#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_32
#ইয়াসমিন_খন্দকার
৫ বছর পর,
প্রভা তৈরি হচ্ছে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য। আজ তার অনেক ব্যস্ত সিডিউল। অনেক রোগী দেখতে হবে। এরমধ্যে হঠাৎ সে লক্ষ্য করল প্রণালী দৌড়ে রুমে প্রবেশ করছে। প্রভা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। এই মেয়েটাকে নিয়ে সে আর পারে না। এত ডানপিটে আর চঞ্চল হয়েছে যা বলার বাহিরে। প্রভা বুঝতে পারে না তার মতো শান্ত নারীর গর্ভে এই অশান্ত মেয়ে কিভাবে এলো। প্রণালী রুমে এসেই বিছানায় বসে পড়ল। প্রভার উদ্দ্যেশ্যে বলল,”আম্মু, আমার আজ হাসপাতালে যেতে খুব ইচ্ছা করছে। তুমি আমাকে নিয়ে চলো না।”
প্রভা ফোস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,”ওখানে গিয়ে তুমি কি করবে? তোমার আজ স্কুল আছে না?”
প্রণালী মুখ ভাড় করে বলে,”আমার আজ স্কুলে যেতে একদমই ইচ্ছা করছে না। তুমি আমায় হাসপাতালে নিয়ে চলো না।”
“তুমি বেশ পড়াচোর হয়েছ দেখছি। এসব একদম চলবে না। আমার সাথে চলো আমি তোমাকে স্কুলে নামিয়ে দেব।”
প্রণালী একদম কান্নাকাটি জুড়ে দেয়। সে আজ কিছুতেই স্কুলে যাবে না। প্রভা নিজের এই জেদি, চঞ্চল মেয়েটাকে সামলাতে ব্যর্থ হয়। এমন সময় রায়ানও রুমে চলে আসে। প্রণালীকে কাঁদতে দেখে সে এসে নিজের রাজকন্যাকে কোলে তুলে নিয়ে বলে,”আমার প্রিন্সেস কাঁদছে কেন? কি হয়েছে মা?”
প্রণালী গাল ফুলিয়ে বলে,”আমি আজ স্কুলে যাব না বাবা।”
রায়ান বলে,”কোন ব্যাপার না। আজ আমি তোমাকে নিয়ে নাহয় ঘুরতে যাব।”
প্রভা বলে,”এভাবেই মেয়েকে মাথায় তোলো৷ ওকে আস্কারা দিয়ে তুমি কিন্তু একদম ঠিক করছ না। সামনে ওর এনুয়াল এক্সাম এইসময় ফাঁকিবাজি আমি একদম বরদাস্ত করব না।”
“তুমি এমন করছ কেন প্রভা? একটা দিনেরই তো ব্যাপার। আমি নাহয় ওকে নিয়ে আজ ঘুরতে যাব।”
“কেন? তোমার কাজ নেই? লোকে যদি জানে এমপি নিজের কাজ ছেড়ে সারাদিন নিজের মেয়েকে নিয়ে ঘুরছে তাহলে কিন্তু পরেরবার একটা ভোটও পাবে না।”
“সারাবছর তো জনগণকে সময় দেই। এই একটা দিন নাহয় নিজের মেয়েকে সময় দিলাম।”
প্রভা আর কিছু বলে না। সে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়। এমন সময় রায়ান এসে প্রভাকে বলে,”নিজের যত্ন নিও। এইসময় কিন্তু তোমাকে নিজের প্রতি আরো যত্নবান হতে হবে। কারণ তোমার মাঝে যে আরো একটা প্রাণ বেড়ে উঠছে।”
প্রভা মৃদু হাসে। দ্বিতীয় বারের মতো মাতৃত্বের স্বাদ পেতে চলেছে সে। কয়েকদিন আগেই জানতে পেরেছে সে মা হতে চলেছে। তাই প্রভার মধ্যে আনন্দের কোন কমতি নেই। সাথে রয়েছে কিছু আশংকাও। যদিও সেই ব্যাপারে রায়ানকে এখনো তার কিছু বলা হয়নি। আজ হসপিটালে গিয়েই প্রভা সবার আগে গাইনি বিশেষজ্ঞ মিসেস চৌধুরীর সাথে কথা বলবে। তিনিই তাকে এই বিষয়ে সঠিক পরামর্শ দিতে পারবে। প্রভা কিছু একটা মনে করে রায়ানকে বলে,”তুমি ওদের খোঁজ নিয়েছিলে?”
