#Journey episode 17

0
197

#Journey episode 17

#১৭

রাতে বাসায় ফিরে সব কাজ শেষে জেসমিন বিছানায় যাবার কথা যখন ভাবে,তখন রাইফের কথা মাথায় আসে।ও কি একটা কল দিবে?শুয়েই না হয় সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে।বিছানায় গা এলিয়েই দেখে স্ক্রিনে রাইফের নাম।খুশিতে কল রিসিভ করে হাসে,

“কিরে,কেমন আছিস?”
“ভালোই,তুই?”
“খুব ভাল”
“খুব ভাল?মনে হচ্ছে মন খুব ভাল?”
“তা না,কিন্তু মাত্রই তোর কথা ভাবছিলাম, আর এখন তোর কল হাজির।সারাদিন কারো সাথে সেভাবে মন খুলে কথা বলা হয়না,তুই সেটা পূরণ করে দিস।”
“হুম।বহু বছর পর কারো সাথে রাতের বেলা কথা বলার নেশা জেগেছে।তোর সাথে ইদানীং মনে হয় সারা রাতই আড্ডা দিতে পারব!”
“হা হা!মন্দ বলিস নি।সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে না হলে সারা রাত সত্যিই কথা বলতাম।”
“যতক্ষন কথা বলা যায়,ততক্ষণ বলি?তাতেই হবে।তা বল,আজকের দিন কেমন কাটল?”
“খারাপ না,ভালোই।তবে একটা খারাপ সংবাদ আছে”
“কি!”
“আমি আগামী তিন মাস কোন বড় ছুটি পাচ্ছি না।তাই…”
“তাই সিসিলিতে আসতে পারবি না,তাই তো?”
“হুম”
“আচ্ছা,কি আর করার।ছুটি জোর করে নিতে গেলে তো আবার সমস্যা।এই দেশের মানুষ গুলো ভালোই পরিশ্রমী,এরা ফাঁকিবাজি করে না।এরা কেন,কোন বিদেশীরাই করে না।কিন্তু যত ফাঁকিবাজি সব আমাদের রক্তে”
“আমি কিন্তু ফাঁকিবাজির জন্যে ছুটি চাই নি”
“সেটা তো তুই আর আমি জানি,বুঝি,তোর প্রফেসর বুঝবে?বুঝবে না।সে যাক,এত ভাবিস না।যখন সময় পাবি,তখনই আসবি,সমস্যা নেই।আর একদম মন খারাপ করবি না ছুটির জন্যে,কেমন?”
“ওকে!”

এভাবেই রাতভর ওদের কথা চলতে থাকে।প্রতি রাত জেসমিন আর রাইফের ঘরটা তাদের কথায় কথায় মুখরিত হয়,জেসমিনের কন্ঠ পাখির মত কিচিরমিচির করে,কখনো সে কন্ঠে মেশান থাকে রহস্য,আর রাইফের রাশভারী কন্ঠে থাকে দুষ্টুমি আর নেশার ছোঁয়া।রাতের অন্ধকার দুজনের কন্ঠে ঢেলে দেয় এক অভেদ্য আকর্ষণ,যে আকর্ষণে প্রতি মুহুর্তে প্রতি রাতে দুজনের মাঝের দূরত্ব ক্রমশ কমে আসে।রাতের অন্ধকারে কি থাকে? রাতের অন্ধকারে থাকে অসীম মাদকতা,যে মাদকতা ছাড়ে না একটি প্রাণকেও।এই রাতেই শুরু হয় ভালোবাসা,এই রাতেই শুরু হয় নতুন জীবন।আর এভাবেই কেটে যায় এক মাস।এই এক মাসে অনেকটাই কাছাকাছি সরে আসে জেসমিন আর রাইফ।মাঝে মাঝেই মনে হয় রাইফের,আজ আমি বলেই দিব আমার মনে যা আছে,আর পরমুহুর্তেই সব ভজকট পেকে যায়।হয় জেসমিন দুম করে ঘুমিয়ে পড়বে,নয়ত কথার মোড় ঘুরে যাবে,কিংবা গলার মাঝে দলা পাকাবে সব কথাগুলো ঠিক সেদিনের মত,যেদিন জেসমিনকে ভালোবাসার কথা বলার পরও শুনল না,যখন কল করল,বলতে পারল না,আর এখন বলার চেষ্টা করছে,বলতে পারছে না। খুব অস্বস্তি লাগে রাইফের,মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় কিছু একটা করে ফেলতে জেসমিনকে ভালোবাসার কথা বোঝানোর জন্য।দম বন্ধ লাগে ভীষণ, যেন পুরো অনুভূতিটা ঝামেলা পাকিয়ে বুকের উপর উঠে বসেছে,দুহাতে সেটা গলা চেপে ধরেছে।আকস্মিক কোন কিছু যেন বাঁধা সৃষ্টি করছে ঠিক সেদিনের ট্রেনের দরজার মত।ইশ!দরজাটা সেদিন আটকে না গেলে কি হত?

