অসম্ভবেও আমার তুমি নুসরাত সুলতানা সেজুথি পর্ব–১১

0
89

#অসম্ভবেও আমার তুমি
নুসরাত সুলতানা সেজুথি
পর্ব–১১

কাউকে ভালোবাসা কোনও অপরাধ নয় বরং গর্বের বিষয়,,, প্রকৃত ভালোবাসলে ভয় না পেয়ে মানুষ বুক ফুলিয়ে নিসঙ্কোচে সেই মানুষ টাকে বলতে পারে,,,আমি তোমাকে ভালোবাসি।
কিন্তু যখন সেই ভালোবাসা পাওয়ার জন্যে মানুষ মিথ্যে আর অন্যায় পথ কে অবলম্বন করে তখন সেটাতে খাঁদ থাকে। প্রশ্ন ওঠে,,,,তার ভালোবাসা নিয়ে,
ঠিক যেমনটা আপনার ভালোবাসা নিয়ে ছিলো,,,তনয়া।
আবরারের আলোড়িত বানী বোধগম্য হয়না তনয়ার। কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গিয়ে বলে,
— এসব কথার মানে কি?

আবরার ছোট্ট করে দম ফেলে উত্তর দিলো।
— আপনি আমাকে মিথ্যে বলেছিলেন তনয়া,,আমি আদৌ আপনার শ্লীলতাহানি করিনি সেদিন।

তোফায়েল হকচকিয়ে তনয়ার দিকে তাকায় কথাটা শুনতেই। স্নিগ্ধা এক রাশ কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে থাকে।
তনয়া কাপা কাপা স্বর তুলে আবরার কে উদ্দেশ্য করে বললো,
— এসব। এসব বানোয়াট কথা বলবেন না আবরার। আপনি সত্যিই…

— চুপ করুন,,
আবরারের ক্ষিপ্ততায় কথা ওখানেই আটকে যায় তনয়ার।আবরার দাঁত চিবিয়ে বললো,
— একটা মেয়ে হয়ে কিভাবে নিজের মান সন্মান নিয়ে অভিনয় করতে পারেন তাও এত দিন ধরে? ক্লান্ত লাগেনা আপনার?

তনয়ার চোখের পাতা গুলো কাঁপতে থাকে অনবরত,,বুকের মধ্যে সত্য উগড়ে আসার ভয় চেপে ধরে আষ্ঠেপৃষ্ঠে। মেয়ের অবস্থায় তোফায়েল এবার ক্রুদ্ধ গলায় বলে ওঠে,,
— অভিনয় আমার মেয়ে নয়,অভিনয় করছো তুমি,,নিজের দোষ ঢাকার চেষ্টা করছো।
আবরার তোফায়েলের দিকে তাকিয়ে বলে,
— আমি নই। করছেন আপনারা,,মিথ্যে অপরাধের দ্বায়ভার আমার কাধে তুলে দিয়ে সেটা আমৃত্যু বজায় রাখার নাটক করে বেড়াচ্ছেন।
যে কাজ আমি করিইনি তার শাস্তি দিতে চেয়েছিলেন আমাকে। কিন্তু সেটাতো পারেন নি,,,আর না কখনও পারবেন।

সবার কথোপকথনে উদ্বিগ্নতা ঘিরে ধরে স্নিগ্ধা কে।স্নিগ্ধা এবার সামান্য গলা বাড়িয়ে বলে ওঠে,
— আপনারা কোন অপরাধের কথা বলছেন এখানে,,আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবেন?
আবরার স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে,,বলে ওঠে,,
— এসব রাঘব বোয়ালদের প্যাঁচালো চাল,,তোমার ছোট্ট মাথায় ঢুকবেনা পরি

স্নিগ্ধা বিরক্তি নিয়ে এগিয়ে এসে উত্তর দিলো,
— কেন বুঝবোনা আমি? কেন? আমি অতোটাও ছোট নই। আপনি আমায় কেন কিছু বলছেন না?
আমার সব টা জানার অধিকার আছে।

