অসম্ভবেও আমার তুমি নুসরাত সুলতানা সেজুথি পর্ব–১২

0
78

অসম্ভবেও আমার তুমি
নুসরাত সুলতানা সেজুথি
পর্ব–১২

সম্পূর্ন মনোযোগি দৃষ্টিতে বাইরের নিকষ কালো আর অন্ধকারাচ্ছন্ন রাতের শহর টাকে অবলোকন করছে স্নিগ্ধা। চোখ সেদিকে থাকলেও আদৌ মন নেই সেখানে। সকালের পর এখন রাত নেমেছে,,,,একটু আগেই তেজি সূর্য টাও লাল রঙ দেখিয়ে ডুবে গিয়েছে পশ্চিমে।
ঠিক আবার ভোরের পাখি ডাকলে উঠে আসবে সে,,,পুরোনো আলো,,ঝলমলে রোদ উপহার দেবে। ক্লান্ত রাত ছটফটে দিনে রুপ নেবে,,ব্যাস্ত মানুষ গুলো আবারো ব্যাস্ত হয়ে পরবে তাদের রোজকার কাজে। সবার দৈনিক,, তাদের রুটিন মাফিক চলে,,,
প্রকৃতি,,, এই প্রকৃতিতে থাকা প্রত্যেকটা বস্তু,,প্রত্যেকটা জীব। একমাত্র মানুষের জীবন কে বাদ দিয়ে। যারা আদৌ জানেনা একটু পরেই ঠিক কি হবে,,, কি হতে চলেছে তাদের সাথে।
ভাগ্যে কি লেখা আছে কিংবা কি নেই,,,,কি চাইছি আর কি পাবো। নিয়তির রেখাতে কি উজ্জ্বল আলো দেখাবে,,নাকি ঢেকে যাবে,, গুরুগুরু বৃষ্টি তে ভেজা কাগজের মত মুড়িয়ে নিঃশেষ হয়ে পরে রবে।
,,
,,
তনয়া চলে গিয়েছে,,,সেই দুপুরে। পরিত্যাগ করেছে এই ঘর,,বছর খানেক ধরে সাজানো সংসার,,,স্বামী সব কিছুকে। ঠিক পরিত্যাগ করেনি,,,পরিত্যাক্ত হয়েছে আবরারের কাছ থেকে। হয়তো আবরারের জীবন থেকেও বরাবরের জন্যেই তার যাওয়া।কিন্তু! যাওয়ার আগে বাবা মেয়ের বলে যাওয়া প্রত্যেকটা কথাই অতিমাত্রায় ভাবাচ্ছে স্নিগ্ধাকে,,,,,বারবার মনে পড়ছে আবরারের সামনে তোফায়েলের আঙুল উচিয়ে আওড়ানো শেষ কথা,,,

“” আমার মেয়ের প্রত্যেকটা চোখের জলের দাম গুনতে হবে তোকে!
তনয়ার অগ্নি দৃষ্টি,,,, যে দৃষ্টির অনলে এক নিমিষেই ঝলসে যেতে পারে সে,,আর তার এই দুদিনের সংসার।
ওরা যাওয়ার পরপরই আবরার ও বেরিয়েছে,,,দুপুর গড়িয়ে বিকেল,, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে,আর এখন প্রায় রাতে মোড় নিতে চললো সময়,, তবুও খোঁজ নেই তার।

এই প্রথম বার আবরারের জন্যে অপেক্ষা করছে স্নিগ্ধা। মন থেকে। আকুলতা বাড়ছে আবরার ফিরে আসা নিয়ে। কখন আসবে,, কখন আসবে এই এক প্রশ্ন বাবার উঁকি মারছে মস্তিষ্কের কোঠায়।
আজ এই বাড়িতে কাজের লোক বাদ দিয়ে শুধুমাত্র আবরার আর স্নিগ্ধা। তনয়ার ছায়াও নেই এখানে।হয়তো আবরারের জীবনেও তাই। আবরারের জন্যে ভীষণ রকম খারাপ লাগা এখনও কাটেনি স্নিগ্ধার।মায়া টান,,,অনুভূতি একটু হলেও সেই বিয়ের সময়টার মতোই নাড়া দিচ্ছে।

