দমকা_প্রেমের_গল্প #Ayrah_Rahman #পর্ব_১১

0
76

#দমকা_প্রেমের_গল্প
#Ayrah_Rahman
#পর্ব_১১
________________

” তোমাদের সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে। আশা করি আমার কথা গুলো সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনবে ”

ডাইনিং টেবিলে খাবার শেষ করে টিস্যু দিয়ে হাত মুছতে মুছতে গম্ভীর কন্ঠে কথা টা বলল মুনতাসিম। মজুমদার বাড়ির সকল সদস্য উপস্থিত তখন। শুধু মাত্র তন্ময় আর মেধা নেই। তন্ময় তার হসপিটালে আর মেধা হলে, ছুটি এখানো পায় নি।

বাড়ির ছেলেরা ডাইনিং টেবিলে বসা আর নারীরা খাবার পরিবেশন করতে ব্যস্ত। হঠাৎ মুনতাসিমের কথায় চোখ তুলে তাকালো সকলে। চোখে মুখে দারুণ আগ্রহ কারণ মুনতাসিম খাবার টেবিলে কখনোই কথা বলে না এমনিতে ও সে স্বল্প ভাষী মানুষ।

” হুম বলো ”

মেহেরাব মজুমদারের গম্ভীর কন্ঠ ভেসে আসলো। মুনতাসিম চোখ ঘুরিয়ে খুঁজলো কাউকে।

” মেহের ”

মেহের ড্রয়িং রুমের এক কোনায় গুটিশুটি মেরে দাঁড়িয়ে ছিলো। মুনতাসিমের কন্ঠে নিজের নাম শুনতে পেয়ে লাফিয়ে উঠলো সে। মুনতাসিম কে সে যথেষ্ট ভয় করে একে বারে যাকে বলে জমের মতো ভয় করে। মুনতাসিম মেহের কে যথেষ্ট আদর করে কখনো ধমক দিয়েছে কি না সেটাও মেহের বলতে পারবে না। প্রতিদিন ফ্রিজ খুলে আইসক্রিম কিংবা চকলেট রাখা দেখতে পায় মেহের জানে এটা মুনতাসিম ই রাখে। তবে কোন দিন মেহেরের হাতে দেয় না।

” জজ্বী বড় ভাইয়া ”

” এদিকে আয় ”

মেহের গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলো মুনতাসিমের দিকে। বাড়ির সকলে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে মুনতাসিমের দিকে কিন্তু এই ছেলের ভাব ভঙ্গিতে বোঝার উপায় নেই সে কি করতে চাচ্ছে।

মেহের মুনতাসিমের পাশে দাড়াতেই মুনতাসিম মেহেরের দিকে তাকালো,

” আমি কি তোর খারাপ চাইবো কখনো?”

মেহের চমকে উঠলো। মুনতাসিমের মুখে এমন কথা সে আশা করে নি। মাথা দুই দিকে নাড়ালো।

” আমি তোর জন্য নিউ টিউটর ঠিক করেছি আশা করি এই নিয়ে তুই কোন কথা বলবি না ”

মেহের আবারো মাথা নাড়ালো মানে সে টু শব্দ ও করবে না। মুনতাসিম হাসলো তবে সেটা হয়তো এক সেকেন্ডের জন্য কিংবা তার চেয়ে ও কম।

মুনারা আক্তার মুখ চেপে হাসছেন। এই মেয়ের যত দস্যিপনা সব মা বাবার সাথে ই মুনতাসিমের সামনে এলে সব ভিজে বিড়াল। যেখানে বাপ ই মুনতাসিম কে যথেষ্ট ভয় করে এই ছেলের বিশ্বাস নেই কখন কি বলে নিজের কথার মার প্যাচে নিজেকে ই ফেলে দেয় তার নেই গ্যারান্টি।

এবার মুনতাসিম সরাসরি মেহেরাব মজুমদারের দিকে তাকালো,

” বড় আব্বু, এই পর্যন্ত আমি যা করেছি আপনার মন পুত হয় নি তা আমি জানি। আমি আপনার মন মতো হতো পারি নি তা নিয়ে আমার কোন আফসোস কিংবা আক্ষেপ নেই তবে আজও হয়তো আমার কাজ আপনার ভালো লাগবে না তবে এই মজুমদার বাড়িতে আপনার, আমার বাবার কিংবা ছোট আব্বুর যেমন অধিকার তেমনি কিন্তু আরেকজনের সমান অধিকার আছে। ”