তনয়ার শরীরে রাগ ছেয়ে যেতে শুরু করে স্নিগ্ধার কথাটা শুনতেই,,,ঝাঁঝালো গলায় বলে,
— কিসের অধিকার তোমার? আবরারের ওপর শুধু আমার অধিকার,,আমি আবরারের স্ত্রী।তুমি আমাদের মাঝে স্রেফ তৃতীয় ব্যাক্তি।
স্নিগ্ধা এরুপ কথার প্রেক্ষিতে উত্তর দেয়না,ঠোঁট কামড়ে চুপ করে যায়। কিন্তু জবাবে আবরার তেঁতে উঠে বলে,
— আপনি কি কানে কম শুনছেন আজকাল তনয়া,,আমিতো বললাম আপনি আমার কেউ নন।

তনয়া ক্রোধানল এ জ্বলে উঠলো একেবারে,,উৎক গলায় জবাব দিলো,
— এখনও প্রমান হয়নি যে আপনি যা বলেছেন সব সত্যি,,,
আবরার ঠোঁট এলিয়ে বললো,
— হয়নি।হয়ে যাবে খুব তাড়াতাড়ি,, মিস্টার আমিনুল যা টাকা খেয়েছেন আপনার বাবার থেকে সেসব নাহলে বেরিয়ে আসবে তো,,
তোফায়েল পাশ থেকে ভ্রু কুঁচকে বললো
— বারবার এক কথা বলে কি বোঝাতে চাইছো? আমি আমিনুল কে ঘুষ দিয়ে এনেছি এখানে?
আবরার দৃঢ় গলায় বললো,
— অবশ্যই নিঃসন্দেহে,,

তনয়া দঁাতে দাঁত চিবিয়ে জোরে চিৎকার করে বলে উঠলো,
— হ্যা এনেছি ওনাকে আমরাই টাকা দিয়ে এনেছি। বেশ করেছি,, আপনাকে পাওয়ার জন্যে সব করবো আমি,,পুলিশ আনা তো অনেক ছোট ব্যাপার।
এভাবে ওভাবে যে কোনও একভাবে আমার আপনাকে দরকার,,আবরার আমি আপনাকে চাই।

স্নিগ্ধা আবরারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে তনয়ার এরুপ ক্ষিপ্র ধ্বনির প্রেক্ষিতে।
আবরার স্নিগ্ধার দিকে তাকায়না।তনয়ার দিকে চোখ রেখেই শক্ত গলায় বলে,
— আপনার এই এক তরফা চাওয়াটাই আজ আপনাকে এমন দিন দেখালো।আমার কিন্তু এখানে কোনও দোষ নেই।

তোফায়েল দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে প্রত্যেকবারের মত আবরারের কলার চেপে ধরার জন্যে হাত বাড়ায়। তবে এবার আবরার তার আগেই হাত আটকে দেয় তোফায়েলের। ক্ষিপ্ত চঞ্চল গলায় বলে ওঠে,
— বারবার আমার গায়ে হাত দিয়ে নিজের ছোট মানসিকতার প্রমান দেবেন না আঙ্কেল,,আমি যেমন ভদ্রতা বজায় রাখছি আপনিও রাখবেন আশা করি।

তোফায়েল একিরকম রক্তলাল চোখ নিক্ষেপ করে তাকিয়ে থাকে আবরারের দিকে,,,পেছন থেকে এগিয়ে এসে তনয়া বাবাকে সরিয়ে দিয়ে আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে,
— তুমি সরো বাবা,ওর সাথে যা বলার আমি বলে নিচ্ছি।

তোফায়েল সরে দাড়ায় মেয়ের সামনে থেকে,,তনয়া আবরার কে উদ্দ্যেশ্য করে প্রশ্ন ছোড়ে,,,
— আপনি কোন ভদ্রতার কথা বলছেন আবরার? একটা মেয়ের সন্মান হানি করে অনেকটা প্রেশারে পরে তাকে বিয়ে করেছিলেন,আর তার সাথে পুরো একটা বছর সংসার করার পর বলছেন আদৌ বিয়েটা হয়নি,এটা কেমন ভদ্রতা,, আর ঠিক কোন ধরনের ভদ্রতা?আমাকে বোঝাবেন?

