#অবুঝ_প্রেম
পর্ব ৪
লেখিকা #Fabiha_Busra_Borno
তাহলে কি উনিও আমার হার্টবিট শুনতে পাচ্ছেন?
চারিদিকে অন্ধকার আর পায়ের নিচে উঁচু নিচু ব্লগের ভিতর দিয়ে আমাকে কোলে নিয়ে আসছেন উনি। আমি তো এখন আমার মাঝে নেই। কেমন যেন ঘোর লাগা আবেশে হারিয়ে গেছি। এমন সময় হালকা ঝাকুনি অনুভব করলাম। সাথে সাথে মনে হচ্ছে আমি এখন নিচে পড়ে যাবো তাই এক হাতে উনার শার্ট খামচে ধরে অন্য হাতে গলাটাও শক্ত করে জড়িয়ে ধরি আর চোখ মুখ খিচে উনার বুকের ভেতর লুকানোর চেষ্টা করি।
আমার ঠোঁটে লোমের মতো কিছু একটা অনুভব করলাম। হয়তো উনার বুকের লোমে আমার ঠোঁটের ছোঁয়া লেগেছে। উনি সাথে সাথে আবারও তরতর করে উপরে উঠে যেতে থাকেন। এই মুহুর্তের এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। ওওহ এখানে তো আবার মাটি নেই। যা আছে তা হলো উনার বুক।
হয়তো আমরা প্রায় উপরে উঠে গেছি এমন সময় দলবদ্ধ লোকজন লাঠি সোটা নিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসে। কাহিনি টা কি বুঝে উঠার আগেই অনেক গুলো টর্চের আলো আমাদের চোখে মুখে এসে লাগে। ঠিক তখনই বখাটে ছেলেরা বলে উঠে দেখুন সবাই দেখুন। প্রেমের নামে বিভিন্ন হোটেল পার্কের পাশাপাশি ব্রিজের নিচেও প্রেম বিতরণ হয় কিভাবে। একজন লোক আমাদের সামনে এসে লাইট জ্বালিয়ে দেখে তুর্জ এর শার্টে এবং গলায় লিপস্টিক লেগে আছে।
তখন উনি আগে উনার হাতের লাঠি দিয়ে আঘাত করেন এবং সাথে সাথে বাকিরাও আঘাত করতে থাকে আমাদের উপর।
তুর্জ সবাইকে বলে চলছে, আগে আমাদের কথা টা শুনুন, আপনারা যা ভাবছেন তা নয়! হঠাৎ আমার মাথায় আঘাত লাগে আর আমি সাথে সাথে সেন্সলেস হয়ে যায়।
যখন চোখ খুলি তখন দেখি আমি কোন মেডিক্যালে, পাশে মামুনি বসা। মামুনি বলে ডাক দিতেই হাউমাউ করে কেদে দিলাম আমি।
কাঁদে না, সোনা মা আমার, কিছু হয় নি তোর, দেখ আমরা সবাই আছি তোর পাশে। আর কোন ভয় নেই মা। সব ঠিক হয়ে গেছে আগের মতো।
মামুনি বিশ্বাস করো আমি কিছু করিনি, যা হয়েছে তাতে,,,
পরে সব শুনবো মা, আগে তুমি সুস্থ হয়ে নাও।
আমার শরীরে তেমন কোন ক্ষত নাই, শুধু মাথায় আঘাত লেগে কেটে গেছে আর অতিরিক্ত ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম। পরের দিন সকালে আমাকে রিলিজ দেওয়া হয়েছে। আমাদের গোছগাছ করার শেষের দিকে দুজন পুলিশ আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে আসেন। কিভাবে কিভাবে আমাকে ধর্ষণ করেছেন তার বিবরণ চাইছেন। আমি উনাদের বারবার বলছিলাম এমন কিছুই হয়নি আমাদের মাঝে কিন্তু উনারা বিশ্বাস করছেন না। বাবাই তখন রেগে পুলিশের সাথে খারাপ আচরণ করেন।
