#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_41
#ইয়াসমিন_খন্দকার
রায়ান সাহেব প্রত্যুষকে নিয়ে বাড়িতে ফিরেছেন। এসেই সোফায় গা এলিয়ে দিয়েছেন৷ বড্ড ক্লান্ত তিনি। নিজের মেয়ের চিন্তায় চিন্তায় একদম শেষ হয়ে যাচ্ছেন। তার সামনেই অপরাধী মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে প্রত্যুষ। আজ প্রত্যুষের নিজেকেই নিজের কাছে অপরাধী মনে হচ্ছে। তার বারবার এটাই মনে হচ্ছে তার জন্যই সবটা হলো। রায়ান সাহেব নিজের ছেলের দিকে তাকিয়েই তার মনোভাব বুঝলেন। কিন্তু কিছু বললেন না এবিষয়ে। বরঞ্চ বললেন,”প্রত্যুষ, তুমি একটু তোমার সৌভিক আঙ্কেলকে ফোন করো। ওকে বলে দাও যে আমরা প্রণালীকে খুঁজে পাইনি। সৌভিক যেন সজল চৌধুরীকে সব কথা বলে দেয়। তার সামনে দাঁড়ানোর মুখ আমার নেই।”
প্রত্যুষ ফোন বের করে কল করতে যাবে ঠিক এমন সময় বিধ্বস্ত প্রণালী পা রাখে বাড়ির মধ্যে। অস্ফুটস্বরে ডেকে ওঠে,”বাবা।”
রায়ান সাহেব, প্রত্যুষ দুজনেই অবাক হয় প্রণালীকে দেখে। সাথে ভীষণ খুশিও হয়। রায়াম সাহেব উঠে গিয়ে নিজের মেয়ের কাছে যান। প্রণালীকে জড়িয়ে ধরে বলেন,”তুমি ঠিক আছ তো মা?”
প্রণালী বলে ওঠে,”তোমার পছন্দ করা ছেলেকেই আমি বিয়ে করবো বাবা।”
প্রত্যুষ, রায়ান সাহেব দুজনেই অবাক। রায়ান সাহেব এবার ভালো করে নিজের মেয়েকে পর্যবেক্ষণ করেন। ফোলা ফোলা দুটি চোখ দেখেই বুঝতে পারছেন কেঁদে কেঁদে মেয়েটার অবস্থা খারাপ। তিনি আর কিছু বলার মতো অবস্থায় ছিলেন না তখন। মেয়ের অবস্থা দেখে তারো ভীষণ কান্না পাচ্ছিল। প্রত্যুষ বাবা-মেয়ের এমন অবস্থা দেখে এগিয়ে এলো। প্রণালীকে বলল,”আপি তুমি ঠিক আছ তো? তোমাকে এমন কেন লাগছে?”
প্রণালী আবার কান্না শুরু করে দেয়। কাঁদতে কাঁদতে বলে,”আমি ঠিক নেই ভাই। আমি একদম ঠিক নেই। ও আমাকে ভেতর থেকে ভেঙে গুড়িয়ে একদম শেষ করে দিয়েছে রে!”
.
বাবা ভাইকে নিজের সাথে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা খুলে বললো প্রণালী। সব শুনে রায়ান সাহেব কিছুটা স্বস্তি পেলেন। বললেন,”যাইহোক, আল্লাহর কাছে এটাই লাখ লাখ শুকরিয়া যে ঐ শান্ত তোমার বড় কোন ক্ষতি করে নি। আমি তো ভেবেছিলাম ও তোমার কি না কি করে। আল্লাহ বাঁচিয়েছেন।”
প্রত্যুষ বলে,”আপি, তুমি আর একদম ঐ শয়তান লোকটার জন্য কাঁদবে না। উনি তোমাকে ধোকা দিতে গিয়ে নিজেই ঠকে গেছেন। তুমি জিতে গেছ। দেখবে একসময় উনি খুব আফসোস করবেন এটা নিয়ে।”
প্রণালী জোরপূর্বক হাসল। রায়ান সাহেব বললেন,”ঐ শান্তর ভয়েই আমি তোমার বিয়ে দিতে চাচ্ছিলাম তাড়াহুড়ো করে। কিন্তু এখন যখন সেই ভয় কে’টে গেছে তার উপর তুমি এমন বিধ্বস্ত অবস্থায় আছো তাই আমাকে তো নিজের সিদ্ধান্ত বদলাতে হবে।”
প্রণালী বলে,”না, বাবা। তোমাকে নিজের সিদ্ধান্ত বদলাতে হবে না। আমি বিয়ের জন্য একদম প্রস্তুত আছি।”
“কিন্তু মা, তোমার এই অবস্থা!”