স্নিগ্ধা তনয়ার কথগুলোয় বাকরুদ্ধ হয়ে আসে,,,তার মানে? তনয়ার সাথে আবরার? ছি ছি!
ঘৃনায় তিক্ত হয়ে আসে স্নিগ্ধার মুখ,,,আবরার এতো জঘন্য কাজ করেছে,,ভাবতেও কোথাও না কোথাও বুকের মধ্যে তোলপাড় শুরু হতে দেরি করেনা তার,,,ভেতর টা ছটফট করতে শুরু করে ওপাশ থেকে আবরারের ইতিবাচক কোনও উত্তর এর আশায়।

আবরার নিশ্চুপ ভাবে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে তনয়ার মুখের দিকে,,,মৃদূ বাকা ঠোঁটে বলে ওঠে,
— আপনার সত্যিই বিন্দুমাত্র লজ্জ্বা নেই তনয়া।
আপনার প্রত্যেক টা কথা আমার কাছে এখন যাস্ট ইউজলেস আর বিরক্তিকর মনে হচ্ছে,,,

তনয়া ভ্রু নাঁচিয়ে প্রশ্ন করে,,,
— আপনি কি সব অস্বীকার করতে চাইছেন? আপনি আমার রেপড করেন নি?
আবরার তৎপর গলায় বলে,,
— কখনোই নাহ।
তনয়া বড় চোখে তাকিয়ে বলে,,
— মিথ্যে বলছেন এখন?

আবরার ক্রোধে দুই হাত দিয়ে তনয়ার বাহু চেপে ধরে। ,, ভয় পেয়ে ঘাবড়ে যায় তনয়া,,তোফায়েল, স্নিগ্ধা দুজনেই ভড়কে যায় আবরারের এমন কাজে।

তনয়ার চোখের দিকে ক্রুর চোখে তাকিয়ে আবরার ব্যাগ্র গলায় বলে ওঠে,
— আমি আপনার রেপড করিনি তনয়া,আপনি আমাকে ফাসিয়েছেন,,,মিথ্যে বলেছেন, নাটকের গুটি হিসেবে ব্যাবহার করেছেন আমার ভালোমানুষীকে আর আমাকে,,
এক নিঃশ্বাস নিয়ে কথা গুলো বলে তনয়াকে ঝাড়া মেরে ছেড়ে দেয় আবরার। পরক্ষণে কৌতুক স্বরে হেসে বলে,

“আর আমিও কি বোকা আপনার চোখের মিথ্যে অশ্রু দেখে বিশ্বাস করে নিয়েছিলাম আপনার কথা,,ভেবে নিয়েছিলাম যে হয়ত বা আমি সন্মান নষ্ট করেছি আপনার। হতেও পারে ভুল করে হলেও অপবিত্র করেছি আপনাকে,,

স্নিগ্ধার ভারি অদ্ভুত অনুভূত হয় আবরারের কথাগুলোতে ,কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে তাড়াহুড়ো করে বলে ওঠে,,
— আমিতো কিছুই বুঝতে পারছিনা,,,কেউ যদি কাউকে রেপড করেই থাকে,, তাহলে তাকে ফাসানোর কথা আসবে কেন? আর সে নিজেও কি তার অপরাধ নিয়ে নিশ্চিত থাকেনা?? অন্যের কথা শুনে নিজের অপরাধের বিশ্বাস করে?? এটাও হয়!আপনার কথাগুলো কি একটু বেশিই হাস্যকর শোনাচ্ছেনা?

আবরার স্নিগ্ধার দিকে চোখ ঘোরায়,, দৃঢ় গলায় জবাব দেয়,,
— হাস্যকর শোনালেও এটাই সত্যি,,,আমি নিশ্চিত ছিলাম নাহ। বিকজ আই ওয়্যাজ ড্রাংক এন্ড সেন্সলেস।
স্নিগ্ধা অবাক হয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে ওঠে,
— তার মানে?? আপনি ইচ্ছে করে কিছু করেন নি?