এলাকায় সবাই আমাকে ধর্ষিতা মেয়ে বা নিজের ইচ্ছায় ওইসব করেছি ভেবে নানা রকম বাজে কথা শোনাচ্ছে। আজ তুতুল আর মিঠি আমাকে দেখতে এসেছে। ভাবলাম ওদের সাথে কথা বললে ভালো লাগবে। কিন্তু অন্যদের মতো ওরাও আমাকে সেইম প্রশ্ন করছে। আমার বিরক্ত লাগছিলো এইসব। তুতুল মিঠিকে নাকি ওদের ফ্যামিলি সাফসাফ বলে দিয়েছে যেন আমার সাথে না মিশে।
কোথায় ভাবলাম বন্ধুদের কাছে পেয়ে ভালো লাগবে তা নয় এখন আরো বেশি মন খারাপ হয়ে গেছে। মিঠি তুতুল যাওয়ার পরে ইচ্ছে মতো কান্না করলাম। বাইরে থেকে বাবাই এর গলা শোনা যাচ্ছে। এই অবেলায় বাবা বাসায় কেন? এখন তো অফিসে থাকার কথা। মামুনির সাথে বাবাই এর কথা ভালো করে শোনার জন্য দরজার কাছে চলে আসছি। বাবাই এর অফিসের সবাই নাকি বলাবলি করছে,, বাবাই নাকি ভালো পোস্টিং এর জন্য নিজের মেয়েকে অফিসের বসের সাথে লাগিয়ে দিয়েছেন। এইসব লজ্জায় বাবা চাকরি রিজাইন করে চলে এসেছেন।
একরকম ঘরবন্দী হয়ে কেটে গেছে দুইদিন। বাসা থেকে লোক লজ্জার ভয়ে কেউ বাইরে যায় না। হঠাৎ কেউ কলিংবেল বাজালেও ভয়ে আত্মা শুকিয়ে যায়। সন্ধ্যা বেলা কলিংবেলের আওয়াজে আমি ঘরের ভিতর থেকে বাইরে আসি। দরজা খুলতেই দেখি তুর্জ এবং উনার সাথে আরো দুজন লোক। আমি কি বলবো কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। তাই সোজা চলে আসছি। পিছনে থেকে মামুনি বলে, কে এসেছে সারা??
মামুনিও এই সময় উনাদের দেখে অবাক। উনাদের বসতে দিয়ে মামুনি নাস্তা রেডি করতে যায় আর বাবাই উনাদের সাথে বসে আছে। বাবাই এর রিজাইন দেওয়ার জন্য উনারা আন্তরিক দুঃখিত তা জানালেন। অনেক কথা হওয়ার পরে তুর্জের বাবা বলেন,
যা হয়ে গেছে তা চাইলেও আর ফেরাতে পারবো না, তবে যা রটে গেছে তা সামান্য হলেও কমাতে পারবো, যদি আপনারা রাজি থাকেন,
বাবাই বললেন, আসলে কি বলতে চাইছেন বুঝলাম না।
দেখুন, শফিক সাহেব,, সমাজের চোখে আপনারা কেমন হ্যানস্থা হচ্ছেন আমরা তা বুঝি। আমরাও যে হ্যানস্থা হচ্ছি না তাও কিন্তু না। তাই আপনারা যদি রাজি থাকেন তাহলে তুর্জের সাথে সারা মামুনির বিয়ে দিয়ে এই সমস্যা থেকে রক্ষা পেতে চাইছিলাম। বাকিটা আপনাদের ইচ্ছে।
আমার সৌভাগ্য আপনারা আমার অবস্থা বিবেচনা করে এমন প্রস্তাব দিয়েছেন।কিন্তু আমার মেয়ে তো এখনো অনেক ছোট্ট, ওর বিয়ে, সংসার এইসব সম্পর্কে কোন ধারণাই নাই। আর আমার ইচ্ছে ও ছিলো না এমন অল্প বয়সে মেয়ের বিয়ে দিবো। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি এমন যে,যদি আপনাদের ফিরিয়ে দিই তাহলে মেয়ের ভবিষ্যত নিজ হাতে ধ্বংস করা হবে।
তাহলে আপনার উত্তর টা কি হ্যাঁ ধরে নিবো।
এটা ছাড়া তো আর কোন উপায় নেই। কিন্তু বিয়েটা চুপিচুপি দিতে হবে,, বয়স কম, থানা পুলিশের ঝামেলায় আবারও নতুন সমস্যা হতে পারে।