“আমি একদম ঠিক আছি বাবা। এমনিতেই আমার জন্য তোমার অনেক ফেস লস হয়েছে। আমার জন্য অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে তোমায়। আমি চাই না আমার জন্য তুমি আরো কষ্ট পাও।”
রায়ান সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতে লাগলেন,”আমার লক্ষী মেয়েটা কত কিছু বুঝতে শিখে গেছে।”
প্রত্যুষ বলে ওঠে,”তাহলে কি বিয়েটা হচ্ছে?”
রায়ান সাহেব এবং প্রণালী দুজনেই সম্মতি দেয়।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
সজল চৌধুরী রাজকীয় ভাবে তৈরি হয়েছেন। তিনি নিজের ছেলেকেও তিনি রাজকীয় ভাবেই তৈরি হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সজল চৌধুরীর পরদাদা ছিলেন একজন বিখ্যাত জমিদার। তাদের বংশের বেশ ভালোই গৌরব। পুরান ঢাকার বনেদী পরিবার বলে কথা। তাই তো তিনি চান তার ছেলের বিয়েটাই সেভাবে হোক। কিন্তু সময় সল্পতার জন্য সেটা সম্ভব না। তবে তিনি ঠিক করে রেখেছেন আপাতত কাবিনটা হবার পর তিনি বেশ ধুমধাম করে ছেলের বিয়ে দেবেন।
সজল চৌধুরী এই বিয়েটা যথাসম্ভব গোপন রাখার চেষ্টা করেছেন। যাতে তার স্ত্রীর কাছে খবর না যায়৷ এজন্য স্ত্রীর বাড়ির কোন আত্মীয় স্বজনকেও বলেন নি৷ শুধু নিজের কাছের কিছু বন্ধু-বান্ধব আর নিজের একমাত্র বোন সায়মাকে বলেছেন৷ সায়মা চৌধুরী সজল চৌধুরীর খুব আপন। সায়মা চৌধুরী নিজের ভাইয়ের এই সিদ্ধান্তে তার পাশেই আছে। কারণ তিনি নিজেও চেনেন তার ভাবিকে। তাই তিনি চান তার ভাবির অনুপস্থিতিতে বিয়েটা ভালোয় ভালোয় মিটে যাক।
সমুদ্র তৈরি হতে একটু বেশি সময় নিচ্ছিল। তাই সজল চৌধুরী বিরক্ত হয়ে তার দরজায় গিয়ে নক করতে থাকেন এবং বলেন,”আর কত সময় লাগবে তোমার? সবাই তো অপেক্ষা করছে।”
সজল চৌধুরী নক করার কিছুক্ষণ পরেই সমুদ্র চৌধুরী বেরিয়ে আসে৷ পড়নে তার কালো রঙের রাজকীয় শেরওয়ানি। মাথায় রাজকীয় টুপি। সায়মা চৌধুরী নিজের ভাতিজাকে দেখে বলে ওঠেন,”মাশাল্লাহ, কি সুন্দর লাগছে। কারো নজর না লাগুক।”
সমুদ্র বলে ওঠে,”নজর তো লাগবেই ফুফি। আমার হবু বউয়ের।”
বলেই দূর্বোধ্য হাসি দেয়।
~~~~~~~~~~~~~~~~~
প্রণালীকে বধূবেশে সাজানো হচ্ছে। গায়ে গোলাপী কালারের বেনারসি শাড়ি, সাবেকি সোনার গহনা সহ, মর্ডান হিরার গহনা এবং প্রসাধনী দিয়ে একদম পরির মতো সাজানো হয়েছে মেয়েটাকে। অনুপমা দেবী তার বড় মেয়ে স্নেহা এবং ছোট মেয়ে সোহিনী সেখানে উপস্থিত ছিল। অনুপমা দেবী নিজের বড় মেয়ে স্নেহাকে বলেন,”দেখ তো অনেক সুন্দর লাগছে না প্রণালীকে।”