“ওদের মানে?”
“আবির ভাইয়ার স্ত্রী ও সন্তানের?”
প্রভার কথা শুনে রায়ানের চোয়াল শক্ত হয়। আবির নামটাকেই তার ইদানীং সহ্য হয়না। এই আবিরের জন্যই তার জীবনের ১২ টা বছর নষ্ট হয়েছে। শুধু তাই নয় আবিরের খাওয়ানো ওষুধের পাশ্ব-প্রতিক্রিয়ার জন্য রুহুল আমিনও কিছু বছর আগে মারা গেছেন। নাহলে তিনি হয়তো আজও পৃথিবীতে থাকতেন। কিছুদিন আগেই রায়ান জানতে পেরেছে আবির গোপনে একটা বিয়ে করেছিল। সেই ঘরে আবিরের একটা ছেলেও আছে। প্রভা এটা জানার পর দুশ্চিন্তায় পড়েছিল। প্রভার মনে হয়েছিল আবির হয়তো ঐ মহিলাকেও বোকা বানিয়েছে। কিন্তু রায়ান খোঁজ নিয়ে দেখেছে ঐ মহিলা আবিরের ব্যাপারে সব সত্যি জেনেই তাকে বিয়ে করেছে। এখনো আবিরের জমানো টাকায় বেশ আয়েসি জীবন যাপন করছে। তাই রায়ান আর এই ব্যাপারে কোন কথা বলে না। প্রভাকে শুধু এটুকুই বলে,”ওরা ভালো আছে। তুমি চিন্তা করো না।”
~~~~~~~
নিজের প্রেগ্ন্যাসির রিপোর্ট হাতে নিয়ে বসে আছে প্রভা। ডা.চৌধুরী প্রভাকে বলে,”আপনি নিজেও একজন চিকিৎসক। তাই অবস্থা যে কতটা ক্রিটিকাল আপনি বুঝতে পারছেন। এই সন্তানটা জন্ম দিতে গেলে আপনার লাইফ রিস্ক আছে। আমার মনে হয় আপনার গর্ভ*পাত করা উচিৎ।”
প্রভা নিজের পেটে হাত বুলিয়ে বলে,”আমি এমনটা চাই না। তাছাড়া আপনিই তো বললেন আমার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ২০%, তাহলে তো রিস্কটা নিতেই পারি।”
“আপনি বুঝতে পারছেন না মিসেস আহসান, এটা একটু বেশিই রিস্কি হয়ে যাবে। আপনার এই রিস্ক নেওয়া উচিত হবে না।”
“আমি একজন মা হয়ে কিছুতেই নিজের গর্ভের সন্তানকে মে*রে ফেলতে পারব না। তার জন্য যদি নিজের জীবনটা রিস্কে ফেলতে হয় তাতেও আমার কোন অসুবিধা নেই।”
বলেই প্রভা উঠে দাঁড়ায়। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। আর নিজের সিদ্ধান্তে যে সে অটল সেটাও সে ভালো করেই বুঝিয়ে দিয়েছে। প্রভা নিজের পেটে হাত বুলিয়ে বলে,”তুমি চিন্তা করো না। তোমার মাম্মা তোমায় পৃথিবীতে আনবেই। তোমার কোন ক্ষতি হতে দেব না।”
~~~~~~~
কয়েক মাস পর,
আজ প্রভার ডেলিভারি ডেইট। প্রভাকে নিয়ে যথাসময়ে হাসপাতালে পৌঁছে গেছে রায়ান। প্রভা রায়ানকে নিজের অবস্থার ব্যাপারে বলে নি। তাই সে অনেকটা নিশ্চিন্তে আছে। কিন্তু আজ যখন ডাক্তারের কাছে সবটা জানতে পারল তখন রায়ানের পায়ের তলার মাটি সরে গেল। রায়ান যদি আগে জানত প্রভার লাইফ রিস্ক আছে তাহলে সে কখনো প্রভাকে এত বড় ঝুঁকি নিতে দিত না। রায়ান তখন সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে থাকে। প্রভার কোন ক্ষতি হলে যে সে সেটা মেনে নিতে পারবে না। রায়ান কাঁদতে থাকে অনবরত। প্রণালীকে নিয়ে অনুরাধা হাসপাতালে আছে। প্রণালী রায়ানকে কাঁদতে দেখে বলে,”বাবা, তুমি কাঁদছ কেন?”