আবরার ঘাড় বাকিয়ে তনয়ার ভীত মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,,
— যেখানে আমি কিছু করিইনি। সেখানে ইচ্ছেতো অনেক পরের ব্যাপার। ওই সব তনয়ার চাল ছিলো,,সবটা,পুরোটা।
আমাকে বার্থ ডে পার্টিতে ডেকে নেয়া,,আমার ড্রিংক্সে ড্রাগস মেশানো আর তারপর,,, আমি যখন পুরোপুরি সেন্স- লেস হয়ে পরি,,,
নিজের জামাকাপড় নিজে ছিড়ে,,এমন বেহাল অবস্থা করা যে আমি ওর রেপড করেছি এটা খুব ভালো ভাবে প্রমান করা যেতে পারে।

কথাগুলো কানে পৌঁছাতে তোফায়েল তনয়া একে অন্যের দিকে তাকিয়ে উশখুশ করতে থাকে।
স্নিগ্ধা হতবাক হয়ে উদ্বেগ নিয়ে বলে,
— তারপর?
আবরার স্নিগ্ধার কথার প্রেক্ষিতে উদ্বেজিত গলায় জবাব দেয়,
— যখন আমার সেন্স ফিরেছিলো,, দেখলাম তনয়া আমার পায়ের কাছে মেঝেতে বসে কাঁদছে,হাহ!যদিও মিথ্যে কান্না!
কিন্তু আমি তখন ও বুঝতে পারিনি আসলে কি হয়েছিলো এখানে,,ব্যাস্ত হয়ে তনয়াকে ধরতে যাই,সত্যিটা জানতে চাই,,কিন্তু যখন ওর মুখ থেকে শুনি যে আমি ড্রিংক করে ওর সাথে জবরদস্তি করেছি মাথায় আকাশ ভেঙে পরেছিলো আমার,,পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গিয়েছিলো,, এক মুহুর্তের জন্যে মনে হয়েছিলো আমি অধম,,,ভীষণ অধম।

এটুকু বলে থামলো আবরার। স্নিগ্ধা অবাক চোখে দেখে যাচ্ছে ওকে,মনোযোগ দিয়ে শুনছে তার কথা। আবরার ছোট্ট করে একটা দম ফেলে তোফায়েলের দিকে তাকায়,, বলে ওঠে,
— তারপর এই ভদ্র লোক এসে জুড়লেন মেয়ের সাথে,,,কি কান্না দু -বাবা মেয়ের। আমার সাথে সাথে আমার বাবার দিকে প্রশ্ন উঠতে শুরু করলো।বাবা যদিও কিছুতেই মানতে পারেনি আমি এরকম করেছিলাম,কিন্তু ওই যে তনয়ার সাথে আমার পূর্বের কয়েক দিনের বন্ধুত্ব দেখায় উনিও বোকা বনে গিয়েছিলেন এদের ড্রামার কাছে।

আবরার বলা মাত্রই তনয়া তেঁতে উঠে বললো,,
— আপনি মিথ্যে বলছেন আপনি সেদিন,
তনয়া এটুকু বলতেই আবরার আগুন চোখে তাকায় তনয়ার দিকে,আবরারের চোখ দেখে ভয়ে চুপসে যায় তনয়া,,কথা না বাড়িয়ে চুপ করে গুটিয়ে থাকে বাবার পাশে।

আবরার ক্রুদ্ধ স্বরে তনয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
— অনেক বলে নিয়েছেন আপনি,, এখন শুধু আমি বলবো আর আপনারা শুনবেন,,,মাঝখানে একটা কথাও কেউ বলবেন না।

