উধয়রনী #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-১১||

0
361

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-১১||

১৬।
আহির দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরে আছে তাজওয়ার। আহি তাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেও পারছে না। তাজওয়ার আহির কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,
“তুমি আমার কাছে খুবই স্পেশাল, আহি। এতো সহজে আমি তোমাকে পেতে চাই না। ধীরে ধীরে তোমাকে নিজের করে নেবো। তোমার বাবার কাছে হয়তো তুমি ইনভেস্টমেন্ট। কিন্তু আমার কাছে ডায়মন্ড।”

আহি তাজওয়ারকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
“তোমার মতো অসভ্য লোকেদের কাছে সব মেয়েরাই ডায়মন্ড। তোমাকে আমি অনেক ভালো করে চিনি, তাজওয়ার খান। তুমি আমাকে তোমার কথার জালে ফাঁসাতে পারবে না।”

“আহি, তুমি আমাকে মানুষ হিসেবে চিনেছো, প্রেমিক হিসেবে চিনো নি। অন্যদের কাছে আমি অসভ্য হলেও তোমার কাছে আমি বরাবরই সভ্য। তুমি মানতে না চাইলে আমার কিছুই করার নেই। তবে মনে রেখো, আমি তোমাকে যে-কোনো মূল্যেই চাই।”

তাজওয়ার কথাটি বলেই আহির গালে তার অধর স্পর্শ করতে যাবে তখনই আহি তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। তাজওয়ার তাল সামলাতে না পেরে দেয়ালের সাথে ঠেকে গেলো। সে আহির দিকে কিছুক্ষণ ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটিয়ে বলল,
“যেই জিনিস আমার ভালো লাগে, তা আমি নিজের করেই ছাড়ি। এর জন্য যদি আমাকে তার ক্ষতি করতে হয়, আমি একবারো ভাববো না।”

আহি দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “আমি মানুষ, কোনো পণ্য নই।”

তাজওয়ার রুমের বাইরে এসে দরজা টেনে দিতে গিয়ে আবার খুলে বাঁকা হেসে বলল,
“তুমি আমার পণ্য। আমি তোমাকে কিনে নিচ্ছি। মাইন্ড ইট।”

তারপর ধড়াম করে দরজা আটকে দিয়ে চলে গেলো। তাজওয়ার চলে যেতেই আহি দৌঁড়ে এসে ভেতর থেকে দরজা আটকে দিলো। এরপর দরজা ঘেঁষে মেঝেতে বসে পড়লো। সবকিছুই তার শূন্যের উপর ভাসছে। কোন উদ্দেশ্যে সে পৃথিবীতে এসেছে, সেটা সে নিজেই জানে না। বাবা সন্তানের রক্ষক হয়। আর তার বাবা একজন কাপুরুষ। হাঁটুতে কপালে ঠেকিয়ে আহি ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। হয়তো কাঁদার জন্যই তাকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে।

(***)

