মেঘের_শহর #পর্ব_৭ Saji Afroz

0
97

#মেঘের_শহর
#পর্ব_৭
Saji Afroz
.
আজ মেঘ ও সাইয়ারা তাদের পরিবারের সাথে প্রতিবেশি মোফাজ্জল হকের মেয়ের বিয়েতে এসেছে। আনন্দ নগর কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ের এক বিশাল আয়োজন করা হয়েছে।
চারদিক চোখ ধাধানো লাইটিং এর আলোতে আলোকিত হয়ে আছে। রাত বলে এসব আরো ফুটে উঠেছে।
মেঘ এখানকার খুব একটা মানুষকে চিনেনা। কিন্তু দুইবছর থেকেই সাইয়ারা এলাকার প্রায় সবাই কেই চিনে। সে নিজের মতো ঘুরে ঘুরে সবার সাথে কথাবার্তা বলছে। মেঘ চুপচাপ একপাশে বসে আছে। মা ও মিন্নীও পাশে নেই। এখানে আসার তার কোনো ইচ্ছেই ছিল না। মায়ের জোরাজোরি তে আসতে বাধ্য হয়েছে। অচেনা সব মানুষের ভিরে থাকতে তার মোটেও ভালো লাগছে না। তবে সাইয়ারার ছুটাছুটি দেখতে ভালো লাগছে। মেয়েটা কত সহজেই মানুষ কে আপন করে নেয়!
আজ সে হালকা গোলাপি রঙের লেহেঙ্গা পরেছে। ওড়না টা ধবধবে সাদা। মনে হচ্ছে এই জামাটি কেবল সাইয়ারার জন্যই বানানো হয়েছে।
বেশ সেজেগুজে এসেছে মেয়েটি৷ চুলে খোপা করেছে। খোপায় গোলাপি রঙের গোলাপ ফুল দিয়েছে। মেঘ গুনে দেখলো, তিনটে গোলাপ দিয়েছে সে।
নাকে ছোট্ট একটা নথ পরেছে, কানে ঝুমকো আর দু’হাতেই অসংখ্য চুড়ি। বেশ ভালোই লাগছে সাইয়ারা কে। স্টেজে থাকা বউ এর চেয়েও তাকে দেখতে ভালো লাগছে। উপস্থিত অনেকের দৃষ্টি তার দিকে।
শ্যামবর্ণের মেয়েদের সাজলে এত সুন্দর লাগে মেঘের জানা ছিল না।
.
বর চলে আসলো। গেটের সামনে ফিতা ধরে দাঁড়িয়েছে কিছু মেয়ে। তাদের সাথে সাইয়ারাও আছে।
টাকা বেশি না দেয়ার কারণে তারা বর কে ভেতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। বরের সাথে আসা ছেলেরা নানাকথা বলে সাইয়ারাদের ক্ষেপাতে চেষ্টা করলো। কিন্তু তারাও ছাড়ার পাত্রী নয়। পাঁচ হাজার টাকা দিলেই ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে জানালো।
এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে টাকা দিতে হলো বর পক্ষকে। টাকা দিতেই কাচি পেল বর। কাচি দিয়ে ফিতা কেটে ভেতরে প্রবেশ করতেই ফুলের পাপড়ি ছিটাতে লাগলো মেয়েরা।
বর কে সাথে নিয়ে কনের পাশে এল তারা। বর কনে কে পাশাপাশি বসিয়ে তারা ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এরপর মিষ্টি খাইয়ে বরের গলায় মালা পরিয়ে নিচে নেমে এল সকলে।
স্টেজের নিচে নামতেই মেঘের দেখা পেল সাইয়ারা।
তার পাশে এসে বলল-
আপনি একা একা দাঁড়িয়ে আছেন কেনো?
-আসলে আমি এখানের কাউকে চিনি না। গুটিকয়েক জন যাদের চিনি কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। অনেক দিন বাইরে ছিলাম তো। এখন কেমন যেন…
.
কথা শেষ হবার আগেই এক মেয়ে এসে সাইয়ারার হাতে টাকা ঢুকিয়ে দিয়ে বলল-
তুই না থাকলে টাকা গুলো আদায় করতে পারতাম না৷ কিপ্টে দুলাভাই দুই হাজার দিয়েই কাজ সারতে চেয়েছিল।
.
মেয়েটি সাইয়ারাকে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে গেল।
মেঘ বলল-
কত দিয়েছে তোমাকে?