আবরার পুনরায় স্নিগ্ধার কৌতুহলী মুখের দিকে ফেরে,,,শান্ত গলায় বলতে লাগে,
— জানেন স্নিগ্ধা,আমার বাবা সন্মানের পরোয়া করতেন ভীষণ, তার কথা মতো, জীবন চলে যাক.. কিন্তু সন্মান যেন না যায়।
আর এই তোফায়েল পাঠান যখন বাবাকে প্রেস মিডিয়াকে নিয়ে তোলপাড় শুরু করবে বলছিলো,,ভয় দেখাচ্ছিলো তার সব কিছু শেষ করে দেয়ার,,হাহুতাশ করছিলো নিজের মেয়ের ধর্ষিতা হওয়ার বিচারের,,
আমার বাবা মেনে নিতে পারেনি,,,যে মানুষ কখনও কারো কাছে মাথা নত করেনি তার ছেলে একটা মেয়ের শ্লীলতাহানির অভিযোগে অপরাধির কাঠগড়ায় দাড়াবে?
ভাবতেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠেছিলো তার,,,
এতোটা প্রেশার সহ্য করতে না পেরে,,মাইল্ড স্ট্রোক হয়েছিলো ওনার,,,

তনয়ার বাবার হুমকি,,তনয়ার কান্নামুখ,,আমার বাবার অসুস্থতা সব কিছু মিলিয়ে আমি দিশেহারা হয়ে পরেছিলাম,,অপরাধের গ্লানি আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিলো।সারাক্ষণ, সব সময়।
ঠিক কি করলে আমি এই অপবাদ ঘোচাতে পারবো পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম সেসব ভাবতে ভাবতে!
তারপর আমি নিজে যেচে তনয়ার সন্মান রক্ষায় তনয়ার সাথে আমার বিয়ের কথা বলেছিলাম,আর এরা? এরা এক পায়ে রাজিও হয়ে গিয়েছিলো সেই প্রস্তাবে।

আবরার থামলে স্নিগ্ধা অধীর গলায় বললো,
— তাহলে বিয়েতে নকল পেপার্স ব্যাবহার কেন করলেন?
আবরার জ্বিভ দিয়ে নিচের ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলে,
— ওদের শাস্তি দিতে,,,

— কিসের শাস্তি?

জবাবে আবরার উদ্বেগহীন গলায় বলে,
— বিয়ের দুদিন আগে আমি জানতে পারি,, এই সব কিছু ওদের সাজানো ছিলো,,পুরোটাই।

তনয়া আর তোফায়েল বিস্ময়কর চাহনি দিয়ে একে অন্যকে দেখতে থাকে।তোফায়েল ফাকা ঢোক গিললো,,
কোনও মতে মোটা ধ্বনি তুলে বলে উঠলো,
— কি বলতে চাইছো আবরার,নিজের দোষ আমাদের ঘাড়ে দিতে চাইছো?
আবরার সন্দেহী ভাবে তাকিয়ে বলে,
— আপনার কি মনে হয়, সত্যিই সেরকম কিছু?

তোফায়েল এবার বাকা হেসে বলেন,
— সেটাতো তুমি ভালো বলতে পারবে। ধরে নিলাম আমরা যা করেছি সব মিথ্যে,এক মুহুর্তের জন্যে মেনে নিলাম তুমি কিচ্ছু করোনি,সব ভুল সব ভ্রান্ত ছিলো,,,কিন্তু তোমার কথা অনুযায়ি তুমিতো তখন অচেতন ছিলে,,তাহলে তুমি কি করে জানলে সবটা সাজানো ছিলো আমাদের? এটা বড্ড বেশিই মনগড়া কাহিনি বলে ফেললে আবরার।

আবরার নিচের দিকে চোখ রেখে মুচকি হাসে।তোফায়েলের কাছে এগিয়ে ,,,,, ভ্রু নাঁচিয়ে উত্তর দিলো,,
— কি জানেন তো মিস্টার তোফায়েল পাঠান,,,গল্প আপনি ভালোই সাজিয়েছিলেন,,কিন্তু ওই যে দেয়ালের ও কান থাকে,,,
আপনি আর আপনার আদরের রাজকন্যা যখন আমাকে আর আমার বাবাকে ফাসাতে সক্ষম হয়ে তার উৎসব উদযাপন করছিলেন,,,আনন্দে মাতিয়ে রেখেছিলেন নিজেদের,,,,আবার কৌতুক করে করে সেসব উচ্চারণও করছিলেন ঠিক সেইসময় আমি আপনাদের দরজার পাশেই ছিলাম। ভাগ্যিশ বিয়ের ব্যাপারে বাবা কথা বলতে পাঠিয়েছিলেন আমাকে,,,,