একটা সময়,,, তনয়ার জন্যে শুরু থেকে তার মায়া হতো,,,, অন্য এক নারীর সংসারে হস্তক্ষেপ করায়,, অপরাধবোধ কাজ করতো। কষ্ট অনুভব হতো কারো জীবনে সতীন হওয়ার তকমা গায়ে লাগার।
সেজন্যে মনে মনে সহস্র গালি,,দোষারোপ,, অভিশাপ কম বেরিয়ে আসেনি আবরারের জন্যে,,,কিন্তু
আজকের পর পরিস্থিতিটা একটু ভিন্ন হয়ে এসেছে।
তনয়ার প্রতি পুরোনো সহানুভূতির জায়গায় সামান্য হলেও ঘৃনা লাগছে এখন,,,আবার কখনও কখনো মায়াও হচ্ছে,,,,আর যাই হোক! মেয়েটাতো ভালোবাসার মানুষকে কাছে পাওয়ার জন্যেই এমন করেছে! ভালোবাসার ক্ষেত্রে সব সত্যি সব নির্দোষ। ওই যে,,,ভালোবাসা যেখানে এক বিশাল সমুদ্র,,,কয়েকটা অন্যায় আর ভুল সেখানে সামান্য আগুনের উল্কাপিণ্ড মাত্র।

আকাশ টা বেশ অস্পষ্ট। খুব একটা তারা জ্বলছে তাও নয়,,,ওইতো হাতে গোনা! কে বলেছে তারা গোনা যায়না? ওইতো গোনা যাচ্ছে,,,বারান্দার গ্রিল থেকে হাত বার করে স্নিগ্ধা আকাশের দিকে উঁচু করে ধরলো,,,ঠোঁট উল্টিয়ে মনোনিবেশ করলো নক্ষত্র গুনতে,,
“” এক,দুই,তিন….!ওই একটা চার….তারপর পাঁচ! এক দুই,, তিন… চার.. পাঁচ ছয়….
হুট করে কিছু একটা মনে পড়তে স্নিগ্ধা থেমে যায়!হাত গুটিয়ে কাছে আনে,,
বিড়বিড় করে বলে ওঠে,,

“”” আচ্ছা সব কিছু ফেলে এখন আমার কি করা উচিত?? আমি কি সম্পর্ক কে সুযোগ দেবো? সুযোগ দেবো ওনাকে? এমন টা তো নয় যে এই বিয়েতে আমি অসুখি ছিলাম। আমিতো দ্বিমত করিনি এই বিয়েতে,,বাবা জিজ্ঞেস করলে মত দিয়েছি। কারণ আমার মনে কখনও কেউ ছিলোইনা,,,সব সময় শুধুমাত্র বাবা মায়ের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে জীবনে এগোতে চেয়েছিলাম। তাদের মুখের ওপর না বলবোনা বিধায় গ্রামের ওই বুড়ো লোকটা কেও বিয়ে করতে রাজি ছিলাম।সেখানে উনিতো হঠাৎ পাওয়া আকাশের চাঁদ তুলনীয় ছিলো।

( একটু থেমে)
কিন্তু মন আর মস্তিষ্কের কথা মিলছেনা,তালগোল পাকিয়ে আসছে। তনয়া আপুর আকুতি,,ওনার সাথে থেকে যাওয়ার মিনতি সেগুলোই চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে। কি করবো আমি তাহলে! ওনার সাথে মন দিয়ে সংসার করবো? কোনও ভাবে এতে কি তনয়া আপুর সাথে আমার অন্যায় করা হবে??এই সংসার থেকে তনয়া আপু বিতাড়িত হলেও “”ওনাকে “”নিজের না করে পাওয়ার দীর্ঘশ্বাস কি একটু হলেও থাকবেনা? অন্য কারো ভারি নিঃশ্বাস সাথে নিয়ে কেউ কি সুখি হতে পারে??

___________________

পরি,,
আবরারের গলার স্বর শুনতেই ভাবনার সুতো ছিড়ে যায় স্নিগ্ধার।চুপ করে যায়।ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে তাকায়। আবরার মৃদূ হেসে ভ্রু নাঁচিয়ে বলে,,
— এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?
স্নিগ্ধা সেসব কথা কানে তোলেনা,,আবরার কে দেখে অনেকটা উদগ্রীব হয়ে এগিয়ে এসে উদ্বেগ নিয়ে বলে,
— আপনি কোথায় ছিলেন এতক্ষন? সেই কখন বের হলেন আর এলেনই না….

