগ করে পাহারাদাররা বাড়ি পাহারা দেন৷ আহির মনে ভূতের ভয় একদমই নেই। সে বিন্দাস থাকে। গভীর রাত পর্যন্ত জেগে ছবি আঁকে, কখনো বা কমিক্সের বই পড়ে। আহিকে দেখলে যে-কেউ বলবে, আহির মতো সৌভাগ্যবতী হয় না। আহির বয়সী মেয়েদের যেখানে বাবা-মার বকুনি খেয়ে পড়তে বসতে হয়, সেখানে আহি বকাঝকার নমুনায় কখনো দেখে নি।

……………….

“দিনগুলো কতো চমৎকার ছিল! এখন ভাবছি কেন এতো বড় হলাম।”
বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আহির। চোখ বন্ধ করে অতীতের সুখ স্মৃতি হাতড়াতে ভালোই লাগছিল তার। বিমান অবতারণের ঘোষণা হতেই চোখ খুললো সে। পাশ ফিরে একনজর নায়ীবের দিকে তাকালো। তারও হয়তো এই মাত্র ঘুম ভেঙেছে। নিভু নিভু চোখে আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“এতোগুলো সময় কীভাবে যে কেটে গেলো!”

আহি নায়ীবের কথা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। এ লোকটার প্রশ্ন থেকে সে অন্তত বেঁচে গেছে।

(***)

বিমান থেকে নেমেই গটগট পায়ে বিমানবন্দরে ঢুকে গেলো আহি। জরুরি কাগজপত্র বের করে তা কাষ্টমস অফিসারকে দেখিয়ে কনভেয়ার বেল্টের সামনে দাঁড়িয়ে গেলো। নায়ীবকে দেখেই মুখ ঘুরিয়ে নিলো। নায়ীব জরুরি কাগজপত্র দেখিয়ে আহির পাশে এসে দাঁড়ালো। আহি ভ্রূকুঁটি মিশ্রিত চোখে নায়ীবের দিকে তাকাতেই নায়ীব বুক পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে আহির দিকে এগিয়ে দিলো। অনিচ্ছাসত্ত্বেও আহি কার্ডটি নিয়ে নিলো। নায়ীব বলল,
“আমি বেশ বুঝতে পেরেছি আপনি ডিপ্রেশনে আছেন। আর এটা ভয়াবহ সমস্যা। তার চেয়ে বড় সমস্যা, সমস্যার কথাটা কাউকে বলতে না পারা। আপনার সীমাবদ্ধতা কোথায় সেটা আমি জানি না। আপনার সাথে কি হয়েছে, তাও আমি জানি না। কিন্তু মিস ওয়াসিকা কবির, মানুষের মন কিন্তু জানালার মতো। জানালা খুলে দিলে যেমন মিষ্টি হাওয়া প্রবেশ করে, তেমনি বন্ধ রাখলে গুমোট বাতাবরণের সৃষ্টি হয়। জীবনটাও ঠিক তেমন। মনের জানালা খুলে দিবেন, সুখ-দুঃখ অন্যের সাথে ভাগ করে নিবেন, তবেই স্বস্তি পাবেন। আর বন্ধ রাখবেন তো নিজেকেই ধীরে ধীরে হত্যা করবেন।”

আহি ঠোঁটে শুকনো হাসি টেনে কার্ডটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। নিজের কষ্ট লুকিয়ে রাখার জন্য এতো চেষ্টা করছে সে, অথচ তার কষ্টটা আজ অপরিচিত একজন দেখেই বুঝে ফেললো। সে তো কঠিন হতে চায়ছে, তাহলে কেন এই ভালোবাসা তাকে বার-বার দুর্বল করে দিচ্ছে?

