আমার_হৃদয়ে_সে #রোকসানা_আক্তার পর্ব-২১

0
622

#আমার_হৃদয়ে_সে
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-২১

৩১.
জার্নাল হাউজের পাশে “কুকিং ফুড” নামের একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছি।কথা ছিল জার্নাল হাউজের সামনে সাক্ষাৎ করবো।কিন্তু হৃদয় নামের ছেলেটি পরে আবার মেসেজ করে বললো “কুকিং ফুড” রেস্টুরেন্টে দেখা করবে।”জার্নাল হাউজ”পাবলিক প্লেস।ওখানে সাক্ষাৎ করা সুবিধের না!তাই এখানেই আসলাম।সামনে অনেকগুলো হলদে কালারের বড় ড্রিম লাইট।সেগুলো খানিকক্ষণ পর পর টিমটিম করে জলছে আবার তা আপনাই বন্ধ হয়ে আবার সেখান থেকে নীল আলো জলে উঠছে।ভাবলাম লাইটটায় শুধু হলদে আলো এবং নীল আলোয় সংমিশ্রণে।কিন্তু না।সময়টা ধীরে ধীরে বিস্তৃতহতে ড্রিম লাইটগুলোতে লাল,সবুজ,আকাশি আরো অনেক কালার জলে উঠছে।এধরনের লাইট সবগুলো ডাইনিং এ খুব পরিপাটি ভাবে সাঁজানো।আমি লাইটগুলোর দিকে বেশ খানিকক্ষণ হলো তাকিয়ে আছি।তাকানোর মাঝে “অপেক্ষা” নামক শব্দটা বারংবার মস্তিষ্কে ঠুকরে উঠতে টাইম দেখে নিচ্ছি।অপেক্ষা সেই ছেলেটির জন্যেই।এখানে এসে বসেছি মিনিট বিশেক হবে।অথচ ছেলেটি এখনো আসছে না।বিরক্তি লাগে যে নি এমন নয়।বিরক্তি ত অবশ্যই লাগছে।মন চায় এখুনি উঠে বাসায় ফিরে যাই।

“এক্সকিউজ মি?”

ভাবনার গোচর কেঁটে যায়।তরহর পেছনে ফিরি।তাকিয়ে হৃদয় ছেলেটি।যাক এসে পড়লো।একটু বৈচিত্র্য হাসলাম।তবললাম,

“বসুন।”

ছেলেটি আমার সামনের চেয়ারটায় বসলো।বসতে বসতে বললো,
“আসলে খুব জ্যাম পড়েছিল। তাই লেট হয়ে গেছে।আপনি নিশ্চয়ই আমার উপর রেগে গেছেন।তাই না?”
“জ্বী না।রাগি নি।”
“থ্যাংকস।”

বলে হাসলো।আমিও তাল মিলিয়ে হেসে নিলাম।তারপর ছেলেটি চারপাশে তাকালো।হয়তো ওয়েটারকে খুঁজছে।আমি বললাম,
“ওয়েটারকে খুঁজতে হবে না।আমি কিছু খাবো না।আপনার সাথে কিছু কথা বলে আমি বাসায় ফিরে যাবো।”
“এত কম সময় নিয়ে এসছেন তা মানছি না,ম্যাম।আপনি আমার গেস্ট।কত রিকুয়েষ্টের পর আপনার সাথে দেখা করার সৌভাগ্য হলো।যদি কিছু না খান। রিয়েলি খুব হার্ট হবো।”
“দেখুন ব্যাপারটা তা নয়।আমার খেতে ইচ্ছে করতেছে না।তাছাড়া আসার সময় আমি পেট ভরে খেয়ে এসেছি।সো এখন এক্সট্রা কিছু খাওয়ার একদম ইন্টারেস্ট নাই।এবার আপনি আমার কথা শুনুন….!”

ছেলেটি সরু চোখে আমার দিকে তাকালো।আমি এবার হালকা নড়ে স্বাভাবিকভাবে বসলাম।মুখে আবার আগের সেই হাসিটুকু টেনে বলতে থাকলাম,
“শুনলাম আপনি আপনার মাকে নিয়ে খালামণির কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন?”

সরাসরি প্রশ্নে ভাবলাম ছেলেটি কিছুটা হলেও অসংযত হয়ে যাবে বা লজ্জা পাবে।কিন্তু না।ছেলেটির মাঝে তেমন ভাবান্তর দেখা হলো।বরঞ্চ সে আগের থেকে এখন আরো স্বাভাবিক।স্বাভাবিক ভাবেই জবাব দিলো,
“জ্বী।”
“কতটুকু জানেন আমাকে?”