আবরার স্নিগ্ধার মুখের দিকে ভ্রুদ্বয় কুঁচকে তাকায়,,
— তুমি কি আমার জন্যে অপেক্ষা করছিলে?
আবরারের চাহনী দেখে স্নিগ্ধা চোখ নামিয়ে নিয়ে বলে,
— না মানে চিন্তা হচ্ছিলো।তাই আর কি!
আবরার জ্বিভ দিয়ে নিচের ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলে,
— খেয়েছো?
মাথা না তুলেই দুদিকে না বোধক মাথা নাড়ায় স্নিগ্ধা।বলে ওঠে — ভাবছিলাম আপনি এলে খাবো।

আবরার সামান্য ঠোঁট এলিয়ে মুগ্ধতার হাসি হাসে। কিন্তু স্নিগ্ধার সামনে অপ্রকাশিত রাখতে ওর সামনে থেকে সরে,,, দু পা এগিয়ে গিয়ে সোফার ওপর বসে পরে।সাড়াশব্দ না পেয়ে স্নিগ্ধা সেদিকে তাকায়। উদ্বিগ্ন হয়ে বলে ওঠে,
— তাহলে এখন কি করবেন?
আবরার জুতো খুলতে খুলতে তাকায় স্নিগ্ধার দিকে,,শীতল গলায় উত্তর দেয়,
— কিসের কি করবো?

স্নিগ্ধা তৎপর হয়ে বলে,
— খাবেন না। আমি কি খাবার রুমে নিয়ে আসবো?
আবরার এবার স্নিগ্ধার দিকে চোখ না দিয়েই বলে,
— নাহ,,,পরে খেয়ে নেবো।

স্নিগ্ধা খানিকক্ষণ উশখুশ করতে থাকে,,নূরী পাথরের মত দাত দিয়ে মৃদূ কামড়াতে থাকে নিচের ওষ্ঠটাকে। হুট করে ব্যস্ত গলায় বলে,
— আপনার কি তেস্টা পেয়েছে? পানি খাবেন…??
আবরার এবার হাতের কাজ থামিয়ে সরু চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
— আজকে আমার এত খেয়াল রাখছো যে? কি ব্যাপার বলোতো??

আবরারের এমন সোজাসাপটা প্রশ্নে স্নিগ্ধা লজ্জ্বা পায়,,,উশখুশ ভাবটা আরো প্রবল ভাবে চেপে ধরে তাকে।কোনও রকম ইতস্তত করে বলে,,,
— না এমনি,,পানিতো যে কাউকে খাওয়ানো যেতেই পারে।
কথাটায় স্নিগ্ধার লাজুক ভঙ্গি চোখ এড়ায়না আবরারের। আবরার মুখ টিপে হাসে । শান্ত আওয়াজে বলে ওঠে,
— আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। খাবার রেডি করো।

ফোল্ড করা শার্টের হাতার ভাজ খুলতে খুলতে ওয়াশ রুমের দরজায় হাত রাখে আবরার,,,তবে সিটকিনিতে টান দেয়ার আগে পেছন ঘুরে একবার স্নিগ্ধার দিকে তাকায়,,,বেশ ঠান্ডা স্বরে বলে,
— সেই প্রথম দিন তোমাকে খাইয়ে দিয়েছিলাম,,,তারপর আর হয়নি। আজকে আবার সেটার পুনরাবৃত্তি করলে মন্দ হয়না কিন্তু।

স্নিগ্ধা চট জলদি গোল চোখে তাকায়। আবরার মুচকি হেসে দরজা ঠেলে ওয়াশ রুমের ভেতরে ঢুকে পরে। দরজা লাগাতেই স্নিগ্ধার পাতলা ঠোঁট গুলোও প্রসারিত হয়ে আসে। কোথাও না কোথাও ভেতর টা ভালো লাগায় ছেয়ে যায়।
_________________________

রুমের বাইরে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে তোফায়েল। ভেতরে একের পর এক জিনিসপত্র ভাঙার তীব্র শব্দ গুলো কানে এসে লাগছে তার।কখনও কাঁচের জিনিস কখনও আবার কোনও মাটির ফুল দানি কিছুই হয়তো ভেঙে গুড়িয়ে দিতে বাদ রাখছেনা তনয়া।

মেয়ে এমনিতে চুপচাপ থাকলেও ভীষণ জেদি। আর তার এমন উৎকট জেদ বাবার কাছে এলেই অতিমাত্রায় বেরিয়ে আসে। যার প্রকাশ এখনও শুনতে পাচ্ছে তোফায়েল। নিজেকে বেশিক্ষন ধরে রাখতে পারলোনা তোফায়েল। হাত বাড়িয়ে আগের মত আরো একবার ধাক্কা দিতে শুরু করলো দরজায়।

— তনু ,,,দরজা খোলো,,বাবার কথা শোনো,, এরকম ভাঙাচোরা করলে আবরার কি ফিরে আসবে,,ও আর কখনও ফিরবেনা তোমার কাছে বোঝার চেষ্টা করো।
তোফায়েলের শেষের কথায় ওপাশের বিকট শব্দ গুলো থেমে আসে,,মেয়ের অবস্থা জানার কৌতূহল চেপে ধরে তোফায়েল কে। মেয়ে কি তার কথা শুনলো? তবে কি এভাবে বোঝালেই হবে?

