মেঘের_শহর #পর্ব_৯ Saji Afroz

0
97

#মেঘের_শহর
#পর্ব_৯
Saji Afroz

.
রাতে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতে থাকতে থাকতে মদ খাওয়া ছিল জিকোর অভ্যেস। মদ খেয়ে বাড়িতে আসার সময় রাস্তায় সিগারেটের ধোঁয়া উড়াতো। শারীরিক পরিবর্তন হবার পর থেকে এসব আর সম্ভব হচ্ছে না। হাতে তেমন টাকাও নেই যে মদ কিনে নষ্ট করবে।
তবে একটা সিগারেট তো খাওয়াই যায়?
আর না ভেবে বাড়ির বাইরে এল জিকো। রাত কম হয়নি। একটা বাজতে চললো। এই রাতে দোকান খোলা থাকে না। কিন্তু কিছু দোকান খোলা থাকে তাদের মতো ছেলেদের জন্য। তাদের তৃপ্তি মেটানোর জন্যই যেন সারারাত দোকান গুলি খোলা থাকে। এসব দোকানের খোঁজ জিকো জানে। তবে বেশ দূরে। এতদূর হেঁটে যেতে তার ইচ্ছে না করলেও হাঁটতে শুরু করলো।
কিছুদূর যেতেই তার দিকে একজন কে এগিয়ে আসতে দেখছে জিকো। লোকটির হাঁটার ভঙ্গিই বলে দিচ্ছে তার পকেটে সিগারেট ও দিয়াশলাই আছে।
একই ঘাটের মাঝি তো, বুঝতে অসুবিধে হবার কথা না!
লোকটি পাশে চলে আসতেই জিকো তাকে থামতে বলল।
শ্যামবর্ণের মোটাসোটা লোকটি থেমে জিকোর দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
জিকো তাকে সিগারেট ও দিয়াশলাই আছে কি না জিজ্ঞাসা করলে তিনি অবাক হলেন না। অথচ তার অবাক হবার প্রয়োজন ছিল। একজন মেয়ে তার কাছে এর রাতে সিগারেট চাইছে, এটা যেন স্বাভাবিক বিষয়!
লোকটি পকেটে হাত দিয়ে সিগারেটের প্যাকেট ও দিয়াশলাই বের করলো। একটা সিগারেট নিয়ে প্যাকেট টা আবারো পকেটে ঢুকিয়ে নিলো। এরপর সিগারেট ধরিয়ে জিকোর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন-
সিগারেট পাবে মেয়ে। কিন্তু আমার মন পাবে না। শরীর ও না৷ আমায় ওমন লোক মনে করার কারণ নেই।
.
জিকো বুঝতে পারলো লোকটি তাকে কি ভেবেছে। নিশি রাতে এমন কিছু মেয়ে ঘুরে বেড়ায়। যারা টাকার বিনিময়ে পুরুষদের নিজের শরীর বিলিয়ে দেয়৷ জিকো হেসে বলল-
আমি বেশ্যা নই।
.
লোকটি উচ্চশব্দে হেসে বললেন-
এত রাতে ভালো মানুষ রা ঘুরে বেড়ায় না।
-আমি ভালো মানুষও নই।
.
লোকটি আর কথা বাড়ালো না৷ কিছু একটা ভেবে দ্রুতগতিতে হাঁটতে শুরু করলেন।
জিকো বিষয়টায় মজা পেয়ে বলল-
ভুতপ্রেত ভাবলো নিশ্চয় আমাকে!
.
সিগারেটের ধোঁয়া টেনে টেনে রাস্তায় হেঁটে চলেছে জিকো। হঠাৎ তার সামনে একটি মোটরসাইকেল এসে থামলো। তিনজন ছেলে ঘেষাঘেষি করে বসে রয়েছে। একজন তার পাশে এসে জানতে চাইলো, এত রাতে সে কি করছে। সিগারেট হাত থেকে ফেললো না জিকো। বরং তাতে টান দিয়ে বলল, সে কি করছে এটার জবাব দিতে বাধ্য নয়।
ছেলেটি জিকোর দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে বাইকে থাকা বন্ধুদের ইশারায় কিছু একটা বলল।
এই ইশারা জিকোর বুঝতে অসুবিধে হলো না। বুঝতে পারলো তার সাথে এখন খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে।
বাইক থেকে নেমে ছেলে দুটিও তার দিকে এগিয়ে এল। একজন জানতে চাইলো, এক রাতের জন্য সে কত টাকা নেয়।
সে নরম স্বরে বলল-
আপনারা ভুল বুঝছেন আমাকে। আমি ওমন মেয়ে নই।
.
তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে একজন বলল-
আচ্ছা তাই! এত রাতে কি শপিং করতে বেরিয়েছিস?
-হাঁটতে বেরিয়েছি।
-সে তুই যে জন্যই বের হোস না কেনো এবার আমাদের সঙ্গ দে। ভালোই ভালোই আমরা যা বলছি তাই কর। নাহলে…
.
ঢোক গিলে জিকো বলল-
নাহলে কি?
-নাহলে কি বুঝছিস না?
.
কথাটি বলে উচ্চশব্দে হাসতে লাগলো তারা। একজন ধীরপায়ে এগিয়ে এল জিকোর দিকে। গায়ের ওড়না টায় হাত দিতেই জিকো তার তার হাতে থাকা সিগারেট টা ছেলেটির চোখের ভেতরে ঢুকিয়ে দিলো।
ছেলেটি চিৎকার করতে করতে মাটিতে বসে পড়লো। বাকি দু’জন তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে সুযোগ টা কাজে লাগালো জিকো।
সে দৌড়ে বাইকের কাছে চলে আসলো। বাইকে চাবি লাগানো ছিল। জিকোর বাইক না থাকলেও চালানোর অভিজ্ঞতা আছে।
দেরী না করে বাইকে উঠে পড়লো সে। ছেলে গুলো কিছু বুঝে উঠার আগেই জিকো বাইক নিয়ে পালালো।
প্রায় বাড়ির পাশে এসে বাইক থেকে নামলো সে। বাইক টা রাস্তায় রেখে সে ছুটতে থাকলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ির সামনে চলে আসলো জিকো।
রাত বারোটার সময়েই বাড়ির দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু জিকোর জন্য রাত চারটে বাড়িতে হলেও বের হতে বা ঢুকতে অসুবিধে হয় না। সে জানে বাড়ির দারোয়ান একজন লোভী ব্যক্তি। বিশ টাকা তার হাতে ধরিয়ে দিলেই দরজা খুলে যায়।
আজও এর ব্যতিক্রম হলো না। জিকো টাকা দিতেই দারোয়ান দরজা খুলে দিলো।
ঘুমঘুম চোখে দারোয়ান বলল-
এই মেয়ে? হাপাচ্ছ কেন এইভাবে?
.
জিকো দারোয়ানের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার প্রয়োজন মনে করলো না। বাসায় এসে বিছানায় শরীর টা এলিয়ে দিলো।
গরম লাগছে তার। মাথার উপরে ভনভনিয়ে পাখা চললেও অনবরত ঘামছে সে। তাই বুকের উপর থেকে ওড়না টা নিয়ে মেঝের দিকে ছিটকে ফেলে দেয় জিকো।
আজ একটা অঘটন ঘটে যেতে পারতো। জিকো কিভাবে ভুলে গেল, এখন সে একটা মেয়ে! দিনের বেলায়ও যেখানে মেয়েরা সুরক্ষিত নয় রাতে কিভাবে থাকবে!
একটা মেয়ে হয়ে তার এই বিষয়ে সতর্ক হবার প্রয়োজন ছিল। সে এখন জেসিকা! তাকে জেসিকা হয়েই বাঁচতে হবে।
অনেক বেশি অস্থিরতা কাজ করছে জিকোর মাঝে। এভাবে চুপচাপ শুয়ে থাকাও যেন কষ্টকর! জিকো শোয়া থেকে উঠে এক গ্লাস পানি খেলো। এরপর সারারুমে পায়চারী করতে লাগলো।
কিসের জন্য তার এই অস্থিরতা?
আজকের খারাপ কিছু ঘটতে পারতো, এসব ভেবে? না কি
আজকের এই ঘটনা টা বড্ড পরিচিত মনে হচ্ছে তার কাছে, এটা ভেবে!
হ্যাঁ, পরিচিত! মনে হচ্ছে এমন টা আগেও হয়েছে। কিন্তু কখন!
.
.
.
অসংখ্য প্রজাপতি উড়ে যাচ্ছে, তার পেছনে ছুটছে এক রমনী!