মুনতাসিম থামলো। আশেপাশে তাকাতেই দেখলো সকলে তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

” তুই কি বলতে চাইছিস মুনতাসিম? ”

মাহমুদ মজুমদারের দিকে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকালো সে।

” বলা শেষ করি তারপর না হয় জিজ্ঞেস করো ”

” তুই কি মাহবুব ভাইয়ের কথা বলছিস মুনতাসিম? ”

তৃষা বেগম এর কথা শুনে তার দিকেও তাকালো পরক্ষণেই বলল,

” হ্যা আমি আমার চাচাজানের কথায় বলছি। মেহেরাব মজুমদার, মাহমুদ মজুমদার, মাহফুজ মজুমদারের মতো মাহবুব মজুমদারের ও সমান অধিকার এই বাড়িতে। আর এতো দিন তোমরা যা করতে পারো নি, ওফফ সরি করো নি তা আজ আমি করবো। আমার চাচা পৃথিবীতে নাই বা থাকতে পারে তবে আমার চাচার উত্তরসূরীরা এখনো বেঁচে আছে। তার সহধর্মিণী এখনো পৃথিবীর বুকে নিঃশ্বাস নেয়।”

মজুমদার বাড়ির সকলে স্তব্ধ, বাকরুদ্ধ, নির্বাক হয়ে পড়লো। তৃষা বেগম আর্তনাত করে বলল,

” মাহাবুব ভাই পৃথিবীতে নেই? ”

” না ”

মুনতাসিমের চোয়াল শক্ত। তৃষা বেগম আহত দৃষ্টিতে তার স্বামীর দিকে তাকালো, মেহেরাব মজুমদারের দৃষ্টি খারাপ প্লেটে যেন সেখানেই স্তব্ধ হয়ে আছেন। তৃষা বেগম ঘাড় ঘুরিয়ে তার দুই দেবরের দিকে তাকালো। মাহমুদ মজুমদার ও মুনতাসিমের দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে যেন কথাটা ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। মাহফুজ মজুমদার একবার বড় ভাইয়ের দিকে তাকাচ্ছে একবার মুনতাসিমের দিকে।

” তুই কি ভাবে জানলি মুনতাসিম? ”

মায়ের কন্ঠ শুনতে পেয়ে চোখ ঘুড়ালো মায়ের দিকে।

” সেটা বলতে বাধ্য নই ”

অরুনা বেগম বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকালো ছেলের দিকে। সিরিয়াস মূহুর্তে এমন ভাব কোথ থেকে আসে এই ছেলের সেটাই ভেবে পান না।

মেহেরাব মজুমদার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো। খুব সন্তর্পনে হাটতে লাগলো নিজের ঘরের দিকে। মুনতাসিম সে দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল,

” আমার কথা এখানো শেষ হয়নি ”

মেহেরাব মজুমদারের পা দুটো থেমে গেলো।

” বলো”

মেহেরাব মজুমদারের স্বাভাবিক কন্ঠ।

” কাল মেহের কে পড়ালে অরিত্রা মাহাবুব আসবে ডটার অব মাহাবুব মজুমদার। ”

মজুমদার বাড়ির সকলে তড়িৎ গতিতে তাকালো মুনতাসিমে র দিকে।

” ভাই অরিত্রা! সেই মে….”

” তুই চুপ থাক সায়র! ”

ভাইয়ের ধমকে চুপ করে গেলো সায়র। মুনতাসিম আবারও বলল,

“কিন্তু সে জানে না এই বাড়িই তার নিজের বাড়ি, এই সেই বাড়ি যেখান থেকে তার দাদাজান তার বাবাকে বের করে দিয়েছিলো শুধু মাত্র তার মাকে বিয়ে করার জন্য। আর তার চাচারা সেদিন কাপুরুষের মতো দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে দেখছিলো। কোন প্রতিবাদ করে নি। আমি মুনতাসিম এমনি এমনি আমার চাচিমা কে এই মজুমদার বাড়িতে আনব না, তার সকল অধিকার, তার প্রাপ্য সম্মান দিয়ে তবেই আনব। এই বিষয়ে আমি কারো কোন কথা শুনতে চাই না

আশা করি আমার কথা সবাই বুঝতে পেরেছো ”

মুনতাসিমের চোয়াল শক্ত। রাগে চোখের সাদা অংশ লাল বর্ন ধারণ করেছে।

” কিন্তু তুমি কি করে জানলে অরিত্রা তোমার চাচার মেয়ে?”