তাজওয়ার খান আহির বাবা রিজওয়ান কবিরের বাল্যবন্ধু সিরাজ খানের ছোট ছেলে। সিরাজ খান নিজেই অনেক বড় ব্যবসায়ী। আবার তার দুই ছেলে সরওয়ার খান আর তাজওয়ার খানের আলাদা ব্যবসা আছে। বংশগত ঐতিহ্যকে ডুবিয়ে দিয়ে তারা অসৎ উপায়ে কোটি কোটি টাকা আয় করেছে। সিরাজ খান দেশে দূর্নীতি মামলা খেয়ে আমেরিকায় পলাতক আছেন। প্রায় দশ বছর ধরে তিনি দেশেই আসেন নি। স্ত্রী রেহানা খানকে রেখেই তিনি পালিয়েছেন৷ বর্তমানে আমেরিকান মেয়েকে বিয়ে করে নতুন সংসার পেতেছেন। বিন্দাস চলছেন তিনি। অন্যদিকে তার বড় ছেলে সরওয়ার খান তার অর্ধেক বয়সী গরিব ঘরের এক মেয়েকে বিয়ে করে এনে দিন-রাত তাদের সংসারে খাটাচ্ছে। আহি মেয়েটিকে একবার দেখেছিল। নাম দোয়েল। মেয়েটা দোয়েলের মতোই সুন্দর দেখতে। কিন্তু দেখে মনে হবে না সে শিল্পপতির স্ত্রী। স্বামীর অবহেলায় তার সর্বাঙ্গে মলিনতা ছেয়ে গেছে। প্রতি রাতে সরওয়ার নতুন নতুন মেয়ে ঘরে এনে আমোদ-ফূর্তি করে। আর দোয়েল নীরবে অশ্রু মুছে। সরওয়ারের কাছের দুই বন্ধু ফারিদ আর কাইসারের কুনজর দোয়েলের দিকে সর্বদাই থাকে। স্বামীর কাছে কয়েক বার অভিযোগ করায় উলটো মার খেতে হয়েছে তাকে। সরওয়ার এমন নিচু স্তরের মানুষ যে তার বন্ধুদের এমন আবদারে তার কোনো আপত্তি নেই। তবে দোয়েল শাশুড়ীর কারণেই নিজের সম্মান রক্ষা করে এখনো সেই সংসারে ঠিকে আছে। শাশুড়ি না থাকলে অনেক আগেই সরওয়ারের বন্ধুদের কাছে নিজেকে সঁপে দিতে হতো তার। এদিকে তাজওয়ার খানও কোনো অংশে কম নয়। অনেকগুলো মেয়ের সাথেই তার প্রেমের সম্পর্কের গুঞ্জন মিডিয়াতে মাঝে মাঝেই প্রকাশ পায়। তাজওয়ারের বন্ধুগুলোও নামি-দামি পরিবারের বিগড়ে যাওয়া সন্তান। দুই বছর আগে সবকটার নামে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল। কিন্তু প্রভাব-প্রতিপত্তির জোরে তারা জামিন পেয়ে গেছে। পরবর্তীতে যেই মেয়ে এই মামলা করেছিল, তার পুরো পরিবার এখনো নিঁখোজ। বেশ কয়েক মাস ছাত্র-ছাত্রীরা প্লেকার্ড আর ব্যানার নিয়ে প্রতিবাদ করেছিল। কিন্তু এখন মেয়েটা কারো মস্তিষ্কেই আর বেঁচে নেই। নতুন-নতুন মশলাযুক্ত খবর এসে পুরোনো খবরগুলোকে দাফন করে দিয়ে গেছে। তবে তাজওয়ার সেই কলঙ্ক থেকে ভাগ্যক্রমে মুক্তি পেয়েছিল, কারণ সে বাবার সাথে দেখা করার জন্য সেই সময় আমেরিকায় গিয়েছিল। যদিও সে এই অঘটন ঘটিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল কি-না সেই বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

তাজওয়ার আর তার পরিবার সম্পর্কে এমন ভয়ংকর সব তথ্য আহি ভালোভাবেই জানতো। তাজওয়ার আহিকে ভালোবাসে কি বাসে না, এটা আহির কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো, এমন একটা ছেলেকে বিয়ে করে সে কোনো অনিশ্চিত ভবিষ্যতে পা দিতে চায় না। যদি সে আফিফকে ভালো না বাসতো, তবুও সে এমন একটা ছেলেকে বিয়ে করতে চাইতো না। এমনকি কোনো বাবাও নিজের মেয়েকে এমন পরিবারে বিয়ে দিতে চাইবেন না। কিন্তু আহির কপালে এমন মন্দ রেখার স্পর্শ পড়েছে যে তার কোনো দিক দিয়েই পালানোর পথ নেই।

(***)