ছেলেটি মৃদু হাসলো।বললো,
“তেমন জানি না।তবে জানার ইচ্ছেও নেই।জীবনে এই প্রথম আমার কোনো মেয়েকে ভালো লাগলো।কত মেয়েকে দেখলাম।কত মেয়ের সাথে স্কুল,কলেজ,ভার্সিটির গন্ডি পেরুলাম।আজ পর্যন্ত মনের মতন তেমন কাউকেই পাই নি শুধু আপনাকে ছাড়া!!যদি বলি রূপ দেখে ভালো লেগেছে তা একদমই ভুল।মানুষ মানুষের রূপের প্রেমে পড়ে।আমি তা নই।আপনি খুব বেশি রূপবতী না।অবশ্যি আপনি মায়াবী।আপনার এই মায়াবীকতারই প্রেমে পড়েছি বলতে পারেন।”
“এক দেখায়,একবার কথায় ব্যাপারটা কেমন অবিশ্বাস্য না?মানে কেউ কাউকে এক দেখায়,একবার কথা বলে কীভাবে বুঝতে পারে সেই মানুষটা মায়াবী?আচ্ছা,আপনার আইকিউ ভালো?”
“তা অবশ্যি জানি না।তবে,আপনার চোখের দিকে তাকালেই মনে হয় আপনি ভীষণ মায়াবী।হুমায়ুন আহমেদের একটা উপন্যাসে পড়েছিলাম, মায়াবী মেয়েদের চোখ আয়তলোচন।আপনার চোখও তাই।”

হাসি চলে এলো।
“ভারী রসিক মানুষ আপনি।”
“নো ম্যাম,আমি রসিকতা করছি না।আমি সত্যি বলছি!”
“বুঝলাম সত্য বলেছেন।তবে আমার ব্যাপারে আপনি ভালোভাবে না জেনে,না শুনে আমাকে পছন্দ করেছেন,বা ভালো বেসেছেন অথবা যেটাই করেছেন সে প্রেক্ষিতে আমি বলছি আপনার তা একদমই উচিত হয়নি!”
“আন্টির থেকে শুনলাম আপনি এখন বিয়ে করতে রাজি না।আসলে কারণটা কী?”
“বিয়ে তো আমার হয়েছে একবার!আবার নতুন করে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখবো কেন?”
“মানে?”

বলে ছেলেটি চোখ বড় করে তাকালো।আমি নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করলাম।খুব জোরে শ্বাস ছাড়লাম।কুটিল হাসলাম।বললাম,
“আমি ডিভোর্সি!আপনি ভুল করেছেন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যেয়ে।ভালো থাকবেন।আসি।”

ছেলেটি আগের মতনই বসে।বলে উঠলো,
“চলে যাবেন!কিছু তো খেয়ে যান।”

আমি ছেলেটির কথা আর কানে নিলাম না।চেয়ার ছেড়ে সুড়সুড় করে বেরিয়ে এলাম।বাসায় ফেরার পর দুইঘন্টার মতন মুড অফ ছিল।খালামণি,আঙ্কেলও তা দেখলেন।বুঝলেন আমার মুড অফ হওয়ার ব্যাপারটা।কিছু বললেন না।নিরবে দেখে গেলেন। উনারা জানেন আমি আজ হৃদয় নামের ওই ছেলেটির সাথে দেখা করেছি।এবং আমার সব বায়ো তাকে বলে দিয়েছি।তাই আমাকে আর কীভাবেঃ সান্তনা দিবেন।কতভাবেই ত দিয়েছেন এ পর্যন্ত।

৩২.
রাত ন’টার দিকে খালামণির খাবারের ডাক আসে।আমি বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে ঢুকলাম।মুখে কয়েক কোষ পানি ঝাপটা দিয়ে নিজেকে হালকা করলাম কিছুটা।তবে মাথাব্যথা টা চরম লেভেলে।টেবলেট খেতে হবে একটা।ফ্রেশ হয়ে এসে বাইরে এলাম।আঙ্কেল, ফাহিম চেয়ারে বসেছে।আমি ডাইনিং এ যেতেই খালামণি আমার হাত ধরে টেনে আরেকটা চেয়ারে বসান।ভাতের প্লেট সামনে এগিয়ে দেন।

“ইলিশ মাছের ভুনা,টাকি মাছের ঝোঁল, সালাদ,সবজি সব আছে তোর যা ভাল্লাগে খা।”
“খালামণি তোমার মাথাব্যথার ওষুধ আছে?”

খালামণি আঁতকে যাওয়ার মতন হয়ে গেলেন।কপালে,চোখে,মাথায় হাত রেখে বলেন,
“কপাল টা তো গরমে খুব পুড়ছে!কখন থেকে তোর মাথাব্যথা?”