-আপনাকে কেনো বলব! ভাগ নিতে চাইবেন পরে।
-নাহ, আমার এত লোভ নেই।
কনের পরিবারের সাথে কি ভালো ভাব আছে তোমার?
-হ্যাঁ। ওর ছোট বোন আমার বান্ধবী।
-আচ্ছা।
-খেয়েছেন?
-নাহ। একা একা খেতে ইচ্ছে করছেনা।
-চলুন খেয়ে আসি। এখানে ছেলেমেয়ে আলাদা বসার আয়োজন করা হয়নি।
.
কথাটি শুনে মেঘ অবাক হলো। এই ব্যাপারটি সে জানেনা। মা আর বোন ও তাকে জানায়নি। তারা কি জানেনা সে এমন পরিবেশে কতটা অস্বস্তিবোধ করে!
হয়তো তারা আড্ডায় জমে আছেন। তাই মেঘের খেয়াল নেই।
সাইয়ারার সাথে ভাত খেয়ে নিলো মেঘ।
মেঘ জানালো তার এখানে থাকতে আর ইচ্ছে করছে না। বাসায় চলে যাবে। সাইয়ারা তাকে আঁটকালো। বলল, সে তার পাশেই থাকবে। আর বিরক্ত লাগবে না তার।
দুজনে স্টেজের সামনে এল। বর ও বউ কে ঘিরে অন্যান্য রা ছবি তুলছে। সাইয়ারা বলল-
বেচারা আর বেচারি।
-কেনো?
-দেখছেন না কেমন জড়সড় হয়ে বসে থাকতে হচ্ছে। কিন্তু আমার বিয়েতে আমি এমন করব না।
-কেমন করবে?
-আমি বউ সেজে বর কে নিয়ে ঘুরাঘুরি করব এদিক সেদিক। এভাবে বসে থাকার দরকার কি! আমরা ঘুরে ঘুরেই তো ছবি তুলতে পারি। তাইনা? সবাই মজা করবে, আমার কেনো বসে থাকব!
-ভালো যুক্তি।
-আমার আরো ইচ্ছে আছে বিয়ে নিয়ে। শুনবেন?
-বলো?
-আমার বর ঘোড়া গাড়ি করে আসবে। গেইটের সামনে আমি নিজেই দাঁড়াব ফিতা ধরে।
-নিজের বিয়ের গেইটের টাকাও নিজে নিবা?
-নাহ! ভাগ করে দিয়ে দিব। আমি দাঁড়ালে সে বেশি দিতে বাধ্য হবে।
-আচ্ছা। তারপর?
-বিয়ে শেষে ফুল দিয়ে সাজানো একটা গাড়ি করে ঠিকই যাব। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি প্রবেশ করব পালকি তে চড়ে।
-বাহ!
-আমার বাসর ঘরটা সূর্যমুখী ফুল দিয়ে সাজানো হবে। এটা আমার প্রিয় ফুল।
-তারপর?
-তারপর আর কি? আমাদের রোমান্সের কাঁপাকাঁপি তে ভূমিকম্প হবে।
.
কথাটি বলে জিভে কামড় বসালো সাইয়ারা।
এইরে! এত বেশি কথা কেনো বলে সে?
এটা কি বলে ফেললো!
মেঘ বুঝতে পারলো সাইয়ারা বেশ লজ্জা পেয়েছে। তাই সে কথা ঘুরিয়ে বলল-
আমাদের ঘরের সব গেল কোথায় বলো তো?
.
.