” সেটা কাল অরিত্রা আসলে নিজেই বুঝতে পারবে ”

মুনতাসিম উঠে দাঁড়ালো। গটগট পায়ে চলে গেলো তার রুমে। ধীরে ধীরে খালি হলো সম্পুর্ন ডাইনিং রুম। শুধু মাত্র তিন বউ ছাড়া। তৃষা বেগম ধীরে ধীরে চেয়ারে বসলেন। তার এক পাশে অরুনা বেগম আর আরেক পাশে মুনারা আক্তার। কারো মুখে কোন কথা নেই শুধু ভেতর থেকে আসছে এক ফালি দীর্ঘ শ্বাস।

_______________

সকালের সূর্য উদিত হয়েছে তারই সাথে রোদের ভ্যাপসা গরম টা সকালেই উপলব্ধি করা যাচ্ছে। অরিত্রা হাতের সকল কাজ সেড়ে গোসল শেষ করে মায়ের রুমে ঢুকলো। নতুন টিউশনির কথা মাকে বলা হয় নি।

” আসবো?”

নাহিদা বেগম বই পড়ছিলেন। মেয়ের কন্ঠ শুনতে পেয়ে বই বন্ধ করে দরজার দিকে তাকালো,

” আয় ”

অরিত্রা ঢুকলো, মায়ের পাশে বসতে বসতে বলল,

” নাস্তা রেডি। খেয়ে নিও আমি এক্ষুনি বের হবো। নতুন টিউশনি পেয়েছি। ভালো ই বেতন। বড়লোকের মেয়ে তো ”

নাহিদা বেগম ভ্রু জোড়া কুঁচকে মেয়ের দিকে তাকালো,

” আবার নতুন টিউশনি? তোর শরীর কে কি শরীর মনে হয় না? নিজের কি হাল করেছিস তুই? চাঁদের টুকরার মতো গায়ের রং কে কি আলকাতরা বানাচ্ছিস দিনে দিনে? চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল। ”

অরিত্রা হাসলো,

” ও তুমি চিন্তা করো না তো আম্মু। দুই দিন ঠিক ভাবে ঘুমালেই ঠিক হয়ে যাবে। তুমি একা কতদিন সংসার চালাবে? তোমার যে দু দুটো ছেলে বড়ো হচ্ছে সেদিকে খেয়াল আছে? তুমি বরং ওদের চিন্তা করো। আমি এখন যাই নাহয় দেরি হয়ে যাবে ”

বলেই অরিত্রা চলে গেলো পিছনে থেকে নাহিদা বেগম অরিত্রার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন। মনে মনে শুধু একটায় দোয়া করেন তিনি মেয়েটা যেনো সবসময় ভালো থাকে।

________

” হ্যালো ইফতেখার ভাই আপনি কোথায়? ”

সকাল সকাল অরিত্রার ফোনে অবাক হলো ইফতেখার। পুরো ঘুম ভাঙার ফলে কিছু ক্ষন থম মেরে রইলো। সে তো ভুলেই গিয়েছিল আজ অরিত্রা মজুমদার বাড়িতে যাবে।

” অরি বোন তুমি চার রাস্তার মোড়ে দুই মিনিট দাড়াও আমি পাঁচ মিনিটে আসছি। ”

বলেই ফোন কেটে মুনতাসিম কে একটা মেসেজ লিখে দ্রুত ফ্রেস হতে গেলো। জীবনের সকল বিষয় নিয়ে ঢিলামি করলেও মুনতাসিমের কোন বিষয় নিয়ে সে বেশ তৎপর।

অরিত্রা দোকানের একটা বেঞ্চে বসলো আপাতত হঠাৎ তার থেকে একটু দুরে কয়েকটা ছেলে দাঁড়ানো। অরিত্রা আড়চোখে দেখলো ছেলেগুলো কে। তারা তার দিকেই তাকিয়ে আছে হয়তো নিজেদের মধ্যে কিছু বলাবলি করছে। বিষয় টা যে অরিত্রা নিজে সে বুঝতে পেরেছে। তবে তাদের কে বুঝতে না দিয়ে সোজা হয়ে বসলো।

” ওড়না দিয়েই কত হট লাগছে দেখ দোস্ত! ওড়না ছাড়া কতটা হ*ট লাগবে চিন্তা করতে পারোস! ”

কথাটা বলেই ছেলে গুলো কিটকিটিয়ে হেসে উঠলো।

” আর ফিগার টা দেখসস মাম্মা! পুরাই জোসস! “এরকম নানা ধরনের কথা!