ভালোই চলছিল দুজনের খুনশুটি।তবে একদিন বাঁধল বিপত্তি।

জেসমিনের গত চার বছরে কি হয়েছিল,সে কথা একদিন কথা প্রসঙ্গে চলে আসে। কিন্তু জেসমিন এ নিয়ে কিছুতেই মুখ খুলতে রাজী হয় না।বার বার এটাই বলে,তুই আমাকে এ ব্যাপারে কোন প্রশ্ন করবি না,আমি কিছু বলতে চাই না।ওদিকে ওর কি হয়েছিল,কেন আজ জেসমিন ইটালিতে,সে কথা না জানলে রাইফের শান্তি হচ্ছে না,মনের ভেতর বারবার খচখচ করছে। জেসমিনকে যতই রাইফ জোর করছে,জেসমিন তত ক্ষেপে যাচ্ছে।এক সময় জেসমিন চিৎকার করে ওঠে,

“তোকে কতবার মানা করলে বুঝবি যে আমার তোর সাথে এই টপিকে কথা বলা পছন্দ না?!আমি চাচ্ছি না!কেন আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করতেছিস! একটা মানুষকে জোর করার মানেটা তো বুঝলাম না! তোর এত শখ থাকলে নিজে খোঁজ নিতি,তাহলেই তো আজ এভাবে খোঁচানো লাগত না আমাকে! আর আমার চার বছরের হিস্ট্রি জেনে তুই কি করবি?তুই তো সবসময় নিজের মতই ব্যস্ত নিজে যেখান থেকে পারিস জেনে নে,কিন্তু আমাকে যেন এরপর আর এই নিয়ে কোন প্রশ্ন করতে না শুনি!!”

মুখের উপর খট করে লাইন কেটে দেয় জেসমিন।রাইফ বুঝতে পারেনি যে এত বড় এটম বোম্ব ফাটবে ওর এই কৌতূহলের কারণে।ও বারবার কল দিত্র থাকে,কিন্তু যতবারই কল যায়,একজন ইটালিয়ান নারী কনকন করে বলে যে ওপাশের লাইনটি বন্ধ আছে।রাইফ দ্রুত টেক্সট পাঠায়,সেটাও “waiting to deliver” লিখা আসে।রাইফ এরপর ফেসবুকে বসে অনেক কিছু লিখে,মাফ চায়,আর কখনও এসব বলবে না বলে টেক্সট পাঠায়।সব চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হাত পা ছড়িয়ে ভাবতে থাকে, “এটা কি হল?!”

তখন থেকে জেসমিন রাইফকে এভোয়েড করতে শুরু করে।কল দিলে কল ধরে না,টেক্সট এর রিপ্লাই দেয় না ফেসবুকে, ইন্সটাতে,বা টুইটারে।জেসমিনের কাছে রিজেক্ট হতে হতে দুদিন পার হয়।রাইফ আর পারে না,এত শক্ত পুরুষ হয়েও কান্না কান্না লাগে,সব ভেঙে ফেলতে মন চায়।আজকাল কাজেও মন বসে না।ওর বস এসে কয়েকবার ঝাড়ি দিয়ে গিয়েছে,যদিও এসব নিয়ে রাইফের কোন মাথা ব্যথাই নেই।সে শুধু ভাবে,জেসমিনকে কিভাবে মানাবে!!