বিয়ে সম্পন্ন হবার পর সাইয়ারা ও মেঘের পরিবার একইসাথে নিজেদের বাড়িতে ফিরে এল।
ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘরে প্রবেশ করেই শুয়ে পড়লেন অন্তরা আহম্মেদ। কাল মেঘ ও সাইয়ারা কে একসাথে দেখে তার খারাপ লাগেনি। বরং ভালোই লেগেছে। সাইয়ারা মেয়েটি বেশ মিশুক। একটু চঞ্চল। উঁহু একটু নয়! অনেকখানিই চঞ্চল। কিন্তু মনটা পরিষ্কার। মনের মাঝে কোনো প্যাচ রাখেনা মেয়েটি। যা বলে সরাসরি বলে। যাকে বলে স্পষ্টবাদী। দুই বছরে এই মেয়েটি তার মনে অনেকটা জায়গা দখল করে ফেলেছে। মন্দ হবে না মেয়েটি তার ছেলের বউ হয়ে এই বাড়িতে আসলে। মিন্নীকে একদিন শ্বশুর বাড়িতে যেতে হবে। মেঘও তার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। তখন সাইয়ারার সাথে বেশ জমবে তার। অন্য কোনো মেয়ে তার এসব চিৎকার-চেঁচামেচি সহ্য করতে পারবে বলে মনে হয়না। কিন্তু সাইয়ারা তার এসবের সাথে অভ্যস্ত। সবচেয়ে বড় কথা সে কখনো বিরক্ত হয় না। উল্টো তার সাথে রসিকতা করে। এই মেয়েটিই তার বাড়িটা হাসিখুশি তে ভরিয়ে রাখতে পারবে।
আজ কমিউনিটি সেন্টারেও তিনি খেয়াল করেছেন, কত সহজেই সবার সাথে মিশেছে সাইয়ারা। দুই বছর হয়েছে এখানে এসেছে অথচ এলাকার বেশিরভাগ মানুষের সাথেই তার ভাবসাব আছে। শুধু তাই নয়। মেঘেরও খেয়াল সে রেখেছে। তিনি ইচ্ছে করেই মেঘের কাছ থেকে দূরে সরে ছিলেন। বুঝতে চেয়েছেন মেঘ ও সাইয়ারার একে অপরের সাথে কি সম্পর্ক?
মেঘ সাধারণত এসব অনুষ্ঠানে যেতে চায়না। গেলেও খুব একটা বেশি সময় কাটায় না। কিন্তু আজ বিয়ে সম্পন্ন না হওয়া অবধি সে সাইয়ারার সাথে ছিল। শুধু তাই নয়, বেশ হাসিখুশিও ছিল। আড়াল থেকে তিনি নজর রেখেছিলেন তাদের উপরে। দুজনে সবসময় একসাথেই ছিল।
হ্যাঁ তিনি প্রেম বিরোধী। কিন্তু ভালোবাসা বিরোধী নন। সাইয়ারা কেও তার অপছন্দ নয়। তবে কেনো তিনি দেরী করবেন? মেঘের সাথে এই বিষয়ে কথাটি সেরেই নিবেন তিনি। সাইয়ারার সাথে তার কিছু আছে কি না জিজ্ঞাসা করতে হবে।
এসব ভাবতে ভাবতে অন্তরা আহম্মেদ ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন।
.
.
সকালে ঘুম থেকে উঠে ড্রয়িংরুমে আসলো মেঘ। সোফায় বসে অন্তরা আহম্মেদ পত্রিকা পড়ছেন। মেঘ কে দেখে ডাইনিং রুমে বসতে বললেন নাস্তা করার জন্য।
কিছুক্ষণ পর তিনি আলু ভাজি ও পরোটা নিয়ে এলেন। মেঘের সামনে প্লেট রেখে চেয়ার টেনে তার পাশে বসলেন। এরপর এক দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
বিষয়টি বুঝতে পেরে মেঘ বলল-
এভাবে কি দেখছ মা?
-আমার ছেলেটা প্রেমে পড়েছে আমাকে জানালো না।
.
মায়ের কথা শুনে মেঘ শব্দ করে কাশতে শুরু করলো। তিনি পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিতেই সে ঢকঢক করে পুরো একগ্লাস পানি খেয়ে ফেললো।
অন্তরা আহম্মেদ বললেন-
কখন থেকে প্রেম করছিস?
.
এবার মেঘ বুঝতে পারলো, তার মা আন্দাজে ঢিল মেরেছে। এটা ছাড়া আর কিইবা হবে! সে হুরায়রা কে পছন্দ করে এটা তার বন্ধুরা ছাড়া কেউ জানে না। তবে পাশের বাসার দুষ্টু সাইয়ারার ভরসা নেই। সে নিশ্চয় অন্য কিছু বুঝিয়ে মায়ের কান ভারি করেছে।
মেঘ খেতে খেতে বলল-
সাইয়ারা তোমার কান আবার ভারি করলো?
-না তো! বেশ কিছুদিন ধরেই তোকে আমি লক্ষ্য করছি।
-কি লক্ষ্য করলে?
-বেশ পরিবর্তন এসেছে তোর মাঝে।
কেনো জানিস?
-কেনো?
-সাইয়ারার প্রেমে পড়েছিস তাই।
.
মায়ের কথা শুনে না হেসে পারলো না মেঘ।
অন্তরা আহম্মেদ বললেন-
হাসছিস!