তোফায়েলের ভাবনা দীর্ঘস্থায়ী হয়না। দরজা খুলে বেরিয়ে আসে তনয়া,,,মেয়েকে দেখে অধৈর্য হয়ে তাকায় তোফায়েল। তনয়া বাবার দিকে
ফোলাফোলা চোখের অগ্নি নিক্ষেপ করে বলে ওঠে,
— এই কথা আর একটা বারও তুমি উচ্চারণ করবেনা বাবা।আবরার কে আমি আমার করেই ছাড়বো!
তোফায়েল একটা ভারি নিঃশ্বাস টেনে নেয়। শান্ত ভাবে বলতে যায়,
— দেখ মা,যা হচ্ছে মেনে নে। আবরার আমাদের হাতের নাগালে নেই,,অন্তত আসাদ বেচে থাকলে বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে হলেও কিছু একটা করতে পারতাম আমি। কিন্তু এখন সেটাও হবেনা।আর আবরারের মত সিংহতেজি ছেলেকে নিয়ন্ত্রণে আনা চাট্টিখানি কথা নয়।
(একটু থেমে)
তুই এসব ছাড়! আবরার তোর হয়নি কিন্তু তোকে ধোকা দেয়ার ফল ওকে ভুগতে হবে,,এত সহজে ওকে আমি ছেড়ে দেবো নাকি!

উত্তরে তনয়া তেঁতে উঠে বললো,
— তুমি আর কিচ্ছু করবেনা বাবা! তোমার একটা প্ল্যানিং ও সাকসেসফুল হয়নি। আর হবেওনা!উল্টে তোমার প্ল্যান অনুযায়ী চলতে গিয়ে আমি সব হারিয়েছি!

তোফায়েল ব্যগ্র হয়ে বলে
— এখানে আমি কি করেছি,,

— তুমি কি করেছো মানে? তোমার বুদ্ধিতেই আমি আবরার কে ফাসানোর নাটক করেছিলাম।তুমিইতো বলেছিলে এসব করলে আবরার অনেক সহজে হাতে আসবে আমাদের। যা বলবো তাই করবে। কই হলো সেসব? এর কিচ্ছু আদৌ হয়নি!
কথা শেষে তনয়া শব্দ করে কেঁদে উঠলো,,,

তোফায়েল অধৈর্য হয়ে বললো,
— আরে বাবা আমি যেরকম ভাবছিলাম সবই তো হচ্ছিলো,,,কিন্তু আবরার যে এতোটা চালাক,,আমি কি করে বুঝবো?? ও যে সবটা জানতো সেসব কি তুই নিজে এতদিন ওর সাথে থেকে বুঝতে পেরেছিলি? পারিস নিতো! তাহলে আমি কি করে বুঝবো?

এটুকু বলে থামলো তোফায়েল। তনয়া এখনও কাঁদছে,,,তোফায়েল ব্যাস্ত হয়ে বললো,,
— তনু তুই এত কেন কাঁদছিস??? আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে,,,আর কাদিস না মা। এতো কান্নাকাটি করলে শরীর টা খারাপ করবে।
তোফায়েল মেয়ের দিকে আগাতে নিলেই তনয়া মুখে হাত চেপে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে চলে যায় রুমের মধ্যে,,,হতাশ হয়ে তোফায়েল মেয়ের পিছু ধরে এগোয়।

____________________

ও গড! এত কিছু? কে রান্না করেছে এসব?
আবরারের উত্তেজিত প্রশ্নে স্নিগ্ধা মাথা নিচু করে মৃদূ গলায় বলে ওঠে,
— আমি।
আবরার অবাক হয়ে তাকায়,,,বলে,,
— তুমি রান্নাবান্না জানো?
স্নিগ্ধা দুদিকে মাথা নাড়ে,,,যার অর্থ নাহ!