অরিত্রার চোখ ততক্ষণে জ্বলা শুরু করেছে, আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। আজ সে তাদের কিছু ই করতে পারবে না। করলে পুরো প্রভাব তার উপর ই আসবে। তার তো বাবা নেই। মাথার উপর ঠায় নেই। মাকে নিয়ে সংসার!

আজ যদি নিজের একটা পরিবার থাকতো তাহলে একটা কেউ ছেড়ে কথা বলতো না। ওড়নার কোনা দিয়ে আনতো হাতে চোখের পানি মুছে নিলো।

প্রায় দশ মিনিটের মাথায় চৌরাস্তার মোড়ে ইফতেখার এসে দাড়ালো। অরিত্রা তখন দোকানের একটা বেঞ্চে বসে ছিলো। ইফতেখার কাছে আসতেই ছেলে গুলোর বাজে বাজে কথা কানে গেলো তার। হাতের মুঠো শক্ত হলো তৎক্ষনাৎ। কিছু একটা ভেবে সোজা মোবাইল বের করে ভিডিও করলো। তারপর কারো কাছে সেন্ড করে এগিয়ে গেলো অরিত্রার দিকে।

অরিত্রা ইফতেখার কে দেখে উঠে দাড়ালো। চোখ মুখ স্বাভাবিক যেন কিছু ই হয় নি।

” চলেন ভাই ”

ইফতেখার আড়চোখে এক পলক ছেলে গুলোর দিকে তাকিয়ে বলল,

” হুম চলো ”

অরিত্রা হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞাসা করলো,

” কত দুর ভাইয়া ”

” এই তো সামনে ”

হাঁটতে হাঁটতে ইফতেখার আর অরিত্রা একটা বড়ো লোহার গেইট এর সামনে এসে দাড়ালো। গেইটের পাশে নেইম প্লেট বসানো তাতে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা ” প্রশান্ত ভিলা “।

অরিত্রা বার দুয়েক নাম টা পড়লো। নামটা সুন্দর মনে হলো অরিত্রা কাছে।

ইফতেখার কে দেখেই দারোয়ান গেইট খুলে দিলো। ইফতেখার ভেতরে ঢুকলো পিছনে পিছনে অরিত্রা। ভেতরে ঢুকতেই অরিত্রার মুখ হা হয়ে গেলো। এটা কে কি বলা যাবে, বাগান বাড়ি?

এক পাশে ফুল আর ফলের বাগান বিশাল জায়গা জুড়ে আর অন্য পাশে পাখি পালার জন্য বিশাল বিশাল খাঁচা। খাঁচার মাঝে বেশির ভাগ ই টিয়া পাখি।

টিয়া পাখি মাহবুব মজুমদারের ভীষণ প্রিয় ছিলো তা অরিত্রা জানে। তবে আজ পাখি গুলো দেখে বাবার কথায় বেশি মনে পড়ছে তার। অরিত্রা রাস্তা ছেড়ে খাঁচার দিকে গেলো। খাঁচায় হাত রেখে সব গুলো পাখিকে এক পলক দেখে নিলো সে। ততক্ষণে চোখে এসে ভর করেছে জলকনা। খুব সন্তর্পনে মুছলো তা।

” কি হলো অরিত্রা চলো ”

” হুম চলেন ”

অরিত্রাকে নিয়ে ইফতেখার এসে দাড়ালো সদর দরজায়। অকারনেই অরিত্রার বুক কাঁপছে। কই কখনো তো এমন লাগে নি তাহলে আজ কি হলো তার! কেন অজান্তেই বুক কাপছে!

চলবে…

[ কেমন লাগলো জানাবেন কিন্তু আর সুন্দর সুন্দর কমেন্ট করবা ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here