গভীর রাত। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সুবর্ণ মঞ্জিলের বাইরে পাহারারত দারোয়ানরা ঝিমুচ্ছে। বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে বাড়ির ভেতরে সব বাতি নেভানো। জানালাগুলোও সব বন্ধ, শুধু একটা জানালা উন্মুক্ত। আর সেই জানালার বাইরে ঝুলছে ঘন কালো কেশগুচ্ছ। হালকা হাওয়ায় তা নৃত্য করছে। আর অন্ধকার রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটি অবয়ব সেই জানালার দিকে তাকিয়ে আছে।
আহি চোখ বন্ধ করে অনুভব করছে কেউ তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আচমকা তার কানের কাছে ভারী নিঃশ্বাস ধাক্কা খেলো। এবার আহির গলা কাঁপতে লাগলো। চোখ খুলবে কি খুলবে না এই নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে সে। আহি তার পাশে কারো উপস্থিতি টের পেতেই চোখ বন্ধ রেখেই আওয়াজ করতে যাবে তখনই সে তার ঠোঁটে আলতো স্পর্শ পেলো। কেউ তার অধর জোড়ায় আঙ্গুল ছুঁয়ে দিয়েছে। এবার আহির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করলো। তার বুকটা ধরফর করছে। নিঃশ্বাস যেন আটকে আছে। আহি বুঝতে পারছে তার সাথে কি হচ্ছে, কিন্তু সে নিরুপায়। হঠাৎ সেই সুধাময় সুর তার কানে ফিসফিসিয়ে বলল,
“তুমি এসেছো? আমি তোমার অপেক্ষায় কতো রাত জেগেছি। আমাকে ফেলে কেন চলে গিয়েছিলে? তুমি কি জানতে চাও না, আমার উত্তর? জানতে চাও না, তোমাকে নিয়ে আমার অনুভূতি?”

আহি জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। তার শরীর যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে। বালিশ শক্ত করে চেপে ধরে চোখ খুললো আহি। চোখ খুলতেই সব আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে গেলো। অন্ধকার ঘরে আহি ছাড়া কেউ নেই। মাথা তুলে জানালার বাইরে তাকালো আহি। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলো ঠিকই জ্বলছে। রাস্তায় কোনো অবয়ব নেই। পাহারাদাররা নিষ্ঠার সাথে তাদের দায়িত্ব পালন করছে। নীরব পরিবেশে দুই পাহারাদারের কথোপকথন হালকা গুজন সৃষ্টি করেছে। তাহলে এতোক্ষণ পুরোটাই কি আহির স্বপ্ন ছিল? আহি ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। এ আর নতুন কি! গত চার বছর ধরেই সে মাঝরাতে আফিফের কন্ঠের স্বর শুনতে পায়। লন্ডনেও এমনটা হতো। তার সমস্যাটা রাদই প্রথমে ধরেছিল। লন্ডনে থাকাবস্থায় একদিন রাতে আহির খুব জ্বর এসেছিল। সে বিছানা থেকে উঠতেই পারছিলো না। তাই রাদকে বাসায় আসতে বলেছিল। সেদিন রাতে রাদ খেয়াল করলো আহি নিজের ঘরে একা একা কথা বলছে। আহির ঘরে উঁকি দিতেই রাদ দেখলো আহি এমনভাবে কথা বলছে যেন সামনে কেউ বসে আছে। আফিফের ব্যাপারটা রাদ সেদিনই জানতে পেরেছিল। পরবর্তীতে রাদ নিজেই আহিকে ডাক্তার দেখিয়েছিল। ডাক্তার জানিয়েছে, আহি সিজোফ্রেনিয়া নামক মারাত্মক মানসিক রোগে ভুগছে। তিনি শীগ্রই আহির চিকিৎসা শুরু করতে বলেছিলেন। কিন্তু আহি দ্বিতীয় বার আর সেই ডাক্তারের কাছে যায় নি। এমনকি রাদকে কড়া ভাবে জানিয়ে দিয়েছে, সে যদি না বলে তাকে কোনো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়, তাহলে তার সাথে সব সম্পর্ক শেষ করে দেবে। রাদ বুঝতে পেরেছে আহি মুখে যতোই বলুক, সে আফিফকে ভুলতে চায়। কিন্তু তার মন আফিফকে ভুলতে চায় না। বরং আফিফকে কল্পনা করেই আহি সুখে থাকে।