আঙ্কেল পাশ থেকে বলে উঠেন,
“জ্বর উঠেছে?”
“তাপমাত্রা ত তাই বলতেছে।তোমার থার্মোমিটারটা কোথায়?”অস্থির হয়ে।
“টেবিলের উপরে পেন ঝুঁড়িতে দেখো।সেখানে পাবে।”

খালামণি হর্ণ পায়ে ছুট লাগালেন রুমের দিকে।ত্রিশ সেকেন্ডের মাথায় থার্মোমিটার হাতে ফিরে এলেন।হা কর।জ্বরটা আগে মেপে নিই!
“উফস, খালামণি কি শুরু করেছো, তুমি?সারাদিন বাইরে ছিলাম তাই রোদে,গরমে একটু তাপমাত্রা বেড়ে গেছে।সেকারণে হালকা মাথাব্যথা করছে।এইতো।”

আঙ্কেল পাশ থেকে বলে উঠেন,
“রাহেলা?ও আগে খেয়ে নিক?তারপর নাহয় দেখো?”
“তুমি চুপ করো।তুমি এই মেয়ের ব্যাপারে জানো?এই মেয়ে ইদানীং নিজের কোনো যত্নই করছে না।কে জানে জ্বরটর যদি হয়েই থাকলো, তখন?পারিসা তুই হা কর।আমি মেপে দেখি তাপমাত্রা আসলেই ঠিক আছে কি না।প্লিজ হা কর মা আমার!”

মন গলানো কথা!পারলাম এই মহিলার কথার অবাধ্য হতে?হা করতেই হলো।খালামণি থার্মোমিটার টা কিছুক্ষণ মুখের ভেতর রেখে তারপর আবার বের করলেন।চেক করলেন।চেক করার পর কিছু বললেন না।কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেলেন।থার্মোমিটারটা জ্যাকেটে ঢুকাতে ঢুকাতে গম্ভীরা মুখে বললেন,

“পারিসা?খেয়ে নে।”

আমি আর খালামণিকে কিছু না জিজ্ঞেস করে খাওয়ায় মন দিলাম।খাওয়া শেষ হলে বেসিনে হাত ধোঁয়া শেষ হলেই খালামণি আবার বলে উঠেন,
“রুমে যা তোর।আমি আসতেছি কিছুক্ষণ পর।”

রুমে আসার পর বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা হাতে নিলাম।মেসেন্জারের চ্যাটলিস্টের প্রথমেই ওই ছেলেটার দেখলাম।ছেলেটা এখন অনলাইনে।আমি আর দেরী করলাম না।খামোখা ছেলেটার সাথে আমার ইনবক্সে এড রাখার মানেই হয় না।ওমনি ব্লক লিস্টে পাঠিয়ে দিলাম।ফেসবুক থেকেও ব্লক করলাম।তারপর ফোন নাম্বারও।এরমাঝে খালামণি ঢুকলেন।তাও খালি হাতে না।ওষুধের অনেকগুলো প্যাকেট নিয়ে।আমি চোখ বড় করে ফেললাম।বললাম,
“মাথাব্যথার জন্যে এত ওষুধ লাগে?”

খালামণি আমার কথার উত্তর না দিয়ে ওষুধগুলো সোঁজা টেবিলের উপর রাখলেন।তারপর আবার আমার দিকে ফিরে চোখমুখ কেমন মলীন করে ফেললেন।আমি এগিয়ে গেলাম,
“কি হয়েছে,খালামণি?তোমার মন বোধহয় খারাপ?”

খালামণি চুপ করে থাকলেন।চল্লিশ সেকেন্ডের মতন পার হতেই বলে উঠলেন,
“ভালো কি আর থাকতে দিলি আমাকে?কতবার বললাম ওই অভিটভি সব ভুলে যেতিস!ওসব খারাপ কিছু ভেবে কী লাভ?যেটা হয়ে গেছে সেটা ত হয়েই গেছে।সেটা কেন বারবার মনে করে নিজের শরীরের অবস্থা খারাপ করতেছিস!কেন?!”
“মানে খালামণি?কি হয়েছে?”
“কী হয়েছে?জ্বর হয়েছে কেন তোর?”
“জ্বর হয়েছে?”
“একশো দুই ডিগ্রী তোর শরীরের তাপমাত্রা এখন।নিজের খেয়া রাখিস তুই?”

মাথা নুইয়ে ফেললাম।আসলে সত্যি আমি বুঝতে পারছি না আমার শরীর এত গরম!ভাবনার মাঝে খালামণি বলেন,

“ওষুধগুলো দিচ্ছি খেয়ে নে।ওষুধ খাওয়ার পর শুয়ে পড়িস।আমি মাথায় জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছি।”
বলে খালামণি টেবিলের উপরে রাখা সবগুলো টেবলেটের পাতা থেকে একটা একটা করে টেবলেট হাতে নিয়ে এবং জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে মুখের সামনে আনেন।
“ওষুধ গুলো খা।”

খালামণির হাত থেকে গ্লাস নিয়ে সবগুলো ওষুধ খেলাম।তারপর শুলাম। শোয়ার পর খালামণি মাথায় জলপট্টি দিলেন। সারা শরীর শীতে শিরশির করে উঠলো।গাঁয়ের।পশম কাঁটা দিলো।সাথে কাঁপনও খুব।খালামণি ওমনি সারা শরীর কম্বলে ঢেকে দিলেন।আমি কম্বল নিজেকে মুড়িয়ে চোখ বুঁজলাম।কাহিল,দুর্বল,অচেতন শরীরে কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম টের পেলাম না।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here