তৃতীয় দিন কাজ শেষ করে এসে সমুদ্রের পাড়ে বসে জেসমিনকে কল দেয়।প্রথম কল জেসমিন কেটে দেয়,দ্বিতীয় কলটাও কেটে দেয়,তৃতীয় বার ওর ফোন অফ দেখায়।রাইফের ইচ্ছা করে ফোন ছুঁড়ে ফেলে দিতে,সাথে জেসমিনের চিন্তাও!এই মেয়ের এত ভাব বেড়ে গেল কেন!ও নাহয় জানতে চাইল,আর তাতেই এত রিএকশন দেখাতে হবে?পরে তো রাইফ সরিও বলেছে,তবুও কেন এত দূরত্ব সৃষ্টি? এত এড়িয়ে চলা?! নাকি রাইফের সরির কোন দাম নেই?! এখন কি এই চার বছর কেন যোগাযোগ রাখল না,তার জন্যে বাকি জীবনটাও কি যোগাযোগ রাখবে না??

কিছুতেই ওকে মন থেকে বের করতে পারে না রাইফ।রাগে চুল টানতে টানতে কাছাকাছি একটা পাবে ঢুকে যায়। পাবে গিয়ে বসে একটা হুইস্কি অর্ডার করে।গত চার বছরে একাকীত্বের কারণে মাঝে মাঝেই দুচারবার এসব গলধকরণ করা হয়েছে।যখন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না,কষ্টগুলো বুকের মাঝে চেপে বসে,তখন হুইস্কি খায়।হুইস্কি খেলে নিজেকে খানিকটা হাল্কা মনে হয়।মনে হয় জগতের অন্যান্য সব কিছু শেষ হয়ে যাক তাতে ওর কিছু আসে যায় না।আজও কয়েক পেগ খাওয়ার পর মাথাটা হাল্কা বোধ হচ্ছে।সামনে এক মেয়ে এসে ওয়াইন অর্ডার করল।ওর দেখাদেখি রাইফেরও মনে হল একটু ওয়াইন খাবে,তাতে মনে হয় আরো ভাল লাগবে।রাইফ হাত তুলল বার টেন্ডারকে ডাকার জন্যে,তখনই ফোনে ক্রিং করে আওয়াজ হল। পকেট থেকে বের করে দেখে,সাবিনা নক করেছে ওকে।বিরক্ত হয়ে ফোনটা আবার পকেটে রাখতে গিয়ে মনে হল,সাবিনাকেই তো জেসমিনের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা যায়!
ওকে অনলাইন দেখে কল দেয়,

“কিরে,কেমন আছিস?”
“আমি তো ভালই আছি,তোর খবর কি রে?”
“ভাল না”
“সে কি!কি হয়েছে?অসুস্থ তুই?কন্ঠ শুনে কেমন ভার ভার লাগছে”
“তা বলা যায়,যদি মনের রোগকে কোন রোগ ধরিস,তবে!”
“মনের রোগ? তুই হেঁয়ালি করা আর ছাড়লি না!সোজা করে বল তো কি হয়েছে?”
“কি আর হবে!তোর বান্ধবী জেসমিন…”
“জেসমিন?ও আবার কি করল?তোদের মাঝে না প্রায়ই কথা হয়?”
“আরে কথা শেষ তো করত্র দিবি! তোর বান্ধবী জেসমিন আমাকে নাকানিচোবানি খাওয়াচ্ছে!”
“কিভাবে!”
“ও সেই যে সিসিলিতে আসল,তারপর থেকে তো প্রতি রাতেই কথা হয়।কিন্তু গত তিন দিন ধরে ও আমার সাথে কিছুতেই কথা বলছে না”
“কেন?”
“কারণ আমি ওর চার বছরের অতীত জানতে চেয়েছি!”
“মানে?!চার বছরের কিসের অতীত?”
“আমি ইটালিতে যখন চলে আসি,তারপর থেকে ওর সাথে আমার কোন যোগাযোগই তো ছিল না।ওর জীবনে নাকি অনেক কিছু ঘটে গেছেতখন,সেসবের কারণে ও ,সে বলবে না!আমাকে নাকিহিতে বিপরীত হয়ে গেল!আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ! আমি পরে সরি বললাম,তবুও লাভ হল না!আমাকে একটা কথা বল তো, যদি আমি সত্যিই ওর বন্ধু হয়ে থাকি,আমাকে ও কাছের মানুষ ভেবে থাকে,তাহলে কেন আমাকে বলা যাবে না?আমি কি জানতাম ওর জীবনে কি চলছে?আমি যদি ইচ্ছা করে ওর বিপদ জেনেও দূরে থাকতাম,তাহলে ও আমার সাথে এমন করতে পারত! তুই তো জানিস আমি কেমন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গিয়েছিলাম।এখানে আমার দোষ কোথায় বলবি?এগুলো কি বাড়াবাড়ি না??আমার উপর, শুধু আমার উপরই এত অভিমান কেন??!!”

