দীপ্ত গোধূলি – পর্ব ২৫

0
361

#দীপ্ত_গোধূলি
#লিখনীতে -স্বর্ণালী তালুকদার
#পর্ব -২৫

গোধূলি ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে দেখে দীপ্ত ওর বিছানাটার ঠিক মাঝখানে কপালে বাম হাতের পিঠ রেখে চোখ বন্ধ করে পায়ের উপর পা তুলে শুয়ে আছে।গোধূলি ওর বিছানায় অন্য মানুষের এত গড়াগড়ি পছন্দ করে না।নিজের ভাই বোনদের ক্ষেত্রে বিষয়টি ঠিক উল্টোই বটে।তবে বাহিরের মানুষের ক্ষেত্রে এই নিয়ম প্রযোজ্য যে, তার অনুমতি ব্যাতিত কেউ এই ঘরের কোনো কিছু স্পর্শ করা তো অনেক পরের কথা ওর ঘরের চৌকাঠও মাড়াতে পারে না।তবে দীপ্ত কি বাহিরের লোক?হে একটু আশ্চর্যজনক হলেও এটাই সত্যি যে গোধূলি দীপ্তকে বাহিরের লোকই মানে।ছোট বেলা থেকেই ওদের দুজনের ঠিক বনতো না। দীপ্ত গোধূলিকে আর গোধূলি দীপ্তকে পদে পদে হেনস্তা করতো।অবশ্য তার জন্য যতেষ্ট কারণও থাকতো।অকারণে গোধূলি কোনো কিছুই করতো না। দীপ্তই গোধূলিকে রাগাতো আবার দীপ্তই বিভিন্ন উপায়ে চেষ্টা করতো গোধূলিকে বাঘে আনার।যার ফলে প্রায়ই দুজনের মধ্যে তুমুলযুদ্ধ বেধে যেত।ঝগড়াঝাটিও হতো খুব করে।দীপ্ত ওর থেকে বয়সে অনেকটা বড় হলেও দীপ্তের সাথে ওর কোনো শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করানো সম্ভব হয় নি।ছোট বেলায় গোধূলি একটু চঞ্চল ছিল।সময়ের ব্যবধানে এখন তা অনেক কমে গেছে।তবে মাঝে মাঝে গোধূলি ওর স্বরুপে ফিরে আসে!যেটা আদিবার বিয়ে ঠিক হওয়া থেকে সবাই বেশ ভালোই লক্ষ্য করছে।তাদের নিজেদের মধ্যে এ নিয়ে কথা হলেও গোধূলিকে তারা তা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে দেয় নি।গোধূলি কোনো কালেই দীপ্তকে অন্য চোখে দেখে নি।ছোট বেলায় সারাদিন মুখ ভরে দীপ্ত ভাইয়া দীপ্ত ভাইয়া আর তুমিতামা করলেও কালক্রমে তা আপনি আজ্ঞেতে উপনীত হয়েছে।যাকগে সেইসব কথা!

দীপ্তকে গোধূলি ওর বিছানায় দেখে রাগ পাওয়ার চেয়ে অবাকেই বেশি হয়েছে।আজকে এই লোকের মতিগতি কিছুই বুঝতে পারছে না ও।এই আহানের ঘর তো এই আদিবার ঘর। এখন আবার ওর ঘরে।এখন গোধূলি যদি কিছু বলেও দীপ্ত তা শুনাবে না,ও সেটাও জানে।দীপ্ত যা ধুরন্ধর,গোধূলি যদি এইখানে থাকে তাহলে ঠিক খুটিয়ে খুটিয়ে বের করার চেষ্টা করবে তখন গোধূলি কি বলতে গিয়েও বলে নি।
গোধূলি এই রিস্কের মধ্যে নাই।তারচেয়ে বরং ভালো হয় দীপ্তকে কিছু না বলে ও নিজেই এই রুম থেকে চলে যাক।

– দাঁড়া!

পা টিপেটিপে দরজার কাছ পর্যন্ত যেতেই দীপ্তের ডাকে থমকে যায় গোধূলি।প্রচন্ডরকম বিরক্ত হয়ে চোখ বুজে নেয়।

– যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়।

বিড়বিড় করে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠে।পরমুহূর্তেই আস্তে আস্তে পিছনে ফিরে মুখে কৃত্রিম হাসি টেনে বললো,

– আরে ভাইয়া!আপনি কখন এলেন?আমি তো আপনাকে খেয়ালই করি নি।

দীপ্ত এক লাফে বিছানা থেকে নেমে একদম গোধূলির সামনে এসে দাঁড়ায়।তারপর গোধূলির চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে গলা টেনে বললো,

– তাই বুঝি?

গোধূলি কাচুমাচু মুখ করে ফোকলা হেসে বললো,

– হে তা্ তাই তো।

গোধূলির মুখের দিকে দীপ্ত সন্দিহান চোখে তাকিয়ে থেকে বলে,

– এমন তোতলাচ্ছিস কেন তুই?
– কো্ কোথায় তো তোতলাচ্ছি আমি?এই তো আ্ আমি স্বাভাবিক ভাবেই ক্ কথা বলছি!

দীপ্ত দাঁত কড়মড় করে বলে,

– হুম তা তো আমি দেখতেই পাচ্ছি।আচ্ছা বাদ দে।
এখন বল তো,আমাকে দেখেও এমন চোরের মতো পা টিপেটিপে চলে যাচ্ছিলি কেন?