(***)

আহি চুপচাপ অন্ধকারে বিছানায় বসে আছে। সে তার হাত এগিয়ে দিয়ে বলতে লাগলো,
“এআর, আমার হাতটা একটু ধরো। আমার চেয়ে বেশি কেউ তোমাকে ভালোবাসবে না। আমার ভালোবাসাটা একটু বোঝো। সবে তো চব্বিশ চলছে আমার। আরো কতো যুগ পড়ে আছে। আমি চারটা বছর তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছি না। এতোগুলো যুগ কীভাবে পার করবো? ভালোবাসি, এআর। হয়তো তুমি সারাজীবন আমার কাল্পনিক প্রেমিক হয়ে থাকবে। তোমাকে একটু ছুঁয়ে দিতে গেলেই তুমি মেঘের মতো মিলিয়ে যাবে। আমি তোমাকে ছুঁয়ে দেওয়ার জন্য ছুটতেই থাকবো। কিন্তু তুমি কখনো আমার স্পর্শ পাবে না।”

আহি জানালার পাশে এসে বসলো। দুই পা জানালার বাইরে বের করে দিয়ে এক দৃষ্টিতে ল্যাম্পপোস্টগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হারিয়ে গেলো অতীতে।

………………………….

এক বছরের বেশি সময় ধরে আফিফকে চেনে আহি। সেদিন মাধ্যমিক বিভাগের পরীক্ষা শুরু হয়েছিল। প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার সেই পরীক্ষাটা হতো। তাত্ত্বিক বিষয়ের পাশাপাশি চিত্রায়ণ, প্রাচ্যকলা, গ্রাফিক ডিজাইনের পরীক্ষা। কিন্তু আফিফ একটা পরীক্ষাও দেয় নি। আহি আফিফের সিটটা খালি দেখে মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষায় দিতে পারছিলো না। এক মাস পর মাধ্যমিক বিভাগের পরের সেশন শুরু হয়ে যায়। আর আহি তৃতীয় স্থান নিয়ে অন্য সেশনে ভর্তি হয়ে যায়। সে ধরেই নিয়েছিল আফিফকে দেখার জন্য তাকে পূর্ব সেশনের ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। কিন্তু তার ভাগ্য ভালো ছিল। আফিফ দ্বিতীয় সেশনেই ভর্তি হয়েছে। এরপর স্যার এসে সবাইকে বলল, আফিফের বড় বোন মারা যাওয়ায় সে পরীক্ষা দিতে পারে নি। পরে সে চারদিনের মধ্যে আলাদা ভাবে পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় সেশনে ভর্তি হয়েছে। সেদিন আফিফের মুখটা আরো বেশি ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। সে চোখ তুলে কারো দিকে তাকায় নি। মনে হচ্ছে সে মারাত্মক অপরাধী। এভাবে দু’মাস কেটে গেলো। শীগ্রই ক্যালিগ্রাফির প্রদর্শনী মেলা শুরু হবে। চারুশিল্পে প্রায়ই মেলা হয়৷ ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেদের আঁকা ছবি বিক্রি করে টাকা আয় করতে পারে। বেশি ছবি বিক্রি করতে পারলে চারুশিল্প থেকেই তাকে পুরষ্কৃত করা হবে।
আফিফ দুই সপ্তাহ ক্লাসে না এসে সেই মেলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। দুই সপ্তাহ পর মেলায় আটটা ক্যালিগ্রাফি নিয়ে এলো আফিফ। প্রতি ক্যালিগ্রাফির দাম পাঁচশো টাকা। নিঁখুত ভাবে সে এঁকেছিল। রঙের মিশ্রণটাই বেশি সুন্দর ছিল। সালমা ফাওজিয়াও মেয়ের সাথে মেলায় এসেছিলেন। আহি তার মাকে বার-বার আফিফের ক্যালিগ্রাফিগুলো কিনে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছিলো। এতো টাকা আহির হাতে সেই মুহূর্তে ছিল না। সে অন্তত একটা কিনতে পারবে। কিন্তু সালমা ফাওজিয়া তো মেয়ের অস্থিরতা বুঝতে পারছিলেন না। তিনি মেলায় ঘুরতে ব্যস্ত। আহি শেষমেশ নিজেই আফিফের স্টলের সামনে এসে বলল,
“আমি একটা কিনতে চাচ্ছি।”

