#গল্পঃ_একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#পর্বঃ_৩৪ (নতুন অধ্যায়)
#লেখাঃ_ইয়াসমিন_খন্দকার
—-
১৮ বছর পর,
আকাশে মেঘের ঘনঘটা। যেকোন সময় বৃষ্টি নামবে। আকাশও তর্জন গর্জন শুরু করে দিয়েছে। এসবের মধ্যেই হাতে ছাতা নিয়ে দৌড়ে চলেছে ২৩ বছর বয়সী এক তরুণী৷ তার চোখেমুখে খুশির ঝলক স্পষ্ট। পথিমধ্যে এক বৃদ্ধ তাকে দেখে বলে,”আস্তে দৌড়াও মা, পড়ে যাইবা তো। তোমায় এত খুশি লাগছে কিল্লাই?”
মেয়েটি হেসে উত্তর দিলো,”আমার ভাই মেডিকেলে চান্স পেয়েছে চাচা। আমি এই খুশির খবরটা পেয়েই তো এভাবে ছুটে যাচ্ছি বাড়ির দিকে। আমার ভাইটার জন্য দোয়া করবেন।”
বলেই মেয়েটি আবার দৌড়াতে শুরু করে। একদম নিজের বাড়ির সামনে এসে দম নেয়। বাড়িতে প্রবেশ করে প্রথমেই নিজের ভাইয়ের রুমে যায়। কিন্তু সেখানে তাকে দেখতে পায়না৷ মেয়েটি বুঝতে পারে তার ভাই এখন কোথায় আছে। সে ছুটে চলে যায় নিজের মায়ের রুমে। তার ভাবনাই সঠিক। নিজের মায়ের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার ভাই প্রত্যুষ। প্রণালী হেসে এগিয়ে যায় তার ভাইয়ের দিকে। প্রত্যুষের কাধে হাত রাখতেই প্রত্যুষ স্বাভাবিক ভাবে ফিরে তাকায়। প্রণালী দেখতে পায় তার ভাইটা কাঁদছে। সাথে সাথেই সে জড়িয়ে ধরে নিজের ভাইকে৷ অতঃপর শান্ত গলায় বলে,”পাগল ছেলে! আজকের মতো একটা খুশির দিনে তুই এভাবে কাঁদছিস কেন?”
প্রত্যুষ ব্যথিত কণ্ঠে বলে,”আজ মা বেঁচে থাকলে খুব খুশি হতো। তাই না আপি?”
প্রণালীর চোখও এবার জলে ভিজে যায়। সে তাকায় তাদের মা প্রভার ছবির দিকে। আজ ১৮ বছর হয়ে গেছে প্রভার মৃত্যুর। মাকে ছাড়া ১৮ বছর পার করে দিল তারা দুজনে। প্রণালী তো তবুও মায়ের ভালোবাসাটুকু পেয়েছিল মায়ের মুখটাও মনে পড়ে অল্পস্বল্প। কিন্তু তার হতভাগা ভাইটার তো সেই সৌভাগ্যও নেই। মাত্র ২ মাস বয়সে মাকে হারিয়েছে সে। কিন্তু মায়ের প্রতি ভালোবাসার বিন্দুমাত্র কমতি নেই। তাই তো মায়ের প্রফেশনটাই বেছে নিলো সে। প্রণালী প্রত্যুষকে জড়িয়ে ধরে। তার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত স্বরে বলে,”মা যেখানেই থাকুক না কেন, তোর এই সাফল্যে অনেক খুশি হয়েছে ভাই।”
দরজায় দাঁড়িয়ে ভাই-বোনের এই সুন্দর মুহুর্ত গুলো দেখছিল রায়ান। তার চোখেও জল এসে গেছে। আজ ১৮ বছর হয়ে গেল তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে হারিয়ে ফেলেছে। তারপর থেকে দুই ছেলে-মেয়েকে ঘিরেই তার জীবন।। রায়ানের মধ্যেও এখন অনেক পরিবর্তন এসেছে। বয়স ষাট ছুঁইছুঁই। চুল, দাঁড়িতে পাক ধরতে শুরু করেছে। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। একজন ছাপোষা বাঙালি পিতার মতোই তার অবস্থা।
প্রত্যুষের নজর যায় তার বাবার দিকে। সে বলে,”বাবা, তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? ভেতরে আসো।”
প্রণালীও তাকায় নিজের বাবার দিকে। রায়ান ভেতরে এসে প্রত্যুষকে অভিনন্দন জানিয়ে বলে,”আমি অনেক খু্শি হয়েছি প্রত্যুষ। আমি আশা করি তুমিও তোমার মায়ের মতো অনেক ভালো ডাক্তার হতে পারবে।”
আর কিছু না বলেই তিনি চলে যান। প্রণালী প্রত্যুষকে বলে,”ভাই তুই কি খেতে চাস বল, আমি তোকে আজ সেটাই রান্না করে খাওয়াবো।”
প্রত্যুষ সামান্য হাসার চেষ্টা করে বলে,”তোর যা ভালো লাগে তাই কর, আমি সেটাই খাবো।”
~~~~~~~~~~~~~
নিজের রুমে বসে ভার্সিটির কিছু এসাইনমেন্ট করছিল প্রণালী৷ বর্তমানে সে একটি স্বনামধন্য প্রাইভেট ভার্সিটিতে ল নিয়ে পড়ছে। এখন তার ফাইনাল ইয়ার চলছে। আর মাত্র কিছুদিন তারপরেই নিজের স্বপ্নকে ছুতে পারবে সে। এসব ভেবেই প্রণালী খুশি হচ্ছিল। এমন সময় হঠাৎ করে রায়ান তার রুমের বাইরে থেকে দরজা নক করে বলব,”আসতে পারি?”