কথাটা শুনতেই তনয়া তোফায়েলের চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম হতে শুরু করে,,,চেহারায় স্পষ্ট ছাপ ফুটে ওঠে চিন্তার।কপালের জমতে থাকা ঘাম ফোটা আকারে গড়াতে শুরু করে।

আবরার প্রগাঢ় আওয়াজে বলে,
— আমি সব শুনে ফেলেছিলাম সেদিন,,যদিও পুরোটা নয়,,তবে কিভাবে কি করে আপনি নিজেদের ভিক্টিম সাজিয়েছিলেন সেসব টা। আর আপনাদের ওইটুকু কথায় বুঝেও নিয়েছিলাম আমি ফেসে যাচ্ছি। তলিয়ে যাচ্ছি ষড়যন্ত্রের চোরাবালিতে।

আর তাই বুদ্ধি খাটিয়ে সেদিনই বিয়ের দায়িত্ব নিজের কাধে নিয়ে সমস্ত নকল পেপার তৈরি করাই সোহরাব আঙ্কেল কে দিয়ে,,তনয়া আর আপনার পাতা চালে আমি আপনাদের দুজনকেই মাত দিতে চেয়েছিলাম।দিয়েওছি,,
এরপর খুব করে চাইছিলাম যে তনয়া ঠিক যে অপরাধের দ্বায় আমাকে দিতে এত নিচে নামতেও ছাড়লোনা সেই কাজ গুলোই ঘটাই ওর সাথে,কিন্তু পারিনি,,,রাগ ক্ষোভ ক্রোধ যত যাই থাকুক,, ওর গায়ে একটা টোকা ফেলতেও দ্বিধাগ্রস্থ ছিলাম আমি,,,
ওর দিকে তাকালেই আমার সব মিথ্যেগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠতো,,ভেসে উঠতো আমার বাবার হসপিটালের বেডে শুয়ে শুয়ে পার করা পুরোএকটা সপ্তাহের কথা।
আমাদের বাবা ছেলের নির্ঘুম রাত পার করার দিন গুলোর কথা।তাই স্পর্শ করাতো দূর,,, মুখ ফিরিয়ে তাকাতেও চাইতাম না আমি তনয়ার দিকে। যতটা বেশিঅত্যাচার করতে চেয়েছিলাম করতে পারিনি,,কারণ তনয়া খুব চেষ্টা করেছিলো আমার মন পেয়ে ওঠার,,,আফটার অল আমিতো মানুষ। এসব দেখে দয়াও হতো। তাই একটু হলেও একজন নারী ভেবে সন্মান দিতাম।

( একটু থেমে তনয়ার দিকে তাকিয়ে)
তাই বলে এটা কিন্তু আমার দূর্বলতা ছিলোনা,,,আর না ছিল আপনার প্রতি ওটা আমার ভালোবাসা।
আপনার প্রতি আজ এখন আর ভবিষ্যৎ এও আমার ঘৃনাই থাকবে তনয়া শুধু ঘৃনাই থাকবে,,
আমি একমাত্র এই পৃথিবীতে স্নিগ্ধাকে ভালোবাসি। আর সারাটাজীবন ওকেই ভালো বাসবো। কারণ ওর মধ্যে আর যাই হোক আপনার মত মিথ্যে নেই।

স্নিগ্ধা একভাবে তাকিয়ে থাকে আবরারের দিকে,,,এত্ত কিছু ঘটে গিয়েছে এই মানুষটার ওপর থেকে?? আর একটু আগেও সে সবটা না জেনে ভেতরে ভেতরে হলেও কত দোষারোপ করেছিলো,,,এখন,এখন তো নিজেকেই নিজের কাছে বড্ড ছোট লাগছে।