ওপাশ থেকে সাবিনা “হুম” বলে চুপ করে থাকে।একটানা এতগুলো কথা বলে রাইফ কিছুটা হাঁপিয়ে যায়।ওর হার্টবিট বেড়ে গেছে।বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে আবার বলে,
“চুপ করে আছিস কেন?আমি কিছু ভুল বলেছি?”
সাবিনা আস্তে করে বলে,
“তুই আসলে জেসমিনকে ভুল বুঝছিস”
“কি!ভুল বুঝছি?তাও আবার আমি? আমাকে ও এই একটা কারণে ভুল বুঝতেছে,তার তুইও উল্টো বলছিস?!”
“আমি উল্টো বলছি না।আসলেই তুই ভুল বুঝছিস।একটু ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখ তো,জেসমিনের তোকে এসব না বলার অন্য কোন কারণও তো থাকতে পারে,পারে না?”
“যেমন?”
“এমন হতে পারে না যে ও তোকে বলতে চাচ্ছে না তা না,ও আসলে তোকে বলতে পারছে না?”
“না পারার কি আছে?আমি কি ওকে মারব?”
“হয়ত মারবি না,কিন্তু ঘৃণা তো করতে পারিস!”
“ঘৃণা কেন করব?প্লিজ,ক্লিয়ার কর!আমার ভাল লাগছে না!এমন কি হল যে আমি ওকে ঘৃণা করব?!”

সাবিনা ধীরে ধীরে ওকে সংক্ষেপে সব খুলে বলল।জেসমিনের পুলিশে নিয়ে যাওয়ার কথা,জেলে থাকার কথা শুনে,তাও আবার বাংলাদেশের জেলের কথা শুনে রাইফের নিশ্বাস আটকে যাবার যোগাড় হয়।এতটা কষ্ট সহ্য করেছে এই মেয়ে? সত্যিই তো,এ কারণেই ও রাইফকে কিছু জানাতে পারছিল না! আসলেই রাইফ জেসমিনকে ভুল বুঝেছে।সব শোনার পর রাইফ আরো অস্থির হয়ে যায়।

“দোস্ত,আমি জেসমিনকে ভালবাসি!”
“সত্যি?!”
“হ্যাঁ!”
“দেখ রাইফ,এইসব কথা শুনে যদি ওর প্রতি সিম্প্যেথী কাজ করে,আর তাকে তুই ভালোবাসা ভাবিস,তবে বিরাট ভুল করছিস!”
“না না,বিশ্বাস কর,আমি ওকে আগে থেকেই ভালবাসি! ও যেদিন এখান থেকে চলে যায়,আমি সেদিনই বলেছিলাম! কিন্তু ট্রেনের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ও শোনে নি।এরপরে আমি যে কতবার বলার চেষ্টা করলাম,কিন্তু মুখ থেকে বেরুল না!”

সাবিনা খুশিতে ওপাশে হাত তালি দিয়ে ওঠে,
“সত্যিই দোস্ত!তোরা তাহলে একজন আরেকজনকে ভালবাসিস!ওয়াও!!”
“একজন আরেকজনকে মানে?”
“মানে ঐ…কিছু না আর কি… তুই কবে ওকে প্রপোজ করবি?!”
“প্রপোজ?জানি না।ও তো কল ধরছেই না!দাঁড়া দেখি কি করা যায়!”

রাইফের নেশা কেটে গেছে।সে ঊর্ধ্বশ্বাসে পাব থেকে দৌড়ে বের হয়।

গন্তব্য রাইফের জন্য অপেক্ষা করছে!

লেখনীতে, #AbiarMaria

**দেরী হল, তাই বড় করে পুষিয়ে দিলাম**

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here