স্নেহা সায় জানায়। সোহিনীও বলছে,”অনেক সুন্দর লাগছে৷ সমুদ্র ভাইয়া তো দেখে একদম পাগল হয়ে যাবে।”
সমুদ্র নামটা শুনতেই কেমন জানি অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগল প্রণালীর৷ লোকটার কথা মনে পড়ে গেল৷ লোকটার সাথে প্রথম সাক্ষাৎ ছিল বিভৎস রকমের। লোকটাকে একদম তার ভালো মনে হয়না। তবে একবার নিজের সিদ্ধান্তের জন্য তাকে পস্তাতে হয়েছে। শান্তকে তো কত ভালো ভেবেছিল। অথচ সেই শান্তই কত সুন্দর অভিনয় করে গেল আর দিনশেষে তাকে বাজেভাবে ঠকালো। তাই প্রণালীর কাছে মনে হলো, সে যখন ২ বছরেও একটা মানুষকে চিনতে পারল না তখন তার একবারের দেখায় কিভাবে চিনবে? তার বাবা নিশ্চয়ই তার খারাপ চায় না। সবদিক ভেবে চিন্তেই হয়তো সমুদ্রকে চয়েজ করেছে। হয়তো সে মনের দিক থেকে এতোটাও খারাপ না যতটা প্রণালী ভাবছে৷ এমনটা ভেবেই প্রণালী আর এই সম্পর্কটাকে মেনে নিতে কোন অমত জানাচ্ছে। এমনিতেও সে যা হারানোর হারিয়েই ফেলেছে। বেঁচে থাকার ইচ্ছাটাও তার মধ্যে তেমন নেই, না তো ভালো থাকার ইচ্ছা৷ শান্ত নামক পুরুষটা একদম তাকে ভেতড় থেকে গুড়িয়ে দিয়েছে। এর থেকে সুন্দর প্রতিশোধ বুঝি আর ছিলই না।
প্রণালীর ভাবনার মাঝেই হঠাৎ করে প্রত্যুষ এসে বলে,”বর এসে গেছে। বাবা আপিকে নিয়ে যেতে বলেছে।”
সোহিনী বলে,”হ্যাঁ, তুমি যাও। আমি প্রণালীকে নিয়ে যাচ্ছি।”
~~~~~~
মুখোমুখি বসে আছে প্রণালী ও সমুদ্র। কাজি ইতিমধ্যে বিয়ে পড়ানো শুরু করে দিয়েছে। সমুদ্র আড়চোখে প্রণালীকে দেখলেও প্রণালীর দৃষ্টি মাটিতে নিবদ্ধ। যা দেখে সমুদ্রর মনে হয় মেয়েটা তাকে ইগ্নোর করছে৷ যা তার ইগোতে লাগে৷ সে মনে মনে বলে,”একবার শুধু বিয়েটা হোক। তারপর এসবকিছুর শোধ তুলব। ”
কাজি সাহেব বলেন,
“আব্দুল্লাহ রায়ানের একমাত্র কন্যা রুকাইয়া জাহান প্রণালীর সাথে মোহাম্মদ সজল চৌধুরীর একমাত্র ছেলে মোহাম্মদ সমুদ্র চৌধুরীর বিয়ে ১০ লাখ টাকা মোহরানা দ্বারা ধার্য করা হইল।”
এরপর তিনি প্রণালীকে কবুল বলতে বললে সে কিছু সময় নিয়ে কবুল বলে। সমুদ্র অবশ্য বেশি অপেক্ষা না করেই কবুল বলে। অতঃপর মনে মনে বলে,”এবার তোমার জীবনটা আমি কিভাবে হেল বানাই দেখো মিস সরি আমার মিসেস।”
to be continue…