উধয়রনী #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-০৩||

0
546

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-০৩||

০৫।
সূর্যকিরণ পিচঢালা রাস্তায় ঠিকরে পড়ছে। পিচের রাস্তা রোদের আলোয় চিকচিক করছে। আহির ঠোঁটে কোমল হাসি। শক্ত হাতে একটা মোটা ডায়েরী আঁকড়ে ধরে আছে সে। স্কুল ছুটি হতেই জমানো টিফিনের টাকা দিয়ে এই ডায়েরী কেনা। এক একটা দোকান, স্কুলের পাশের লাইব্রেরি, শপিংমল ঘেঁটে সে এই বিচিত্র ডায়েরী কিনেছে। মলিন সাদা পৃষ্ঠার বাদামী চামড়ার ডায়েরী। ডায়েরীর মলাটে আর পাতায় ক্লাসিকাল ছাপ। আহি ডায়েরীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“এআর, এক যুগ পর যখন তুমি এই ডায়েরী পাবে, তখন বুঝবে, এই আহি তোমাকে কতোটাই না ভালোবাসতো।”

অকস্মাৎ আহির এলোমেলো ভাবনায় ছেদ ঘটলো। সামনে হাস্যোজ্জ্বল প্রাণবন্ত মুখটি আহির গতিরোধ করলো। আফিফ ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছেলের সাথে কথা বলছে। এ তো মেঘ না চাইতে বৃষ্টি! এভাবে আফিফের সাথে দেখা হয়ে যাবে, আহি কল্পনাও করে নি।
আহি ঝটপট আশপাশ চোখ বুলিয়ে নিলো। তার চোখ পড়লো জীর্ণশীর্ণ দাঁড়িয়ে থাকা একটা রিক্সার দিকে। সে রিক্সার কাছে এসে তার কাঁধের ব্যাগটা রিকশার হাতলে ঝুলিয়ে দিলো। তারপর ব্যাগের সাইড পকেট থেকে একটা কলম আর পেন্সিল বের করলো। রিক্সার পাশেই ইটের স্তূপ। হয়তো ইটগুলো ভাঙার জন্য একপাশে জড়ো করে রাখা হয়েছে। আহি চারটা ইট বসিয়ে বসার জায়গা করে নিলো। এরপর আফিফের দিকে তাকিয়ে নতুন ডায়েরীটা খুলল। কোলের উপর রেখে সাদা পৃষ্ঠায় কলম চালালো।

“তোমার দিকে তাকিয়ে তোমার আমার প্রেমের গল্প লেখা শুরু করছি। বিষয়টা চমৎকার না? এমন উন্মাদ প্রেমিকা কি আগে দেখেছো? নিশ্চয় দেখো নি। জানো, আজই কিনলাম এই ডায়েরীটা। আর পথে দেখা হয়ে গেলো তোমার সাথে। তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে, কথা বলছো কোনো এক অচেনা ছেলের সাথে। আর আমি রৌদ্রতাপ ভুলে রিকশার পাশে তোমাকে দেখা যায় এমন স্থানে বসে আছি। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছি তোমাকে। আচ্ছা এআর, মেয়েরা কি এভাবে লুকিয়ে কারো দিকে তাকায়? মেয়েরাও কি এভাবে ভালোবাসে? জানি না, কিন্তু আমার তোমাকে এভাবে ভালোবাসতেই ভালো লাগে।”

লেখা শেষ করে আহি আফিফের দিকে তাকালো। চোখ-মুখ কুঁচকে রেখেছে আহি। রোদের তাপে মুখ জ্বালা করছে, তবুও ঠাঁই বসে আছে সে। পেন্সিল হাতে নিতেই দেখলো আফিফ ছেলেটির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছে। আহি দাঁড়িয়ে গেলো। ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে ছুটলো আফিফের পিছু। কিন্তু অর্ধেক পথ যেতেই আফিফকে হারিয়ে ফেললো। শেষমেশ শুকনো মুখে এদিক-ওদিক তাকিয়ে হতাশ হয়ে বাসায় ফিরলো সে। এরপর বাসায় এসে কারো সাথে কোনো কথা না বলে সোজা নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিলো। সালমা ফাওজিয়া আহির ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। সেকেন্ড খানিক নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেলেন।