ছুটতে ছুটতে হঠাৎ রমনী থেমে গেল। তার সাথে থেমে গেল প্রজাপতি রাও।
আশ্চর্য! প্রজাপতি রা যেন রমনীর বান্ধবী। সে থেমে যাওয়াতে তারাও থেমে গেল!
একটু পরেই প্রজাপতি গুলো রমনীর চারপাশে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। তা দেখে রমনী মিষ্টি সুরে হেসে উঠলো শব্দ করে।
এই হাসির শব্দ শুনলে যেন হাজার টা কারণে মন খারাপ থাকলেও ভালো হয়ে যাবে!
প্রজাপতি সহ সেই রমনী কে দেখে চলেছে মেঘ।
এমন একটি দৃশ্য কি না দেখে উপায় আছে!
মেঘের মন ব্যাকুল আছে মেয়েটির চেহারা দেখার জন্য। যার হাসির শব্দই এত সুন্দর না জানে দেখতে কত সুন্দর সে!
কিছু না ভেবেই মেঘ বলে উঠল-
এই যে প্রজাপতি দের বান্ধবী?
.
মেঘের ডাক কানে আসতেই পেছনে ঘুরে তাকালো মেয়েটি। মেয়েটির চেহারা দেখেই ঘুমটা ভেঙে যায় মেঘের।
এক লাফে শোয়া থেকে উঠে বসলো সে।
এটা কি দেখলো মেঘ! সে সাইয়ারা কে স্বপ্নে দেখেছে। কিন্তু কেনো! সারাদিন তার মাথায় ঘুরপাক করে হুরায়রা কিন্তু স্বপ্নে আসলো সাইয়ারা!
মেঘ বিছানা ছেড়ে উঠে দেয়াল ঘড়ির দিকে নজর দিলো। সকাল দশটা বাজতে চলেছে আর সে কি না এখনো ঘুমিয়ে আছে! এতক্ষণ ঘুমানোর কারণেই উল্টাপাল্টা স্বপ্ন সে দেখেছে। হ্যাঁ, সাইয়ারা তার স্বপ্নে থাকা মানেই উল্টাপাল্টা।
মেঘ ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেল। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেরে তাকে বেরুতে হবে। কাল হুরায়রা তার এত কাছে ছিল, আর আজ এত দূরে! অশান্ত হয়ে আছে মেঘের মন। হুরায়রা কে এক নজর দেখে তা শান্ত করার প্রয়োজন।
.
.
মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে মেঘ হুরায়রার আশায়। তবে আদৌ সে আজ ভার্সিটিতে এসেছে কি না জানা নেই তার। তবুও অস্থির মন তো আর মানে না! এক পলক মেয়েটাকে দেখার জন্য বুকের ভেতরটায় সর্বদা ছটফট করতেই থাকে।
আচ্ছা, হুরায়রা কি একটুও বুঝেনি যে মেঘ তাকে ভালোবাসে?
অবশ্য বোঝার মতো সে কিছু করেনি। চোখের ভাষা বোঝার ক্ষমতা সবার থাকে না।
-আরে আপনি এখানে?
.
পেছনে ফিরে সাইয়ারা কে দেখে খানিকটা বিরক্ত হলো মেঘ। এই মেয়ে তাকে এখানে দেখেছে মানে এখন হাজার টা প্রশ্ন করবে। ভাবতে ভাবতেই সাইয়ারা শুরু করে দিলো প্রশ্ন করা-
আপনি এখানে কেনো? একা এসেছেন? দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? কারো জন্য অপেক্ষা করছেন?
.
মেঘ কপালে বিরক্তির রেখা ফুটিয়ে তুলে বলল-
প্রশ্ন করা শেষ হয়েছে?
-হু।
-অপেক্ষা করছি কারো জন্য।
-কার জন্য?
-তুমি চিনবে না।
-ওহ! আমি কি দাঁড়াব আপনার সাথে?
-ক্লাসে যাও।
-ক্লাস নেই এখন।
আমি থাকি। আপনার একা দাঁড়াতে আর বিরক্ত লাগবে না।
.
বিড়বিড় করে মেঘ বলল-
একাই ভালো ছিলাম।
-কিছু বললেন?
-বললাম তুমি যাও। আমি ঠিক আছি।
.