সব খারাপের পিছনে হয়তো ভালো কিছু লুকিয়ে থাকে। আজ এমন পরিস্থিতিতে না পড়লে ব্যাটা মহব্বত আলি কে পেতাম না। আর বাবাই টা যে কি,, এখনো আমাকে ছোট্ট মনে করে। এইসব বিয়ে, সংসার আমি অনেক আগে থেকেই বুঝি হিহিহিহি।
উনারা কাল বিকালে কাজি অফিসে আমাকে নিয়ে যেতে বলেন। শুধু আমাদের পরিবার আর উনাদের পরিবারের উপস্থিতিতে বিয়ে সম্পুর্ণ হবে।
কত স্বপ্ন ছিল, আমার বিয়েতে হেব্বি একটা অনুষ্ঠান হবে এতো এতো মানুষ আসবে, আমি ওরেএ সাজুগুজু দিবো কিন্তু বাস্তবে কিচ্ছু হলো না। না হয় না হোক, অন্তত মহব্বত আলি কে পাচ্ছি এটাই অনেক।
কাল কি কি হবে,, মহব্বত আলি কি কি বলবে এইসব কথা ভাবতে ভাবতে রাতে আর ঘুম হলো না। ইচ্ছে করছে একটা ডিজে পার্টি দিয়ে ড্যান্স করে বলি,,ও-ই হোই আমার বিয়া,,,,
সকালে মামুনি আমাকে জরিয়ে ধরে কান্না করছে আর সব কিছু মেনে নিতে বোঝাচ্ছে। কি আজিব বোঝাতে হবে কেন? আমি তো সব বুঝি,, মামুনি এমন ভাবে কান্না করছে যে মনে হচ্ছে আজ বিকালে আমি মারা যাচ্ছি। আরে বাবা মেয়ে হয়ে যখন জন্ম নিয়েছি তখন বিয়ে করে বরের বাড়ি যেতেই হবে এতে এতো কান্নাকাটির কি হলো বুঝলাম না।
মামুনি চলে যাওয়ার পরে, মনের সুখে সময় নিয়ে গোসল করলাম। তারপর মনে মনে রেডি হতে শুরু করি। শুধু একবার, রেডি হয়েছি নাকি জিজ্ঞেস করলেই বেড়িয়ে যাবো। অবশেষে অপেক্ষা শেষ হলো,, মামুনি আমাকে নিয়ে বাইরে আসে,, আজ আমি লাল রঙের সালোয়ার-কামিজের সাথে লাল লিপস্টিক ছোট্ট কালো টিপ,কানে ছোট্ট দুল পড়েছি। আমি বাবাই মামুনি বিকাল চারটায় কাজি অফিসে চলে আসছি। উনারা এখনো আসেন নি। বাবাই ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করেন কতদূর আছেন। উনারা ১০ মিনিটের মধ্যে এসে পৌঁছাবেন।
বুকের ঢিপঢিপানি শব্দ গুলো এতো জোরে বাজছে কেন? মহব্বত আলির প্রেমে তো প্রথম দিন থেকে ই হাবুডুবু খাচ্ছি আর আজ পুরো ডোবাডুবি খাচ্ছি। এতো সুন্দর হতে কে বলেছেন উনাকে। ইইশ কি সুন্দর আমার বর টা। বিয়ে পরে স্কুলে নিয়ে গিয়ে সবাই কে দেখাবো আমার বর কত্ত সুন্দর হিহিহিহি।
আপনি এখানে বসুন আর বর কনে পাশাপাশি বসুন, কাজির এমন কথাতে ভাবনার জগৎ থেকে কাজি অফিসে পৌছালাম আমি। যদি ও আমার বয়স নিয়ে কাজি ঝামেলা করছিলো একটু। তখন দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগ কন্ট্রোল করেছিলাম। যদি কোন কারণে আমার আজ বিয়ে না হতো তাহলে এই টাকলু কাজির ২৪ টা বাজায় দিতাম,,
বিয়ে শেষ,, তুর্জ ওদের গাড়িতে উঠে বসে গেছে। মামুনি আর বাবাই তুর্জের মা বাবার সাথে কথা বলে বিদায় নিয়ে আমাকে নিয়ে আমাদের গাড়িতে উঠতে যাবে, এমন সময় আমি বলে উঠি,,