উত্তরে আবরার ভ্রু কুঁচকে বলে,
— তাহলে এসব কি করে করলে?
স্নিগ্ধা ঠোঁট কামড়ে কয়েক সেকেন্ড পর বলে ওঠে,,,
—- বই দেখে দেখে,,,
জিজ্ঞাসায় গাঢ় হয়ে আসে আবরারের ভ্রু কুঞ্চন।
— বই দেখে মানে?বই কোথায় পেলে?

— রান্নাঘর গোছাতে গিয়ে পেয়েছিলাম।তনয়া আপু রেখেছিলো হয়তো!
উত্তর পেয়ে আবরারের মুখ স্বাভাবিক হয়ে আসে। একটু ভেবে নিচের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
— বই টাকি অনেক পুরোনো ছিলো?
— জ্বি!

আবরার ছোট্ট করে নিঃশ্বাস নিয়ে বললো,
— তাহলে তনয়া নয়,,ওটা আমার মা রেখেছিলেন। কারণ তনয়াকে রান্না করতে কখনও দেখিনি৷ অবশ্য করতো কিনা জানিনা, কারন আমিতো বেশিরভাগ বাইরেই থাকতাম। যত দূর জানি , সার্ভেন্টরাই রান্না করে তনয়ার ইন্সট্রাকশন অনুযায়ী।
তবে আর যাই হোক বই দেখে এই ইন্টারনেটের যুগে তনয়া রান্না করবে এরকম টা আদৌ মনে হয়না আমার। যেহেতু বইটা পুরোনো বললে তখন হয়ত বা মা-ই রেখেছিলো কোনও কালে।শুনেছি মাও যখন এই বাড়িতে প্রথম এসেছিলো সেও রান্নাবান্না জানতোনা,,,,আর আমিও প্রায়ই দেখতাম মা কোনও রান্না ভুলে গেলে বই বের করে পড়ে নিয়ে তারপর রান্নার কাজে হাত চালাতো!

আবরার চুপ করে যায়। হয়তোবা মায়ের স্মৃতিচারন করতে ব্যাস্ত হয়ে পরছে তার আবেগ গুলো।স্নিগ্ধার খারাপ লাগে,,পরিস্থিতিকে অন্য রুপ দিতে
স্নিগ্ধা এবার চঞ্চল গলায় বলে,,

— জানেন আমি না এত বড় বড় আইটেম কখনও করিনি,,,সামান্য ভাজি তরকারি করেছি,,, তাও দু এক দিন,,,ওই যখন মা – নিতুকে নিয়ে নানু বাড়ি যেতো তখন উপায় না পেয়ে বাবার জন্যে করতাম এগুলো।
কিন্তু আজ একটু ইচ্ছে হলো রান্না করি। তাই এলাম,,কিন্তু জানেন পরবর্তীতে এতো চিন্তায় পরে গেলাম কি দিয়ে কি কিরবো সে নিয়ে,,,কারো কাছে জিজ্ঞেস করতেও লজ্জ্বা লাগছিলো। পরে সেল্ফের মধ্যে বই টা পেয়ে খুব উপকার হলো আমার।একটু করে পড়েছি আর রেধেছি। খেয়ে দেখুন না কেমন হয়েছে?
আবরার মুচকি হাসে,,মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে বলে,,
—- তোমার হাতের বিষ খেলেও আমার শান্তি লাগবে পরি।রান্না তো অনেক ছোট ব্যাপার!

স্নিগ্ধা লজ্জ্বা পায়। লাজুক ভঙিতে কাপা কাপা হাত বাড়িয়ে আবরারের প্লেটে তরকারি তুলে দেয়। আবরার প্লেটে,, আগে থেকে রাখা চামচ দুটোকে প্লেট থেকে সরিয়ে টেবিলের ওপর রেখে বলে,,,
— আজ আমিও হাত দিয়ে খাবো!একচুয়েলি কি বলোতো চামচ দিয়ে খেলে ঠিক পরিপূর্ণ তৃপ্তিটা পাওয়া যায়না।

স্নিগ্ধা মৃদূ হেসে সায়মুলক মাথা নাড়ে। আবরার উৎফুল্ল মন নিয়ে ভাতের সাথে তরকারি মাখতে উদ্যত হয়। হঠাৎ কিছু একটা মাথায় আসতেই এক রাশ কৌতূহল নিয়ে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে তৎপর হয়ে বলে,
— এক সেকেন্ড!
ভাতের লোকমা মুখে তুলতে গিয়েও আবরারের কথায় থেমে যায় স্নিগ্ধা৷ তাড়াহুড়ো করে বলে,,,
— কি হয়েছে? কোনও সমস্যা হয়েছে খাবারে?