রায়ান নিজের মেয়েটাকে কোলে তুলে নিয়ে কাঁদতে থাকে। প্রণালী কিছু বুঝে উঠতে পারে না। এমন সময় একজন ডাক্তার এসে বলে,”অবস্থা ভীষণ ক্রিটিকাল। আমরা মা এবং সন্তানের দুজনেরই লাইফ রিস্ক আছে। তবে আমরা বাচ্চাটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করব। মাকে বাঁচানোর কথা আমরা দিতে পারছি না।”
প্রণালী অনুরাধার কাছে গিয়ে বলে,”ডাক্তার কি বলছে আন্টি? মায়ের কি হয়েছে?”
অনুরাধা এই ছোট বাচ্চাটাকে কিভাবে সামলাবে সেটা বুঝে উঠতে পারে না। সময় যত এগোচ্ছিল রায়ান ততই দূর্বল হয়ে পড়ছিল। প্রভাকে হারানোর ভয় জেকে বসতে থাকে তার মনে। এমন সময় ডাক্তার এসে বলে,”আপনার ছেলে হয়েছে। সে একদম সুস্থ আছে তবে আপনার স্ত্রীর অবস্থা আশংকাজনক। আমরা নিজেদের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাব। বাকিটা আল্লাহর হাতে।”
এই বলে তিনি চলে যান। রায়ানের মধ্যে এই মুহুর্তে অদ্ভুত অনুভূতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। সে বুঝতে পারছে না নিজের ছেলে হওয়ার খবরে খুশি হবে নাকি প্রভার এই অবস্থার জন্য কষ্ট পাবে। কিছুক্ষণ পরেই একজন নার্স এসে তাদের সন্তানকে রায়ানের কোলে দিয়ে যায়। রায়ান নিজের ছেলেকে কোলে নিয়ে বলে,”আমার রাজপুত্র!”
সময় গুলো কাঁটতে থাকে দুশ্চিন্তা এবং উদ্বেগের মধ্যে দিয়ে। প্রভার অবস্থা এখনো স্থিতিশীল। তার চিকিৎসা চলছে। ডাক্তার এখনো কোন ভরসা দিতে পারছে না। রায়ান নিজের ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে আছে। সৌভিক তার কাধে হাত রেখে বলে,”অনুরাধা প্রণালীকে সামলাচ্ছে। তুই চিন্তা করিস না। ভাবির কিছু হবে না।”
রায়ান নিজের ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমার সন্তানেরা কি মাতৃহারা হয়ে যাবে সৌভিক? আমি ওদের একা কিভাবে সামলাবো? প্রভাকে ছাড়া বাকি জীবনটাই বা কিভাবে কাটাবো? ও কিভাবে এরকম স্বার্থপরতা করতে পারল কিভাবে?”
বলে আবারো কান্নায় ভেঙে পড়লো রায়ান।
to be continue…