-হ্যাঁ। সাইয়ারা আর আমি! হাসালে মা।
-এখন তো অস্বীকার করবিই।
.
মেঘ মুখে খাবার নিচ্ছিল। মায়ের কথা শুনে থেমে গেল সে। হাসতে হাসতেই বলল-
না আমি ওকে ভালোবাসি, না ও আমাকে। আর আমাদের মাঝে কিছু নেই।
ভুল বুঝেছ তুমি।
.
অন্তরা আহম্মেদ চেয়ার ছেড়ে উঠে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালেন। কি যেন ভেবে পেছনে ফিরে বললেন-
আমি প্রেম করা পছন্দ করি না৷ কিন্তু তুই কাউকে ভালোবাসলে তাকে আমি অপছন্দ করব ভাবিস না। কাউকে ভালোবাসলে আমাকে জানাবি৷ আমি নিজেই তোদের বিয়ের ব্যবস্থা করব।
.
কথাটি বলে তিনি চলে গেলেন। ছেলের জবাব শোনার প্রয়োজন মনে করলেন না।
কাল হুরায়রার কথা একটুও মনে পড়েনি মেঘের। হয়তো ব্যস্ত ছিল তাই নয়তো তার কঠোর ব্যবহারের জন্য। কিন্তু এখন মায়ের কথা শুনে মেয়েটির কথা মনে পড়ে গেল। ইচ্ছে করছে এখুনি ছুটে গিয়ে তাকে দেখতে। তাকে জানাতে নিজের মনের কথা। এখন তার মাও বলেছে, মেঘের ভালোবাসা কে তিনি গ্রহণ করবেন। ইচ্ছে করছে এই কথাটিও তাকে জানাতে। কিন্তু কি লাভ জানিয়ে? মেয়েটি তার কি হয়? কিছুই না। কালকের পর তার সামনে যেতেও মেঘের কেমন যেন লাগছে। অহেতুক কাউকে বিরক্ত করার অভ্যেস তার নেই।
আর খেতে ইচ্ছে করছে না মেঘের। বাইরে থেকে ঘুরে আসা প্রয়োজন। যদি তাতে একটু তার অশান্ত মনটা শান্ত হয়!
বাইরে বেরুনোর সময় সাইয়ারার বারান্দার দিকে নজর গেল তার। আজ সাইয়ারা কে দেখা গেল না। হয়তো ভার্সিটিতে গেছে।
এই কয়েকদিনে মেয়েটির সাথে তার বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে তার। যার কারণে তার মাও তাদের সন্দেহ করলো। অবশ্য করাটা অস্বাভাবিক কিছু না। দুজন ছেলেমেয়ের মাঝে কেবল বন্ধুত্বই আছে এটা সহজে কেউ মানতে চায় না। সেই জায়গায় সাইয়ারা তার বয়সে ছোট। সে তার বন্ধুও নয়। তাহলে সে কি একটু বেশিই ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ছে মেয়েটির সাথে? হয়তো হ্যাঁ। যার কারণে তার মা এসব ভেবেছে। যাক, যা হবার হয়েছে। আজ থেকে নিজেকে দূরে রাখবে সে সাইয়ারা থেকে। যাতে দ্বিতীয়বার তার মা এসব নিয়ে তাকে প্রশ্ন না করেন। আর হুরায়রা? তার কাছ থেকে দূরে থাকা সম্ভব হবে কি? দেখা যাক…
.
.
আজ আবার আকাশ মেঘলা হয়ে আছে। অল্প অল্প বাতাস বইছে চারপাশে। সে বাতাসে ঘাটে বাধানো নৌকা দুলছে। চারপাশে পাখিরা উড়ে বেড়াচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে তারা বুঝতে পেরেছে একটু পরেই বৃষ্টি নামবে। আর তাই নিজেদের বাড়ি ফেরা প্রয়োজন!
কিন্তু হুরায়রার মোটেও বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে না। এই আনন্দ নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে ইচ্ছে করছে তার।
এদিকে গুটিগুটি পায়ে আনন্দ নদীর দিকে এগিয়ে আসছে মেঘ। আজ সে হুরায়রা কে দেখার জন্য ভার্সিটি যায়নি। মন কে শান্ত করার জন্য আসছে আনন্দ নদীর পাড়ে। কিন্তু কেইবা জানতো! ভাগ্য যে চেয়েছে আজ মেঘ ও হুরায়রার আবারো দেখা হোক…
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here