(***)

বিকেলে আহি ডায়েরী খুলে তার লেখাটা একবার পড়ে নিলো। তারপর খালি স্থানগুলোতে গোলাপের পাপড়ি লাগিয়ে একপাশে আফিফের নাম লেখা নোটটি আঠা দিয়ে লাগিয়ে দিলো। আর নিচে লিখলো,

“প্রথম তোমার নাম জানার চেষ্টা। কি সুন্দর নাম! আফিফ রাফাত।”

তারপর একটা পেন্সিল হাতে নিয়ে আজকের দৃশ্যটা স্কেচ করতে বসে গেলো।

রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে হাস্যোজ্জ্বল চেহারার আফিফ। সামনে একটা ছেলের অবয়ব। আহি বসে আছে ইটের উপর। পাশে একটা রিকশা৷

স্কেচ শেষে ডায়েরীটা বন্ধ করে আলমারীতে তুলে রাখলো আহি৷ এরপর ক্যানভাসে আটকানো সেই স্কেচটার দিকে তাকালো যেটা সেদিন বটবৃক্ষের পরিবর্তে এঁকেছিল। স্কেচটা বাঁধিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলো সে। যেই ভাবা সেই কাজ। স্কেচটা হাতে নিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো আহি। সালমা ফাওজিয়া মেয়েকে চপল পায়ে বেরিয়ে যেতে দেখে ভ্রূ কুঁচকালেন। আহি পাশের দোকানে গিয়ে স্কেচটা বাঁধাতে দিলো। একদিনের মধ্যেই আফিফ তার ঘরে শোভা পাবে, ভাবতেই ভীষণ ভালো লাগা কাজ করছিল আহির মনে।

………………………….

জানালার পর্দা দু’পাশে সরিয়ে দিতেই জানালা ভেদ করে রোদের আলোকচ্ছটা আহির মুখে এসে পড়লো। কড়া রোদে মানুষ হাঁসফাঁস করছে। প্রকৃতি কেমন ভ্যাপসা গরম ছড়াচ্ছে। দেশে গরম বোধহয় একটু বেশি। তবে আহির তেমন খারাপ লাগছে না। সে তো অভ্যস্ত এসবে। প্রিয় মুখটা দেখার জন্য কিছু বছর আগেও সে রোদে পুড়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু ফলাফল শূন্য।
অতীত স্মৃতি থেকে বেরিয়ে শুকনো ঢুক গিললো আহি। বুকটা আবার জ্বালা করছে তার। ঠোঁট দু’টিও কাঁপছে। মাঝে মাঝেই প্যানিক এটাক আসে আহির৷ সেই চার বছর আগে প্রথম এসেছিল। তারপর থেকে প্রতিনিয়ত এই সমস্যায় ভুগছে। ওয়াশরুমে গিয়ে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে নিলো বার কয়েক। এরপর ভেজা মুখেই সে হোটেলের বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। রোদের তাপে বারান্দার মেঝেতে পা রাখা যাচ্ছে না। রেলিঙে হাত রাখতেই বুঝলো, গরমের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন। চার বছর আগেও প্রকৃতি এতো উত্তপ্ত ছিল না। দিন দিন আবহাওয়ার ভিন্ন রূপ সৃষ্টি হচ্ছে। আজ হয়তো দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। আর এদিকে সে নিম্ন মানের হোটেলে উঠেছে। রুমে এসির ব্যবস্থা নেই। ফ্যানটাও খুব আস্তে ঘুরছে। বাবাকে কয়েকবার ফোন দিয়েছিল আহি, কিন্তু তিনি ধরলেন না। তাই বাধ্য হয়েই কাছের একটা হোটেলে উঠতে হলো তাকে। ক্রেডিট কার্ডে অল্প কিছু টাকা ছিল, তা উঠিয়ে নিয়েছিল। সেই টাকা দিয়েই ঢাকায় জরুরী কাজ সেরে চট্টগ্রাম যেতে হবে।