এই লোকের কি চোখ বন্ধ থাকলেও দেখতে পায় নাকি?স্ট্রেঞ্জ! ঠিক বুঝতে পেরে গেছে।গোধূলি মনে মনে কথাটা আওড়াচ্ছে।

– কি হলো বলছিস না কেন?

দীপ্তের ধমকে আঁতকে উঠল গোধূলি।বুকে ফুঁ দিয়ে বললো,

– এইভাবে কেউ চিল্লায়!আরেকটুর জন্য আমার প্রানটা চলে যায় নি!

– কেন তুই কি চুরি করেছিস যে চিল্লালে কেউ শুনে ফেলবে?আর চিল্লালে কারো প্রান চলে যায়?এই গোধূলি একদম আমার মাথা গরম করাবি না!যা জিজ্ঞাস করেছি তার উত্তর দে।

গোধূলি বেশ বুঝতে পারছে দীপ্ত এবার রেগে যাচ্ছে।কিন্তু গোধূলি তো গোধূলিই।বরাবরের মতোই চ্যাটাং চ্যাটাং উত্তর দিবেই।তবে এখন কন্ঠে একটু নরম ভাব এনে বললো,

– আমার বাড়ি আমার ঘর!আমি কেন চোরের মতো যাব?আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়তো ঘুমিয়ে আছেন।যদি শব্দ হয় তাহলে হয়তো আপনার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে তাই আস্তে আস্তে যাচ্ছিলাম!দ্যাটস ইট।

– ইজ ইট!
– হুম।
– আচ্ছা যা তোর এই উত্তরটা নিলাম।এখন আমার আরেকটা প্রশ্নের উত্তর দে তো!

এই রে এখন আবার কি জিজ্ঞাস করবে উনি।এমনিতেই আমার এখানে ভালো লাগছে না।তারউপর উনি যদি এই ভাবে আমাকে একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকে তাহলে তো এইখানেই আমি শহীদ হয়ে যাবো।মনে মনে কথা গুলো ভেবে মলিন মুখে দীপ্তের দিকে তাকায় গোধূলি।

– তখন আদিবাপুর ঘরে কি যেন বলতে গিয়েও থেমে গিয়েছিলি!সবাই চলে আসায় আমি তখন কিছু বলি নি।তবে,ডালমে কুচ কালা হে!এ মুঝে মালুম থা!এখন বল তখন কি বলতে চেয়েছিলি?

– দেখেছিস গোধূলি, যে ভয়টা এতক্ষণ পাচ্ছিলাম সেটাই সত্যি হলো।এখন আমি কি জবাব দিবো?পালা!তুই এখান থেকে পালা গোধূলি।যত তাড়াতাড়ি পালাতে পারবি তোর ততই মঙ্গল!

– কি হলো কি বিড়বিড় করছিস?জোরে বল শুনতে পাচ্ছি না।

কিছুটা ঝাঝালো কন্ঠে বলল দীপ্ত।গোধূলির মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।ও এখন কি বলবে।কিন্তু এখান থেকে যেতে হলে এটলিষ্ট কিছু একটা তো বলতে হবে।গোধূলি মুখে গম্ভীরতার ভাব এনে বললো,

– এখন আমি আপনার কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো না। আমার অনেক কাজ আছে আমি গেলাম।

– আমার কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে আদিবাপুর ঘরে আমি কাউকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছিলাম!

দরজার চৌকাঠের কাছে গিয়েই থেমে যায় গোধূলি। দীপ্তের কথায় কান গরম হয়ে আসে।হঠাৎ করেই বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যায়।ঘন ঘন শ্বাস পরছে গোধূলির।

– তুই ছিলি?

দীপ্ত এগিয়ে গিয়ে গোধূলির একদম কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে কথাটা।কথাটা কানে যেতেই চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিয়ে জামাটা খামছে ধরে গোধূলি।গোধূলির হৃদস্পন্দন এতটাই বেড়ে গেছে যে তার আওয়াজ দীপ্তের কান অব্দি পৌঁছাচ্ছে!গোধূলি এখনও চোখ বন্ধ করেই রেখেছে।

– নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ!

গোধূলি অবস্থা দেখে একটা শব্দহীন মুচকি হাসি দিয়ে কানে কানে কথাটা বলেই চলে যায় দীপ্ত।কারো পায়ের আওয়াজ পেয়ে চোখ মেলে তাকায় গোধূলি।ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারে দীপ্ত চলে গেছে।গোধূলি সোজা ওর রুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে ব্যালকনিতে চলে যায়।ওর আজ আর ছাদে যাওয়া হবে না!ব্যালকনিতে গিয়ে বসেছে গোধূলি।পড়ন্ত বিকালে লালা ভাব আকাশের পানে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বললো,

– গোধূলি লগ্নে আজ গোধূলির ছন্দ পতন ঘটে গেলো!পড়ন্ত বিকেলের রাঙানো গোধূলির দীপ্ত আকাশ আজ না হয় এই ব্যালকনি থেকেই দেখলাম।

এতটুকু বলেই থামে গোধূলি।তারপর ব্যালকনিতে চোখ বুলিয়ে এক মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে,

ব্যালকনি তুই শুন
আজ তুই সঙ্গি হবি মোর!

বলবি কথা সেদিন,
থাকবি যেদিন আমিহীন!

আজ না হয় আমিই বলি
অনেক কথার ফুলঝুরি!

শুনতে যদি নাই বা চাস
তুই না হয় সঙ্গি হয়েই থাক!

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here