প্রণালী রায়ানের হঠাৎ এমন আগমনে চমকে গেল। রায়ানকে এখানে একদমই আশা করে নি সে। কারণ ৫ বছর আগে থেকে তাদের মধ্যে কিছু দ্বন্দ্ব চলছে। যার জন্য রায়ান প্রণালীর সাথে ঠিক করে কথা পর্যন্ত বলে না। প্রণালী তবুও স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,”জ্বি, আসো।”
রায়ান রুমের ভেতরে এসে নিজের মেয়েকে বলে,”কি করছ?”
“কিছু এসাইনমেন্ট করছিলাম। কিছু বলবে?”
রায়ান কিছুটা হতাশ কন্ঠে বলে,”তুমি তো জানোই প্রণালী আমি কি বলতে চাই। তোমাদের দুই ভাইবোনকে নিয়ে আমার যে কত চিন্তা হয় তুমি বোঝো না? প্রভাকে হারানোর পর এখন তোমরাই তো আমার সব। আমি চাইনা তোমাদের কোন বিপদ হোক। তোমাদের সুরক্ষিত রাখার জন্য তো আমি রাজনীতি ছেড়ে দিলাম। নিজের শহর চট্টগ্রাম ছেড়ে ঢাকায় আসলাম। এসব কিছু কেন করেছি আমি? যাতে তোমাদের উপর কোন বিপদের আঁচ না পড়ে৷ অথচ তুমি সেই বিপদকেই আমন্ত্রণ জানাতে চাইছ। তুমি কেন বোঝো না প্রণালী তোমার জন্য আমার কতটা চিন্তা হয়?”
প্রণালী রায়ানের সব কথাই শোনে কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া জানায় না। সে জানে তার বাবার ভয়টা কোথায়। প্রভার মৃত্যুর পর রায়ানের মধ্যে আপনজনকে হারানোর ভয় জেকে বসে৷ এইজন্য নিজের ছেলে-মেয়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে সে রাজনীতি ছেড়ে দেয়। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে বিজনেস শুরু করে। সবসময় চেষ্টা করেছে দুই ভাইবোনকে সুখী রাখার এমনকি দ্বিতীয় বার বিয়ের কথাও ভাবেন নি। প্রণালীর সাথেও রায়ানের সম্পর্ক ভালো ছিল। আসলে প্রত্যুষ ভীষণ চাপা স্বভাবের এবং খুব কম কথা বলে। সারাক্ষণ পড়ার মাঝেই থাকে। প্রচণ্ড ইন্ট্রোভার্ট হওয়ায় পরিবারের লোকের সাথেও তার কিছুটা মানসিক দূরত্ব আছে। সেখানে প্রণালী একদম বিপরীত। চঞ্চল, প্রাণবন্ত এবং ভীষণ আনন্দময় একটি মেয়ে। যেখানে থাকে সেই জায়গাই মাতিয়ে রাখে। সাথে ভীষণ প্রতিবাদীও সে। স্বাধীনচেতা মনোভাব নিয়েই বড় হয়েছে। প্রণালীর ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছা সে একজন বড় উকিল হবে। আর রায়ানের ঠিক এটাই পছন্দ হয়নি। কারণ এই পেশায় অনেক ঝুঁকি রয়েছে এবং রায়ান চায়না তার সন্তানদের জীবনে নতুন করে কোন সমস্যা আসুক। ঠিক এই কারণে যখন ৫ বছর আগে প্রণালী ল’ নিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেয় তখন থেকেই বাবার সাথে তার একটা মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়। তারপর থেকে রায়ান আর মেয়ের সাথে ঠিক করে কথা বলে না।আজ অনেকদিন পর তিনি নিজের মেয়ের সাথে নিজে থেকে কথা বলতে এসেছেন। প্রণালীও তাই নিজের বাবাকে রাগিয়ে দিতে চায়না। কিন্তু নিজের প্যাশনও সে ছাড়তে পারবে না। তাই প্রণালী এই বিষয়ে কথা বলতে চাইছিল সে। সে প্রসঙ্গ বদলে বলে,”বাবা, প্রত্যুষের এত বড় সাকসেসের কোন সেলিব্রেশন হবে না?”