কি ব্যাপার মামুনি, আমি এখন তোমাদের সাথে যাবো কেন,, এখন ই ভুলে গেলে আমার বিয়ে হয়েছে তা।আমি তো এখন শশুর বাড়িতে যাবো তাইনা।
আমার কথা শুনে সবাই কাশি দিতে শুরু করেছে। আরে সর্দি কাশি হবি ভালো কথা তাই বলে বাবা মা শশুর শাশুড়ী জামাই সবার এক সাথে হতে হবে কেন বুঝলাম না। আমি মামুনিকে বলি,,
আমার জন্য চিন্তা করবে না ওকে!!ও বাড়িতে গিয়েই তোমাকে ফোন দিবো। আর বাবাই তুমিও কিন্তু বাইরে থাকবা না। বুঝোই তো এখন থেকে আমি আর মামুনির সাথে থাকবো না, মামুনি একা একা সারাদিন বোরিং লাগবে তাই তুমি মামুনির সাথে থাকবে। আচ্ছা তাহলে আসি, তোমরা ভালো থেকো হ্যাঁ।
কথা শেষ হতে দেরি কিন্তু তুর্জের পাশের সিটে বসতে দেরি নাই। আচ্ছা আমি কি কথার ফাঁকে কখনো স্ট্যাচু বলেছিলাম? মনে হচ্ছে না কেন? না মানে সবাই এমন স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে আছে কেন? তুর্জ কে জিজ্ঞেস করলাম,, ওমা সেও আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
কি হলো? সবাই এইভাবে আছো কেন? আমার কথাতে সবাই যে যার গাড়িতে উঠে পড়ে। তুর্জ আর আমি সামনের সিটে আর মা বাবা পিছনে। আজ প্রথম বরের সঙ্গে শশুর বাড়ি যাচ্ছি,, নিজেকে অনেক ফুরফুরে মনে হচ্ছে।
বিশাল বড় বাড়িতে গাড়ি থামানো হলো। উউউরিইবাবা আমি এতো বড়লোক বাড়ির বউ, কি রাজ কপাল আমার, বড় বর বড় বাড়ি আয়াহহহ্।
এ বাড়িতে দুজন কাজের লোক তুর্জ বাবা মা আর এখন আমি ছাড়া কেউ নাই। সারা সন্ধ্যাভর মা(শাশুড়ীর) সাথে কথা বলে শেষ করলাম। আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম আমার মামুনিকে মামুনি ডাকবো আর বরের মা কে মা ডাকবো। এর ফাঁকে তুর্জকে এক বার ও দেখিনি। রাতে ডিনার শেষে মা বলেন,, আজ তুমি আর আমি এক সাথে ঘুমাবো আচ্ছা। নতুন বাড়িতে একা একা ভয় করতে পারো।
একা ঘুমাবো কেন মা? বাবাই আর মামুনি তো এক সাথে ঘুমায়, আপনি আর বাবা ও তো মনে হয় এক সাথে ঘুমান,, তাহলে আমি আর আমার বর ও এক সাথে ঘুমাবো।
মা এর আবারও কাশি উঠলো,, কই এতোক্ষণ তো কাশি ছিলো না আবারও হঠাৎ করে কাশি হলো কেন?
যাক উনাদের কাশি উনারা সারাবেন,
আচ্ছা মা! উনি কোথায় গেছেন মানে আপনার ছেলে? সেই সন্ধ্যা থেকে মনে মনে খুজে চলেছি কিন্তু পাচ্ছি না।
মা ও একটু বাইরে গেছে, একটু পরে আসবে,, তুমি আজ আমার সাথে ঘুমাও কেমন?
আমি নাছোড়বান্দা,, বরের ঘরে ঘুমাবো। কিন্তু মা আমাকে ভুজুংভাজুং বুঝিয়ে চলেছে। আমি হাত পা ছেড়ে ছুড়ে কান্না শুরু করেছি বরের সঙ্গে ঘুমাবো বলে। এমন সময় তুর্জ ফোনে কথা বলতে বলতে বাসায় আসে। আমার এমন কান্না দেখে সে অবাক। কান্নার চোটটা অবশেষে বাধ্য হয়ে আমাকে উনার ঘরে নিয়ে যান।
চলবে,,,,