আহির কন্ঠ শুনে আফিফ তার দিকে তাকালো। এই প্রথম তাদের চোখাচোখি হলো। আফিফের চোখাচোখি হতেই আহির অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। আফিফ নিজের হাতে কাগজে মুড়িয়ে আহিকে ক্যালিগ্রাফিটা দিয়ে দিলো। যতোক্ষণ আফিফ কাগজ ক্যালিগ্রাফিটা বাঁধায় ব্যস্ত ছিলো, ঠিক ততক্ষণ আহি তার দিকে তাকিয়ে ছিল। এতো কাছ থেকে আফিফকে দেখার সুযোগ সে হাতছাড়া করতে চায় নি। আহি ছয়শো টাকা দিয়ে চলে যেতে নেবে তখনই আফিফ পিছু ডেকে বলল,
“আপনি একশো টাকা বেশি দিয়েছেন।”

আহি আফিফের চোখে চোখ রেখে বলল,
“মাত্র পাঁচশো টাকা দিয়ে বিক্রি করছেন? এর মূল্য তো এর চেয়ে বেশি হওয়া উচিত।”

আফিফ নিরুত্তর ছিল। আহি মনে মনে বলল,
“আমার কাছে তোমার প্রতিটা জিনিসের মূল্য অনেক বেশি, এআর। টাকা দিয়েও এর মূল্য ঠিক করা যাবে না।”

এবার আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আফিফকে বলল,
“আমি এমন ক্যালিগ্রাফি অনেক খুঁজেছি। কিন্তু কোথাও পাই নি। তাই একশো টাকা বেশি দিয়েছি। কারণ আমি যা খুঁজছিলাম, তা আপনার জন্য সময়ের মধ্যে পেয়ে গেছি।”

আফিফ প্রতিত্তোরে মুচকি হেসে ধন্যবাদ দিলো। আহিও পেছন ফিরে চলে এলো। আফিফের দিকে আর তাকানোর সাহস নেই তার৷ আজকের এই চমৎকার দিন আহি কখনো ভুলতে পারবে না। এদিকে সালমা ফাওজিয়া মেয়ের কর্মকান্ড দেখছেন। একটা ক্যালিগ্রাফি কিনে তার মেয়ে এতো খুশি? তাও আবার সেই ছেলের কাছ থেকে, যার কাছ থেকে এতোক্ষণ ক্যালিগ্রাফি কেনার জন্য আহি জোরাজোরি করছিল। সালমা ফাওজিয়া মেয়ের খুশির জন্য আফিফের সব ক’টা ক্যালিগ্রাফি কিনে নিলেন। সব বিক্রি হওয়ায় আফিফের চোখেও অশ্রু ভীড় করছে। আহি তা দেখে মায়ের কাছে এসে তার হাতের উলটো পিঠে চুমু খেয়ে বলল,
“থ্যাংক ইউ মা। তুমি অনেক ভালো।”

সালমা ফাওজিয়া মেয়ের থুতনি ধরে বললেন,
“ছেলেটা কে?”

আহি লাজুক হেসে বলল,
“এখনো তো কেউ না। কিন্তু ও অনেক ভালো। ভালো ছবি আঁকে। বলতে পারো অতি উত্তম।”

সালমা ফাওজিয়া ভ্রূ কুঁচকে বললেন,
“তুমি কি এই ছেলের জন্য নামাজ ধরেছিলে?”