(***)

ব্যাগ নিয়ে বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে এলো আহি। চারপাশে একবার চোখ বুলালো। তাকে নিতে কেউ আসে নি। আসার কথাও নয়। বাবা ঢাকাতেই আছেন। তিনি জানেন আজ আহি আসবে, সময়টাও আহি জানিয়েছিল। তবুও আসেন নি। তবে বাবার কাছ থেকে কোনো আশা রাখে না সে৷ গেল বছরগুলোতে তার যেই রূপ দেখেছে, আহির আশা-ভরসা সব হারিয়ে গেছে। জীবন যুদ্ধে সে নিজেকে পরিত্যক্ত মাঠে একাই আবিষ্কার করেছে। যার আগেপাছে কেউ নেই।

বিমানবন্দরের সামনে থেকে গাড়ি নিয়ে হোটেলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো আহি। গাড়িতে উঠেই ফোনে নতুন সিম ঢুকালো। ফোন চালু করেই বাবার নম্বরে ডায়াল করতে যাবে তখনই ফোন বেজে উঠলো। ফোনের স্ক্রিনে পরিচিত নাম দেখে ঠোঁটে মৃদু হাসি টেনে কল রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে উদ্বিগ্নতায় ভরা ভারী পুরুষালি কন্ঠ ভেসে এলো,
“কি রে ফোন বন্ধ কেন তোর?”

“মাত্রই তো ফোনে সিম লাগালাম।”

“মাত্র কেন? ল্যান্ড তো অনেক আগেই করেছিস।”

“ব্যাগপত্র নিতে গিয়েই তো সময় গেলো।”

“আর আমি এদিকে চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছি। তুই মানুষ নাকি গরু?”

আহি গাল ফুলিয়ে বলল, “গরু বলবি না আমাকে।”

“আচ্ছা, গাভীই বলবো।”

ওপাশ থেকে হাতাহাতির শব্দ কানে আসতেই আহি ফোন সরিয়ে নিয়ে মিনমিনিয়ে বলল,
“পাগল ছাগলের দল।”

কল কেটে যেতেই আহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। রাদের সাথেই এতোক্ষণ কথা বলছিল আহি।
রিদমাম রাদ আহির ছোটবেলার বন্ধু। আর যার সাথে রাদের হাতাহাতি হচ্ছিল, সে লাবীব, আহির আরেক বন্ধু। তারা একই স্কুলে পড়েছিল। রাদ আর লাবীব এতোদিন আহির সাথে লন্ডনে ছিল। একই ইউনিভার্সিটি থেকে তারা পড়াশোনা শেষ করেছে। লাবীবের দাদা মারা যাওয়ায় লাবীব ও রাদ দেশে আগেভাগেই চলে এসেছিল।

(***)

রাদ ফোনের দিকে তাকিয়ে বিরক্তির সুরে লাবীবকে বলল,
“দেখছিলি না কথা বলছিলাম? ফোনটা কেটে গেলো তো!”

লাবীব ভ্রূ কুঁচকে বললো, “আমারও কথা ছিল আহির সাথে।”

“দেখা হলে বলিস। আর বেশি কথা বলতে ইচ্ছে করলে নিজের ফোন থেকে কল দে। আমার ফোনে কি?”

(***)

ব্যাগে ফোন রাখতে গিয়েই আহির চোখ পড়লো বাদামী মলাটের ডায়েরীটির দিকে। বেশ মোটা আর ভারী ডায়েরী। ব্যাগের ভারটা বোধহয় এই ডায়েরীর কারণেই একটু বেশি লেগেছিল। ভার হওয়ায় তো স্বাভাবিক। এই ডায়েরীতেই তো বাঁধা পড়ে আছে তার অতীত স্মৃতি। সে যেখানেই যায়, এই ডায়েরী তার সঙ্গী হয়। আহি ডায়েরীটা হাতে নিয়েই মলিন হাসলো। আলতো হাতে মলাটের উপর হাত বুলালো। চোখ সরিয়ে জানালার বাইরে ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে তাকাতেই তার মনে পড়ে গেলো এই ডায়েরীকে ঘিরে তার সৃষ্টি হওয়া সেই অদ্ভুত দিনটির কথা।

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here