বারান্দার দেয়ালে হেলান দিয়ে এক দৃষ্টিতে ব্যস্ত রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে আহি। আর আনমনে বলতে লাগলো,
“দেখো, কেমন পাগল হয়ে যাচ্ছি, এআর। তুমি হয়তো আমাকে মনেই রাখো নি৷ কিন্তু আমি এক পাগল, তোমাকে এতো চেষ্টা করেও ভুলতে পারছি না। আমি তো ভোলার অনেক চেষ্টা করেছি। নিজেকে ব্যস্ত রেখেছি। এর চেয়ে বেশি চেষ্টা করতে গেলে মস্তিষ্ক বের করে তোমার স্মৃতি ঘেরা অংশটা মুছে দিতে হবে৷ এছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না। কেন এতো ভালোবেসেছিলাম তোমাকে, বলো না এআর? ভালোবাসার সাগরে ফেলে দিয়েছো ঠিকই, কিন্তু ভুলে যাওয়াটা শিখিয়ে দাও নি। এখন শুধু একটাই চাওয়া, দ্বিতীয় বার যাতে তোমার মুখোমুখি হতে না হয়। তোমার জন্য দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম, কিন্তু এখন বাধ্য হয়েই ফিরতে হলো। নয়তো কখনোই আসতাম না আমি। গ্রীষ্ম শেষ হলে আবার বর্ষার মাস আসবে। এমনই এক গ্রীষ্মে তোমাকে পাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম, আর বর্ষা এসে তোমাকে আমার কাছ থেকে অনেক দূরে নিয়ে গেলো। সেদিন শুধু তোমাকে হারায় নি, অনেক মানুষকে একসাথে হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমি তো কাউকে কষ্ট দেই নি, এআর। তাহলে আমি কেন এতো কষ্ট পাচ্ছি? আমি এতো অসহায় কেন? মাঝে মাঝে ভাবি, কেন বেঁচে আছি? আমার বেঁচে থাকা না থাকায় কারো কিছুই আসে যায় না। আমি শুধু কিছু মানুষের জন্য ইনভেস্টমেন্ট মাত্র।”

আহি দেয়াল ঘেঁষে বারান্দার মেঝেতে বসে পড়লো। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে৷ দেয়ালে ধীরগতিতে মাথার পেছন ভাগ টুকাতে লাগলো। এতে যদি মাথার চাপ একটু কমে। ভীষণ ভারী ভারী লাগছে মাথাটা।

০৬।

লিনাশা, পদ্ম, আহি আর পুষ্প। তারা মোট চার বন্ধু। স্কুল-কলেজ একসাথেই শেষ করেছিল তারা। কিন্তু অনার্সে ভর্তি হওয়ার পর পরই তারা সবাই আলাদা হয়ে যায়। আর তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কটা ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে পড়ে। তারা তাদের নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে তাদের চারজনের এই ছোট বন্ধু মহলটির একটা নামও রেখেছিল, ‘পলি আপু’ নামে। সবাই এই নামটা শুনে হাসাহাসি করতো, আবার অবাক হতো চারজনের বন্ধুত্ব দেখে।
বন্ধু মহলে পদ্ম ছিল সবচেয়ে শান্ত। আর পুষ্প ছিল খুবই চঞ্চল। অন্যদিকে লিনাশা আর আহি ছিল অনেক মিশুক। তবে এই চারজনের মধ্যে লিনাশা আর আহির বন্ধুত্ব একটু বেশিই গভীর ছিল। কিন্তু হঠাৎ কি যেন হলো! আহি চার বছরের জন্য দেশের বাইরে চলে গেলো। যেই লিনাশার সাথে আহির গলায় গলায় ভাব ছিল, তারা এখন একে অপরের নামও উচ্চারণ করে না। অন্যদিকে পদ্ম বিয়ের পর থেকে সংসার নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আর পুষ্পের সাথে আহির খুব কমই যোগাযোগ হয়। কিন্তু আহির ফোনের ওয়ালে এখনো কলেজের বিদায় অনুষ্ঠানে চারজনের একসাথে তোলা শেষ ছবিটি শোভা পায়। ফোন হাতে নিয়ে সেই ছবিটিই দেখছিলো আহি। ঠোঁটে মলিন হাসি টেনে আহি বলল,
“অন্তত তোরা আমার সাথে থাকলে, আমার জীবনটা এমন এলোমেলো হতো না। পরিবার, বন্ধু, ভালোবাসা সব হারিয়ে আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। এই বিস্বাদ জীবনে কোথাও ছিঁটেফোঁটা আনন্দও নেই।”

ফোনের স্ক্রিনে রাদের নামটা ভেসে উঠতেই আহি ভেজা চোখ মুছে নিলো। ফোন কানের কাছে আনতেই ওপাশ থেকে গম্ভীরমুখে রাদ বলল, “কাঁদছিস!”