আহি মাথা নেড়ে বলল,
“হ্যাঁ, ও তো মসজিদে গিয়ে পড়ে। আমি দেখেছি, মা। ও বাবার চেয়েও ভালো। আমায় কখনো মারবে না।”

সালমা ফাওজিয়া মেয়ের কথায় থমকে গেলেন। আহিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
“এভাবে বলে না, মা। তুমি আমার শাহজাদী। তোমার জীবনে যে আসবে সে তোমাকে সম্রাজ্ঞীর মতো রাখবে।”

(***)

আহি মায়ের সাথে বাসায় ফিরলো না। মায়ের হাতে ক্যালিগ্রাফিটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, সে পরে বাসায় আসবে। সালমা ফাওজিয়া বাসায় ফিরে গেলেন। আহি আফিফের অপেক্ষায় বসে আছে। আফিফের সবগুলো চিত্র বিক্রি হয়েছে, তাই সে স্যারের সাথে কথা বলতে গিয়েছিল। স্যার তার নাম টুকে নিয়েছেন। আফিফ আজ ভীষণ খুশি। সে খুশি মনেই বের হয়েছে চারুশিল্প থেকে। আহিও তার পিছু নিয়েছে। আফিফ আজ বাসে উঠলো না। রাস্তার ওপাড়ে যেতে লাগলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে আফিফের যাওয়া দেখছে।
ব্যস্ত রাস্তা। ট্রাফিক পুলিশও দেখা যাচ্ছে না। চারদিক থেকে গাড়ি আসা-যাওয়া করছে। আহি এক দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে। অজানা ভয় তার মনে ভীড় করতে লাগলো। হঠাৎ চোখের পলকে একটা মিনি বাস এসে আফিফকে ধাক্কা দিলো। রাস্তা ব্যস্ত থাকায় গাড়ির গতি কম ছিল। নয়তো আফিফের শরীরটা হয়তো চাকার নিচেই পড়তো।
আহি এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়ালো না। দৌঁড়ে আফিফের কাছে গেলো। ততোক্ষণে রাস্তায় ভীড় জমে গেছে। মিনি বাসের ড্রাইভার যাত্রী রেখেই পালাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যাত্রীরাই তাকে ধরে রেখেছে। রাস্তায় একটা হট্টগোল শুরু হয়ে গেছে। আহি চেঁচিয়ে বলল,
“আগে ওকে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করুন।”

ভীড়ের মধ্যে আফিফের নড়নচড়ন না দেখে অনেকেই বলতে লাগলো,
“ছেলেটা হয়তো মারা গেছে।”

আহি আফিফের মাথাটা উঠিয়ে দেখলো মাথার পেছন থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। এভাবে রাস্তায় পড়ে থাকলে ক্ষতস্থানে সংক্রমণ হবে, তাই আহি আফিফের মাথাটা তার কোলে রাখলো। এরই মধ্যে আফিফকে উঠিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। আফিফের কাছে আজকে আয় করা টাকা আর একটা অল্প দামী ফোন ছিল। আহি সেখান থেকেই আফিফের মায়ের নম্বরে কল দিলো। তিনি বিশ মিনিটের মধ্যেই হাসপাতালে চলে এলেন।

(***)

আফিফের মাকে আহি প্রথম দেখছে। আহি তার হাতে আফিফের মানিব্যাগ আর মোবাইলটা দিয়ে বলল,
“আন্টি আমি উনার সাথেই চারুশিল্পে ক্লাস করি। আপনি চিন্তা করবেন না। উনি ঠিক হয়ে যাবেন।”

আফিফের মা, আফিফা বেগম আহির হাত ধরে কান্নাভেজা কন্ঠে বললেন,
“আমার ছেলেটা না বাঁচলে আমি শেষ হয়ে যাবো। ও ছাড়া আর কেউ নেই আমার।”

আহি আফিফা বেগমকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বলল,
“আংকেল….”