জবাবে আবরার সরু চোখে বলে,,
—তুমি বই দেখে রান্না করেছো মানে? তুমি পড়াশুনা জানো?
স্নিগ্ধা মৃদূ আওয়াজে উত্তর দেয়,,
— জানি তো! টুকিটাকি!

আবরার অবাক হয়ে বলে,,
— তাই!কোন ক্লাশ অব্দি পড়েছো তুমি?
স্নিগ্ধা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
— এইচ এস সি দিয়েছি গতবছর।

— রেজাল্ট কি এসছে?

স্নিগ্ধা কাচুমাচু মুখে বলে ওঠে,
— টেনেটুনে 4.35 পেয়েছিলাম!
আবরার ঠোঁট এলিয়ে হেসে বলে,
— ওহ,,খারাপ নাহ৷ তারপর আর পড়লে না যে…??

স্নিগ্ধার গলার আওয়াজ আরো কমে আসে এবার,,মুখ কালো করে বলে,
— বাবার অর্থনৈতিক অবস্থা আপনার তো কিছুই অজানা নয়। আমার পড়ার আগ্রহ দেখে এইটুকু কোনও মতে কষ্ট করে চালিয়েছে,,,,কিন্তু বাবার পরিস্থিতি টা বুঝতে পেরে আমিই আর চাইনি পড়তে।

আবরার কিছুক্ষন নিশ্চুপ থাকলো,,,স্নিগ্ধাও আর কথা তুললোনা। কয়েক মুহুর্তের জন্যে একটা গুমোট পরিস্থিতি তৈরি হলো,,,,আচমকা আবরার গলা বাড়িয়ে বললো,
— তুমি পড়তে চাও??
স্নিগ্ধা গোল চোখে তাকায়। উচ্ছ্বাস নিয়ে ঘন ঘন ওপর নিচ মাথা দোলায়।যার অর্থ–হ্যা!

স্নিগ্ধার উৎসাহ দেখে আবরার মুচকি হেসে বললো,
— বাবাহ পড়ার কথা শুনতেই এত্ত আনন্দ??
আর আমি ছোট বেলায় পড়াশুনায় কত ফাকিবাজ ছিলাম জানো,,,পড়তেই চাইতাম নাহ,মা জোর করে বসাতো,,তাও কত কিছুর লোভ দেখিয়ে দেখিয়ে।

কথা শেষ করে দাঁত বার করে হাসলো আবরার। আবরারের হাসিতে স্নিগ্ধার ভালো লাগে,,,নিজেও মুচকি হাসে ঠোঁট বাকিয়ে। মৃদূ গলায় বলে,,,
—আমি পড়তে চাই,,অনেক কিছু শিখতে চাই। আপনাদের মত গ্রাজুয়েট হতে চাই!

আবরার নিচের ঠোঁট ভিজিয়ে মৃদূ হেসে নিয়ে বললো,
— ঠিক আছে,,আমি তোমাকে অনার্সে ভর্তি করে দেবো।
স্নিগ্ধার মুখ উজ্জ্বল হয়ে এলো। চকচক করে উঠলো চোখগুলো।কৃতজ্ঞতা সূচক চাহনীতে আবরারের দিকে তাকিয়ে রইলো,,
স্নিগ্ধার এমন চাহনি দেখে আবরার ভ্রু কুচকে বললো,– এভাবে কি দেখছ?

স্নিগ্ধা কিছু না বলে তাকিয়ে থেকেই মাথা নেড়ে বোঝালো— কিছুনা।
আবরার ব্যাস্ত হাতে ভাত মেখে স্নিগ্ধার মুখের সামনে লোকমা তুলে ধরে বললো,,,
— খেয়ে দেখোতো কেমন হয়েছে?? আমার বউয়ের রান্না!
স্নিগ্ধা মুচকি হেসে হা করে।আবরার আর দেরি করেনা ওকে খাওয়াতে,,,,স্নিগ্ধার মনে পড়ে বিয়ের প্রথম দিনের কথা। সেদিন আবরারের হাতে খাওয়া নিয়ে যতটা ঘৃনা,,, অস্বস্তি লাগছিলো আজ তার এক ফোটাও অনুভূত হচ্ছেনা।বরং ভালোলাগা কাজ করছে,, ভীষণ ভালো লাগা।

চলবে,
[ কি মনে হচ্ছে তনয়া কি এতো সহজে আবরার কে ছেড়ে দেবে??]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here