“টপিক বদলানোর চেষ্টা করো না প্রণালী।”
প্রণালী বুঝতে পারে না এবার সে কি বলবে। তাই চুপ করে বসে থাকে। রায়ান বলতে থাকে,”আমি বুঝতে পারছি তুমি আমার কোন কথা শুনবে না। নিজের জেদেই তুমি অটল থাকবে। তাই আমিও আর তোমাকে কিছু বলব না৷ যা ইচ্ছা করো। তোমার মাকে তো অনেক আগেই হারিয়েছ এবার আমাকে হারালেই ষোলকলা পূর্ণ হবে।”
“বাবা! এসব কেমন কথা বলছ তুমি?”
রায়ান আর কিছু না বলে প্রণালীর রুম থেকে বেরিয়ে যায়। এদিকে প্রণালীর মন একদম খারাপ হয়ে যায়। তাই সে উদাস মনে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। সাথে করে সে নিজের ফোনটাও নিয়ে এসেছিল। সে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ানোর কিছুক্ষণ পরেই তার ফোন বেজে ওঠে। ফোনের দিকে তাকাতেই প্রণালীর মুখে হাসি ফুটে ওঠে। নাম্বারটা “প্রিয়তম” দিয়ে সেইভ করা। ফোনটা রিসিভ করতেই বিপরীত দিক থেকে কেউ বলে ওঠে,”নিশ্চয়ই এখন তোমার মন খারাপ?”
“তুমি কি করে বুঝলে? তোমার কাছে কি কোন সুপার পাওয়ার আছে শান্ত? সবসময় আমার মন খারাপের খবর তোমার কাছে কিভাবে পৌঁছে যায়?”
“এটাকে ট্যালিপ্যাথি বলে প্রণালী। যাদের মধ্যে ভালোবাসা বেশি থাকে তাদের মাঝে এটা বেশি কাজ করে।”
প্রণালী খুব খুশি হয় শান্তর কথা শুনে। শান্ত আর প্রণালীর মধ্যে প্রণয়ের সম্পর্ক। তাদের প্রেম কাহিনিটাও কিন্তু বেশ রোমাঞ্চকর ছিল। শান্ত ছিল প্রত্যুষের হোম টিউটর। সেখান থেকেই প্রণালীর সাথে তার পরিচয়। শান্তর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব প্রণালীকে মুগ্ধ করে এবং সে শান্তর প্রেমে পড়ে যায়। শান্তকে যখন সে নিজের মনের কথা ব্যক্ত করে তখন তো শান্ত কিছুতেই রাজি হয়না। কারণ সে একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে আর প্রণালীরা এত বড়লোক। কিন্তু প্রণালী শান্তকে ঠিকই রাজি করিয়ে নেয়। তারপর থেকে ২ বছর ধরে তারা রিলেশনে আছে। প্রণালী তো ভেবে নিয়েছে উকিল হয়ে যাবার পরই সে রায়ানকে তাদের সম্পর্কের ব্যাপারে জানাবে। আর রায়ানের কাছেও এসব ধনী-গরিবের কোন পার্থক্য নেই। তাই রায়ানও খুশি খুশি সব মেনে নেবে। আর একটা সময় রায়ান হয়তো প্রণালীর প্রফেশনটাও মেনে নেবে। এসব ভেবে প্রণালীর দুঃখী মনে সুখের সঞ্চার ঘটে এবং সে খুশি মনে শান্তর সাথে কথা বলতে থাকে।
(চলবে)…
#গল্পঃএকই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
[নতুন অধ্যায় আপনাদের কেমন লাগল জানাতে ভুলবেন না।]