আফিফা বেগম বললেন,
“সে তো অনেক আগেই মারা গেছে। তিন সন্তানকে আমি একাই মানুষ করেছি। আফিফ আমার মেজো ছেলে। আমার বড় মেয়েটা মারা গেছে বেশি দিন হচ্ছে না। এখন আফিফের কিছু হলে আমি বাঁচবো না।”

আফিফা বেগম নিজেই কান্নার সুরে বিড়বিড় করতে লাগলেন,
“আমার ছেলেটা বোনের সম্মান বাঁচানোর জন্য এভাবে পাগলের মতো টাকা জোগাড় করছিল। এখন ওকে বাঁচানোর টাকা আমি কোথা থেকে জোগাড় করবো?”

আহি বেসরকারি হাসপাতালে আফিফকে নিয়ে এসেছিল। হাসপাতালে যেই পরিমাণ খরচ হবে, তা জোগাড় করতেই আফিফা বেগম হিমশিম খেয়ে যাবেন। আহি সেটা বুঝতে পেরে বাসায় এসে মাকে জানালো। সালমা ফাওজিয়া মেয়ের সাথে হাসপাতালে এসে আফিফা বেগমের অগোচরেই কিছু টাকা জমা করিয়ে দিলেন। বাকি টাকা আফিফকে রিলিজ দেওয়ার পর দিতে হবে। আর ওষুধের টাকা তিনি আফিফা বেগমকে নিজ হাতেই দিলেন।
আফিফা বেগম নিরুপায়। হাত পেতে চাওয়া তার পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু ছেলের জীবন বাঁচানো এই মুহূর্তে তার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই তিনি বিনাবাক্যে টাকাটা নিয়ে নিলেন। এখন আফিফের রিপোর্ট আসার পরই বোঝা যাবে তার অবস্থা কেমন।

এদিকে বাসায় আসার পর আহি তার পরণের জামাটা খুলে রেখে দিতেই সালমা ফাওজিয়া মেয়ের কাছে এসে বললেন,
“কি করছো, আহি? মুনিয়াকে জামাটা দিয়ে দাও। ও ধুয়ে দিক।”

আহি চকিত দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালো। সে কোনো ভাবেই এই জামা ধুতে দেবে না। আফিফের রক্ত তার জামায় লেগে আছে। এই জামায় আফিফের স্পর্শ আছে। সে এটাতে ছিঁটেফোঁটা পানিও লাগাবে না। সালমা ফাওজিয়া মেয়ের হাত ধরে বললেন,
“আমার মনে হয় না তোমার বাবা এই সম্পর্ক কখনো মেনে নেবেন। আর তুমি এখনো ক্লাস টেনে পড়ো। তুমি অনেক ছোট। আগে বড় হও। তারপর এসব নিয়ে ভেবো।”

আহি মায়ের হাত ধরে বলল,
“আমার ওকে ছাড়া চলবে না মা। আমি ওকে ভালোবাসি।”

“আমি চাইলে তোমাকে বকা দিতে পারি। কিন্তু দেবো না। একটা কথা মনে রেখো, তোমার বাবার বিরুদ্ধে যাওয়া তোমার পক্ষে সম্ভব নয়। এখন তোমার জন্য সেই ছেলের কোনো ক্ষতি না হলেই হলো। তুমি বড় হলে আমার কথাটা ঠিক বুঝবে। আপতত তুমি ওর সাথে কোনো সম্পর্কে যেও না। ওকে ভালো একটা ভবিষ্যৎ গড়তে দাও। তুমিও নিজের পায়ে দাঁড়াও, যাতে নিজের ভালোবাসার জন্য সবার বিরুদ্ধে যেতে পারো। এমন একটা ক্যারিয়ার গড়ো, যাতে তোমার নাম তোমার বাবার চেয়েও উপরে থাকে। তখনই তুমি সব জয় করতে পারবে।”

………………….

আহির চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। মায়ের কথাটা ঠিক ছিল। বাবার চেয়ে উপরে না উঠলে, সে বাবার বিরুদ্ধে কখনোই যেতে পারবে না।

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here