কয়েক মুহুর্ত সবাই নিশ্চুপ হয়ে থাকে,তনয়ার মুখে কোনও কথাই আসছেনা আর। শুধু আহত দৃষ্টি তে এক নাগাড়ে আবরারের শক্ত মুখ টাকে অবলোকন করতে থাকে ।
হুট করে এমন নীরবতায় তোফায়েলের ফোন বেজে উঠলো,, নাক মুখ কুচকে চূড়ান্ত বিরক্তিতে পকেট থেকে ফোন বের করে সামনে ধরলো তোফায়েল,,স্ক্রিনে আমিনুলের নম্বর দেখে কিঞ্চিৎ ভ্রুদ্বয় কোঁচকালো।
তনয়ার কান্না মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,,– আমিনুল কল করেছে,,
আবরার স্নিগ্ধা স্বাভাবিক চেহারায় তাকালো,,তনয়া ধড়ফড় করে চোখের পানি মুছে বললো,
— নির্ঘাত প্রমান পায়নি,আবরার সব মিথ্যে বলেছে ওনাদের,,দেরি করোনা বাবা,,,রিসিভ করো।
তোফায়েল মেয়ের কথায় রিসিভ বাটনে প্রেস করে কানে তোলে ফোন। স্নিগ্ধা,,অধৈর্য চোখে সেদিকে মনোযোগ দেয় এবার।

— হ্যালো অফিসার? কিছু জানতে পারলেন?
………….
— আপনি কি বলছেন টা কি? (বিস্ময় নিয়ে)
তনয়া ব্যাস্ত চোখে বাবার দিকে চেয়ে আছে,উদগ্রীবতা ছেয়ে আছে মনের মধ্যে। তোফায়েল ফোন রেখে হতাশ দৃষ্টিতে মেয়ের মুখের দিকে তাকায়।তনয়া ব্যাতিব্যস্ত হয়ে বলতে লাগে,,
— কি হলো বাবা? আমি ঠিক বলছিলাম তো? প্রমান পায়নি তাইনা?? বলো বাবা! কি হলো বলো,

তোফায়েল ছোট্ট করে দম নিয়ে বলে ওঠে,,
— বিয়েটা সত্যিই হয়নি রে মা!

তনয়া নির্বাক হয়ে আসে,,গলায় দলা পাকানো কান্না উপচে আসে তার,,,পরক্ষণেই মাথা ভো ভো করে ঘুরতে শুরু করে,,ঘুরে পরতে নিলেই দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে ধরে ফেলে স্নিগ্ধা। নিজের সাথে জাপটে নেয় তনয়াকে,অধির হয়ে বলে,
— সাবধানে আপু,পরে যাচ্ছেন তো!

গলার স্বর শুনতেই তনয়া কপাল কুচকে ক্রোধ নিয়ে তাকায়। স্নিগ্ধাকে দেখতেই গায়ে ফুটন্ত পানি পরে ফোস্কা পরার মত অনুভব হতে শুরু করে,,,এক ধাক্কায় নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় স্নিগ্ধার থেকে,,,,ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে,
— তোর এত বড় সাহস তুই আমাকে ছুয়েছিস? নির্লজ্জ বেহায়া মেয়ে,,,এই সব তোর জন্যে হয়েছে সবটা।
স্নিগ্ধা কথার জবাব দেয়না। তবে আবরার এতক্ষনে স্নিগ্ধাকে সরিয়ে নিজের কাছে এনে বলে ওঠে,
— নির্লজ্জ বেহায়া ও নয়,, আপনি।
তনয়া ফিচেল গলায় বলে,
— আবরার!
আবরার এবার শক্ত মুখে উত্তর দিলো,
— এবার নিশ্চয়ই প্রমান পেয়েছেন? আর কিছু বাকি নেই। তবে এবার আসুন আপনারা।বেড়িয়ে যান বাড়ি থেকে।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here