রাদের কথায় কান্নার বেগ যেন আরো বেড়ে গেলো আহির। মুখে হাত চেপে নিজেকে সংবরণের ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলো সে। রাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“থাক কথা বলিস না। আমার কথা শোন। তোকে একটা গান শোনাই। চোখ বন্ধ করে রাখ। ভালো লাগবে।”

আহি চোখ বন্ধ করতেই অশ্রুগুলো গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো। রাদ কন্ঠে গান ধরলো,
“খোলা জানালা দখিনের বাতাসে….
ঢেকে যায় পর্দার আড়ালে,
তখন তুমি এসে হেসে বলে দাও
আছি তোমার পাশে।
বহুদূর পথ ভীষণ আঁকাবাঁকা,
চলতে ভীষণ ভয়,
তুমি এসে বলে দাও আছি আমি পাশে
করো না কিছুতেই ভয়।
তখনও বুঝিনি চলে যাবে তুমি
আমাকে এভাবে কাঁদিয়ে,
তখনও বুঝিনি ফিরে আসবেনা
আমার পৃথিবী রাঙিয়ে।
অনেক পথের পথিক আমি ক্লান্ত সর্বশেষ,
তোমার পথের ঠিকানা খুঁজে, আমি আজ অবশেষ।
তুমি আমার প্রথম ও শেষ জীবনের ভালোবাসা,
তোমার মাঝে তাইতো আমার জীবনের শত আশা।
তখনও বুঝিনি চলে যাবে তুমি
আমাকে এভাবে কাঁদিয়ে,
তখনও বুঝিনি ফিরে আসবেনা
আমার পৃথিবী রাঙিয়ে।”

আহি ভেজা কন্ঠে বলল,
“আমার কষ্ট আরো বাড়িয়ে দিলি, রাদ।”

“তোর কষ্টগুলো ভীষণ ঘাড়ত্যাড়া রে। শুনেছি মানুষ কষ্ট পেতে পেতে পাথর হয়ে যায়। আর তুই বরফ গলা নদী। কখনো শক্ত, কখন গড়িয়ে পড়িস। এভাবে চলবে না, আহি। শক্ত হ। এখন তো তোকে আরো শক্ত হতে হবে। আংকেলের মুখোমুখি দাঁড়ানোর জন্য তো অন্তত তোকে শক্ত হওয়া দরকার।”

আহি বিড়বিড় করে বলল,
“বাবার সাথে শক্তির জোরে আমি পারবো না। আমি হয়তো হেরে যাবো।”

রাদ এবার ধমকের সুরে বলল,
“আহিনি, তোকে সামনে পেলে রামধোলাই করবো আমি। মিনমিন করে কি বলছিস? হেরে গেলে মার খাবি। তোকে হারাতে হবে।”

“পারবো আমি?”

“কেন পারবি না? যথেষ্ট বড় হয়েছিস তুই। এখন তোর মতামতের একটা মূল্য আছে। আর এসব পরে ভাবিস। আগে চট্টগ্রাম গিয়ে দেখ, বাসার পরিবেশ কেমন। তারপর সুযোগ বুঝে নিজের মত রাখবি। আংকেলের সব অন্যায় কেন মেনে নিবি?”

“তুই বাবাকে চিনিস না। আমি এই চার বছরে তার যেই রূপ দেখেছি, মনে হচ্ছে না আমি তার হাত থেকে মুক্তি পাবো। মনে বলছে সামনে আরো ভয়ংকর কিছু দেখতে হবে।”

চলবে-

(আজকে বাংলাদেশ জিতলে আগামীকাল একটা পর্ব দিবো। হারলে দেবো না।😁)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here