সাইয়ারার সাথে কপাল কুচকে কথা বলছে মেঘ। গলার স্বর শুনেই বোঝা যাচ্ছে সে বিরক্ত হচ্ছে। তাই সাইয়ারা আর দাঁড়ালো না। মেঘ কে বিদায় জানিয়ে সেখান থেকে সরে আসলো সে। তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। হঠাৎ মেঘের এমন আচরণে কষ্ট পেল সে। মেঘ কি কোনো কারণে তার উপর বিরক্ত?
.
.
সাইয়ারা যেতেই যেন মেঘ হাফ ছেড়ে বাঁচলো। স্বপ্ন টা দেখার পর থেকেই তার মেজাজ টা খারাপ হয়ে আছে। এখন সাইয়ারা কে দেখে স্বপ্নের কথা আবারো মনে পড়ে গেল তার। তাকে নিয়ে এমন একটা স্বপ্ন দেখার কারণ টা কিছুতেই তার মাথায় আসছে না। অবশ্য না আসাটাই স্বাভাবিক।
.
.
.
পরিবারের বড় সন্তান মোখলেস। সে বর্তমানে তার বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করে। কয়েকদিন ধরেই তার মা তাকে বিয়ে করার জন্য চাপ দিচ্ছেন। বেশ কয়েকটা মেয়েও তার জন্য দেখা হয়ে গেছে। কিন্তু কাউকেই ভালো লাগেনি মোখলেসের।
এদিকে প্রথম দেখাতেই তার জেসিকা কে ভালো লেগে যায়। মেয়েটি কেবল সুন্দরীই নয়, ভদ্রও বটে! ঠিক যেন তার মনের মতই। তাকে দেখলে পরিবারের সবাই পছন্দ করবে। তবে একটু সমস্যা আছে। জেসিকার ভাই অর্থ্যাৎ জিকো কে তার পরিবারের কেউ পছন্দ করে না। কারণ তার বদঅভ্যাস সম্পর্কে সবাই জানে। মোখলেসের মা জিকোর মতো একটা ছেলে কিভাবে তার প্রিয় বন্ধু হতে পারে ভেবে পান না। তিনি এই বিষয়ে বেশ কয়েকবার কথা কাটাকাটিও করেছে মোখলেসের সাথে। মোখলেস প্রতিবারই বলে, সে জানে একদিন জিকো সঠিক পথে ফিরে আসবে। সে চেষ্টা করছে তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করার। তার চেষ্টা বিফলে যাবে না নিশ্চয়।
.
দেখতে দেখতে বছর খানেক হয়ে গেলেও জিকোর স্বভাব পরিবর্তন হলো না। তাই মোখলেস ধীরেধীরে তার থেকে দুরত্ব বজায় রাখতে শুরু করে।
কিন্তু এখন মনে হচ্ছে জিকোর সাথে সম্পর্ক টা আরো দৃঢ় হবে। তার বোন কে যে পছন্দ হয়ে গেল মোখলেসের!
বাসায় বিষয় টা কিভাবে নিবে সে জানে না। তবে বাসায় কিছু বলার আগেই সে জেসিকার মতামত জানতে চায়। জেসিকা ও জিকো যদি রাজি থাকে তবেই সে নিজের বাসায় জানাবে। কিন্তু জেসিকা কে নিজের মনের কথা কিভাবে বলবে সে?
কেনো যে জিকো টা এই সময়েই গ্রামের বাড়িতে গেল!
.
.
.
হুরায়রা কে দেখে মেঘ যেন তার প্রাণ ফিরে পেল! মেয়েটি তার পাশ দিয়েই হেঁটে যাচ্ছে কিন্তু তাকে দেখলো না। মেঘ না চাইতেও তাকে ডেকে বলে উঠল-
ধন্যবাদ।
.
হুরায়রা থেমে বলল-
ধন্যবাদ কেনো?
-কালকের চায়ের জন্য। চা টা ভালো ছিল অনেক।
-কোন চা?
-কাল যে করিম চাচার দোকানে আপনি বানিয়েছিলেন। ধন্যবাদ দেওয়া হয়নি আপনাকে চায়ের জন্য।
-করিম চাচার দোকানে আমি কেনো চা বানাব?
.
হুরায়রার কথা শুনে মেঘ যেন বিস্ময়ের শেষ পর্যায়ে চলে গেল। এসব কি বলছে সে!
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here